চাঁদপুরে অরাজকতার নেপথ্যে ‘আমি রনি বলছি’

নিউজ ডেস্ক :

চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীবেষ্টিত রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দুর্গম এই ইউনিয়নের চরগুলোতে বসবাস করছেন নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ২৫ হাজার মানুষ। যাদের মূল পেশা নদীতে মাছ ধরা। কিন্তু গোষ্ঠীগত আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সেখানে প্রতিনিয়ত ঘটেছে চলেছে নানা ধরনের অপরাধ। এতে বাদ পড়ছে না, খুন ধর্ষণ এবং লুটপাটের মতো ঘটনাও। ফলে চরের নিরীহ মানুষজন ভীতসন্ত্রস্ত জীবন যাপন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন এই জনপদের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। ফলে চরের বিভিন্নস্থানে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।

জেলা শহরের মূল ভূখণ্ড থেকে নদী পাড়ি দিয়ে কয়েক ঘন্টার পথ। তারপর উত্তাল পদ্মা ও মেঘনার মাঝেই রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন। যেখানে সামান্য কিংবা তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে সংঘাত সহিংতা নিত্য ঘটনা। সেই জনপদের একটি লক্ষ্মীরচর। যেখানে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংর্ঘষ, লুটপাট, হামলা, ভাঙচুর, খুন খারাবি এমনকি ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। যার মধ্যে রয়েছে গত রোববার রাতে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ। তারও আগে গত ২৮ মে দুপক্ষের সংর্ঘষের ঘটনায় লোকমান হোসেন গাজী নামে একজন মারা যান। এই ঘটনার জের ধরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গাজী গোষ্ঠীর মধ্যে। ফলে প্রতিপক্ষ বকাউল গোষ্ঠীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে শতাধিক বসতবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট, নারী পুরুষদের মারধর, প্রায় ৪’শ গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়।

শুধু তাই নয়, এলাকার বেশ কয়েকটি দোকানপাটে হামলা ও ভাঙচুরসহ লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। মূলত বিচ্ছিন্ন জনপদ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের আধারে টানা কয়েকদিন এসব ঘটনা ঘটছে। ফলে বাড়িঘরে নারী ও শিশু ছাড়া আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পুরুষদের অনেকেই এলাকা ছাড়া। শুধু তাই নয়, ফের লুটপাটের আতঙ্কে চরের বাজারটিও এখন ফাঁকা। তবে বৃহস্পতিবার থেকে চরে পুলিশের অবস্থান দেখে পুরুষরা সেখানে ফিরে আসতে শুরু করেন।

হামলা, লুটপাট আর নির্যাতনের শিকার চরের নারীরাও তাদের মুখ খুলতে শুরু করেন। পুলিশের সামনে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে আর ভয়ভীতি দেখিয়ে কিভাবে তাদের নাজেহাল করা করেছে। এমন কি অন্য কোথাও যেন যোগাযোগ করতে না পারে, সেই জন্য তাদের মুঠোফোনগুলোও কেড়ে নেওয়া হয়।

ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আলী আহমেদ বকাউল অভিযোগ করেন, সন্ত্রাসীদের ভয়ে গত কয়েকদিন ধরে তাকেও পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। চরে পুলিশ এসেছে, এমন সংবাদ পেয়ে অজ্ঞাতস্থান থেকে তিনিও ছুটে আসেন। এসময় নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে সেই ভয়াবহ হামলার বর্ণনা দেন এই জনপ্রতিনিধি।

এদিকে, ঘটনার প্রতিকার চেয়ে অভিযুক্তদের শাস্তি দাবি করেছেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. হযরত আলী বেপারী।

অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার থেকে চরে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ফলে সেখানে নতুন করে আর কোনো ঘটনা না ঘটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন চাঁদপুর সদর মডেল থানার ওসি মো. নাসিমউদ্দিন।

তিনি আরো জানান, চরে খুন, ধর্ষণ এবং লুটপাটের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এদিকে রাজরাজেশ্বরের ঢালিকান্দি এবং রাজার চরের ওয়ার্ড সদস্য পারভেজ গাজী রনি, ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি শরাফত আলী গাজী এবং বিএনপি নেতা ওসমান গাজী।

অন্যদিকে, পাশের লক্ষ্মীরচরের নুর মোহাম্মদ বকাউল গোষ্ঠী। এই দুই পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে চরের আধিপত্য নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে যায়। ফলে তুচ্ছ যে কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত শুরু হয়ে যায়। যার জের ধরে নারীঘটিত একটি সালিশকে কেন্দ্র করে গাজী এবং বকাউল গোষ্ঠী প্রথমে মারামারিতে লিপ্ত হয়। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত নুর মোহাম্মদ বকাউল (৬০), লোকমান হোসেন গাজী (৫০)সহ আরো বেশ কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে গত ২৮ মে লোকমান হোসেন গাজী চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যুর সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে প্রতিপক্ষ বকাউল গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থকদের বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

অভিযোগ উঠেছে, গাজী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকা পারভেজ গাজী রনি ও তার সাঙ্গপাসঙ্গরা প্রতিপক্ষের ৪’শ গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। হামলা ও ভাঙচুর এবং লুটপাট করে শতাধিক বসতবাড়িতে। তার তিন সপ্তাহ পর লক্ষ্মীরচরে স্বামীর গলায় ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে দুই সন্তানের জননী এক গৃহবধূকে ৬ জনে মিলে ধর্ষণ করে। এসব ঘটনার পর পুরুষ শূন্য হয়ে যায় গোটা লক্ষ্মীরচর।

লোমহর্ষক এসব ঘটনা জানতে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য পারভেজ গাজী রনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মুঠোফোনে দরাজ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ আমি রনি বলছি’। সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা করি। আমি ঝামেলা করতে চাই না। সত্য কথা লেখেন। ‘আমি রনি বলছি’।

প্রসঙ্গত, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছাড়াও একই সঙ্গে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজেকে দাবি করছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত কয়েক বছর আগে চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন এলাকার একটি আবাসিক বোর্ডিংয়ে নারীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হন রনি। পরে জেলও খাটেন তিনি। নদীতে অবৈধভাবে জাটকা ধরাসহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এই রনির বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।

মামলার আসামি হলেও তিনি এবং তার আরো দুই ভাই সময় নিউজের প্রতিনিধিকে হুমকি ধমকি দিয়ে পেশাগত কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এসব বিষয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও জানানো হয়েছে।

সবশেষ তথ্য হচ্ছে, রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের চরের বাসিন্দাদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে এবং অপরাধীদের ধরতে পুলিশের সঙ্গে র‌্যাবও কাজ করছে।