শিবচরে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে, ইটভাটায় পোড়া শ্রমিকদের জীবন-সংগ্রাম

মাজহারুল ইসলাম রুবেল, শিবচর (মাদারীপুর) :

ফরিদ উদ্দিন পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার বড়। ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মাকে নিয়ে তার সংসার। জীবনের শুরুতে দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবনযাত্রা তার, শিক্ষা যেখানে ডুমুরের ফুল। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি তাকে নিয়ে যায় হাড়ভাঙা ইটভাটায়। নোয়াখালী জেলার মাইজদী উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে অগ্রিম দাদন হিসেবে মাত্র ২০ হাজার টাকায় ছয় মাসের চুক্তিতে ফরিদ উদ্দিন কাজ করতে এসেছেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার নানকরা মেসার্স মুন্সী ব্রিকস ফিল্ডে।

ইটের দাম হাজারে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা। প্রতিদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে এমন হাজার হাজার ইটের যারা যোগানদাতা তাদের পেটে জুটে দৈনিক মাত্র ৫ থেকে ৭শ টাকা। নিম্নমানের আবাসন ব্যবস্থা, নেই টয়লেটের কোন সুযোগ সুবিধা! তবুও পরিবারকে ভালো রাখতে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অন্নের জন্য পুঁজিতে লাগায় তাদের জীবন।

কেউ তৈরি করে মাটি, কেউ ইট, কেউবা ইট পুড়িয়ে ভাঁজ দেওয়ার কাজে। এভাবে তাদের তৈরি ইটে মালিকরা বছরে বছরে কোটিপতি হলেও বছরঘুরে এভাবেই কাজ করতে হয় তাদের। উপজেলায় প্রায় সব ইটভাটাতেই এমন চিত্র।

উপজেলার কাঁঠালবাড়ি এলাকার মেসার্স হাওলাদার ব্রিকস ফিল্ডের শ্রমিক হান্নান মল্লিক বলেন, আমরা ইটভাটায় মহাজনের মাধ্যমে কাজে আসি। মহাজনের কাছ থেকে দৈনিক ৫ থেকে ৭শ টাকা বেতন পাই। সেখান থেকে খাওয়া দাওয়া বাদে বাকিটা বাড়ি পাঠাই।

কোনো ধরনের অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসা করার টাকা পয়সাও দেয় না। নিজের খরচে চিকিৎসা করাতে হয়। টাকা চাইলে দিবে অগ্রিম দাদন হিসেবে। পরে মজুরি থেকে কর্তন করে নেয় মহাজনরা। অসুখের মধ্যে কাজে না আসলে মজুরি হয় না। এমনভাবেই কথা তুলে ধরেন মেসার্স হাওলাদার ব্রিকস ফিল্ডের শ্রমিক হান্নান মল্লিক।

অন্যদিকে প্রশাসনকে অবৈধ ইটভাটা গুঁড়ানোর অভিযান চালাতে দেখা গেলেও বৈধ ইটভাটাগুলোতে বাসস্থান, টয়লেট ব্যবস্থাসহ শ্রমিক সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে দেখভাল করতে দেখা যায়নি কখনো। সব ইটভাটাতেই বানানো হয়েছে খোলা টয়লেট। কারো টয়লেটের সংযোগ খালে কারওবা অন্যের কৃষি জমিতে। অথচ খোলা টয়লেট ব্যবহার নিষিদ্ধ।

ইটভাটাগুলির শ্রমিকদের খাওয়ার জন্য নেই কোন বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, খোলা টয়লেটের পাশাপাশি মানববর্জ্যগুলি আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকছে তা দেখার বালাই নেই। অথচ নিরাপদ খাবার পানি এবং মানববর্জ্য ও ব্যবহৃত পানি যথাযথ নিষ্কাশন সংক্রান্ত গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থাই হল স্যানিটেশন। মলমূত্রের সাথে মানুষের সংস্পর্শ রোধও স্যানিটেশনের একটি অংশ। স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্যই হল একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করা যাতে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।

ইটভাটাগুলির আসেপাশে বসবাসরত সচেতন মহলের দাবি, এলাকায় স্যানিটেশন প্রযুক্তির পদক্ষেপসমূহের বিস্তৃত পরিসর বিদ্যমান। এই পরিসরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন, টেকসই স্যানিটেশন, জরুরি স্যানিটারি ল্যাট্রিন, কন্টেইনার ভিত্তিক স্যানিটেশন, বাস্তুতান্ত্রিক স্যানিটেশন প্রভৃতি পদক্ষেপ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু শিবচরে স্যানিটেশন ব্যবস্থায় এই সেক্টরে সরকারি কিংবা বেসরকারি ভাবে কারো নজর ছিলোনা এখনও অবধি নেই।

এই বিষয়ে সাংবাদিক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, মানববর্জ্য এবং ব্যবহৃত পানিকে যে প্রক্রিয়ায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে কাজে লাগানো হয় তাকে ‘স্যানিটেশন ভ্যাল্যু চেইন’ বা ‘স্যানিটেশন ইকোনমি’ বলা হয়, কিন্তু গ্রামীন জবপদে এই প্রক্রিয়াটার দরকার না হওয়ায় ইটভাটা মালিকদের খরচও কমছে তবুও তারা শ্রমিকের জীবন নিয়ে না ভাবা মানে গুরতর মানবাধিকার লংঘন বলে ধরে নেয়া যায়।

পাচ্চঁর লাইফ কেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ মোঃ আরিফুজ্জামান বলেন, ইটভাটায় শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বেশি থাকে। অধিকাংশ ভাটায় ধোঁয়া রোধক মাস্ক (মুখোশ) ছাড়া কাজ করেন শ্রমিকরা। তাদের শরীরে ধূলাবালি অবাধে প্রবেশ করার সুযোগ পেলেও, তার প্রতিরোধে শ্রমিকদের অসচেতনতার পাশাপাশি, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে মালিক পক্ষের রয়েছে উদাসীনতা।

এদিকে উপজেলায় অবস্থিত ইটভাটাগুলিতে ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে দেখা মিলেছে শিশু শ্রমিকেরও। বিশেষ করে উপজেলার মেসার্স ওকেআর ব্রিকস ফিল্ডসহ কয়েকটি ব্রিকস ফিল্ডে শিশু শ্রমিকের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।

এই বিষয়ে মের্সাস ওকেআর ব্রিকস ফিল্ডে কাজ করা এক শিশুশ্রমিকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, মজুরি কম দেওয়া এবং নিয়মের বাইরেও ধমক দিয়ে অতিরিক্ত কাজ আদায় করার লোভেই মূলত শিশুদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। শিশুটি আরো বলেন, এখানে আমাদের মালিকের তেমন কোন খরচ না থাকলেও আমাদের মজুরি ঠিক ভাবে দেয়না।

অপরদিকে দেশের প্রচলিত আইনে শিশুশ্রম সরাসরি নিষিদ্ধইতো বটে কিশোরশ্রম আইনে বলা আছে, কিশোর শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কাজে নিয়োগ করতে হলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিটনেস সনদ নিতে হবে, যেটার খরচ বহন করতে হবে মালিককে। কিশোর শ্রমিকদের স্বাভাবিক কাজের সময় হবে ৫ ঘণ্টা। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না।

শিবচর উপজেলা সেনিটারি ইন্সপেক্টর মোঃ ফজলুল হককে কল করা হলে তিনি বলেন অবশ্যই এসব ইটভাটার মালিকদের আইনের আওতায় আনা হবে। এই বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রাজিবুল ইসলাম বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মাথায় দিয়েছেন। তার জন্য ধন্যবাদ। এই বিষয়ে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে।