চোর : রুদ্র অয়ন

চোর : রুদ্র অয়ন

সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের একটি গান আছে-
ইস্ দুনিয়া মে সাব চোর চোর/কই প্যায়সা চোর কই মুরগি চোর/ওর কই দিল কা চোর….

জগতের সবাই চোর নয়, কিন্তু সুযোগ পেলে যেকোনো পরিস্থিতিতেও অনেকের পুরনো, আসল চেহারা বেরিয়ে আসে ; করোনাভাইরাসের এক কঠিনতম সময়ে এসে এইদেশের অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা তাই দেখিয়ে দিয়েছেন।

মোল্লা বাড়ির মেয়েদের মধ্যে একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে বর্ষা। মাষ্টার্স শেষ করে একটা কলেজে জয়েন করেছে। বিয়ে করেনি এখনও। পিএইচডি শেষ করার পরেই বিয়ের চিন্তা ভাবনা তার।

গতরাতে বাড়িতে চুরি হয়েছে। চোরের হয়তো খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। প্রথমে চোর রান্না ঘরে ঢুকে। পাতিল থেকে ভাত আর কড়াই থেকে একটু ডাল নিয়ে পেট ভরে খেয়ে নেয়। তারপর পাশে রাখা চালের বস্তা চুরি করে পালিয়ে যায়।

বাড়ির সবাই চোর আর চুরি যাওয়া মালামালের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত।

সেদিকে অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই বর্ষার। তার ভাবনায় কেবল নাড়া দিয়ে যায় সাম্প্রতিক আলোচিত সমালোচিত চোর ও ধান্ধাবাজ কথিত নেতা, জনপ্রতিনিধি, সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তা – আমলাদের ঘটনা।

করোনাভাইরাসের এই লকডাউনে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দিনমজুর ও শ্রমহারা মানুষদের খাদ্য-অর্থ সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিসহ অনেকেই সেই সহায়তা মানুষদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন। সেই সুযোগে দেশের এই চরম সংকটেও গরিবের ত্রাণ চুরি বা লুট করছেন অনেকে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে তাদের কয়েকজন সম্পর্কে খবরও বের হয়েছে।

বর্ষার দৃষ্টিতে এই চোর ও চুরি যাওয়া মালের হিসেবের চেয়ে চোরের অসহায়ত্বের দিকটা বেশি নাড়া দেয়। কারণ বিশেষ কিছু নয় রান্না ঘর থেকে রান্না করা খাবার আর চালের বস্তা নিয়ে গেছে চোর। হয়তো পেটের জ্বালায় এমন কাজ করেছে।

কিন্তু যারা জনপ্রতিনিধি সেজে গরীরের হক মেরে লুটেপুটে খাওয়ার নেশায় মত্ত, দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে ; ঘুষ – দূর্নীতি – মানিলেন্ডারিং করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তাদের ক্ষমা করা যায়না। ক্ষমার যোগ্যও নয় তারা।

সাম্প্রতিক এক ডিজিটাল চোর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার। তাকে ডিজিটাল চোর বলা-ই যায়।

কেননা তিনি ত্রাণ চুরি করতে গিয়ে ডিজিটাল কায়দায় কাজ করেছেন। গত ৬ এপ্রিল ইউনিয়ন পরিষদে মানুষদের ডেকে ২৬টি পরিবারকে ত্রাণ দেন চেয়ারম্যান।

সবাইকে ত্রাণ দিয়ে সেই ছবি তোলা হয়। এরপর সবার থেকে সেই ত্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়। এটা বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৭ এপ্রিল ২০২০এ প্রকাশ।

ডিজিটাল চোরের মতোই অ্যাকশন চোরের দেখা মিলেছে রাজশাহীতে। বাঘা উপজেলার আড়া‌নি পৌরসভার মেয়র তিনি, নাম মুক্তার আলী।

পাবলিকের ত্রাণ আত্মসাত করতে তিনি কোনো কায়দা-কানুনে যাননি, সরাসরি অ্যাকশনে গেছেন। সোজা কথায় বলতে গেলে, মেরেছেন এক নারী ও আরিফুল ইসলাম নামের ভ্যানচালককে! শুধু কি তাই? ত্রাণ চাইতে যাওয়ায় তাদেরকে মারধর করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে।

গরিব মানুষ ত্রাণের জন্য গিয়েছিলেন, কিন্তু তালিকায় নাকি তাদের নাম ছিল না। পেটের ক্ষুধা কি অতশত তালিকা টালিকা বোঝে? তাই তারা ত্রাণ চেয়েছিলেন।

কিন্তু মুক্তার আলী যে পুরোনো অ্যাকশন পার্টি, সেটা স্থানীয়রা জানলেও ওই হতদরিদ্র নারী-পুরুষ বোঝেনি। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে।

দেশ উন্নত হচ্ছে, বিচার-বুদ্ধি সবার বাড়ছে। সেখানে বৃদ্ধি না খাটিয়ে দাম্ভিকতা দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন আয়েত আলী। তিনি নওগাঁ রানীনগর উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। বলা চলে বয়সী নেতা। খাই-দাইয়ে পুরোনো হস্ত তার, তা বলাই বাহুল্য।

তাই তো গরিবের চাল নিজের গুদামে রেখেছিলেন তিনি। দেশ ডিজিটাল, এমন তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহে সেই চুরির খবর কি আর আটকে থাকে! সেই খবর চলে যায় ইউএনও’র কাছে।

এরপর ঘটনাস্থলে পৌঁছে খাদ্য অধিদপ্তরের সিল মারা ১৩৮টি চালের বস্তা জব্দ করেন ইউএনও। এ ছাড়া ওই গুদাম থেকে খাদ্য অধিদপ্তরের সিল মারা আরও ২০০টি খালি বস্তা জব্দ করা হয়। এই খবর, প্রথম আলো অনলাইন, ৩ এপ্রিল ২০২০ প্রকাশিত। ঘটনার পর থেকে সেই চোর নাকি পলাতক।

আয়েত আলী ধরা খাওয়ার পর সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভিন্ন পন্থায় পা বাড়িয়েছিলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন। তবে কৌশলি এই চোরকেও শেষ পর্যন্ত ধরা খেতে হয়েছে

তিনি একজন জনপ্রতিনিধিও। আগড়বাড়ি গ্রামের ৮ নম্বর ইউপি সদস্য তিনি। শুধু কি তাই, জেলা মেম্বর ফোরামের সভাপতিও তিনি। ভাবা যায়, এত বড় প্রতিনিধি ব্যক্তিত্ব, তার কি কম কৌশল থাকবে? আহারে দুনিয়া, সেই কৌশলও ধরা খেল।

আরেক ঘটনা। ত্রাণের সরকারি আড়াই টন (২৫০০ কেজি) চাল মনির হোসেনের বাড়ি থেকে জব্দ করে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন।

গত ৫ এপ্রিল রাতে সেই চালগুলো জব্দ করা হয় কৌশল খাটিয়ে চালগুলো সরকারি বস্তা খুলে অন্য বস্তায় রাখা হয়েছিল, যেন কেউ বুঝতে না পারে।

প্রথমে হয়তো বোঝার উপায় ছিল না সেই চাল কার। কেননা চালের গায়ে তো আর লেখা নেই! কিন্তু তারপরও দক্ষ প্রশাসনের দৃষ্টি পড়ে নেতার সেই গোলাঘরে। নিমিষেই সেই গোলা ফাঁকা হয়ে যায়। স্বপ্নের ‘তাসের ঘর’ ভেঙে যায় রাতারাতি।
এই সংবাদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইন, ৬ এপ্রিল ২০২০ প্রকাশিত।

দেশে এত সব চোর দেখে বগুড়ার সারিয়াকান্দি কুতুবপুর বাজারের ডিলার গাজীউল হক গাজী একটু-আধটু উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাই হতদরিদ্রের চাল নিজের মতো করে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।

ওএমএস’র (ওপেন মার্কেট সেল) ১০ টাকা কেজি দরের ২৮৮ বস্তা চাল আত্মসাতের অভিযোগে তাই তার জেলও হয়েছে এক মাস।

ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাসেল মিয়া গত ৬ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে এ আদেশ দেন। এ ছাড়া তার ডিলার শিপ বাতিল করা হয়েছে। ইত্তেফাক অনলাইন, ৬ এপ্রিল ২০২০ এই খবর প্রকাশ করে।

জেলে গিয়ে গাজীউল হক হয়তো ভাবছেন- ইস্ দুনিয়া মে সাব চোর চোর…! কিন্তু আমি একাই ধরা খেলাম। বাকিদের হয়তো কিছুই হবে না। এমনটি অন্য যাদের নাম গণমাধ্যমে আসেনি, তারা তো এখনো হিরো।

চোরের আরও অনেক খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এই যেমন সিলেট সিটি করপোরেশনের এক কাউন্সিলরের বাসায় ১২৫ বস্তা ত্রাণের চাল পাওয়া গেছে।

বরগুনার পাথরঘাটায় জেলেদের চাল আত্মসাতের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাগেরহাটের শরণখোলায় পাচারের সময় ১৮ বস্তা চল জব্দ করা হয়েছে। নোয়াখালীতে চাল পাচারের ঘটনায় যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে।

করোনার এই সংকট সময়ে যারা সুযোগ নিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রযোগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অতীত প্রয়োজন। না হলে আগামী দিনে এরাই বাংলাদেশকে চুষে খাবে।

কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতার পাশে থাকা এসব মানুষদের হয়তো কিছুই হবে না। তাই শাস্তির আশা করাটাও হয়তো বোকামি।

মুখোশধারী ও ডিজিটাল চোর চাট্রার কথা ভাবতে ভাবতে কলেজের পথে পা বাড়ায় বর্ষা।

এদিকে সকাল থেকে গ্রামজুড়ে আলোচনার বিষয় একটিই মোল্লা বাড়িতে চুরি হয়েছে। চার দিকে খোজ খবর লেগে গেলো। তিন চারটি দলে ভাগ হয়ে বাড়ির যুবক ছেলেরা চোরের সন্ধ্যানে বেরিয়ে যায়।

অবশেষে চুরি হওয়া চালের বস্তা সহ চোর ধরা পরেছে। ভুল মানুষকে ধরা হয়নি। তার সাথে চুরি যাওয়া চালের বস্তা পাওয়া গেছে।

মোল্লাবাড়ির আঙ্গিনায় কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে সবাই সাধ মিটিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছে। গাছের ডাল দিয়ে একজন পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আরেক জনের হাতে লাঠি তুলে দিচ্ছে।

হাটুতে কোমরে পিঠে লাঠির একেকটা আঘাতে ও বাবাগো বলে লাফিয়ে ওঠছে চোর। ঠোট কেটে রক্ত গড়িয়ে পরছে। গায়ের ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জিটা রক্তে ভিজে গেছে।

ছেড়া লুঙ্গীটা কোমর থেকে আলগা হয়েগেছে। বিশ বাইশ বছর বয়সী যুবকের শরীরে আরো মার হজম করার শক্তি আছে বলে উৎসাহ দিচ্ছে কেউ কেউ। কেউ বলছে -এই ব্যাটা জাত চোর, চোখ দিয়ে পানি আসছে না।

সারা গ্রামের মানুষ দূর থেকে চোর পিটানোর তামাসা দেখছে। এক বৃদ্ধ এসে পেটে পিঠে দুই একটা লাত্থি দিয়ে সাধ মিটিয়ে যায়।

তিন দিন আগে তার অভাবের সংসারে পুরাতন কিছু জামা কাপড় আর রান্নার চাল চুরি হয়। সেদিন তার ঘরে রান্না হয়নি। চোর ধরা পরেনি বলে তার মনে ক্ষোভ। তাই পিটিয়ে ক্ষোভ মিটালো সে।

কলেজে বর্ষা তার ক্লাস নেয়া শেষ করলো এমন সময় তার কাছে খবর আসে তাদের ঘরে রাতে যে চোরটা চুরি করেছে সে ধরা পরেছে। তাকে খুব পিটানো হচ্ছে। খবর পেয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আসে বর্ষা।

তাকে দেখে ছোট বড় সবাই দূরে সরে যায়। বর্ষা চোরের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে আলগা হয়ে যাওয়া লুঙ্গীটা পড়ে নিতে বললো। এরপর একটা কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে ক্ষতস্থান আর গায়ে লেগে থাকা শুকনো রক্ত মুছে দেয়।

পুকুর ঘাটে নিয়ে গোসল করিয়ে ঘর থেকে একটা লুঙ্গী আর শার্ট পড়তে দেয়। রান্না করে গরম ভাত আর আলু ভর্তা করে বাড়ান্দায় পাটি বিছিয়ে খেতে দেয়। এরপর পাশে বসে জানতে চায়, ‘তুই কেন চুরি করেছিস?’

-ক্ষিদার জ্বালায় আফা।

-এটাই প্রথম নাকি আগেও চুরি করেছিস?

-এর আগে একটা দুহানে চুরি করছি। আরেক বার চাইল আডার গাড়ি থেইক্কা এক বস্তা আডা ফালায়া দিছিলাম।

– চুরি করতে কি তোর ভালো লাগে?

-না আফা। চুরি খুব খারাপ কাম।

-ভালো কাজ দিলে করবি তুই?

-হ আফা করমু।

-ঠিক আছে এখন ভাত খা। আর এই পাঁচ হাজার টাকা রাখ। কোন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত যখনই ক্ষিদা লাগে আমার কাছে এসে ভাত খেয়ে যাবি।

-আইচ্ছা আফা।

এতোক্ষনে চোরের চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখা গেলো। চোখে জল আসতে আবেগ লাগে। গাছের সাথে বেঁধে পিটানো চোরের আবেগ থাকেনা। মনে তখন ভয় থাকে। ভয়ে চোখের জল শুকিয়ে যায়।

এসব পেটের দায়ে চুরি করা চোরদের ভাল হবার সুযোগ দিলে খুব সহজেই ভাল হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু চুরি যাদের নেশায় পেশায়, শিরায় শিরায় তারা যতই নেতাগিরি দেখাক, যতই জনপ্রতিনিধি সাজুজ।

সুযোগপেলে এরা অন্যের হক চুরি করতে, লুটপুটে খেতে ছাড়বেনা। পেলে গোটা দেশটাকেই গিলে খাবে! ধিক্কার চোর, দূর্নীতিপরায়ন নেতা- জনপ্রতিনিধিদের। শত হাজার ধিক্কার।