নিস্তব্ধ বুড়িগঙ্গার খেয়াঘাটের মাঝিরা

মো. শিপন, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি :
করোনার প্রভাব পড়েছে নদী বন্দর গুলোতে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের খেয়া মাঝিরা চরম সংকটে দিন পার করছে। দীর্ঘ প্রায় একমাস কর্মহীন থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছে ফতুল্লা গুদারাঘাটের অন্তত দেড় শতাধিক মাঝি।এর ছোয়া পড়েছে বুড়িগঙ্গার বুকেও!

সোমবার সরেজমিনে দেখা যায় এমন হৃদয়স্পর্শী চিত্র।যেন যৌবন হারিয়ে নামের যথার্থতাই তুলে ধরতে চাইছে নিরবে! তাইতো বুড়িগঙ্গা আজ নিস্তব্ধ।

মালবাহি জাহাজ ও যাত্রীবাহি লঞ্চ-ট্রলারের চিরচেনা সেই ঠক ঠক শব্দও আজ ভেষে আসছে না কানে। যেন শ্রোত থেমে গেছে বুড়িগঙ্গার। এই বুড়িগঙ্গার বুক চিরে এপার ওপার দাপিয়ে বেড়ানো সেই মাঝি-মাল্লারাইতো আজ নিস্তব্ধ।

এদিন দেখা যায়, গুদারা ঘাটে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু ট্রলার ও নৌকা। লকডাউন থাকায় যাত্রী নেই। ওপারেও একই চিত্র। এপাড়ে সাড়ি বাধা ফাঁকা নৌকা গুলোর পাশে অবশ্য দেখা মিলল কয়েকজন মাঝির। লকডাউনে কেমন আছেন আপনারা ?

প্রশ্ন করতেই হতাশার দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে একজন বললেন, ‘ঘরে চাইল-ডাইল নাই। আমগো খবর কেডায় লয়?

ইউসুফ মিয়া (৫৬)। শারীরিক প্রতিবন্ধি এই ব্যক্তি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ও ট্রলার চালিয়ে আসছেন। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন- ‘গত একমাস ধইরা কাম কাইজ নাই। করোনার লাইগ্যা যাত্রীও নাই। তাই ইজারাদাররা ঘাড বন্ধ কইরা রাখছে। আমার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন চিত্র জীবনেও দেহি নাই। আল্লায় কি রোগ যে দিলো!’‘আমগো এই ঘাডে ১৫০ জন মাঝি আছে। সবার একি অবস্থা। ঘরে খাওন নাই। মনে হইতাছে যে, ওপার (কেরানীগঞ্জ) যাওয়া ভুইলা গেছি। যাত্রীই নাই, যামুই ক্যান? মাঝে মইধ্যে গেলেও ওই পাড়ে ভীরতেই দেয় না।’

তিনি আরো বলেন- ‘করোনার আগে প্রত্যেক দিন না হইলেও ৫০০-৬০০ টাকা কইরা কামাইতে পারছি। তেল আর বোট খরচ বাদে যা থাকতো তা দিয়া সংসার চলতো। কিন্তু এহনতো কাম নাই। ভোর বেলা ওই পারের (কেরানীগঞ্জ) কিছু মানুষ বাজারের লাইগা এই পারে আহে। কিন্তু আমরা হেগোরে লইয়া গেলে ওই পাড়ের মাইনষে আমগোরে মাইর ধইর করে। ভিরতে দেয় না। কয় আমগো এই পাড়ে (ফতুল্লায়) বলে করোনায় বাসা বানছে।

 

দুঃখ প্রকাশ করে ইউসুফ মিয়া আরো বলেন- ‘আমি ফতুল্লার লালপুরে থাহি। বউ-পোলাপাইন লইয়া পরিবারে ৪ জন। ঘরে যা টাকা আছিলো, হেগুলা দিয়া এতো দিন চলছি।ঘরে চাইল-ডাইলো ফুরাইছে। খবরে দেহি যে, চেয়ারম্যান আর নেতারা গরিব মাইনষেরে কতভাবে সহযোগিতা করে।

তবে, ফতুল্লা গুদারাঘাটে মাঝিদের শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি সবুজ মিয়ার পক্ষ থেকে কিছু চাউল ও আটা দেয়া হয়েছিল মাঝিদের। কিন্তু এমন দুর্দিনে এই অসহায় মাঝিদের পাশে দাঁড়ায়নি ঘাটের ইজারাদাররা। কোন খোঁজ খবরও নেয়নি কেউ। অথচ এই মাঝি-মাল্লাদের কাধে ভর করেই সচল ছিলো ফতুল্লার গুদারা ঘাটটি।এবিষয়ে মাঝিদের সংগঠনের সভাপতি সবুজ মিয়া বলেন, ‘প্রায় ১ মাস ধরে লকডাউনের আওতায় থাকলেও গত ১২ দিন যাবত সবকিছু পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ওপাড়ের কেউ এপাড়ে আসলে সমস্যা নেই, কিন্তু এই পাড়ের কোন ট্রলার ওই পাড়ে গেলেই তারা মারধর করছে। বলছে, ফতুল্লার মানুষতো বটেই, কোন ট্রলারও এই পাড়ে আসতে পারবে না। এমন অবস্থায় আমার মাঝিরা কর্মহীন হয়ে থাকলেও ফতুল্লা গুদারা ঘাটের ইজাদাররা কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছেন না। অসহায় মাঝিদের কোন ভাবে সহায়তাও করেনি। আমি নিজের পক্ষ থেকেই মাঝিদের চাউল-আটা বিতরণ করেছি।কিন্তু নিজ ঘাটের মাঝিদের এই দুঃসময়ে যেন গাঁ ঢাকা দিয়েছেন সকলেই।

এ বিষয়ে কথা হয় ঘাটের অন্যতম ইজারাদার ফরুক চৌধুরীর সাথে।

তিনি বলেন- ‘এক মাস যাবৎ মাঝিদের কাজ কর্ম কম সেটা ঠিক, কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে কাজ কর্ম একেবারেই নেই। সব কিছু বন্ধ রেখেছি। গুদারা ঘাটও বন্ধ আবার ফতুল্লা ডিআইটি মাঠের মঙ্গলবারের হাটও বন্ধ। ঘাটের স্টাফ রয়েছে ২২জন। তাদের চালাতে হচ্ছে। অনেক লোকসানের মধ্যে আছি।যেহেতু মাঝিদের পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে, সেহেতু আমি মানবিক দিক বিবেচনা করে ইজারাদারদের বলব যেন মাঝিদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়।’

তবে, এমন পরিস্থিতিতে ওই কর্মহীন মাঝিদের ভবিষ্যৎ পরিনতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।মাঝিদের অাশা তাকিয়ে অাছেন সাহাজ্যের জন্য। নয়তো নিজের ও সংসারে নেমে অাসবে করুন পরিনতি।দুকে দুকে মরা ছারা কোনো পথ ই অার খোলো নাই তাদের। এমন মন্তব্য ই করেন সকল মাঝিরা।