

তথ্য-প্রযুক্তি কণ্ঠ ডেস্ক :
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি কিছু জটিলতাও তৈরি হয়েছে। মুঠোফোন, বিশেষ করে স্মার্টফোন, আজ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং বিনোদন, তথ্য, কাজ, সামাজিক যোগাযোগ—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রযুক্তি কি আমাদের পরিবারিক বন্ধনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে? এই ফিচারে আমরা বিশ্লেষণ করব কীভাবে মুঠোফোন আমাদের পারিবারিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো, এবং কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।

প্রযুক্তির আশীর্বাদ না অভিশাপ
মুঠোফোনের আবির্ভাবের ফলে মানুষ এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে মুহূর্তেই যোগাযোগ করতে পারে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ভিডিও কল, ছবি শেয়ার, বার্তা আদান-প্রদান—সবই সম্ভব হয়েছে এই যন্ত্রের মাধ্যমে। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, ঘরের ভেতরে বসে থাকা মানুষগুলো একে অপরের সঙ্গে কথা না বলে নিজেদের ফোনে ডুবে থাকে। এক ছাদের নিচে থেকেও যেন একেকজন একেক জগতে বাস করছে।
সম্পর্কের জগতে প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ
একসময় সন্ধ্যা মানেই পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করা, খাওয়া, টিভি দেখা বা বই পড়া। এখন সেই সময়টুকু চলে গেছে স্ক্রিনের দখলে। বাবা-মা ব্যস্ত ফেসবুকে, সন্তান ব্যস্ত ইউটিউবে বা গেমে। একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানোর বদলে সবাই নিজের ভার্চুয়াল জগতে মগ্ন। এতে করে পারস্পরিক বোঝাপড়া, আবেগের আদান-প্রদান, এবং সম্পর্কের গভীরতা কমে যাচ্ছে।
দাম্পত্য জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব
বর্তমানে অনেক দাম্পত্য সমস্যার পেছনে মুঠোফোন একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকলেও একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানোর বদলে ফোনে সময় কাটায়। কেউ হয়তো অফিসের কাজ করছে, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত। এতে করে আবেগের দূরত্ব তৈরি হয়, ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে, এবং সম্পর্কের উষ্ণতা কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহ, অবিশ্বাস, এবং মানসিক চাপের জন্ম দেয় ফোনে অতিরিক্ত সময় কাটানো।
সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন
শিশুদের ক্ষেত্রে মুঠোফোনের প্রভাব আরও গভীর। বাবা-মা ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের হাতে ফোন তুলে দেওয়া হয় যেন তারা চুপচাপ থাকে। এতে করে শিশুরা বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সামাজিক দক্ষতা কমে যায়, এবং মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে আবেগীয় সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
একাকিত্বের জন্ম
মুঠোফোনে অতিরিক্ত সময় কাটানো মানুষকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়। ভার্চুয়াল জগতে হাজারো বন্ধু থাকলেও বাস্তব জীবনে সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিবারে একে অপরের সঙ্গে সময় না কাটানো, অনুভূতি ভাগ না করা—সব মিলিয়ে মানুষ একা হয়ে যায়। এই একাকিত্ব থেকে জন্ম নেয় বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, এবং মানসিক অসুস্থতা।
প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক
তবে মুঠোফোনের সব দিকই নেতিবাচক নয়। দূরবর্তী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, জরুরি অবস্থায় সাহায্য পাওয়া, সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসব ক্ষেত্রে ফোন অত্যন্ত কার্যকর। অনেক পরিবার ভিডিও কলের মাধ্যমে দূরত্ব কমিয়ে আনে, একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। প্রযুক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে পারে।
ভারসাম্য রক্ষার উপায়
পরিবারিক বন্ধন রক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিচে দেওয়া হলো
– পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন, যেখানে কেউ ফোন ব্যবহার করবে না
– একসঙ্গে খাওয়া, গল্প করা, হাঁটতে যাওয়া—এসব অভ্যাস গড়ে তুলুন
– সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটান, তাদের অনুভূতি শুনুন, খেলাধুলায় অংশ নিন
– দাম্পত্য জীবনে একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন, ফোনের ব্যবহার নিয়ে সচেতন থাকুন
– প্রযুক্তিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করুন, বিকল্প নয়
মুঠোফোন আমাদের জীবনে বিপ্লব এনেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বিপ্লব যেন সম্পর্কের বিপর্যয় না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পরিবারিক বন্ধন গড়ে ওঠে সময়, মনোযোগ, এবং আবেগের মাধ্যমে। প্রযুক্তি যদি সেই জায়গাগুলো দখল করে নেয়, তাহলে সম্পর্কের গভীরতা হারিয়ে যাবে। তাই প্রয়োজন সচেতনতা, ভারসাম্য, এবং আন্তরিকতা। প্রযুক্তি হোক আমাদের সম্পর্কের সেতুবন্ধন, বিভাজন নয়।
মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
