সাহিত্যের জন্যে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকা প্রয়োজন

রফিকুজ্জামান রণি :
বৈষম্যমুক্ত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এদেশের লাখ লাখ মানুষ। তিরিশ লাখ তাজা প্রাণের বিনিমেয়ে স্বাধীন হলো দেশ কিন্তু বৈষম্য কি আদৌ দূর হয়েছে? জাতির জনকের সোনার বাংলা কি সত্যিসত্যিই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি আমরা? আমি যেহেতু শিল্পসাহিত্যের মানুষ, তাই প্রসঙ্গটা এ বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

আমি দেখেছি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে যতটা ভালোবাসে, সাহিত্য অঙ্গনকে ততটা বাসে না। এ দেশের লেখকদের ব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক কোনো ভূমিকা আমার চোখে পড়েনি। অথচ সাংস্কৃতিক অঙ্গন আর সাহিত্য অঙ্গনের রাষ্ট্রীয় অভিভাবক তাঁরা।

প্রতি বছর জেলার চল্লিশোর্ধ্ব সাংস্কৃতিকর্মীরা চৌদ্দ পনেরো হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান পায়,  লেখকরা এক টাকাও পায় না। প্রতি বছর জেলায় জেলায় পাঁচ-ছয়জন করে সাংস্কৃতিকর্মীকে দেয়া হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, সেখানেও দশ হাজার টাকার একটি সম্মানী চেক থাকে। কিন্তু লেখকদের কিছুই দেয়া হয় না। নামমাত্র লোক-গবেষণায় একটি পুরস্কার দেয়া হয় কালেভদ্রে। এ দেশে লোকসাহিত্য ছাড়া কি আর কোনো সাহিত্য নেই? সাহিত্যের মূলধারাকে অবজ্ঞা করে এসব দেয়া মূলত লেখকদের এড়িয়ে যাবার চমৎকার কৌশল।

তাছাড়া কিছুদিন আগে প্রতি জেলার সাংস্কৃতিকর্মীদের শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা করে সম্মানী দিয়েছে সরকার। ছোটবড় সবাই পেয়েছে সে টাকা। লেখকরা কী পেয়েছে? কেউ কি নিয়েছে তাদের খবর? জেলা প্রশাসনও সাংস্কৃতিকর্মীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে করোনাকালে। লেখকদের দেয়া হয়নি কিছুই।

শিল্পকলা একাডেমি থেকে কয়েক দফা করোনাকালীন সহযোগিতা দেয়া হয়েছে সাংস্কৃতিকর্মীদের। কিন্তু একজন লেখক কি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে? খেয়ে আছে নাকি না খেয়ে আছে- কেউ খবর রাখে না। অথচ লেখক গান লেখে, শিল্পী গায়; লেখক নাটক লেখে শিল্পী অভিনয় করে। সাংস্কৃতিক জগতকে টিয়ে রাখার নেপথ্যেও লেখকরাই অগ্রণি ভূমিকা পালন করে। লেখকদের সৃষ্টিই সাংস্কৃতিককর্মীদের স্পর্শে প্রাণ খুঁজে পায়। তারপরও লেখকদের পাশে দাঁড়াতে এত কৃপণতা, এত উদাসীনতা কেন? আজও বইকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে কি? আর কবে বইকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হবে?

সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মূল্যায়ন করার উদ্যোগটি নিঃসন্দেহ চমৎকার, গুণিজনদের মূল্যায়ন করলে জাতির মেরুদণ্ড শক্ত হয় কিন্তু সেটা কেবলেই সাংস্কৃতিক অঙ্গন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? লেখকদের দায়িত্ব নেবে কে? লেখকরাই তো ইতিহাস রচনা করে, সময়কে ধারণ করে, রাষ্ট্রের দুঃসময়ে এগিয়ে আসে, তাদের প্রতি কি দায়িত্বশীল আচরণ করার প্রয়োজন নেই?

তাদের পেটের খোঁজ নেয়ার কি কোনো দরকার নেই? বাংলা একাডেমি কি বইমেলা করে আর কিছু অনিয়মিত প্রকাশনা বের করেই দায়িত্ব শেষ? কজন লেখকের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলা একাডেমি? স্বজনপ্রীতি থেকে কি বাংলা একাডেমি বেরিয়ে আসতে পেরেছে? তাছাড়া রাষ্ট্রীয় পুরস্কারগুলির নিয়ে যে বিতর্ক ওঠে প্রতিবছর, সেসবের পেছনে কাদের হাত থাকে? কেন অপাত্রে পুরস্কার দিয়ে আবার ফেরৎ নেয়া হয়? জাতিকে কেন বারবার বিব্রত করা হয়, বৈষম্যনীতির মাধ্যমে কেন সরকারের ভাল কাজগুলিকেও খারাপভাবে উপস্থাপনের ষড়যন্ত্র করা হয়?

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ রাখছি, নতুন করে ‘শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ সৃষ্টি করে এ দেশের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলুন। সাহিত্যিকদের মর্যাদা আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন সুলেখক। তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একজন দক্ষ লেখক ছিলেন। সুতরাং সাহিত্যের প্রতি সরকারের আলাদা নজর থাকার বিষয়ে তাঁর সুদৃষ্টি কামনা করি। সেকারণে আলাদাভাবে ‘শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ থাকা আবশ্যক। কবি আসাদ চৌধুরী, কবি কামাল চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের সে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।

লেখক পরিচিতি : মহাপরিচালক, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর।