অন্ধকারের আলোকবর্তিকা

ক্ষুদীরাম দাস :

১৯৬৫ সাল। ঢাকা শহর তখনো পুরোদমে জেগে ওঠেনি। বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের ল্যাবরেটরিতে এক যুবক দাঁড়িয়ে। নাম ড. জন আব্রাহাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে গেইগার কাউন্টার। রেডিয়োঅ্যাকটিভ কণা গুনতে গুনতে সে ভাবে, “এই কণাগুলো যেমন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, তেমনি আমার জীবনও একটা কেন্দ্র খুঁজে পাবে।”

সেই কেন্দ্র এলো ১৯৭০ সালে। মেরি গ্রেসÑঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগের ছাত্রী। তাদের বিয়ে হয়েছিল এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে, গুলশানের ছোট্ট চার্চে। পাস্টর ড্যানিয়েল বাইবেল খুলে পড়লেন, “পুরুষ তার পিতা-মাতাকে ছেড়ে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবে, আর তারা এক দেহ হইবে।” মেরি গ্রেস ফিসফিস করে বললেন, “তুমি পদার্থের নিয়ম পড়াও, আমি জীবনের। দুজনে মিলে একটা পরিবার তৈরি করব।”

প্রথম সন্তান রেবেকা গ্রেস। জন্মের পর জন তার কপালে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিয়ে বললেন, “তুমি আমার প্রথম ইলেকট্রন। চারদিকে ঘুরে আলো ছড়াবে।” রেবেকা হাসত, ছোট্ট হাতে বাবার আঙুল চেপে ধরত।

দ্বিতীয় সন্তান পিটার জোসেফ। জন্মের দিন জন ল্যাব থেকে ছুটে এসে বললেন, “এ আমার প্রোটন। শক্তিশালী, স্থির।” পিটার ছোটবেলায় বাবার কাঁধে চড়ে আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলত, “বাবা, আমি পাইলট হব। আকাশে উড়ব।”

তৃতীয় সন্তান ডেভিড স্যামুয়েল। সে এলো যখন জন জাহাঙ্গীরনগরে যোগ দিয়েছেন। “আমার নিউট্রন,” জন বলতেন, “নিরপেক্ষ, কিন্তু ছাড়া নিউক্লিয়াস অসম্পূর্ণ।”
পরিবারটা ছিল একটা পরমাণু। জন ছিলেন নিউক্লিয়াস। মেরি গ্রেস ইলেকট্রনের মতো ঘুরতেন। বাচ্চারা কক্ষপথে। প্রতি রবিবার সকালে তারা গুলশান ব্যাপ্টিস্ট চার্চে যেত। পাস্টর ড্যানিয়েল হাত তুলে আশীর্বাদ করতেন, “গধু ঃযব খড়ৎফ নরহফ ুড়ঁ ঃরমযঃবৎ ঃযধহ ধহু ধঃড়সরপ নড়হফ.”

১৯৮৮ সাল। জন অ্যাটমিক এনার্জি ছেড়ে পুরোপুরি শিক্ষকতায়। ছাত্ররা বলত, “স্যারের ক্লাসে গেলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সও প্রেমের গল্প।” কিন্তু ১৯৯৫ সালে মেরি গ্রেস ক্যান্সারে চলে গেলেন। চার্চের গায়কদল তাঁর কফিনের চারপাশে গাইল, “ওঃ রং বিষষ রিঃয সু ংড়ঁষ.” জনের নিউক্লিয়াসে প্রথম আঘাত। তিনি রাতে ল্যাবে বসে চিঠি লিখতেন: “প্রিয় মেরি, তুমি চলে গেলে আমার ইলেকট্রন চলে গেছে। বাকি কণাগুলো এখনো ঘুরছে, কিন্তু কেন্দ্রটা দুর্বল।”

রেবেকা তখন আমেরিকায় পড়তে গেছে। পিটার এয়ার ফোর্সে। ডেভিড অস্ট্রেলিয়ায়। জন একা। পেনশনের টাকা থেকে ডেভিডের পড়াশোনায় ২৬ লাখ পাঠালেন। পিটারের বিয়ের জন্য ফ্ল্যাট কিনে দিলেন। রেবেকার গ্রিন কার্ডের খরচ বহন করলেন।

২০০৬ সাল। অবসর। ছাত্ররা কাঁদছিল। জন হাসছিলেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখলেন, তিনি একা। পিটারের বিয়ে হয়েছে। বউ সারা। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল। জন বড় ছেলের বাসায় উঠে গেলেন। কিন্তু এক রাতে শুনলেন সারা চিৎকার করছে: “তোমার বাবা এখানে থাকলে আমি থাকব না!”

পরদিন সকালে জন ব্যাগ গুছলেন। পিটার বলল, “বাবা, থেকে যান।” জন চশমা তুলে বললেন, “বেটা, আমি তোমার জীবনের বোঝা হতে চাই না।”

তিনি চলে গেলেন কল্যাণপুরের ফ্ল্যাটে। রেবেকা মাসে একবার ফোন করত: “বাবা, আমি ব্যস্ত।” ডেভিড ইমেইল করত: “বাবা, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

২০১৪ সাল। ডেভিড দেশে এলো। মিরপুর-১-এ একটা কফি শপে দেখা। “বাবা, আমি বিয়ে করছি।” জন চোখ ছলছল করে বললেন, “বউকে দেখব?” ডেভিড মাথা নামাল, “না বাবা, সময় নেই।”

সেইদিন জন বুঝলেন, তিনি আর নিউক্লিয়াস নন। তিনি একটা পরিত্যক্ত আইসোটোপ।

২০১৫ সাল। জন নিজেই আবেদন করলেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে। কর্তৃপক্ষ অবাক। “স্যার, আপনার তো ফ্ল্যাট আছে।” জন হাসলেন, “আমার একাকিত্ব আছে।”
৫০২ নম্বর ঘর। দেওয়ালে মেরি গ্রেসের ছবি, পাশে একটা ছোট্ট ক্রস। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি বসতেন জানালার পাশে। দূরে ঢাকা শহরের আলো জ্বলত। তিনি ভাবতেন, “আমি যে আলো জ্বালিয়েছিলাম, সেটা নিভে গেল কীভাবে?”

প্রতিবেশী এক বুড়ো বলত, “স্যার, আপনার ছেলে-মেয়ে কোথায়?” জন হাসতেন, “তারা তাদের কক্ষপথে। আমি আর কেন্দ্র নই।”

২০২০ সাল। এক রবিবার সকালে ৫০২ নম্বর ঘরের দরজায় টোকা। এক লম্বা লোক, সাদা শার্ট, হাতে বাইবেল। “আমি পাস্টর জেমস ডেভিড। আগারগাঁও ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে। শুনেছি আপনি একা।”

জন চশমা তুলে তাকালেন। “আমি তো আর চার্চে যাই না।”

পাস্টর জেমস হাসলেন, “চার্চ আপনার কাছে আসতে পারে।”

তারপর থেকে প্রতি বুধবার বিকেলে পাস্টর আসতেন। দুজনে বসতেন বারান্দায়। পাস্টর গাইতেন, “অসধুরহম মৎধপব, যড়ি ংবিবঃ ঃযব ংড়ঁহফ…” জন চোখ বন্ধ করে শুনতেন। একদিন বললেন, “পাস্টর, আমি জীবনে অনেক কিছু দিয়েছি। কিন্তু কেউ ফেরত দেয়নি।”

পাস্টর বাইবেল খুললেন, লূক ১৫: “যে পুত্র হারিয়ে গিয়েছিল, সে ফিরে এলে পিতা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।” জনের চোখে জল। “আমার ছেলে-মেয়েরা কি ফিরবে?”

পাস্টর বললেন, “আপনি প্রথমে ফিরে আসুন। ঈশ্বরের কাছে। তারপর দেখবেন, কক্ষপথ নিজেই সংশোধন হয়।”

২০২৩ সাল। একদিন দরজায় টোকা। পিটার। চোখ লাল। “বাবা, আমরা ভুল করেছি। বাড়ি চলুন।” পেছনে ডেভিড। ভিডিও কলে রেবেকা।

জন চশমা তুলে তাকালেন। “বেটা, আমি এখনো নিউক্লিয়াস। কিন্তু তোমরা যদি আমার চারপাশে ঘুরতে চাও, তাহলে ফিউশন হবে।”

তিনি উঠলেন। ব্যাগে কয়েকটা বই, মেরি গ্রেসের ছবি, আর পাস্টর জেমসের দেওয়া ছোট্ট ক্রস। দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, “চলো, বাড়ি যাই। কিন্তু মনে রেখোÑউচ্চ শিক্ষা যদি মনুষ্যত্ব না শেখায়, তাহলে সেটা শুধুই রেডিয়োঅ্যাকটিভ ডিকে।”

বাড়ি ফিরে জন দেখলেন, ফ্ল্যাটটা এখনো আছে। পিটার ফিরিয়ে দিয়েছে। ডেভিড অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসেছে। রেবেকা প্রতি রবিবার ভিডিও কলে যোগ দেয়।
প্রতি সন্ধ্যায় জন বারান্দায় বসেন। চারপাশে ছেলে-মেয়েরা। পাস্টর জেমসও আসেন। সবাই মিলে গাই:

“ইরহফ ঁং ঃড়মবঃযবৎ, খড়ৎফ, রিঃয পড়ৎফং ঃযধঃ পধহহড়ঃ নব নৎড়শবহ…”

রাতে জন মেরি গ্রেসের ছবির সামনে দাঁড়ান। “দেখো, তোমার ইলেকট্রন ফিরে এসেছে।”

জন এখন ৮৫ পেরিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট লেকচার দেন। ছাত্রদের বলেন, “পদার্থবিজ্ঞান শেখায়, শক্তি ধ্বংস হয় না, রূপান্তরিত হয়। ভালোবাসাও তাই। তোমরা যদি বাবা-মাকে ছেড়ে যাও, সে ভালোবাসা রেডিয়োঅ্যাকটিভ ডিকে হয়। কিন্তু ফিরে এলেÑফিউশন। নতুন তারা জন্মায়।”
প্রবীণ নিবাসের ৫০২ নম্বর ঘর এখনো খালি। দেওয়ালে একটা ফলক:
“এখানে একজন নিউক্লিয়াস একা ছিলেন।

সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫

ডায়াবেট্সি হলে কি করবেন?

শেয়ার করুন
প্রিয় সময় ও চাঁদপুর রিপোর্ট মিডিয়া লিমিটেড

You might like