

ক্ষুদীরাম দাস :
আগেকার দিনগুলোতে, যখন শহরের রাস্তায় এখনকার মতো গাড়ির হর্নের শব্দ নয়, বরং ঘোড়ার গাড়ির খটখট শোনা যেত, তখন রাহুলের মতো ছেলেরা ছিল সমাজের আদর্শ। রাহুলের বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক, যার বাড়িতে বইয়ের গন্ধ ছিল টাকার চেয়ে বেশি। রাহুল নিজে পড়াশোনা করে একটা ছোট চাকরি পেয়েছিল সরকারি অফিসে। তার চরিত্র ছিল কাচের মতো স্বচ্ছ। কখনো কোনো মেয়ের সাথে অযথা কথা বলত না, বন্ধুদের সাথে রাত জাগত না, এমনকি সিগারেটের ধোঁয়াও তার নাকে লাগেনি। গ্রামের লোকজন বলত, “রাহুলের মতো পাত্র পেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ সোনায় মোড়া।” তার মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন, কোনো ভালো পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে রাহুল একটা সুখী সংসার গড়বে।

রাহুলের প্রতিবেশী ছিল অর্জুন। অর্জুনের বাবা ছিলেন জমিদার, কিন্তু অর্জুন ছিল উচ্ছৃঙ্খল। সে রাতের পর রাত ক্লাবে কাটাত, মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করত, এমনকি কয়েকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল যা সমাজের চোখে পাপ। কিন্তু অর্জুনের পকেটে টাকা ছিল প্রচুর। তার বাবা বলতেন, “টাকা থাকলে সব ঢাকা যায়।” রাহুল অর্জুনকে দেখে মনে মনে লজ্জা পেত। সে ভাবত, “চরিত্র ছাড়া জীবন কী?” কিন্তু যুগ পাল্টাতে শুরু করল। শহরে কারখানা গড়ে উঠল, ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল, আর মানুষের মূল্যায়ন হতে লাগল পকেটের গভীরতা দিয়ে।
আজকের যুগে, রাহুলের নাতি রাহুল জুনিয়র, যাকে সবাই রাজ বলে ডাকে, একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। রাজ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে, মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা পায়। সে পড়াশোনায় ভালো, বই পড়তে ভালোবাসে, এবং তার চরিত্রও দাদুর মতো স্বচ্ছ। কখনো কোনো মেয়ের সাথে অযথা জড়ায়নি। তার স্বপ্ন একটা সাধারণ জীবনÑএকটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করে, ছোট সংসার গড়ে তোলা। কিন্তু আজকের বিয়ের বাজারে রাজের মতো ছেলের কদর নেই। তার বন্ধু অভি, যে একটা স্টার্টআপের সিইও, প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা কামায়। অভির জীবনটা ফ‚র্তির। বিয়ের আগে সে কয়েকটা গার্লফ্রেন্ড বদলেছে, পার্টিতে মদ খায়, এমনকি একবার হোটেলে পুলিশ রেইডে ধরা পড়েছিল। কিন্তু অভির পকেটে টাকা আছে, তাই তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবের লাইন লেগে যায়।
রাজের জীবনে এল প্রিয়া। প্রিয়া ছিল কলেজের মেয়ে, সুন্দরী, পড়াশোনায় ভালো। রাজের সাথে তার পরিচয় হল লাইব্রেরিতে। দুজনের মধ্যে কথা হল বই নিয়ে, তারপর কফি শপে। রাজ প্রিয়াকে ভালোবেসে ফেলল। সে তার স্বপ্নের কথা বললÑএকটা ছোট বাড়ি, দুটো বাচ্চা, আর সুখী জীবন। প্রিয়াও যেন ভালোবাসল। কিন্তু প্রিয়ার বাড়িতে বিয়ের কথা উঠলে তার মা বললেন, “পাত্রের ক্যারিয়ার দেখো। টাকা না থাকলে সুখ কীভাবে আসবে?” প্রিয়া রাজকে বলল, “তুমি ভালো, কিন্তু আমার বাবা-মা চান পাত্রের ব্যাংক ব্যালেন্স মোটা হোক।”
এদিকে, অভি প্রিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। সে তার গাড়ি নিয়ে প্রিয়ার কলেজে গেল, দামি গিফট দিল, আর বলল, “আমার সাথে থাকলে তুমি রানী হবে।” প্রিয়া দোটানায় পড়ল। তার মনে রাজের ভালোবাসা ছিল, কিন্তু চোখে অভির টাকার চমক। শেষমেশ, প্রিয়া অভিকে বেছে নিল। রাজের হৃদয় ভেঙে গেল। সে ভাবল, “আমার চরিত্রের দাম নেই?” কিন্তু যুগটা এমনই। রাজের মতো ছেলেরা এখন হাপিত্যেশ করে বেড়ায়, খালি পকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখে।
এই যুগের আরেক ছবি হল সুগার ড্যাডিদের। শহরের একটা পশ পার্টিতে মিলল রিয়া। রিয়া ছিল বিশ বছরের, কলেজ স্টুডেন্ট, সুন্দরী আর অ্যাম্বিশাস। তার স্বপ্ন ছিল দামি জীবনÑলাক্সারি কার, বিদেশ ভ্রমণ, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইকের বন্যা। কিন্তু তার বাবা ছিলেন একটা ছোট দোকানের মালিক, টাকা ছিল না। রিয়া জানত, তার সৌন্দর্য তার অস্ত্র। পার্টিতে সে মিলল মিস্টার গুপ্তার সাথে। গুপ্তা ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব, একটা বড় কোম্পানির মালিক, বিবাহিত কিন্তু স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। তার পকেটে টাকা ছিল অফুরন্ত। গুপ্তা রিয়াকে দেখে বললেন, “তুমি আমার সাথে থাকো, আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করব।”
রিয়া হেসে বলল, “প্রেম তো বয়স মানে না।” কিন্তু তার মনে ছিল টাকার লোভ। সে গুপ্তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। গুপ্তা তাকে দামি ফোন কিনে দিলেন, বিদেশ ঘুরিয়ে আনলেন, এমনকি একটা ফ্ল্যাটও লিখে দিলেন। রিয়ার বন্ধুরা বলত, “তুই লাকি!” কিন্তু রিয়ার মনে একটা খাঁজ ছিল। গুপ্তার সাথে থাকলে শরীরের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু ভালোবাসা ছিল না। সে ভাবত, “এটা কি প্রেম?” কিন্তু টাকার চমক সব ঢেকে দিত।
এদিকে, রাজ রিয়াকে দেখে অবাক হয়। সে রিয়ার সাথে একবার কথা বলেছিল কলেজে। রিয়া তাকে বলেছিল, “তুমি ভালো ছেলে, কিন্তু জীবনে টাকা ছাড়া কিছু নেই।” রাজের মনে দুঃখ হল। সে ভাবল, আগেকার দিনে তার দাদু রাহুলের মতো ছেলেরা কত সম্মান পেত। তার দাদু বিয়ে করেছিলেন একটা গরীব পরিবারের মেয়েকে, কিন্তু তাদের জীবন ছিল সুখের। কোনো টাকার লোভ ছিল না, শুধু ভালোবাসা আর চরিত্র। কিন্তু এখন? রাজ দেখল, তার অফিসের কলিগ সোনালীও একটা সুগার ড্যাডির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। সোনালী বলত, “বিয়ে করব না, কিন্তু লাইফ এনজয় করব।”
একদিন রাজের জীবনে টুইস্ট এল। সে একটা ছোট ব্যবসা শুরু করল, তার চরিত্র আর পরিশ্রমের জোরে। ধীরে ধীরে সফল হল। কিন্তু ততদিনে প্রিয়া অভির সাথে বিয়ে করে ফেলেছে। প্রিয়ার জীবন দেখে রাজ অবাক। অভি তার চরিত্র না রক্ষা করে অন্য মেয়ের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে রাজকে বলল, “আমি ভুল করেছি। টাকা সুখ দেয় না।” কিন্তু রাজ বলল, “যুগ পাল্টেছে, কিন্তু চরিত্রের দাম এখনো আছে।”
রিয়ার জীবনও ভেঙে পড়ল। গুপ্তা তার স্ত্রীর সাথে পুনর্মিলন করলেন, আর রিয়াকে ছেড়ে দিলেন। রিয়া একা হয়ে গেল, তার সম্পত্তি ছিল কিন্তু হৃদয় খালি। সে ভাবল, “প্রেমের নামে টাকার লোভে আমি নিজেকে হারিয়েছি।” শহরের রাস্তায় রিয়া দেখল রাজকে, যে এখন সফল কিন্তু চরিত্রবান। রাজ একটা সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করেছে, যার সাথে তার ভালোবাসা আছে। রিয়া লজ্জায় মুখ লুকাল।
যুগ পাল্টেছে, কিন্তু কিছু সত্য অপরিবর্তিত। টাকা সুখ কিনতে পারে না, শুধু ছায়া দেয়। আগেকার দিনের ভদ্র ছেলেরা যেমন সুখী ছিল, এখনকার খালি পকেটের যুবকেরাও যদি চরিত্র রক্ষা করে, তাহলে একদিন সত্যিকারের প্রেম পাবে। কিন্তু সুগার ড্যাডিদের যুগে, লোভের ফাঁদে পড়ে অনেকে হারায়। রাজের মতো ছেলেরা হাপিত্যেশ করে না, তারা লড়াই করে। আর প্রিয়া-রিয়াদের মতো মেয়েরা শেখে, টাকা একমাত্র মাপকাঠি নয়। এই গল্প শেষ হয় না, কারণ যুগ পাল্টাতে থাকে। কিন্তু চরিত্রের আলো কখনো নিভে না।
সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫











