কুত্তা পাললে স্মার্ট আর গরু পাললে ক্ষ্যাত?

ক্ষুদীরাম দাস :

আমাদের সমাজে এমন অনেক ধারণা প্রচলিত আছে, যার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। “কুত্তা (কুকুর) পাললে স্মার্ট আর গরু পাললে ক্ষ্যাত”Ñএ ধারণাটি তেমনই একটি উদাহরণ। এ ধরনের চিন্তাভাবনা সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়, যারা পশ্চিমা জীবনধারাকে অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করে। গরু পালন একটি প্রাচীন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পেশা, যা’ আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদÐ। বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে গরু শুধু একটি প্রাণী নয়, এটি কৃষকের সম্পদ, পরিবারের আয়ের উৎস এবং আমাদের খাদ্যাভ্যাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরুর দুধ, মাংস এবং গোবর (জ্বালানি ও সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়) আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য। একজন কৃষক যখন গরু পালন করেন, তিনি কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সেখানে ‘ক্ষ্যাত’ (অশিক্ষিত বা নিম্নশ্রেণির) হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না; বরং এটি একটি সম্মানজনক ও উৎপাদনশীল কাজ।

অন্যদিকে, কুকুর পালনকে ‘স্মার্টনেসের’ প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়। আধুনিক শহুরে জীবনে কুকুর পালন একটি শখ, যা’ মানসিক শান্তি এবং সঙ্গ দিতে পারে। কুকুর সত্যিই মানুষের খুব ভালো বন্ধু হতে পারে। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, এটি অন্য সব প্রাণীর চেয়ে উত্তম, বা যারা কুকুর পালে তারা গরুর পালকের চেয়ে কোনো অংশে বেশি স্মার্ট। স্মার্টনেস মানুষের জ্ঞান, বিচক্ষণতা, এবং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ববোধ দিয়ে পরিমাপ করা হয়, কোনো প্রাণী পালার শখ দিয়ে নয়।

যারা এমনটা মনে করেন, তারা হয়তো ভুলে যান যে আমাদের প্রতিদিনের জীবন গরুর দুধ, ঘি, দই এবং মাংসের ওপর কতোটা নির্ভরশীল। গরুর দুধ ছাড়া চা বা মিষ্টির কথা ভাবাই যায় না। এ ধরনের মন্তব্যকারীরা আসলে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা ঐতিহ্যবাহী জীবনধারাকে অবজ্ঞা করে এমন কিছুকে গ্রহণ করতে চায়, যা তাদের কাছে তথাকথিত ‘আধুনিক’ মনে হয়।

“যারা এমনটা মনে করে তারা গরুর দুধের চা বাদ দিয়ে কুত্তার দুধের চা খাক”Ñএ বাক্যটি একটি তীব্র ব্যঙ্গ। এর মাধ্যমে লেখক আমাদের সমাজের এ দ্বৈত নৈতিকতার ওপর আঘাত হেনেছেন। এটি একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আমরা কীভাবে নিজেদের মূল্যবোধকে ভুলে যাচ্ছি। আমাদের বোঝা উচিত, কোনো প্রাণী পাললেই কেউ ছোট বা বড় হয়ে যায় না। প্রতিটি পেশা এবং শখেরই নিজস্ব গুরুত্ব আছে। একজন কৃষকের কঠোর পরিশ্রম যেমন শ্রদ্ধার যোগ্য, তেমনই একজন শৌখিন ব্যক্তির শখও তার ব্যক্তিগত জীবনের অংশ।

আমাদের উচিত সব পেশা এবং জীবনধারাকে সম্মান করা। যখন আমরা গরুকে সম্মান করি, তখন আমরা আসলে সেই কৃষকদের সম্মান করি, যারা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। প্রকৃত স্মার্টনেস হলো সবধরনের জীবিকা এবং প্রাণীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, আর নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভুলে না যাওয়া।

শেয়ার করুন
বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

You might like