ছোট গল্প : ভাঙ্গা রিক্সা

ছোট গল্প

ভাঙ্গা রিক্সা

লিখেছেন : ক্ষুদীরাম দাস

এক.
বাড়িটি বেশ দৃষ্টিনন্দন! যে কেউ একবার তাকালেই পরের বার অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। অনেক টাকা ব্যয় করে তৈরি করা হয়েছে। আর যারা প্রতিদিন দেখে, তারাও যতবার দেখে ততবারই অবাক হয়ে দেখে। অবশ্য নতুন প্রজন্ম অতটা অবাক হয় না। তারা এ ধরনের বাড়ি দেখতে দেখতে অভ্যস্ত।

বয়স্করা ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছে, এখানে একসময় খড়ের দোচালা ঘর ছিলো। লোকটার নাম কানাই বাবু। এক নামে সকলে চেনে। কেউ কেউ আদর করে কানু বলে ডাকতো। গায়ের রং কালো। কিন্তু লোকটার মনটা ভীষণ ভালো ছিলো। বিশ^স্ত ও সততার জন্যে সবাই তাকে ভালোবাসতো।

লোকটাকে চিনতো না এমন মানুষ কমই ছিলো। তার কারণ হলো লোকটা রিক্সা চালাতো সারাদিন। রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাতো। ভালো টাকা কামাই করতো। কোনো এক এনজিও কর্মী লোকটাকে সঞ্চয় করার কৌশল শিখিয়েছিলো। সেই থেকে লোকটার মধ্যে সঞ্চয় করার ইচ্ছা হলো। প্রতিদিনের আয়ের একটা অংশ ঐ এনজিও প্রতিষ্ঠানে জমিয়ে রাখতো। প্রতিটি পয়সা হিসেব করেই খরচ করতো। তাই তাকে কেউ কেউ হাড়কীপটেও বলতো।

এসব শুনে লোকটা মোটেও রাগ করতো না। তাদের সেসব কথায় মোটেও কান দিতো না। তার বউটাও সে রকমই ছিলো। বাড়িতে হাস মুরগীর ডিম বিক্রি করে টাকাগুলো মাটির ব্যাংকে জমিয়ে রাখতো। বছর শেষে সোনা তৈরি করতো। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সোনায় সোহাগা ছিলো। এভাবে প্রচুর টাকা জমিয়েছিলো। কানাই বাবুর একমাত্র ছেলে কিশোরও একই রকমের ছিলো। নিজের বাবার মতো হিসেব করে চলতো।

মানুষকে বলতে শোনা যায়, এক লুঙ্গি তিন বছরও নাকি পড়েছিলো। বাবার টাকায় বাজারে একটি মুদি দোকান দিয়েছিলো। সেই দোকান থেকে আয় করতে করতে টিভি ফ্রিজের দোকান দেয়। এভাবে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলো। এরপর খড়ের দোচালা ঘর ভেঙ্গে বড় করে একটা টিনের ঘর দিয়েছিলো। এখন সেই ঘরটি পরিত্যক্ত। সেই ঘরটি ভালো হলেও পুরোনো হয়েছে বলে কেউ থাকে না, থাকতে চায়ও না।

একদিন হঠাৎ কিশোরের বাবা কানাই বাবু মারা যায়। সেদিন কানাই বাবুকে দেখার জন্যে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর লোক এসেছিলো। লোকটা এতো ভালো ছিলো যে, সকলেই তার মৃত্যুতে চোখের জল ফেলেছিলো। লোকটার সাথে প্রতিটি মানুষের স্মৃতি জড়িত ছিলো। এমন কেউ নেই যে, লোকটার রিক্সায় চড়ে বসেনি। রাত যত গভীরই হোক না কেন কেউ তাকে ডাক দিলে রিক্সা নিয়ে ছুটে যেতো। কোনো লোক অসুস্থ হলে সবার আগে রিক্সা নিয়ে ছুটে যেতো এই কানাই বাবু।

বাবার মৃত্যুতে কিশোর বাবু একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলো। যেদিন কানাই বাবু মারা যায়, সেদিন সকাল বেলা বলেছিলো, আজ পহেলা বৈশাখ। সুতরাং আজ অনেক বেশি আয় হবে। এরপর কিশোরকে একটা সাইকেল কিনে দেবো। ছেলেটা যেন স্কুলে তাড়াতাড়ি যেতে পারে। পড়াশোনা যেন আরো ভালোভাবে করতে পারে। ভালো মানুষ, এরপরক্ষণেই হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পরে। কিশোর দূর থেকে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ততক্ষণে ওপারে চলে যায়। সেই থেকে রিক্সাটি কিশোর যতœ করে রেখে দিয়েছে বাবার স্মৃতি রক্ষার জন্যে। প্রতিদিন রিক্সার কাছে যায় এবং বাবাকে অনুভব করে।

কালক্রামে রিক্সাটি পুরোনো হতে হতে মরিচা ধরে গেছে। টিনের ধরের পাশে টিক বারান্দার থেকে একটু দূরে রিক্সাটি পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন! কেউ সেই রিক্সাটি ধরে না। কেউ রিক্সাটি ধরলে কিশোর খুবই ক্ষেপে যায়। কিশোর ভাবে, আমি এই রিক্সার জন্যেই বেঁচে আছি। এই রিক্সা দেখলে মনে হয় আমার বাবা এখনো আমার সামনে রয়েছে। রিক্সার প্রতিটি স্থানে বাবার হাতের স্পর্শ।


এরপর কিশোর টিনের ঘরের পাশে দোতালা বিল্ডিং তৈরি করে। আধুনিক বিল্ডিং। বেশ দৃষ্টিনন্দন। কিশোর দেখে, চারিদিকে লোকজন ঘরবাড়ি তৈরি করছে। সেই দেখা থেকে নিজেরও ইচ্ছে হলো একটি বড় করে বাড়ি করবে। সবাই তাকে বলেছিলো, টিনের ঘরটি ভেঙ্গে ফেলতে। কিন্তু না, কিছুতেই সেই টিনের ঘর ভাঙ্গতে রাজী ছিলো না কিশোর। আর বাড়ির সবকিছু সুন্দরের মাঝে অসুন্দর হয়ে দাঁড়িয়েছে টিনের ঘরটি। সবারই একই কথা যে, এই টিনের ঘরটি ভেঙ্গে দিলে বাড়ির সৌন্দর্য আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু কিশোরের দৃঢ় সিদ্ধান্তের কাছে সবাই হেরে যায়।

দুই.
একদিন কিশোরের মেয়ে রিনার বান্ধবী তাদের বাড়িতে আসে। মেয়েটি নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওদের দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব জমে গেছে। তাই একদিন রিনা তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের বাড়িতে আসার জন্যে। মেয়েটি গেইট দিয়ে ঢোকার সময় বেশ খুশি হয়। বাড়ির ভেতর ঢুকেই একটু দাঁড়ায়। আর এতো সুন্দর একটি বাড়ি চোখ বুলিয়ে নেয়। কিন্তু চারিদিকে তাকাতে তাকাতে একসময় তার চোখ চলে যায় টিনের ঘরের পাশে পড়ে থাকা ভাঙ্গা রিক্সাটির দিকে। রিক্সাটি বেশ পুরোনা ও নষ্ট। দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, দীর্ঘদিন পরে আছে। চাকাগুলো খুলে গেছে। সামনের চাকার একটি শিকও নেই। হাতল নেই।

রিক্সার সীট বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। রিক্সার চারিদিকে ঘাস জন্মেছে। রিক্সার উপরও ময়লা আবর্জনা, আর গাছের শিকড় উঠে গেছে। বড় বড় ঘাসে রিক্সাটি ঢেকে আছে। বেশ উৎসাহের সাথে রিনাকে জিজ্ঞাসা করলো ঃ এই রিক্সাটি এখানে কেনো? জায়গাটাও নোংরা হয়ে আছে। পরিস্কার করলে তো বেশ সুন্দর লাগতো।


রিনা ঃ তুই ঠিকই বলেছিস! এই রিক্সার জন্যে পুরো বাড়িটাই নোংরা বলে মনে হয়। সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে।
বান্ধবী ঃ তাহলে এটাকে ফেলে দিস না কেনো?
রিনা ঃ বাবার জন্যে ফেলতে পারি না।
বান্ধবী ঃ মানে?
রিনা ঃ বাবা কোনোভাবেই এই রিক্সাটি ফেলতে দেবে না।
বান্ধবী ঃ এটা তো এখন আর কোনো কাজেই লাগবে না। ফেরিওয়ালার কাছে কেজি হিসেবে বিক্রি করলেও কোনো টাকা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
রিনা ঃ আমিও তাই ভাবি। বাবাকে কতো করে বললাম, এই জায়গাটি পরিস্কার করতে। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হলো না। এটা নাকি তার বাবার স্মৃতি। আচ্ছা, তুই বলতো আধুনিক যুগে এসব স্মৃতি মানুষ বিশ^াস করে? আমি বলেছিলাম, এখানে একটি বাড়ি করে ভাড়া দিতে পারতো। তা না করে বাবা এই স্মৃতি কোনোভাবেই বিলীন করতে চায় না। আমার খুবই লজ্জা লাগে এই ভাঙ্গা রিক্সার দিকে তাকালে।
বান্ধবী ঃ লুকিয়ে লুকিয়ে তোরাই তো এটা পরিস্কার করে ফেলতে পারিস। অথবা যেদিন তোর বাবা থাকবে না সেদিনই কিছু মানুষ দিয়ে এই ভাঙ্গা রিক্সা অচেনা কোনো ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিতে পারিস। তাহলেই তো হয়ে গেলো।
রিনা ঃ ওরে বাবা সে রকম যদি করি তাহলে তো লঙ্কাকাÐ ঘটে যাবে। বাড়িতেই থাকা যাবে না। বাবা চেঁচিয়ে বাড়ি এক ধরে ফেলবে।

বান্ধবী ঃ শুধু এই পুরোনো ভাঙ্গা রিক্সার জন্যেই বাড়ির আধুনিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে এসব পুরোনো মানুষগুলো আধুনিকতা বোঝে না। তাদের সেন্টিমেন্ট অন্য রকম। তাদের সাথে আমাদের কিছুতেই মিলে না। আমার কথা হলো, পুরোনোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাও সামনের দিকে। তবেই তো জীবন আরো সুন্দর হবে। পুরোনো স্মৃতি রাখার মোটেও দরকার নেই।
রিনা ঃ তুই ঠিকই বলেছিস্। থাক ওসব কথা বাদ দে তো। চল, আমরা গিয়ে ছাদে বসি।

ওরা দু’জন একসাথে বাড়ির ছাদে গিয়ে বসলো। ছাদ থেকে চারিদিকে তাকালে সবকিছু অপূর্ব লাগে। শুধু ঐ টিনের ঘর, আর বিশ্রী রকমের ভাঙ্গা রিক্সার জন্যে মনটা সেখানেই নষ্ট হয়ে যায়। রিনার বান্ধবী ভাবছে, থাক থাক, রিনাকে আর এসব বিষয়ে কিছু বলে লাভ নেই। তাকে আর বিরক্ত করার দরকার নেই। ওরা দু’জন একসাথে ছাদের উপর পায়চারি করতে করতে রিনার বান্ধবী বললো ঃ আজ এ পর্যন্ত। এবার আসি রে। আবার অন্য একদিন আসবো।
রিনা ঃ চল তোকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। আবার যদি কখনো সময় সুযোগ মিলে, তাহলে চলে আসবি। দু’জন একসাথে সময় কাটানো যাবে।

তিন.
রিনা কলেজ থেকে ফিরে এসেছে। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে ভাত খেয়েছে। এরপর একটু বিশ্রামের জন্যে যাবে এমন সময় রুমে দেখতে পেলো তার মা ঘরে বসে টিভি দেখছে। এই সুযোগে মায়ের সাথে কথা বলতে গেলো রিনা। রিনা মায়ের পাশে বসে বলতে লাগলো ঃ আচ্ছা মা, তোমাকে একটা কথা বলবো?
মা ঃ বলতে পারো, কী কথা।
রিনা ঃ তুমি রাগ করবে না তো?
মা ঃ কেন রাগ করবো?
রিনা ঃ না থাক, আজকে বলবো না। আরেকদিন বলবো।
মা ঃ কেন রে, আজকেই তো বলতে পারো।
রিনা ঃ তুমি রাগ হবে না তো?
মা ঃ একথা কেন বার বার বলছিস?

রিনা ঃ এমন একটা কথা, যে কথায় বাবাও রাগ করে। তাই ভাবছি, তোমাকেই কথাটি বলি। যদি কাজে আসে তো ভালো হবে। আমিও খুশি হবো।
মা ঃ তোমার বাবা তো খুবই ভালো মানুষ। তোমার বাবা তো এমন নয়। তোমার বাবাকে তো কোনোদিনই তোমার উপর রাগ করতে দেখিনি। তাহলে কেন তুমি এভাবে বলছো?
রিনা ঃ আমার ভয় হচ্ছে।
মা ঃ কোনো ভয় নেই। তুমি বলতে থাকো।

রিনা ঃ আমাদের বাড়ির চারিদিক তো একটু পরিস্কার করা দরকার।
মা ঃ হুম। তুমি চুপ করে থাকো। বেশি কথা বলো না। মজা করার সময় এখন নয়।
রিনা ঃ এটা মজা নয় মা। সত্যিই বলছি। আমাদের বাড়ির চারিদিক পরিস্কার করা দরকার।
মা ঃ চারিদিক তো ভালোই পরিস্কার আছে। আমাদের বাড়ির মতো আর কোনো বাড়ি পরিস্কার আছে কিনা? তুমি একটু তাকিয়ে দেখো তো?

রিনা ঃ একটা বিল্ডিংয়ের পাশে একটা টিনের ঘর কি মানায়? তুমি বলতো মা। তার উপর একটা ভাঙ্গা রিক্সা পড়ে আছে যুগের পর যুগ। ঐ ভাঙ্গা জিনিসটা আমি লাথি দিয়ে ফেলে দিবো।

রিনার মা চোখ বড় বড় করে রিনার দিকে তাকিয়ে বললো ঃ খুব সাবধান! তুমি এভাবে বলতে পারো না। তোমার এতো বড় সাহস হয় কীভাবে এসব কথা বলার?
রিনা ঃ আমি খারাপ কী বললাম?
মা ঃ এটা তোমার দাদুর স্মৃতি। তোমার বাবা সেই স্মৃতি রক্ষা করে চলেছেন। ঐ রিক্সার প্রতিটি তুমি কোনোভাবেই অপমান করতে পারো না। এসব কথা আর একবারও তুমি বলবা না।

রিনা ঃ এসব পুরোনো স্মৃতি আমাদের কোনো কাজে লাগবে মা। যত পুরোনা জিনিস নিয়ে থাকবে ততই মন ছোট হয়ে যাবে। পুরোনোকে বাদ, পুরোনোকে ফেলে দাও। পরিস্কার কর, আর নতুনকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দাও।

মা ঃ না রে মা! পুরোনো থেকেই মানুষকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। সাহস অর্জন করতে হয়। এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা নিতে হয়। ঐ রিক্সা হলো তোমার বাবার স্মৃতি! তোমার এসব কথা শুনলে তোমার বাবা কতো দুঃখ পাবে সেটা তুমি বুঝতে পেরেছো? আজ আমরা যে এ অবস্থায় আছি, এই রিক্সার কারণেই। একসময় এই রিক্সা ভালো ছিলো। তখন তোমার দাদু, এই রিক্সা চালিয়ে সংসার চালিয়েছেন। রিক্সা চালিয়ে টাকা জমিয়েছেন। তোমার বাবাকে কলেজে পরিয়ে বড় করেছেন। এরপর ব্যবসায় ঢুকিয়েছেন। আর তোমার বাবাও তোমার দাদুর উৎসাহে কষ্ট করে সঞ্চয় করেছেন অনেক টাকা। এখন বিল্ডিং হয়েছে বলে তুমি ঐ রিক্সাটাকে অপমান করছো কেনো? আর কোনোদিন তুমি এসব কথা বলবে না?
রিনা মায়ের কথা শুনে আর সহ্য করতে না পেরে নিজের রুমে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

চার.
রিনা ধীরে ধীরে বাবার রুমে ঢুকে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
কিশোর বাবু রিনাকে পাশে দেখতে পেয়ে তাকায়। আর জিজ্ঞাসা করে ঃ কিছু বলবে মা?
রিনা ঃ আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই বাবা।
কিশোর ঃ কী বলতে চাও, বলতে পারো।
রিনা ঃ আমার বান্ধবীরা আমাকে দুঃখ দেয়!
কিশোর ঃ কীভাবে দুঃখ দেয়?
রিনা ঃ এমন কথা বলে, যা শুনলে আমার খুবই লজ্জা লাগে।
কিশোর ঃ কী এমন কথা বলে তোমাকে, যার জন্যে তোমার লজ্জা লাগে?
রিনা ঃ ওরা আমাকে রিক্সাওয়ালার মেয়ে বলে!
হাসতে হাসতে বললো কিশোর বাবু ঃ তোমাকে ক্ষ্যাপানোর জন্যে এই কথা বলে। ওরা তোমাকে রাগিয়ে দিলে ওরা বেশ মজা পায়। তুমি রাগ করবে না, তাহলে তোমাকে ওরা রাগাতে পারবে না।
রিনা ঃ সত্যি সত্যি ওরা আমাকে রিক্সাওয়ার মেয়ে বলে। তুমি কি আমার কথা বিশ^াস করছো না?
কিশোর ঃ মানে কী? আমি তো রিক্সা চালাই না। তাহলে তোমাকে রিক্সাওয়ালার মেয়ে বলে কেন?
রিনা ঃ ওই যে আমাদের টিনের ঘরের পাশে যে ভাঙ্গা রিক্সাটা আছে, সেটা আমার বান্ধবীরা দেখেছে। তাই তারা আমাকে বলে রিক্সাওয়ালার মেয়ে।
কিশোর ঃ ও এই কথা। তাদের কথা তো ঠিকই আছে। তুমি তো রিক্সাওয়ালারই মেয়ে।
রিনা ঃ তার মানে? তুমি তাহলে রিক্সা চালাও।
কিশোর ঃ ছোট বেলায় দেখেছি আমার বাবাকে রিক্সা চালাতে। তাই মাঝে মাঝে আমিও রিক্সা চালাতাম। বেশ কয়েকদিন আমিও টাকা আয় করেছি।
রিনা এবার স্তব্ধ হয়ে গেলো। কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো ঃ বাবা তুমি ঐ ভাঙ্গা রিক্সাটা ওখান থেকে সরাও। আমি ঐ রিক্সা দেখতে পারছি না। বান্ধবীরা আমাকে লজ্জা দেয়।
কিশোর ঃ তুমি সত্যি সত্যিই রিক্সাওয়ালার মেয়েই। তাহলে তোমার লজ্জা হবার দরকার কি।
রিনা ঃ না না। এটা আমি মানতে পারছি না।

কিশোর ঃ আমার বাবা রিক্সা চালিয়েছেন বলেই আজ তুমি এই বড় সুন্দর বিল্ডিংয়ে থাকতে পারছো। মানে তোমার দাদু রিক্সা চালিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে বিল্ডিং করার রাস্তা তৈরি করে দিলেন। আমি আর তোমার দাদু-আমরা দুই বংশ রিক্সা চালিয়েছি; আর টাকা কামাই করেছি বলেই তুমি অতীতকে অস্বীকার করতে পারো না। আমরা দুই বংশ পরিশ্রম করেছি; আর তুমি বাহাদুরি করবে এটা তো ঠিক নয়। তোমার মা আমাকে সবকিছু বলেছে, আমি তোমার কথায় মোটেও কিছু মনে করিনি। কারণ, তুমি বিষয়টি মোটেও বুঝতে পারোনি। হাতে টাকা পয়সা আসলে, ধনী হয়ে গেলে অনেকেই এসব বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। আজ তোমাকে যারা রিক্সাওয়ালার মেয়ে বলে ঠাট্টা করছে, তাদের অতীত খুঁজে তাদেরও কয়েকটি বংশ ঠেলা গাড়ি ঠেলেছে। গরুর গাড়ি চালিয়েছে। দিনমজুরীর কাজ করেছে। তাদের মায়েরা মানুষের বাসায় জি এর কাজ করেছে। টাকায় জমিয়েছে বলে তাদেরও কিছু বাড়িঘর, আর টাকা পয়সা হয়েছে। হয়তো তারা সেসব জানে না।

রিনার হাত ধরে কিশোর বাবু নিয়ে গেলেন সেই ভাঙ্গা রিক্সার কাছে। আর বললেন ঃ এই ভাঙ্গা রিক্সা চালিয়ে আমার বাবা পরিবারের খাবার জুগিয়েছে। আমাকে পড়াশোনা শিখিয়েছে। বাড়ি করেছে। তার থেকে সাহস পেয়েছে বলেই আমি এই বিল্ডিং করতে পেরেছি। এখন তুমি এই বিল্ডিংয়ে থাকতে পারছো। এসবই এই ভাঙ্গা রিক্সার জন্যে হয়েছে। এবার তুমিই বল, আমি কীভাবে এই ভাঙ্গা রিক্সা বলে, ময়লা আবর্জনা বলে এটাকে এখান থেকে ফেলে দিতে পারি। তোমার কাছে এই ভাঙ্গা রিক্সা ময়লা আবর্জনা মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এই ভাঙ্গা রিক্সা ও প্রেরণা। এই ভাঙ্গা রিক্সার দিকে তাকালে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই।

রিনার মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনছিলেন। রিনা তার বাবার হাত ধরে বললো ঃ বাবা আমি বুঝতে পেরেছি, এই ভাঙ্গা রিক্সাটা তোমার জীবন!

———– সমাপ্ত ————–