ছোটগল্প : পরীক্ষা

ক্ষুদীরাম দাস

মেঘলা দিনের সকাল। রহিম মিয়া বাজার থেকে ফিরছিলেন, হাতে ভারী প্লাস্টিকের ব্যাগ। তার পাঞ্জাবির পকেটে কয়েকটা টাকার নোট আর একটা পুরনো ফোন। পঞ্চাশ বছর বয়সেও তার চোখে-মুখে একটা তরুণ উদ্যম। গ্রামের মুদির দোকানটা তার জীবনের অহংকার। তিন বছর আগে শুরু করা এই দোকান এখন গ্রামের মানুষের কাছে একটা নির্ভরতার জায়গা। রহিম মিয়ার মুখে হাসি থাকত সবসময়, আর এই হাসির পেছনে ছিল তার সফলতার গল্প। দোকানের আয়ে তার সংসার চলত, মেয়ে রুনার পড়াশোনার খরচ জুটত, আর গ্রামের লোকজন তাকে সম্মান করত। সুখের দিনে তার চারপাশে বন্ধু-আত্মীয়ের অভাব ছিল না। দোকানে বসে চা খেতে খেতে গল্প করতেন কতশত মানুষ। কেউ ঋণ চাইত, কেউ বাকিতে মাল নিত, আর রহিম মিয়া সবাইকে সাহায্য করতেন। তার মনে হত, এই মানুষগুলোই তার আপনজন।

কিন্তু জীবনের ছন্দ সবসময় এক থাকে না। একদিন বিকেলে, বাজারের পাশে একটা মাটির ঢিবিতে দাঁড়িয়ে রহিম মিয়া দেখলেন, তার দোকানের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা। কে বা কারা রাতের অন্ধকারে দোকানে আগুন লাগিয়েছে। দোকানের কাঠের তাক, চাল-ডালের বস্তা, তেলের ক্যানÑসব পুড়ে ছাই। পুলিশ এল, তদন্ত শুরু হল, কিন্তু কোনো কিনারা হল না। রহিম মিয়ার সারা জীবনের সঞ্চয় আর স্বপ্ন এক রাতে ধ্বংস হয়ে গেল।

পরের দিন সকালে গ্রামের লোকজন এসে ভিড় করল। কেউ কেউ সমবেদনা জানাল, কেউ বলল, “এই বিপদ কাটবে, রহিম ভাই, তুমি শক্ত মানুষ।” কিন্তু দিন যেতে লাগল, আর রহিম মিয়ার জীবনের ছাকনি কাজ শুরু করল। যারা একদিন তার দোকানে বসে চা খেত, তাদের দেখা মিলল না। যারা বাকিতে মাল নিয়েছিল, তারা আর ফোন ধরল না। এমনকি গ্রামের মোড়ল আব্দুল হক, যিনি রহিমের দোকান থেকে প্রতি মাসে বিনামূল্যে মাল নিতেন, তিনিও বললেন, “এখন আমার নিজের ঝামেলা আছে, রহিম। পরে দেখা যাবে।” রহিম মিয়ার মনে হল, এই গ্রামের মানুষগুলো ছিল দুধের মাছিÑযখন দোকান ছিল, তখন তারা ছিল; এখন বিপদে তারা উধাও।

রহিমের স্ত্রী ফাতেমা আর মেয়ে রুনা ছিল তার একমাত্র সান্ত¡না। ফাতেমা রান্নাঘরের কাজ ফেলে এসে বলত, “চিন্তা করো না, আমরা আবার সব ঠিক করব।” রুনা, যে এখন কলেজে পড়ে, তার বইয়ের দাম বাঁচিয়ে বাবাকে বলল, “আমি টিউশনি করে তোমাকে সাহায্য করব।” কিন্তু রহিম মিয়ার মন ভারী ছিল। তিনি ভাবতেন, এতদিন যাদের জন্য সব করেছেন, তারা কোথায়?

একদিন সন্ধ্যায়, রহিম মিয়া বাড়ির উঠোনে বসে ছিলেন। তার হাতে একটা পুরনো খাতা, যেখানে তিনি বাকির হিসাব লিখতেন। খাতাটা উল্টে দেখছিলেন, কত মানুষ তার কাছে ঋণী। হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনলেন, “রহিম ভাই, কেমন আছ?” সামনে দাঁড়িয়ে হাসান, তার পুরনো বন্ধু। হাসান গ্রামের একজন গরিব কৃষক। রহিমের দোকান থেকে সে কখনো বাকিতে কিছু নেয়নি, শুধু দু’জনে মাঝেমধ্যে চা খেত আর গল্প করত। হাসানের হাতে একটা ছোট বস্তা। সে বলল, “এই নাও, আমার বাড়ির ধান। বিক্রি করে যদি কিছু টাকা হয়, তা দিয়ে আবার দোকান শুরু করো। আর এই নাও,” বলে সে পকেট থেকে একটা ছোট পুটলি বের করল। তাতে কয়েক হাজার টাকা। “আমার সঞ্চয়, তুমি নাও। পরে ফেরত দিও।”

রহিম মিয়ার চোখ ভিজে গেল। তিনি বললেন, “হাসান, তুমি এত গরিব, তবু আমার জন্য এত করছ?” হাসান হেসে বলল, “রহিম ভাই, তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। যখন আমার ছেলে অসুস্থ ছিল, তুমি দোকান থেকে টাকা দিয়েছিলে। আমি ভুলিনি।” রহিম মিয়া বুঝলেন, এই হাসানই তার প্রকৃত আপনজন।

কয়েকদিন পর আরেকটি চমক। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক রফিক স্যার এলেন। তিনি বললেন, “রহিম, আমরা স্কুলে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সবাই মিলে একটা ফান্ড তৈরি করেছে। এই নাও, এটা তোমার দোকানের জন্য।” রফিক স্যারের হাতে একটা খাম, তাতে কিছু টাকা। রহিম মিয়া অবাক হয়ে বললেন, “এসব কেন, স্যার?” রফিক স্যার বললেন, “তুমি গ্রামের জন্য অনেক করেছ। যখন আমার ছেলের বই কেনার টাকা ছিল না, তুমি বিনামূল্যে দিয়েছিলে। আমরা ভুলিনি।”

এই ঘটনাগুলো রহিম মিয়ার জীবনে একটা ছাকনির মতো কাজ করল। যারা তার সুখের দিনে দুধের মাছির মতো ঘুরত, তারা বিপদে উধাও। কিন্তু যারা তার প্রকৃত আপনজনÑহাসান, রফিক স্যার, তার পরিবারÑতারা পাশে দাঁড়াল। রহিম মিয়া ঠিক করলেন, এই টাকা দিয়ে তিনি আবার দোকান শুরু করবেন। কিন্তু এবার তিনি আরও সতর্ক হবেন। তিনি বুঝেছেন, সুখের সময়ে সবাই বন্ধু, কিন্তু বিপদে যারা পাশে থাকে, তারাই আসল।

মাস কয়েক পরে রহিম মিয়ার দোকান আবার চালু হল। ছোট হলেও, তার আগের মতো জৌলুস ফিরে এল। হাসান প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে চা খায়, রফিক স্যার মাঝেমধ্যে ছাত্রদের নিয়ে আসেন। গ্রামের লোকজন আবার ভিড় করতে শুরু করল। কিন্তু এবার রহিম মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। তিনি বুঝেছেন, জীবন একটা ছাকনি। বিপদ এলে তা সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়।

একদিন সন্ধ্যায়, দোকানের বাইরে বসে হাসানের সঙ্গে চা খেতে খেতে রহিম মিয়া বললেন, “জানিস, হাসান, জীবনটা একটা ছাকনির মতো। সুখের সময়ে সবাই আসে, কিন্তু বিপদে শুধু তুই আর আমার পরিবার পাশে ছিল।” হাসান হেসে বলল, “রহিম ভাই, এটাই জীবন। যারা থাকে, তারাই আপন। বাকিরা শুধু দুধের মাছি।”

বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫

ডায়াবেট্সি হলে কি করবেন?

শেয়ার করুন
প্রিয় সময় ও চাঁদপুর রিপোর্ট মিডিয়া লিমিটেড

You might like

About the Author: priyoshomoy