গল্প : নীরব চায়ের উষ্ণতা

ক্ষুদীরাম দাস

ঢাকার শীতের সকাল। নভেম্বরের শেষ। কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা, মানুষের মুখে মাফলার, আর চায়ের দোকানে ভিড়। আমি, রিফাত, সকাল সাতটায় বের হয়েছিলাম। অফিসের বাস ধরতে হবে। কিন্তু পকেটে টাকা কম, মনের ভিতরে আরো কম। গতকাল রাতে সে ফোন করেছিলো। শুধু বলেছিলো, “আমি আসছি।” তারপর লাইন কেটে গেছে।
আমি জানি না কেন আসছে। জানি না কী বলবে। শুধু জানি, সে আসছে। আর সেই “সে” হলোÑঅর্ণি। আমার নীরব প্রেম।

আমাদের গল্প শুরু হয়েছিলো দশ বছর আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। আমি বই খুঁজছিলাম, সে বসে ছিল জানালার পাশে। তার হাতে একটা পুরোনো বইÑ‘নির্বাচিত প্রেমের কবিতা’। সূর্যের আলো তার চুলে পড়ে সোনালি করে তুলেছিলো। আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বলিনি। শুধু দেখেছিলাম। তার চোখে একটা শান্তি ছিলো, যেন সমুদ্রের গভীর। আমি ডুব দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম।

তারপর থেকে শুরু। লাইব্রেরিতে দেখা। ক্যান্টিনে। বাসে। কখনো কথা হয়নি। শুধু চোখে চোখে। একদিন সে একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলÑ“চা খাবে?” আমি মাথা নেড়েছিলাম। তারপর আমরা বসেছিলাম ক্যান্টিনের কোণে। এক কাপ চা। দুটো কাপ। কোনো কথা নেই। শুধু চুমুক। চায়ের ভাপ। আর চোখের ভাষা।

সেই প্রথম চা খাওয়ার দিন।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছিলো। ক্যান্টিনের ছাদে টিপটিপ শব্দ। আমাদের টেবিলের পাশে জানালা। বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। আমি চায়ের কাপ ধরে আছি। সে ধরে আছে। হঠাৎ তার আঙুল আমার আঙুলে ঠেকলো। এক মুহূর্ত। কিন্তু যেন বিদ্যুৎ। আমি চোখ তুললাম। সে তুললো। বৃষ্টির শব্দের মাঝে শুধু আমাদের হৃদস্পন্দন। সে হাসলো। নীরবে। আমি হাসলাম। নীরবে। চা ঠান্ডা হয়ে গেলো। কিন্তু হাতের উষ্ণতা বেড়ে গেলো।

গ্র্যাজুয়েশনের পর সে চলে গিয়েছিলো সিলেটে। বাবার বদলি। আমি থেকে গিয়েছিলাম ঢাকায়। চাকরি। বাসা। একা। কিন্তু প্রতি শুক্রবার সকালে আমি যেতাম একই চায়ের দোকানে। যেখানে প্রথম বসেছিলাম। এক কাপ চা নিয়ে বসতাম। সে আসতো না। কিন্তু আমি বসতাম। যেন সে আসবে। যেন সেই নীরবতা এখনো আছে।

গতকাল ফোন। “আমি আসছি।” শুধু এটুকু।

আজ সকালে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই চায়ের দোকানের সামনে। একই জায়গা। একই টেবিল। একই কাপ। চা গরম। আমার হাত ঠান্ডা।

সে এলো।
সাদা শাড়ি। চুলে খোঁপা। চোখে একই শান্তি। কিন্তু আজ তার ঠোঁটে একটা হালকা হাসি। সে বসলো। আমি চুপ। সে চুপ। চায়ের কাপ এলো। দুটো। গরম। ভাপ উঠছে।

চা এলো। আমি কাপ তুললাম। সে তুললো। হঠাৎ বাতাসে একটা ফুলের গন্ধ। পাশের দোকান থেকে কেউ গোলাপ বিক্রি করছে। সে চোখ তুলে দেখলো। আমি দেখলাম। তার চোখে একটা আলো। আমি উঠলাম। একটা গোলাপ কিনলাম। লাল। ফিরে এসে তার সামনে রাখলাম। কোনো কথা নেই। সে গোলাপ তুললো। তার আঙুলে কাঁটা ফুটলো। এক ফোঁটা রক্ত। আমি তার হাত ধরলাম। নীরবে। আঙুলে রক্ত মুছিয়ে দিলাম। সে চোখ বন্ধ করলো। আমি চোখ বন্ধ করলাম। চায়ের ভাপ আমাদের মুখে লাগছে। গোলাপের গন্ধ। রক্তের ছোঁয়া। হাতের উষ্ণতা।
চা ঠান্ডা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মাঝের উষ্ণতা বাড়ছে।

সে হাত বাড়ালো। আমার হাতের কাছে। আমি হাত বাড়ালাম। দুটো হাত মিললো। চায়ের কাপের পাশে। গরম। তার আঙুল আমার আঙুলের মাঝে জড়িয়ে গেলো। যেন দশ বছরের অপেক্ষা এক মুহূর্তে মিলে গেলো। আমি তার হাতের তালুতে আঙুল দিয়ে লিখলামÑ“ভালোবাসি”। সে চোখ তুললো। তার চোখে জল। কিন্তু হাসি। সে আমার তালুতে লিখলোÑ“জানি”। চায়ের কাপ ঠান্ডা। কিন্তু হাত গরম।
সে বললো, নীরবে।
আমি শুনলাম, নীরবে।
সে বললো, “আমি বিয়ে করছি।”
আমি শুনলাম। হাসলাম। নীরবে।
সে বললো, “তুমি কখনো বলোনি।”
আমি বললাম, “তুমি কখনো শোনোনি।”
চা শেষ। কাপ ফাঁকা। কিন্তু হাত এখনো ধরা।

সে উঠলো। আমি উঠলাম। বাইরে কুয়াশা কেটে গেছে। সূর্য উঠছে। তার শাড়ির আঁচলে সূর্যের আলো পড়ে লাল হয়ে গেছে। সে আমার দিকে তাকালো। আমি তার দিকে। হঠাৎ সে এগিয়ে এলো। আমার কপালে একটা চুমু দিলো। নীরবে। আমার চোখ বন্ধ। তার ঠোঁটের উষ্ণতা কপালে লেগে রইলো। আমি তার কপালে চুমু দিলাম। নীরবে। চায়ের দোকানের লোকজন দেখছে। কিন্তু আমরা দেখছি না। শুধু একে অপরকে।
সে চলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে।
তারপর সে ফিরলো।
একটা কাগজ দিলো।
তাতে লেখাÑ
“তোমাকে নীরবে ভালোবেসেছিলাম।”
আমি হাসলাম।
আমার পকেটে একটা কাগজ ছিলো।
আমি দিলাম।
তাতে লেখাÑ
“আমিও। সবসময়।”
সে চলে গেলো।
আমি বসলাম।
চা ঠাÐা।
কিন্তু মন গরম।

দশ বছর পর।
আমি এখনো যাই সেই চায়ের দোকানে।
প্রতি শুক্রবার।
এক কাপ চা।
আমি বসি।
সে আসে না।
কিন্তু তার কাগজটা আমার পকেটে।
আমার কাগজটা তার পকেটে।
আমাদের নীরব প্রেম এখনো গরম।
যেমন ছিলোÑ
চায়ের কাপে, হাতের মাঝে, চোখের ভাষায়।

শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫

ডায়াবেট্সি হলে কি করবেন?

শেয়ার করুন
প্রিয় সময় ও চাঁদপুর রিপোর্ট মিডিয়া লিমিটেড

You might like

About the Author: priyoshomoy