মিজানুর রহমান রানা, সাংবাদিক ও লেখক :
গত ক’দিন ধরে বাংলাদেশে চলছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। এই আন্দোলন গত ক’দিনের আন্দোলন নয়, এটা গত ক’দশক ধরে চলা একটা ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন বলা চলে।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’ অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশী স্বতঃসিদ্ধভাবে কতিপয় মৌলিক অধিকারের মালিক। তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’-এর শুরুতেই ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সংকোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ। সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক বাংলাদেশীর মৌলিক অধিকার ১৮টি। এর মধ্যে রয়েছে :
আইনের দৃষ্টিতে সমতা : সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য করা যাবে না : ২৮(১)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।
নারী পুরুষের সমঅধিকার: ২৮(২)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।
সরকারী নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা : ২৯নং অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।
সুতরাং সংবিধানে যেহেতু বলা রয়েছে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে সেহেতু চাকুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নাগরিকের প্রতি কেনো এই বৈষম্য?
বলা হয়ে থাকে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশের জন্যে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন সময়ে দেশের জন্যে মরণপণ যুদ্ধ করেছেন। কেউ শহীদ হয়েছেন, কেউ জয়ী হয়েছেন। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করুন, তাঁরা কেনো যুদ্ধ করেছিলেন? তখনকার সময় তাঁরা শুধুই দেশকে রক্ষায় যুদ্ধ করেছিলেন। এরপর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তারপরের ইতিহাসও অনেক করুন। শাসনক্ষমতা দখল, দলাদলি, কোন্দলেও বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে, ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, গুপ্ত হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রায় সকলকেই হত্যা করা হয়েছে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কখনই অন্যায় অবিচার চায়নি। নিজের পেটের উদরপূর্তি করে অন্যের অধিকার খর্ব করার জন্যে তারা তৎপর নয়। তারা জীবন দিতে জানে, কিন্তু কারও অধিকারে অন্যায় হস্তক্ষেপ করতে জানে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর বহু শাসক এসেছে বাংলাদেশে। তাদের দুর্বলতার সুযোগে অনেক সাপ ঢুকেছে মুক্তিযোদ্ধার রূপে। এই সাপগুলোই আসলে কালের প্রবাহে বহুরূপী চরিত্র ধারণ করে বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চাইছে। এরাই এখন নিজেদের উদরপূর্তির জন্যে, স্বার্থের জন্যে উপরোক্ত সাংবিধানিক সিস্টেমের বাইরে গিয়ে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে, যা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদেরকে মন-মগজে প্রভাব ফেলছে।
‘বাংলাদেশে মেধার মূল্যায়ন হয় না’- এই কথাটি বহু পুরোনো। কথাটি নিচক একটি তুচ্ছতাচ্ছিল্যরূপক কথা নয়। সত্যি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো লোক দেখানো মূল্যায়ন হয়, কিন্তু পাঠকমাত্রই জানেন যে, বহু মেধাবী চাকুরি না পেয়ে আত্মহত্যা, সার্টিফিকেট পোড়ানো, অনেকেই বিদেশে চলে যাচ্ছেন।
জানামতে, লেখকেরই বোন, বোনের ছেলেমেয়ে বাংলাদেশে ভালো কোনো চাকুরি না পেয়ে ইউকে ও কানাডায় ব্যাংকে স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চতর পদে চাকুরি করছে, ব্যবসা করছেন। তাদের ভাষ্য, এই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি ইত্যাদিতে যে ধরনের হয়রানি, পদে পদে বাধাবিঘ্ন সেগুলো অন্য দেশে নেই। এ দেশে প্রায় সব চাকুরিতেই ভিন্ন পন্থা অবলম্বনকারীরাই মেধাবীদের চেয়ে এগিয়ে যায়। মেধাবীদের অনেক ক্ষেত্রেই চাকুরি হয় না, অথচ থার্ড ক্লাস প্রাপ্ত তারই অমেধাবী শিক্ষার্থী বিশাল অর্থের বিনিময়ে, ফাঁসকৃত প্রশ্নের বিনিময়ে চাকুরি করছে। অনেক অমেধাবী ছাত্র-ছাত্রী কোটা প্রথায় চাকুরি পেয়েছে, অথচ তারই ক্লাসমেট অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর চাকুরি হয়নি।
এসব বিষয় স্বাধীনতার পর থেকেই চলে এসেছে। কেউ তা’ আমূল সংস্কার করতে পারেনি। যে নীতি আদর্শে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই বৈষম্য পদে পদে এখনও বহাল আছে বলেই শিক্ষাথীদের আজ মাঠে নামতে হচ্ছে, বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে হচ্ছে। এতে গত ক’দিনে কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। আজ ১৮ জুলাই সারাদেশে অনেক আন্দোলনকারী গ্রেফতার ও হতাহত হয়েছেন।
যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৭ জুলাই তাঁর ভাষণে বলেছেন, ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল করে একটা পরিপত্র জারি করে সরকার। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের জারি করা সরকারি পরিপত্র বাতিল করে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয়। আদালত শুনানির দিন ধার্য করেন। এ সময় ছাত্ররা কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে আবারো আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহশীলতার পরিদর্শন করেছে।
তিনি আরও বলেন, আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি প্রদানের ইচ্ছাপোষণ করে সেক্ষেত্রে তাদের সুযোগ করে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমি প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাই।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা পৌনে ৩টার দিকে সা¤প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সংসদের ট্যানেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে সরকার একমত। তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছেন, তারা বলেছেন আন্দোলনের পাশাপাশি তারা আলাপ-আলোচনা করতেও আগ্রহী। আমরা তাদের এই আলাপ-আলোচনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের এই প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং তাদের এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে (আইনমন্ত্রী) ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা তাদের সঙ্গে বসবো। তারা যদি আজকে বসতে চান, আমরা আজকেই বসতে রাজি আছি। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঘোষণা দিতে বলেছেন যে, কোটা সংস্কার নিয়ে ৭ আগস্ট যে মামলার শুনানিটা ছিল, সেই শুনানিটা এগিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে। আমি সেই মর্মে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছি, তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল বিভাগে আবেদন করবেন, যাতে মামলার শুনানির তারিখ তারা এগিয়ে আনেন।
আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাক, সার্বিকভাবে বৈষম্য দূর হোক, যাতে আন্দোলন করতে গিয়ে মায়েদের বুক খালি করতে না হয় আর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা না হয়। প্রতিটি প্রাণেরই মূল্য আছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে।
প্রকাশিত : বৃহস্পতি বার, ১৮ জুলাই ২০২৪
স্ক্যাবিস বা চুলকানি থেকে রক্ষা পেতে কী করবেন?
ডায়াবেটিস প্রতিকার ও প্রতিরোধে শক্তিশালী ঔষধ
শ্বেতী রোগের কারণ, লক্ষ্মণ ও চিকিৎসা
যৌন রোগের কারণ ও প্রতিকার জেনে নিন
পাইলস ফিস্টুলা রোগের কারণ ও প্রতিকার
শ্বেতীর সাদা দাগ দূর করার উপায়