ফলবৃক্ষ : ক্ষুদীরাম দাস

ফলবৃক্ষ বলতে সেইসব গাছকে বোঝায়, যা’ থেকে ফল পাওয়া যায়। এ গাছগুলো মানুষের খাদ্য, পুষ্টি এবং জীবিকার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, পেয়ারা, নারকেল, পেঁপে, জাম, কুল, জামরুল, এবং লেবুÑএগুলো বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত কিছু ফলবৃক্ষ। ফলবৃক্ষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও সাহায্য করে। এরা বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে, যা’ বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখে। এদের শেকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং মাটিকে উর্বর করে তোলে। তাছাড়া, ফলবৃক্ষ বিভিন্ন ধরনের পাখি ও প্রাণীর জন্যে আশ্রয়স্থল এবং খাদ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। অর্থনৈতিকভাবেও ফলবৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। ফল বিক্রি করে বহু কৃষক ও ব্যবসায়ী জীবিকা নির্বাহ করে। ফল দিয়ে জ্যাম, জেলি, জুস এবং আচার তৈরির মতো ক্ষুদ্র শিল্পও গড়ে উঠেছে। তাই ফলবৃক্ষ শুধু আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে না; বরং পরিবেশ এবং অর্থনীতির উন্নয়নেও অপরিহার্য ভ‚মিকা রাখে।

আদিপুস্তক ১:১১ পদে রয়েছে, ‘পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভ‚মি তৃণ, বীজোৎপাদক ওষধি ও সবীজ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফলবৃক্ষ ভ‚মির উপরে উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল।’ আমেন। এ পদটি কেবল প্রকৃতির সৃষ্টিরই বর্ণনা করে না; বরং ফলবৃক্ষের গভীর আধ্যাত্মিক গুরুত্বকে তুলে ধরে। ফলবৃক্ষকে বাইবেলে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ধার্মিকতা, উর্বরতা এবং আত্মার ফলপ্রসূতার প্রতিনিধিত্ব করতে। এ পদের আলোকে ফলবৃক্ষের গুরুত্ব অন্বেষণে আমরা বুঝতে পারি যে, যা’ আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। প্রথমত, এ ফলবৃক্ষের সৃষ্টি ঈশ্বরের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং পরিকল্পনার প্রতিফলন। ঈশ্বরের বাক্যে ভ‚মি থেকে উদ্ভিদ জীবনের উদ্ভব হয়, যা’ ‘স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী’ ফল উৎপাদন করে। এখানে ফলবৃক্ষ কেবল খাদ্যের উৎসই নয়; বরং সৃষ্টির নিয়মাবলীকে মেনে চলার প্রতীক। এ পদটি ঈশ্বরের সৃষ্টিকে সংগঠিত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ দেখায়, যেখানে ফলবৃক্ষের বীজ নিজের মধ্যে রয়েছে, যা’ জীবনের ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঈশ্বরের সৃষ্টিতে কোনো কিছুই অপচয় হয় না; প্রত্যেক ফলবৃক্ষ তার নিজস্ব ফল দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে পুষ্ট করে। আধ্যাত্মিকভাবে, এটি মানুষের জীবনকে প্রতিফলিত করেÑআমরা যা’ বপন করি, তাই ফলন পাই (গ্যালাতীয় ৬:৭)। ফলবৃক্ষের গুরুত্ব বাইবেলের অন্যান্য অংশে আরো স্পষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, গীতসংহিতা ১:৩-এ ধার্মিক মানুষকে জলধারার কাছে লাগানো গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা’ ‘সময়মতো ফল দেয় এবং যার পাতা শুকায় না’। এখানে ফলবৃক্ষ ধার্মিকতা এবং আধ্যাত্মিক ফলপ্রসূতার প্রতীক। আদিপুস্তকের এ পদের আলোকে, ফলবৃক্ষ আমাদের শেখায় যে, আধ্যাত্মিক জীবনও একইভাবে উর্বর হওয়া উচিত। যেমন ঈশ্বর ভ‚মিকে আদেশ দিলেন ফল উৎপাদন করতে, তেমনি আমাদেরও আত্মার ফল উৎপাদন করতে হবেÑপ্রেম, আনন্দ, শান্তি, ধৈর্য, দয়া, মঙ্গল, বিশ্বাস, নম্রতা এবং আত্মসংযম (গ্যালাতীয় ৫:২২-২৩)। এ ফলগুলো কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমাজকে পুষ্ট করে, যেমন ফলবৃক্ষ ভ‚মিকে সমৃদ্ধ করে। এদন বাগানে ফলবৃক্ষের উল্লেখ আরো গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ যোগ করে। আদিপুস্তক ২:৯-এ বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর বাগানে সকল প্রকার ফলবৃক্ষ উৎপন্ন করলেন, যার মধ্যে জীবনের বৃক্ষ এবং ভালো-মন্দের জ্ঞানের বৃক্ষ ছিলো। এখানে ফলবৃক্ষ মানুষের পছন্দ এবং পরিণামের প্রতীক। আদিপুস্তক ১:১১-এর সৃষ্টির পরিকল্পনা অনুসারে, ফলবৃক্ষ মানুষের জন্যে খাদ্য এবং আশীর্বাদের উৎস ছিলো; কিন্তু পাপের মাধ্যমে এর অপব্যবহার হয়। তবু, ঈশ্বরের করুণায় ফলবৃক্ষের প্রতীকী গুরুত্ব অটুট রয়েছে। নতুন নিয়মে যীশুখ্রীষ্ট নিজেকে দ্রাক্ষালতা বলে অভিহিত করেন (যোহন ১৫:১-৫), যেখানে আমরা শাখা হিসেবে ফল বহন করি। এটি আদিপুস্তকের ফলবৃক্ষের সাথে সংযোগ স্থাপন করেÑযদি আমরা ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থাকি, তাহলে আমাদের জীবন ফলপ্রসূ হবে।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে ফলবৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশগত সঙ্কটের যুগে, এ পদটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঈশ্বরের সৃষ্টি রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব (আদিপুস্তক ২:১৫)। ফলবৃক্ষের উর্বরতা প্রতীকীভাবে আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রভাবিত করেÑযেমন একটি গাছ তার মূল থেকে পুষ্টি নিয়ে ফল দেয়; তেমনি আমরা বাইবেলের বাক্য থেকে পুষ্ট হয়ে ভালো কাজ করি। ফলবৃক্ষের প্রতীকী অর্থ শান্তি, বিজয় এবং সমৃদ্ধির সাথে যুক্ত (যেমন-খেজুর গাছ), যা’ বাইবেলে বারবার উল্লেখিত। যা’ শান্তি এবং আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির প্রতীক; আমাদের জীবনও ঈশ্বরের আশীর্বাদে ফলবান হওয়া উচিত। প্রকাশিত বাক্য ২২:২-এ জীবনের বৃক্ষের উল্লেখ নতুন সৃষ্টির প্রতিশ্রæতি দেয়, যা’ বারো প্রকার ফল দেয় এবং তার পাতা জাতিগণের সুস্থতার জন্যে। এটি আদিপুস্তক ১:১১-এর সাথে চক্রাকারে সংযুক্ত, যেখানে সৃষ্টির শুরু থেকে ফলবৃক্ষ ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ। আধ্যাত্মিকভাবে, এটি আমাদের আহŸান করে যে, আমরা ফলবৃক্ষের মতো হইÑউর্বর, ধারাবাহিক এবং অন্যদের পুষ্টিকর। আদিপুস্তক ১:১১ ফলবৃক্ষকে কেবল প্রকৃতির অংশ নয়; বরং আধ্যাত্মিক জীবনের দর্পণ হিসেবে উপস্থাপন করে। এর গুরুত্ব আমাদেরকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত থেকে ফল বহন করতে অনুপ্রাণিত করে, যাতে আমাদের জীবন সমৃদ্ধ এবং অর্থপূর্ণ হয়। এ বোঝাপড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করে, আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারি।

নহিমিয় ৯:২৫ পদে রয়েছে, ‘তাহাতে তাহারা প্রাচীরবেষ্টিত অনেক নগর ও উর্বর ভ‚মি লইল, এবং সমুদয় উত্তম দ্রব্যে পরিপূর্ণ গৃহ, খনিত ক‚প, দ্রাক্ষাক্ষেত্র, জলপাইক্ষেত্র ও প্রচুর ফলবৃক্ষ অধিকার করিল, এবং ভোজন করিয়া তৃপ্ত ও পুষ্ট হইল, এবং তোমার কৃত মহা মঙ্গলে আপ্যায়িত হইল।’ আমেন। নহিমিয় গ্রন্থের ৯ম অধ্যায়ে ইস্রায়েলীয়রা তাদের পাপ স্বীকার করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে। এ প্রেক্ষাপটে ২৫ পদটি ঈশ্বরের অপরিমেয় কৃপা ও দানের একটি চিত্র তুলে ধরে। এ পদে ‘প্রচুর ফলবৃক্ষ’ কেবল ভৌতিক সম্পদের অংশ নয়; বরং ঈশ্বরের মহা মঙ্গলের প্রতীক। এতে আমরা ফলবৃক্ষের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অন্বেষণ করব, যা’ ঈশ্বরের প্রতিশ্রæত আশীর্বাদ, তৃপ্তি এবং আত্মার পুষ্টির সাথে গভীরভাবে যুক্ত। প্রথমত, নহিমিয় ৯:২৫-এ ফলবৃক্ষের উল্লেখ ঈশ্বরের বিশ্বস্ততা ও প্রতিশ্রæতি পূরণের সাক্ষ্য। ইস্রায়েলীয়রা কনান দেশে প্রবেশের সময় ঈশ্বর যে আশীর্বাদের কথা বলেছিলেন (দ্বিতীয় বিবরণ ৮:৭-১০), তা’ এখানে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “কেননা সদাপ্রভু তোমার ঈশ্বর তোমাকে এক উত্তম দেশে… যেখানে দ্রাক্ষা, অঞ্জীর ও আনারের বৃক্ষ আছে… সেই দেশে লইয়া যাইতেছেন।” ফলবৃক্ষÑদ্রাক্ষা, জলপাই, অঞ্জীরÑএগুলো কেবল খাদ্য নয়, ঈশ্বরের প্রতিশ্রæত ‘দুধ ও মধুময়’ দেশের প্রতীক। নহিমিয়র প্রার্থনায় এ ফলবৃক্ষগুলো ঈশ্বরের ‘মহা মঙ্গল’-এর দৃশ্যমান প্রমাণ। আধ্যাত্মিকভাবে, এটি আমাদের শেখায় যে, ঈশ্বরের আশীর্বাদ সর্বদা ফলপ্রসূÑযেমন ফলবৃক্ষ তার ঋতুতে ফল দেয়, তেমনি ঈশ্বরের কৃপা আমাদের জীবনে তৃপ্তি ও পুষ্টি আনে। দ্বিতীয়ত, ফলবৃক্ষ এখানে তৃপ্তি ও আনন্দের প্রতীক। পদটি বলছে, তারা “ভোজন করিয়া তৃপ্ত ও পুষ্ট হইল, এবং তোমার কৃত মহা মঙ্গলে আপ্যায়িত হইল।” ফলবৃক্ষের প্রাচুর্য শারীরিক পুষ্টির সাথে আধ্যাত্মিক আনন্দকে যুক্ত করে। গীতসংহিতা ১০৪:১৪-১৫-এ বলা হয়েছে, ঈশ্বর “মানুষের জন্য খাদ্য উৎপন্ন করেন… দ্রাক্ষারস যাহা মানুষের হৃদয় আনন্দিত করে, তৈল যাহা মুখ উজ্জ্বল করে, এবং ভোজ্য যাহা মানুষের হৃদয় সবল করে।” এখানে দ্রাক্ষা ও জলপাই ফলবৃক্ষের উৎপাদন ঈশ্বরের দান যা’ শরীর ও আত্মা উভয়কে পুষ্ট করে। নহিমিয়র পদে এ তৃপ্তি ঈশ্বরের কৃপার ফল। আধ্যাত্মিকভাবে, যীশু খ্রীষ্ট বলেছেন, “আমি জীবনের রুটি… যে আমার কাছে আসে, সে কখনও ক্ষুধার্ত হইবে না” (যোহন ৬:৩৫)। ফলবৃক্ষের মতো, খ্রীষ্ট আমাদের চিরন্তন তৃপ্তির উৎস। তৃতীয়ত, ফলবৃক্ষ দায়িত্ব ও কৃতজ্ঞতার আহŸান জানায়। নহিমিয় ৯ অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে ইস্রায়েলীয়রা স্বীকার করছে যে, এ প্রাচুর্য পেয়েও তারা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে (৯:২৬)। ফলবৃক্ষের আশীর্বাদ তাদের গর্বিত করেছে; কিন্তু কৃতজ্ঞতাহীনতা তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। এটি আমাদের সতর্ক করেÑঈশ্বরের দান (ফলবৃক্ষের মতো) আমাদের জন্যে পরীক্ষা। আমরা কি এ আশীর্বাদকে ঈশ্বরের গৌরবের জন্যে ব্যবহার করি, নাকি নিজেদের স্বার্থে? হোশেয় ১৪:৮-এ ঈশ্বর বলেন, “আমিই তাহার সবুজ তরুবৃক্ষ; আমারই দ্বারা তোমার ফল পাওয়া যায়।” ফলবৃক্ষের ফল ঈশ্বরের, আমরা কেবল তত্ত¡াবধায়ক। চতুর্থত, ফলবৃক্ষ আধ্যাত্মিক ফলপ্রসূতার প্রতীক। নহিমিয়র পদে ‘প্রচুর ফলবৃক্ষ’ শুধু বাহ্যিক নয়, আমাদের অভ্যন্তরীণ জীবনের প্রতিফলন। যিরমিয় ১৭:৭-৮-এ ধন্য ব্যক্তিকে জলের কাছে লাগানো গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা’ “ফল ছাড়ে না” এবং “শুষ্ক বৎসরেও চিন্তিত হয় না।” নতুন নিয়মে যীশু বলেন, “যে শাখা আমাতে থাকে… সে বহু ফল ফলায়” (যোহন ১৫:৫)। নহিমিয়র ফলবৃক্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ঈশ্বরের আশীর্বাদ আমাদের মধ্যদিয়ে অন্যদের পুষ্ট করবেÑপ্রেম, দয়া, বিশ্বাসের ফল।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে, ফলবৃক্ষের এ চিত্র আমাদের বস্তুবাদী সমাজে চ্যালেঞ্জ করে। আমরা প্রায়ই ‘প্রাচীরবেষ্টিত নগর’ ও ‘উত্তম দ্রব্য’ খুঁজি; কিন্তু ফলবৃক্ষের মতো আধ্যাত্মিক প্রাচুর্য উপেক্ষা করি। নহিমিয় ৯:২৫ আমাদের প্রশ্ন করে: আমরা কি ঈশ্বরের দানে তৃপ্ত, নাকি আরো বেশি চাই? ফলবৃক্ষের প্রাচুর্য শিক্ষা দেয় যে, সত্যিকারের পুষ্টি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে। নহিমিয় ৯:২৫-এর ফলবৃক্ষ ঈশ্বরের মহা মঙ্গলের দৃশ্যমান স্মারক। এটি আমাদের বিশ্বাস, কৃতজ্ঞতা ও ফলপ্রসূতার জন্যে আহŸান করে। যেমন ইস্রায়েলীয়রা এ ফল উপভোগ করেছে, তেমনি আমরাও খ্রীষ্টে থেকে আত্মার ফল বহন করতে পারি। ফলবৃক্ষের মতো, আমাদের জীবন যেন ঈশ্বরের গৌরব প্রকাশ করে এবং অন্যদের আশীর্বাদ করে।

ফলবৃক্ষের আধ্যাত্মিক রোপণ: উপদেশক ২:৫-এর আলোকে উপদেশক গ্রন্থের ২য় অধ্যায়ে শলোমন তার জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন। ৫ পদে তিনি বলেন, “আমি আপনার জন্য অনেক উদ্যান ও উপবন করিয়া তাহার মধ্যে সর্বপ্রকার ফলবৃক্ষ রোপণ করিলাম।” এ পদটি প্রথম দর্শনে রাজকীয় বিলাসিতার চিত্র তুলে ধরেÑউদ্যান, উপবন, সর্বপ্রকার ফলবৃক্ষ। কিন্তু উপদেশকের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক সতর্কবাণী। ফলবৃক্ষ এখানে মানুষের প্রচেষ্টা, আকাক্সক্ষা এবং অর্থের অন্বেষণের প্রতীক। এখানে আমরা ফলবৃক্ষের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অন্বেষণ করব, যা’ ঈশ্বরের উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষের সৃষ্টি কতোটা অসার তা’ প্রকাশ করে। প্রথমত, উপদেশক ২:৫-এ ফলবৃক্ষ রোপণ মানুষের সৃজনশীলতা ও পরিশ্রমের শিখর প্রতিনিধিত্ব করে। শলোমন বলছেন, “আমি আপনার জন্য” করেছিÑঅর্থাৎ নিজের সুখ ও তৃপ্তির জন্য। তিনি উদ্যান সৃষ্টি করলেন, সর্বপ্রকার ফলবৃক্ষ রোপণ করলেন। এটি আদিপুস্তক ২:৮-৯-এর ইডেনের বাগানের স্মৃতি জাগায়, যেখানে ঈশ্বর নিজে বাগান রোপণ করেছিলেন মানুষের জন্যে। কিন্তু শলোমনের উদ্যান ঈশ্বরের উদ্যান নয়; এটি মানুষের হাতের সৃষ্টি। আধ্যাত্মিকভাবে, ফলবৃক্ষ এখানে মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রতীক। আমরা প্রায়ই নিজেদের জন্যে ‘উদ্যান’ তৈরি করিÑক্যারিয়ার, সম্পদ, সম্পর্কÑআশা করি এগুলো আমাদের তৃপ্ত করবে। কিন্তু শলোমনের স্বীকারোক্তি: “তাহাতে আমি দেখিলাম, এ সকলই ব্যর্থতা ও বায়ু অনুসরণ” (২:১১)। ফলবৃক্ষ ফল দিলেও, ঈশ্বর ছাড়া তা’ অর্থহীন। দ্বিতীয়ত, ফলবৃক্ষের ‘সর্বপ্রকার’ উল্লেখ বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের কথা বলে, কিন্তু একই সাথে অস্থায়িত্বের। শলোমন সব ধরনের ফলবৃক্ষ রোপণ করলেনÑদ্রাক্ষা, জলপাই, অঞ্জীর, আনারÑযা বাইবেলে প্রায়ই আশীর্বাদের প্রতীক (দ্বিতীয় বিবরণ ৮:৮)। কিন্তু এ প্রাচুর্যও তাকে শান্তি দিল না। গীতসংহিতা ১:৩-এ ধার্মিক ব্যক্তি “জলধারার কাছে লাগানো বৃক্ষের ন্যায়, যে ঋতুমত ফল দেয়”Ñকিন্তু তার মূল ঈশ্বরের বাক্যে। শলোমনের ফলবৃক্ষ মানুষের পরিশ্রমে রোপিত, তাই তা’ ক্ষণস্থায়ী। আধ্যাত্মিকভাবে, এটি আমাদের শেখায় যে, সত্যিকারের ফল কেবল ঈশ্বরের হাতে রোপিত জীবন থেকে আসে। যীশু বলেছেন, “আমি দ্রাক্ষালতা, তোমরা শাখা… আমাতে থাকিলে তোমরা বহু ফল ফলিবে” (যোহন ১৫:৫)। মানুষের উদ্যানে ফল থাকলেও, খ্রীষ্ট ছাড়া তা শুষ্ক। তৃতীয়ত, ফলবৃক্ষ রোপণের ক্রিয়া আধ্যাত্মিক বিনিয়োগের প্রতীক। শলোমন ‘রোপণ করিলাম’Ñঅর্থাৎ সময়, শ্রম, সম্পদ বিনিয়োগ করলেন। এটি আমাদের জীবনের প্রতিফলন। আমরা কী রোপণ করছি? মথি ৬:১৯-২১-এ যীশু বলেন, “পোকা ও মরিচায় যাহা নষ্ট করে… পৃথিবীতে ভাÐার সঞ্চয় করিও না… যেখানে তোমার ভাÐার, সেখানে তোমার হৃদয়ও থাকিবে।” শলোমনের উদ্যান পৃথিবীর ভাÐারÑসুন্দর, কিন্তু অস্থায়ী। আধ্যাত্মিক ফলবৃক্ষ রোপণ মানে ঈশ্বরের রাজ্যে বিনিয়োগÑপ্রার্থনা, সেবা, প্রেম। গালাতীয় ৬:৮ বলে, “যে আত্মার জন্য বপন করে, সে আত্মা হইতে অনন্ত জীবন কাটিবে।” চতুর্থত, উপদেশকের এ অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের গুরুত্ব শেখায়। ফলবৃক্ষের উদ্যান সুন্দর, কিন্তু উপদেশক ১২:১৩-এ উপসংহার: “ঈশ্বরকে ভয় কর ও তাঁহার আজ্ঞা পালন কর; ইহাই মানুষের সমুদয় কর্তব্য।” ফলবৃক্ষ যদি ঈশ্বরের গৌরবের জন্যে না হয়, তবে তা’ ব্যর্থ। ইসাইয়া ৫:১-৭-এ ঈশ্বরের দ্রাক্ষাক্ষেত্রের দৃষ্টান্তে দেখা যায়, ঈশ্বর আশা করেন ফলÑধার্মিকতা। কিন্তু ইস্রায়েল কাঁটাঝোপ দিল। শলোমনের উদ্যানও একইÑফল আছে, কিন্তু আধ্যাত্মিক ফল নেই। আধুনিক প্রেক্ষাপটে, আমরা শলোমনের মতোই ‘উদ্যান’ তৈরি করিÑকর্মজীবন, বিনোদন, প্রযুক্তি। কিন্তু উপদেশক প্রশ্ন করে: এগুলো কি আমাদের তৃপ্ত করে? ফলবৃক্ষের সৌন্দর্য আমাদের আকর্ষণ করে, কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া তা’ শূন্য। আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা প্রায়ই ‘সর্বপ্রকার ফলবৃক্ষ’ রোপণ করি, কিন্তু আত্মার উদ্যান অবহেলিত। উপদেশক ২:৫-এর ফলবৃক্ষ আমাদের জীবনের উদ্যানের দর্পণ। এটি সুন্দর, কিন্তু ঈশ্বরকেন্দ্রিক না হলে অসার। সত্যিকারের ফল কেবল খ্রীষ্টে রোপিত জীবন থেকে আসে। আসুন আমরা নিজেদের জন্যে নয়, ঈশ্বরের গৌরবের জন্যে ফলবৃক্ষ রোপণ করিÑযাতে আমাদের জীবন চিরন্তন ফল বহন করে। “যাহাতে তোমরা ফলবান হইয়া বৃদ্ধি পাও” (কলসীয় ১:১০)।

যিশাইয় ভাববাদীর ৩২তম অধ্যায়ে এক অপূর্ব রূপান্তরের দর্শন উন্মোচিত হয়। ১৫ পদে বলা হয়েছে: “যে পর্যন্ত ঊর্ধ্বলোক হইতে আমাদের উপরে আত্মা সেচিত না হন, প্রান্তর ফলবৃক্ষের উদ্যানে পরিণত না হয়, ও ফলশালী ক্ষেত্র অরণ্য বলিয়া গণ্য না হয়।” এখানে ‘প্রান্তর’ থেকে ‘ফলবৃক্ষের উদ্যান’-এর রূপান্তর কেবল প্রকৃতির চিত্র নয়; বরং পবিত্র আত্মার কার্যকলাপের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ও সমাজের আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের প্রতীক। ফলবৃক্ষ এ পদে কেন্দ্রীয় ভ‚মিকা পালন করেÑএটি আশা, উর্বরতা, ধার্মিকতা ও ঈশ্বরের রাজ্যের ফলপ্রসূতার প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে আমরা ফলবৃক্ষের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অন্বেষণ করবো, যা’ আত্মার সেচন ছাড়া অসম্ভব। প্রথমত, যিশাইয় ৩২:১৫-এ ফলবৃক্ষের উদ্যানের উল্লেখ ঈশ্বরের পুনরুদ্ধারকারী ক্ষমতার সাক্ষ্য। ‘প্রান্তর’ বাইবেলে প্রায়ই পাপ, শূন্যতা ও আধ্যাত্মিক মৃত্যুর প্রতীক (যিশাইয় ৩৫:১; যিরমিয় ২:৬)। কিন্তু পবিত্র আত্মা যখন “ঊর্ধ্বলোক হইতে” সেচিত হন, তখন এ প্রান্তর ফলবৃক্ষের উদ্যানে পরিণত হয়। এটি এদনের বাগানের স্মৃতি জাগায় (আদিপুস্তক ২:৮-৯), যেখানে ঈশ্বর সকল প্রকার ফলবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। আধ্যাত্মিকভাবে, ফলবৃক্ষের উদ্যান মানুষের হৃদয়ের পুনরুদ্ধার নির্দেশ করে। যেখানে পাপের কারণে শুষ্কতা ছিলো, সেখানে আত্মার সেচনে উর্বরতা আসে। যিশাইয় ৪৪:৩-এ ঈশ্বর বলেন, “আমি তৃষ্ণার্তের উপরে জল ঢালিব… আমার আত্মা তোমাদের সন্তানদের উপরে ঢালিব।” ফলবৃক্ষ এখানে আত্মার ফলের দৃশ্যমান প্রমাণÑপ্রেম, আনন্দ, শান্তি (গালাতীয় ৫:২২)। দ্বিতীয়ত, ফলবৃক্ষের উদ্যান ধার্মিকতা ও শান্তির রাজ্যের প্রতীক। পদের পরবর্তী অংশে (৩২:১৬-১৭) বলা হয়েছে, “তখন ন্যায়পরায়ণতা প্রান্তরে বাস করিবে… ধার্মিকতার ফল শান্তি হইবে।” ফলবৃক্ষের উদ্যান কেবল সৌন্দর্য নয়, এটি ন্যায় ও শান্তির ফল বহন করে। গীতসংহিতা ১:৩-এ ধার্মিক ব্যক্তি “জলধারার কাছে লাগানো বৃক্ষের ন্যায়, যে ঋতুমত ফল দেয়।” আত্মার সেচন এ ফল উৎপাদন করে। নতুন নিয়মে যীশু বলেন, “আমি দ্রাক্ষালতা… যে আমাতে থাকে, সে বহু ফল ফলায়” (যোহন ১৫:৫)। যিশাইয়র দর্শনে ফলবৃক্ষ সমাজের রূপান্তরও নির্দেশ করেÑযেখানে অন্যায় ছিল, সেখানে ধার্মিকতার উদ্যান গড়ে উঠবে। তৃতীয়ত, “ফলশালী ক্ষেত্র অরণ্য বলিয়া গণ্য” হওয়ার কথা অপরিমেয় প্রাচুর্যের চিত্র। এটি বিপরীতমুখী রূপকÑসাধারণত অরণ্যকে প্রান্তর বলা হয়, কিন্তু এখানে ফলশালী ক্ষেত্র এতোই প্রচুর যে, তাকে অরণ্য বলে গণ্য করা হয়। এটি ঈশ্বরের আশীর্বাদের অতিপ্রাচুর্য দেখায় (ইফিষীয় ৩:২০)। ফলবৃক্ষের এ প্রাচুর্য পেন্টেকস্টের ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে পবিত্র আত্মা অগ্নিশিখার মতো নেমে এসে শিষ্যদের হৃদয়কে উর্বর করে তুললেন (প্রেরিত ২:১-৪)। ফলবৃক্ষের উদ্যান আজকের গির্জা ও বিশ্বাসীর জীবনের প্রতিচ্ছবিÑযেখানে আত্মার কার্যে অসম্ভব রূপান্তর ঘটে। চতুর্থত, এ পদটি আত্মার উপর নির্ভরতার আহŸান। “যে পর্যন্ত… আত্মা সেচিত না হন”Ñঅর্থাৎ মানুষের প্রচেষ্টায় প্রান্তর উদ্যান হয় না। যিশাইয় ৫৫:১০-১১-এ বলা হয়েছে, ঈশ্বরের বাক্য বৃষ্টির মতো নেমে ভ‚মিকে উর্বর করে। আধ্যাত্মিকভাবে, ফলবৃক্ষের বৃদ্ধি আমাদের নয়, আত্মার। ১ করিন্থীয় ৩:৬-৭-এ পৌল বলেন, “আমি রোপণ করিয়াছি… কিন্তু ঈশ্বর বৃদ্ধি দিয়াছেন।” ফলবৃক্ষের উদ্যান গড়তে আমাদের কাজ প্রার্থনা, আনুগত্য ও আত্মার প্রতি উন্মুক্ততা। আধুনিক প্রেক্ষাপটে, আমাদের সমাজ প্রায়ই ‘প্রান্তর’Ñঅনৈতিকতা, বিভেদ, আধ্যাত্মিক শূন্যতা। কিন্তু যিশাইয় ৩২:১৫ আশা দেয়: আত্মার সেচনে এ প্রান্তর ফলবৃক্ষের উদ্যান হতে পারে। গীর্জা, পরিবার, ব্যক্তিÑসবাই এ রূপান্তরের অংশীদার। আজকের পরিবেশ সঙ্কটেও এ পদ প্রাসঙ্গিকÑযেমন শুষ্ক ভ‚মি সেচনে সবুজ হয়, তেমনি আধ্যাত্মিক সেচনে সমাজ নবজীবন লাভ করে। যিশাইয় ৩২:১৫-এর ফলবৃক্ষের উদ্যান পবিত্র আত্মার কার্যের মহিমান্বিত চিত্র। এটি আমাদের আহŸান করে আত্মার সেচনের জন্যে অপেক্ষা করতে, যাতে আমাদের প্রান্তরময় জীবন ধার্মিকতা, শান্তি ও প্রাচুর্যের উদ্যানে পরিণত হয়। “যিনি তোমাদের শুরু করিয়াছেন, তিনিই সম্পূর্ণ করিবেন” (ফিলিপীয় ১:৬)। আসুন আমরা আত্মার জন্যে উন্মুক্ত হই, যাতে ফলবৃক্ষের উদ্যান আমাদের মধ্যে ও চারপাশে ফুটে উঠুক। আমেন।

-সমাপ্ত-

সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫

ডায়াবেট্সি হলে কি করবেন?

শেয়ার করুন
প্রিয় সময় ও চাঁদপুর রিপোর্ট মিডিয়া লিমিটেড

You might like

About the Author: priyoshomoy