রাধাপুকুর : যুবক অনার্য

আমাদের বাংলাভাষায় খুব পরিচিত
একটি গান আছে- ” তুমি ছাড়া আর কোনো কিছু ভালোলাগে না আমার ”
এই “তুমি” কে নরনারীর প্রেম বুঝানো হয়েছে – স্বভাবতই এরকম আমরা ধরে নেই।
বিষয়টি মোটা দাগে না রেখে যদি
একটু পেচিয়ে দেই তাহলে এই তুমি বহুমাত্রিক -যেমন: যার টাকার নেশা আছে তার কাছে টাকাটাই “তুমি” যার ক্ষমতার নেশা তার কাছে ক্ষমতাই “তুমি”।
এই পেচানো বিষয়টি সাধারণতভাবে
কবিতার সংগেই যায়, গানের সংগে
সম্ভবত যাচ্ছে না।

গানে বরং নরনারীর প্রেমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় কথিত ” তুমি”।

তবে সাবারই একটা “তুমি ” থাকে – যেমন : আমাদের কবিবন্ধু অপরাজিতা’র কবিতায় একজন “তুমি” থাকে । একবার তাকে বলেছিলাম : তুমিটাকে কেটে বাদ দিয়ে দিন। বোলে, নিজেই লজ্জা পেয়ে গেছিলাম। আরে কী অদ্ভুত কথাই না বলেছিলাম।!নিজস্ব তুমি ছাড়া নিজের অস্তিত্ব বিচিত্রভাবে টের পাওয়া সম্ভব নয়।

“তুমি”র জন্যই তো অনেকে মহৎ হয়ে ওঠে
যেমন :”তুমি” যদি হয় স্বদেশ আর স্বদেশ-কে ভালোবেসেই যখন একজন অবিনাশ যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ দেয় তখন সেই অবিনাশ মহৎ হয়ে ওঠে যেমন মহৎপ্রাণ আমাদের নূর হোসেন হয়ে আছেন চিরদিন – গণতন্ত্র ভালোবেসে।
আমি শুরু করেছিলাম বাংলা গান দিয়ে –
বস্তুত বাংলা ও হিন্দি ভাষায় যত সংখ্যক
ভালো গান আছে, সমগ্র পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষাতেই ততো সংখ্যক ভালো গান নেই।
উৎকৃষ্ট বা সহজবোধ্য উদাহরণ হতে পারেন
বব মারলে। তার ‘বাফেলো সোলজার’ এর বাইরে ভালো গানের সংখ্যা কি খুব বেশি?
তিনি গানে একটি নতুন জ’ ( genre)
সৃষ্টি করেছিলেন বটে কিন্তু সাঁইজি বা রবি ঠাকুরের ভালো গানের সংখ্যা মারলে-কে ছাড়িয়ে যাবে – যদি বলি- আমাকে সংগীতজ্ঞগণ – জানি –
-মুর্খ ব’লে তেড়ে আসবেন। আসুক।তবু আমি আমার বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে থেমে যেতে শিখি নি।এবং আরেকটু সাহস ক’রে বলেই ফেলছি যে বাংলা ভাষায় যে পরিমাণ দেশাত্নবোধক গান আছে অন্য কোনো ভাষাতেই
তা নেই, এমনকি হিন্দিতেও নয়।হবেই বা কেনো।অন্য কোনো ভাষার জন্যে কি মানুষ প্রাণ দিয়েছে?

আমি গান দিয়ে শুরু করে একটি ‘তুমি’ অভিমুখে এবাউট টার্ন নিয়ে মারলে সাঁইজি রবি ঠাকুর হ’য়ে দেশাত্নবোধকে এসে ল্যান্ড করার পর বুঝতে পারি – মনিষা, আমি আসলে এতদিনে তোমাকেই আমার ‘তুমি’ ক’রে ফেলেছিলাম আর সেই কথাটি
বলতে গিয়েই মিছেমিছি গানের আশ্রয় নিয়েছিলাম আর বব মারলে বেচারাকে সাইঁজি দিয়ে ঘায়েল করে দিয়েছিলাম।মানুষেরা ‘তুমি’র জন্য অনেক কিছুই তো করে।আমি না হয় এইটুকু করলাম।

কার কী এসে যায়!এমনকি,মনি,তোমারও যে
এসে যায় না- সে কথা আমার অজানা নয়। বলেছিলে একদিন আমায় তুমি শঙ্খ দেখাতে
নিয়ে যাবে তোমাদের রাধাপুকুরের বাগানবাড়ি।
এ কথায় আমি কি যে এক বোকার মতন ধরে নিয়েছিলাম- আমিও বুঝি তোমার কাছে তোমার ‘তুমি’ হয়ে গেছি।আজ পড়ন্ত এমন জীর্ণতা ঘেরা
চল্লিশোর্ধ কোটায় এসে বড্ড বেশি টের পাই-
শঙ্খ দেখাতে চাওয়া আর ‘তুমি’ হ’য়ে যাওয়া কখনো এক নয়।রাধাপুকুরে যাওয়া আর রাধার কাছে যাওয়া এক কখনো নয়!

এই যে চুড়ান্ত সত্য এক আবিষ্কার করে নিয়েছি এ কথা তোমাকে বোলবার উদ্দেশে
সেই রাধাপুকুরে যাবার কোনো অধিকার
আজ আর নেই।অথচ কী অদ্ভুত –
রাধাপুকুরে যাবার অধিকার আর রাধার কাছে যাবার অধিকার এক কখনো নয়!