নিরামিষ নির্মোহ জীবন যাপন করতেন অ্যাড. মিজানুর রহমান

মিজানুর রহমান রানা :
গত ২১ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রি. রাতে যখন অ্যাড. মিজানুর রহমানের মৃত্যুর খবরটা শুনি, তাৎক্ষণিক আমার হৃদয়টা বরফ হয়ে গিয়েছিল। চোখে জমা হয় বাধভাঙ্গা অশ্রুবিন্দু। কিন্তু কেন? প্রতিটি মানুষেরই তো মৃত্যুবরণ করতেই হবে। এই পৃথিবীতে কেউ মৃত্যুর হিমশীতল ছোঁয়া ছাড়া তো বের হতে পারেনি, পারবেও না। তাহলে কেন কিছু কিছু মানুষের মৃত্যুতে হৃদয় ছুঁয়ে যায়, দাগ কেটে যায়?

সময়টা ২০০৯ সাল হতে পারে। ওই সময় আমরা অ্যাড. মিজানুর রহমান সাহেবদের বাড়িতে বাসাভাড়া থাকতাম। প্রতিরাতে ওনার আব্বা আমাদেরকে ফজর নামাজের সময় ডাকতেন। এছাড়া অন্যান্য নামাজের সময়ও ডাকতেন। ওনার আব্বা এবং আম্মাকে আমি দেখেছি। খুবই পরহেজগার মানুষ ছিলেন। নম্র, ভদ্র অমায়িক মানুষ ছিলেন দু’জনই।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। ’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)

অ্যাড. মিজানুর রহমান ছিলেন এমন মানুষের সন্তান, যাঁর বাবা ছিলেন সৎ কাজের আদেশদানকারী এবং অন্যায় কাজের নিষেধ প্রদানকারী। আর তিনি তাঁদেরই যোগ্য সন্তান ছিলেন।

একদিন তিনি আমার প্রতিষ্ঠানে কিছু কম্পিউটারের কাজের জন্যে এসেছিলেন। পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করবেন। সম্ভবত সম্পাদক মহোদয়ই আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। ওই লেখাটার শিরোনাম ছিলো ‘হৃদয়ের সম্পাদকীয়’। লেখাটা কারও মৃত্যু উপলক্ষে লেখা ছিলো তা আমার মনে নেই তবে সত্যিই ওনার ওই লেখাটা পড়তে গিয়ে আমি তাঁকে এক ভিন্ন মানুষ হিসেবে আবিস্কার করেছিলাম। এভাবে যে একটা লেখার হেডলাইন হতে পারে তা ছিলো আমার কল্পনারও বাইরে। সত্যিই হেডলাইনটা চমৎকার হয়েছিল।

ওনাকে দেখে কিন্তু মনে হয়নি যে, ওনার মন মানসিকতায় সাহিত্যের আবেগ আছে, ভাব আছে, আর আছে একটা আলাদা সৃষ্টিজগত। যে জগতে ভদ্রতা, নম্রতা ও পরোপকারের ছোঁয়া আছে।

সত্যিকার অর্থে ওনার মন-মানসিকতা ঠিক তাঁর বাবার মতোই ছিলো। পরোপকারী মনটা তাঁকে মানুষের উপকারের পথে ঠেলে দিতো। যদি ওনার পরিবারের এক দুষ্টু রমণীর চক্ষুশূল হয়ে আমাকে ওনাদের বাসা ত্যাগ করতে হয়েছিল ব্যথিত চিত্তে, কিন্তু অ্যাড. মিজানুর রহমান সাহেব আমাকে বলেছিলেন, আমি যাতে ওনাদের বাসা ত্যাগ না করি। ওনার আম্মাও আমাকে সংক্ষিপ্ত একটি চিঠি লিখে তাঁর নিতান্ত অপরাগতার কথা এবং আমাকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন, যা আমি দীর্ঘদিন যাবত মনের গহীনে লুক্কায়িত রেখেছিলাম। পরে আমি চিঠিটি হারিয়ে ফেলি।

অ্যাড. মিজানুর রহমান সাহবের সেই লেখাটি পড়ে আমি ওনার মহৎ হৃদয়টা বুঝতে পেরেছিলাম। তাঁর মধ্যে ধান্ধাবাজি ও মেকি কিছু ছিলো না। যদি থাকতো তিনি অনেক টাকা উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনই পেশাগত ক্ষেত্রে নয়-ছয় করতেন না। তাঁদের অনেক সম্পদ থাকা সত্তে¡ও ওনারা নিরামিষ, নির্মোহ জীবন যাপন করতেন। কোনো প্রকার অতি আড়ম্বর দেখাতেন না, রাগ দেখাতেন না। অহঙ্কার তো আমি কখনই তাঁর মধ্যে দেখিনি। দেখেছি সহাস্যে অনুজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মানুষের উপকার করে, সেই সবচেয়ে ভালো মানুষ। ’ (সুনানে দারাকুতনি)। আমি অ্যাড. মিজানুর রহমান সাহবের মধ্যে অন্য মানুষের প্রতি উপকার করার প্রয়াস দেখেছি। আল্লাহতায়ালা তাঁকে ভালো মানুষ হিসেবে কবুল করে জান্নাত নসীব করুন। আজ এটাই ‘তাঁহার’ প্রতি আমার হৃদয়ের শেষ সম্পাদকীয়।