

তথ্যপ্রযুক্তি কণ্ঠ ডেস্ক :
বিশ্ব প্রযুক্তির গতিপথে এখন এক উত্তাল পরিবর্তনের সময়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সহায়ক হিসেবে কাজ করে আসছে—চ্যাটবট, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, ছবি বিশ্লেষণ, রোগ নির্ণয়, এমনকি লেখালেখিতেও। কিন্তু এই সহায়ক প্রযুক্তি এখন আর শুধু নির্দিষ্ট কাজের জন্য নয়, বরং এক নতুন রূপে আবির্ভূত হতে চলেছে—এজিআই (Artificial General Intelligence)। এমন এক প্রযুক্তি, যা মানুষের মতো চিন্তা করতে পারবে, শেখার ক্ষমতা থাকবে, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবে। প্রশ্ন উঠছে, এই প্রযুক্তি কি মানব মস্তিষ্ককেও হার মানাবে?

Narrow AI বনাম General AI: পার্থক্যের সূক্ষ্ম রেখা
বর্তমানে ব্যবহৃত এআই মূলত Narrow AI—যা একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রশিক্ষিত। যেমন, ভয়েস কমান্ড বুঝে উত্তর দেওয়া, ছবি থেকে বস্তু শনাক্ত করা, বা নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। এই এআই গুলো দক্ষ হলেও সীমাবদ্ধ। তারা নিজেরা নতুন কিছু শেখে না, বা এক কাজ থেকে আরেক কাজের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।
অন্যদিকে, AGI বা Artificial General Intelligence হলো এমন এক প্রযুক্তি, যা মানুষের মতো যেকোনো কাজ শেখার, বিশ্লেষণ করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এটি শুধু তথ্য বিশ্লেষণ নয়, বরং অভিজ্ঞতা থেকে শেখা, আবেগ বোঝা, এবং নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। এক কথায়, এটি একটি মাল্টি-ট্যালেন্টেড, আত্ম-উন্নয়নশীল মেশিন।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি
বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো AGI নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। OpenAI-এর CEO স্যাম অল্টম্যান বলেছেন, “আমরা জানি কীভাবে AGI তৈরি করতে হয় এবং আমরা সে পথেই এগোচ্ছি।” Nvidia-এর CEO জেন্সেন হুয়াং বলেন, “আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই AI এমন সব জটিল কাজ করতে পারবে, যেগুলো এতদিন কেবল মানুষের জন্যই সম্ভব ছিল”।
Google DeepMind-এর CEO ডেমিস হাসাবিস এবং Google-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনও AGI নিয়ে আশাবাদী। তাঁরা মনে করেন, ২০২৭ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে AGI বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
AGI-এর সম্ভাবনা: এক নতুন দিগন্ত
AGI-এর আগমন মানে শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং মানব সভ্যতার এক নতুন অধ্যায়। এটি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গবেষণা, মহাকাশ, আইন, এমনকি শিল্প-সাহিত্যেও বিপ্লব ঘটাতে পারে। AGI যদি মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে, তবে তা হতে পারে একজন চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী বা শিল্পী—সব একসাথে।
AGI-এর মাধ্যমে এমন এক ভবিষ্যৎ কল্পনা করা যায়, যেখানে একটি মেশিন নিজে নিজে নতুন ভাষা শিখতে পারবে, নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারবে, এবং মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এটি শুধু কাজের দক্ষতা নয়, বরং চিন্তা, আবেগ এবং নৈতিকতার প্রশ্নেও ভূমিকা রাখতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও শঙ্কা: নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন
AGI যতই সম্ভাবনাময় হোক, এর সঙ্গে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তিবিদ ইলন মাস্ক বহুবার সতর্ক করেছেন, “AGI একবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে”। কারণ, যদি একটি মেশিন মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে, তবে সে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এবং তা সবসময় মানবিক নাও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, AGI যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে তা মানুষের কাজ, স্বাধীনতা, এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে। এটি হতে পারে একটি অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, যা মানুষের জায়গা দখল করে নিতে পারে।
নৈতিক কাঠামো ও নিরাপত্তা
AGI নিয়ে গবেষণা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি একটি নৈতিক ও নিরাপদ কাঠামো গড়ে তোলা। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, এখনই প্রয়োজন AGI নিয়ে সচেতনতা, গবেষণা এবং একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা। যাতে এই শক্তিশালী প্রযুক্তি মানুষের সহায়তায় আসে, বিরোধিতায় নয়।
AGI-এর বিকাশে প্রয়োজন ট্রান্সপারেন্সি, জবাবদিহিতা এবং মানবিক মূল্যবোধ। গবেষকরা বলছেন, AGI-এর নকশা, প্রশিক্ষণ এবং ব্যবহারে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। এটি যেন মানুষের বিকল্প নয়, বরং সহায়ক হয়।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
AGI এখনো পুরোপুরি বাস্তব নয়, তবে এর ছায়া আমাদের জীবনে পড়তে শুরু করেছে। ChatGPT, Gemini, Claude, এবং অন্যান্য AI মডেলগুলো ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। তারা এখন শুধু প্রশ্নের উত্তর নয়, বরং বিশ্লেষণ, পরামর্শ এবং সৃজনশীল কাজেও পারদর্শী হয়ে উঠছে।
AGI-এর দিকে যাত্রা মানে একটি দীর্ঘ পথ, যেখানে প্রযুক্তি, নৈতিকতা, এবং মানবিকতা একসাথে চলতে হবে। এটি হতে পারে মানবজাতির সবচেয়ে বড় আবিষ্কার, আবার সবচেয়ে বড় হুমকিও।
এআই থেকে এজিআই—এই যাত্রা শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং মানব সভ্যতার। Narrow AI আমাদের কাজ সহজ করেছে, কিন্তু AGI আমাদের চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে চলেছে। এটি যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে হতে পারে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সহায়ক। আর যদি নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে হতে পারে এক ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী।
তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার, গবেষণায় বিনিয়োগ করার, এবং একটি নিরাপদ, নৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার। AGI যেন মানুষের সহায়তায় আসে, মানুষের বিরুদ্ধে নয়—এই হোক আমাদের লক্ষ্য।
বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
