ক্ষুদীরাম দাসের ছোট গল্প : পিতার মন!

ক্ষুদীরাম দাস :

মধ্যরাত! চারিদিকে নিস্তব্ধ! পাড়ায় মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক শোনা যায়। ওরা চোর আসলেও ডাকে, না আসলেও ডাকে। এক বাড়ির কুকুর ডাক দিলে অন্য বাড়ির কুকুরও ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। মাঝে মাঝে সে রকমই ডাকাডাকি শোনা যায়।

দিনের কর্মব্যস্ততার পর পাড়ার সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সরকার বাড়ির সকলে একটু দেরি করেই ঘুমায়। এটা তাদের অভ্যাস। রাত একটার আগে কেউ ঘুমায় না। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তখন রাত আড়াইটা বাজে। ঘরের দরজায় ঠক ঠক আওযাজে মিসেস রিতু সরকারের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাড়ার সাত আটজন মানুষ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরের দরজার সামনে থেকে কথা বলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারা নানান বিষয়ে কানাঘুষা করছে, কেউ কেউ হুতাশ করছে, হায় হায় করছে-এসব কথা শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। মিসেস রিতু সরকার ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে অনেকটা বিরক্তি ভাব নিয়ে ঘরের দরজা খুললেন।

রিতু সরকার এতো মানুষ একসাথে দেখতে পেয়ে হতবাক হলেন। নিশ্চয় কোনো অঘটন ঘটেছে বলেই এতো মানুষ এসে হাজির। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

একজন এগিয়ে এসে বললো, আপনার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

তার সাথে অন্যেরাও বলতে লাগলো, এই মাত্র তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো। আমরা দেখলাম একদল পুলিশ গাড়ি নিয়ে আসলো, আর রাস্তা থেকে মাতাল অবস্থায় তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

এসব বলার পর পাড়ার লোকজন চলে গেলো। তারা আর কিছু বলতে চাইলো না। লোকজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কী যেন ইশারা করছিলো।

লোকজন চলে যাবার পর মিসেস রিতু সরকার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। লোকজনের মুখে কথাটা শোনার সাথে সাথে মাথা ঘুরছিলো তার। কী করবে বুঝতে পারছিলেন না। নিশ্চয়ই সে কোনো অঘটন ঘটিয়েছে। বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে কিছুক্ষণ পানি ছিটালেন। তারপর শাড়ির আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে খাটের এককোণে বসে ছেলের কথা ভাবছিলেন। এর আগেও তাকে নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাকে অনেক নিয়ে অনেকবার শালিস দরবার করতে হয়েছে। একের পর এক অন্যায় করেই চলেছে। পাড়ার কেউ ছেলেটাকে তার কাÐর্কীতির জন্যে মোটেও পছন্দ করে না। এই ছেলের জন্যে তাদের অনেক অপমানিত হতে হয়েছে।

হাতের কাছেই ফোনটা ছিলো। তার মনটা চাইছে স্বামীকে ফোনটা করবেন। কিন্তু এতো রাতে বিরক্ত করাটা উচিত হবে কিনা ভাবছেন। তাছাড়া বাবা হিসেবে ছেলের প্রতি তিনিও খুবই বিরক্ত । সুতরাং ফোন করলেও তার স্বামী খুব একটা গুরুত্ব দেবেন না বলে মনে হয় না। ছেলেটা হাড়ে হাড়ে এতোটাই জ¦ালাতন করেছে যে, গুরুত্ব দেয়ার মতো না। এই ছেলেকে নিয়ে জ¦ালাতন এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু এবার পুলিশই ধরে নিয়ে গেছে। তবুও স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ববোধ থেকেই এত রাত হলেও ফোন করবেন বলে হাতে ফোনটা তুলে নিলেন।

কল করতেই রিং বাজতে লাগলো। এদিকে সমীর সরকার আগেই অন্য একজনের ফোন পেয়ে দশ মিনিট কথা বলে ফোন রেখে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে-সেসব বিষয় নিয়েই কথা হয়েছিলো। অর্থাৎ বাবার কানে আগেই খবরটা পৌঁছে গেছে। এখন স্ত্রীর ফোনটা পেয়ে ইচ্ছা করেই ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। ভাবছেন, স্ত্রীর সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেই বা কী লাভ। এতো দূর একটা প্রোগ্রামে এসেছেন, এখন হুট করে তো বাড়ি যাওয়া যায় না। ছুটে যাওয়া যেতো; যদি ছেলেটা ভালো হতো তাহলে যেভাবেই হোক মনের টানে যাওয়াটা হতো। কিন্তু ছেলের জ¦ালাতন এতোটাই বেশি যে, যেতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। সমীর সরকার এসব ভাবছেন, আর এদিকে ফোন বেজেই চলেছে। রিতু সরকার ভাবছেন, হয়তো মোবাইল সাইলেন্স করে ঘুমিয়েছে; তাই ফোনটা রিসিভ করছে না। এদিকে স্বামীর সাথে কথা না বলে থাকতেও পারছে না। মনটা নিদারুণভাবে ছটফট করছিলো। ধৈর্যের সাথে মিসেস রিতু সরকার ফোনের পর ফোন করেই যাচ্ছেন। অপরদিকে সমীর সরকার এতো বার ফোন বাজায় মনটা নরম হয়ে গেলো।

বেশ কিছুক্ষণ পর ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরলেন। মিসেস রিতু সরকার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, টিপুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
মিঃ সমীর সরকার ঃ কখন?
মিসেস রিতু সরকার ঃ এই তো ঘন্টাখানেক হবে!
মিঃ সমীর সরকার ঃ তুমি কী করে জানলে?
মিসেস রিতু সরকার ঃ পাড়ার লোকজন এসে খবরটা দিলো।
মিঃ সমীর সরকার ঃ তার মানে পাড়ার লোকজন সব জেনে গেছে! তারা কতোজন এসেছিলো?
মিসেস রিতু সরকার ঃ সাতআটজন পাড়ার লোক এসে আমাকে বলে গেছে।
মিঃ সমীর সরকার ঃ কেনো পুলিশ নিয়ে গেছে?
মিসেস রিতু সরকার ঃ একটা মেয়ের সাথে শ্লীলতাহানি করেছিলো, তাই ধরে নিয়ে গেছে।
মিঃ সমীর সরকার ঃ তাহলে তো ঠিক আছে। এজন্যে এতো চিন্তা করার দরকার নেই। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
মিসেস রিতু সরকার ঃ এসব তুমি কী বলছো?
মিঃ সমীর সরকার ঃ সে যদি শ্লীলতাহানি না করতো, তাহলে কি পুলিশ ধরে নিত, তুমিও বল তো। সে একটা গরীব মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছে তাই তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, তাই না?
মিসেস রিতু সরকার ঃ হ্যাঁ!
মিঃ সমীর সরকার ঃ তাহলে তো ঠিকই আছে। এসব করলে তো পুলিশ ধরবেই।
মিসেস রিতু সরকার ঃ তুমি কিছু করবে না?
মিঃ সমীর সরকার ঃ এর আগে তো অনেক করেছি। তার জন্যে অনেক টাকা পয়সাও খরচ করেছি। পড়াশোনা তো করেনি, শুধু টাকা পয়সা নষ্ট হয়েছে। তাকে সংশোধনের অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। সে অনেক জ¦ালিয়েছে। অনেক শালিস দরকার করতে হয়েছে। তার জন্যে মানসম্মান অনেক খুইছে। পাড়ার লোকজন আমাদেরকে একঘরে করেনি সেটাই ভাগ্য। তাছাড়া আত্মীয়স্বজন তো এই ছেলের জন্যে দূরে দূরে রয়েছে। সে তা কারো কথাই শোনে না। সুতরাং এমন ছেলের জন্যে আর কী করার আছে। এখন তো মুখ দেখানোটাই দায় হয়েছে।
মিসেস রিতু সরকার ঃ তাহলে বাবা হিসেবে তোমার কিছুই করার নেই?
মিঃ সমীর সরকার ঃ অবশ্যই। আমার সীমানা শেষ হয়ে গেছে। আমার যা করার আমি তাই করবো। এখন তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, আমিও ঘুমাই।
মিসেস রিতু সরকার ঃ আমার ঘুম আসবে না।
মিঃ সমীর সরকার ঃ তাহলে কী করবে?
মিসেস রিতু সরকার ঃ তোমার তো এখন টাকা আছে। একটু চেষ্টা করে দেখতে পারো, যদি তাকে ছাড়িয়ে আনা যায়।
মিঃ সমীর সরকার ঃ এতে কী লাভ হবে? ছাড়িয়ে আনলে কি ছেলেটা ভালো হয়ে যাবে? আমার তো মনে হয় না সে ভালো হবে।
মিসেস রিতু সরকার ঃ তাহলে কী করতে চাও? তুমি বাবা হয়ে কী চাইছো?
মিঃ সমীর সরকার ঃ বাবা হয়ে অনেক ভূমিকা পালন করেছি, সেটা তুমি নিজেও জানো। তোমার আমার আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রæটি ছিলো না।
মিসেস রিতু সরকার ঃ সেটা তো জানি।
মিঃ সমীর সরকার ঃ তাহলে তুমি এখন কী করতে বলছো আমাকে?
মিসেস রিতু সরকার ঃ থানা পুলিশ পর্যন্ত যেহেতু গিয়েছে, সেহেতু টাকা খরচ তো হবেই।
মিঃ সমীর সরকার ঃ আমি অনেক কষ্ট করেছি জীবনে। সরকারি প্রাইমারী স্কুলে চাকুরী করেছি। এখন রিটায়ার্ড হয়েছি বলে কিছু টাকাও পেয়েছি। আমার আর কোনো টাকা নেই। সেই টাকা আমি এই ছেলের জন্যে মোটেও খরচ করতে চাই না। তোমাকে আমাকে বাঁচতে হবে। আমাদের একটা মেয়ে আছে, তার ভবিষ্যৎ আছে সেটাও আমাকে ভাবতে হবে। যদি এই টাকা অপদার্থ ছেলের পেছনে খরচ করি তাহলে ভাবার কিছুই থাকবে না। যদি ছেলের পেছনে টাকা খরচ করে লাভ হতো, সেই ভরসা থাকলেও চিন্তা করতাম। কিন্তু এমন ছেলের জন্যে কোনো ভরসা নাই। অযথাই টাকা খরচ হবে।
মিসেস রিতু সরকার ঃ তাহলে–?
মিঃ সমীর সরকার ঃ তারচেয়ে বরং ছেলেটা জেল খাটুক। দুইতিন বছর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে। জেলে থেকে যদি নিজের চরিত্র সংশোধন হয়, তো সেটা বরং ভালো। নিজেকে শোধরানোর সুযোগটা অন্তত দেয়া উচিত এই সুযোগে। যদি তার চরিত্র সুধরায় তাহলে সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে। নিজেকে চিনতে শিখুক। জেলে থেকে নিজের অন্যায় ও অপরাধগুলোর কথা চিন্তা করুক সেটা বরং তার জন্যে সবচেয়ে ভালো হবে। অপরদিকে পাড়ার মেয়েরাও ভালো থাকবে। নিশ্চিন্তে, নির্বিঘেœ মেয়েরা চলতে পারবে, বাঁচতে পারবে। আর মেয়ের মা বাবারাও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। আমি আমার কষ্টের টাকা ছেলের জন্যে খরচ করে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনলে ছেলেটা আবার একইভাবে জ¦ালাতন করবে। বরং জেলে থাকুক সেটাই তার জন্যে সবচেয়ে ভালো হবে। কৃতকর্মের জন্যে শাস্তি না পেলে মানুষ কখনো সংশোধিত হয় না। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সেটা বুঝতে পারে না। অন্তত ছেলেটা জেলে থাকুক কয়েকবছর তাহলে সে মানুষের কষ্ট, মা বাবার কষ্ট বুঝতে পারবে।
মিসেস রিতু সরকার ঃ এখন আমি কী করবো?
মিঃ সমীর সরকার ঃ তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। মানসম্মান যা’ চলে যাবার, তা তো চলেই গেছে। মনটাকে শক্ত করে রাখ-
মিসেস রিতু সরকার ঃ আমি কি তাকে দেখতে যাবো?
মিঃ সমীর সরকার ঃ তোমার মন চাইছে?
মিসেস রিতু সরকার ঃ তোমাকে ছাড়া যেতে চাইছি না?
মিঃ সমীর সরকার ঃ হুম! বুঝতে পারলাম। কিন্তু গিয়ে কাকে কী বলবো? বলার মতো তো জায়গা নেই। শুধু অপমানিত হতে হবে।

কথা বলতে বলতে ফোনটা কেটে গেলো। মিসেস রিতু সরকারের দু’চোখ বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়লো। সারা রাত ঘুমাতে পারলো না। সকালের সূর্যটা উঁকি দিয়েছে জানালার কাচ ভেদ করে। পাড়ার সকলের ঘুম ভেঙ্গে গেলেও রাত জাগা মায়ের ঘুমটা ভাঙ্গেনি তখনো। এদিকে রতন সরকারও রিক্সা করে পাড়ায় ঢুকছেন। পাড়ার কিছু লোক তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আবার চোখ ঘুরিয়েও নিলেন। কারো কাছে কিছু বলতে তার ইচ্ছা হচ্ছে না। তবে পাড়ার মানুষজন ছেলের প্রতি বিরক্ত হলেও রতন সরকারকে সকলেই সম্মানের চোখেই দেখেন। ফলে তিনি যে সিদ্ধান্তটা নিলেন, সেটার জন্যে কারো কোনো প্রশ্ন ছিলো না।

একদিন রতন সরকার বারান্দায় বসে আছেন। দূরে একজন পাড়া প্রতিবেশীর দৃষ্টি পড়লো রতন সরকারের দিকে। দেখলেন, রতন সরকারের দু’চোখ বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়ছে। তিনি দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বিড় বিড় করে বললেন, পিতার মন! তবে তার এই কথা কেউ শুনতে পেলো না। -সমাপ্ত-

You might like