অমানুষ : হুমায়ূন আহমেদ (১ম পর্ব)

মেয়েটির মধ্যে কিছু-একটা আছে
মেয়েটির মধ্যে কিছু-একটা আছে যা পুরুষদের অভিভূত করে দেয়। রূপের বাইরে অন্যকিছু।

অসামান্য রূপসী মেয়েদেরকেও প্রায় সময়ই বেশ সাধারণ মনে হয়। এই মেয়েটি সেরকম নয়। এবং সে নিজেও তা জানে।

মেয়েটির চোখ দুটি ছোট ছোট এবং বিশেষত্বহীন। গালের হাড় উঁচু হয়ে আছে। ছোট্ট কপাল কিন্তু তবু কী অদ্ভুত দেখতে! কী মোহময়ী!

তার পরনে সাধারণ কালো রঙের একটি লম্বা জামা। পিঠের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে মনে হয় মেয়েটির গায়ের রং ঈষৎ নীলাভ। দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে।

মেয়েটি প্রকাণ্ড জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে ছিল। তাকে দেখে বোঝায় উপায় নেই সে কিছু ভাবছে কি না। এইজাতীয় মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝা যায় না। এদের চোখ সাধারণত ভাবলেশহীন হয়ে থাকে।

মামণি!

মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অ্যানি এসে ঢুকেছে। অ্যানির পায়ে ঘাসের স্লিপার। চলাফেরা নিঃশব্দ।

অ্যানি

কী মামণি?

তোমাকে বলেছি না ঘরে ঢুকতে হলে জিজ্ঞেস করে ঢুকবে?

অ্যানি লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে মা’র দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি অবিকল মায়ের মতো দেখতে। শুধু চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল, আরো গম্ভীর।

অ্যানি, তুমি এগারোয় পড়েছ, এখন তোমার অনেক কিছু শিখতে হবে, ঠিক না?

জি, মা।

এখানে আমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকতে পারতাম? পারতাম না?

পারতে।

আমাদের অনেক ব্যাপার আছে যা তোমার দেখা বা শোনা উচিত নয়।

অ্যানির গাল লাল হয়ে উঠল। সে মায়ের দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না।

কিছু বলবার জন্যে এসেছিলে, অ্যানি?

হু

বলে ফ্যালো।

মা, ঘরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না। বড় একা একা লাগে। আমি আবার স্কুলে যেতে চাই।

তুমি তো একা থাকছ না, মিস মারিয়াটা আছেন। আছেন না?

মিস মারিয়াটাকে আমার ভালো লাগে না। মা, আমি স্কুলে যেতে চাই।

বললেই তো যেতে পারছ না। তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না হয়ে তোমাকে স্কুলে পাঠাব না। যাও, এখন শুয়ে পড়োগে।

অ্যানি তবুও দাঁড়িয়ে রইল। রুন বড় বিরক্ত হল। তার গলার স্বরে অবিশ্যি সেই বিরক্তি প্রকাশ পেল না।

অ্যানি, তুমি আরকিছু বলবে?

আমি স্কুলে যেতে চাই মা।

সেকথা তো আমি একবার শুনেছি। আবার বলছ কেন? যাও ঘুমুতে যাও। একই কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে না।

অ্যানি নিঃশব্দে চলে গেল। রুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল। তার মেয়েটি অসামান্য রূপসী হয়েছে। এরকম রূপবতীদের অনেকরকম ঝামেলার মধ্যে বড় হতে হয়। তার নিজের যখন মাত্র দশ বছর বয়স তখন তার মুখে রুমাল বেঁধে তাকে জোর করে…। না, এইসব নিয়ে তার এখন আর ভাবতে ভালো লাগে না। রুন অল্প খানিকটা মার্টিনি ঢেলে গ্লাস হাতে করে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখল ভিকির গাড়ি এসে ঢুকছে।

ভিকি ব্যবসার ব্যাপারে রোম গিয়েছিল। তার আরো দুদিন পরে ফেরার কথা। রুন অবিশ্যি মোটেই অবাক হল না। ভিকি প্রায়ই এরকম করে। অসময়ে এসে উপস্থিত হয়। রুনের বিষয়ে তার কিছু সন্দেহ আছে। অসময়ে এসে দেখতে চায় রুনের সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আছে কি না। রুন হাসিমুখে বলল, আগেই এসে পড়লে যে?

কাজ হয়নি তাই ফিরে এলাম।

ডিনার দিতে বলব?

ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, খেয়ে এসেছি। ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে রুন।

মার্টিনি তৈরি করে দেব? অলিভ আছে।

দাও।

মার্টিনির গ্লাসটি এক চুমুকে শেষ করল ভিকি। তার মানে সে কোনো-একটি বিষয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত। ব্যবসা নিয়ে? কিন্তু ব্যবসা তো তার অনেকদিন থেকেই খারাপ যাচ্ছে। এটা তো নতুন কিছু নয়।

রুন!

শুনছি, বলো।

বসো। সামনের চেয়ারটাতে বসো। তোমার সঙ্গে ঠাশ্ৰা মাথায় কিছু কথাবার্তা বলা দরকার। জরুরি।

রুন বসল না। আরেক গ্লাস মার্টিনি তৈরি করে পাশে এসে দাঁড়াল। ভিকি গম্ভীর স্বরে বলল, তোমাকে খরচ কমাতে হবে, রুন। অনেকটাই কমাতে হবে।

রুন খিলখিল করে হেসে উঠল।

হাসির কথা না। এই পেইন্টিংটি আমি রোমে যাবার পর কিনেছ তুমি। ওর দাম কত?

খুব সস্তা। নয় লক্ষ লিরা!

ভিকির মুখ পলকের জন্যে ছাই হয়ে গেল।

নয় লক্ষ লীরা!

হু। কার আঁকা দেখবে, মেসি! অদ্ভুত না? মোতিস এ-ছবি আর আঁকেনি। তোমার ভালো লাগছে না?

ভিকি বহু কষ্টে রাগ সামলাল! রেগে গেলে রুনের সঙ্গে তর্ক করা অসম্ভব। রুনকে বোঝাতে হবে। ঠান্ডা মাথায়, পরিষ্কার যুক্তি দিয়ে। রুন দয়া করে একটা জিনিস বুঝতে চেষ্টা করো। আমার অবস্থা ভালো না। খারাপ। খুবই খারাপ।

কীরকম খারাপ?

এ-বছরও লোকসান দিয়েছি। এদিকে ব্যাংকের কাছে বিরাট বড় দেনা।

কত বড়?

প্রায় এক কোটি লিরা।

রুন নিঃশব্দে হাসল। ভিকি ভেবে পেল না এই অবস্থায় এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেউ হাসে কী করে।

হাসছ কেন?

তোমার নার্ভাস অবস্থা দেখে।

বাস্তবকে বুঝতে শেখো, রুন। প্লিজ।

রুন হাসিমুখে সামনের চেয়ারটায় বসল। এমন অবস্থা তোমার হল কেমন করে? তোমাদের এতদিনের সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির হঠাৎ করে এমন ভগ্নদশা হল কেন?

ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, আমাদের মেশিনপত্র সমস্তই পুরনো। আমাদের নতুন স্পিনিং মেশিন কিনতে হবে। খরাটস জাতীয় মেশিন। নতুন মেশিন না বসালে আমরা হংকং-এর চীনাদের সঙ্গে পারব না। ওরা এখন অর্ধেক খরচে চমৎকার সিল্ক দিচ্ছে বাজারে।

কিনলেই হয় নতুন মেশিন।

টাকা পাব কোথায়? ব্যাংক থেকে লোন নিতে হবে। তার জন্যে গ্যারান্টি দরকার। সেজন্যেই বলছি খরচপত্র কমাও।

হংকং-এর চীনাদের জন্যে আমার জীবনযাত্রা বদলাতে হবে?

বদলাতে বলছি না, খরচপত্র কমাতে বলছি।

রুন উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ভিকি দেখল সে ক্লসেটের কাছে দাঁড়িয়ে কাপড় খুলে ফেলছে। ভিকি চোখ ফেরাতে পারছে না। যত দিন যাচ্ছে রুনের বয়স কমছে। রুন হালকা সুরে বলল, চলো, ঘুমুতে যাই।

বসো একটু। রাত বেশি হয়নি।

গায়ে কোনো কাপড় নেই অথচ কী সহজ ভঙ্গিতে রুন চলাফেরা করছে। ভিকি একটু চিন্তিত বোধ করল। রুন তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে চাইছে। নিশ্চয়ই কোনো-একটা কারণ আছে। কী হতে পারে সেটি? রুন একটি সিগারেট ধরিয়ে ভিকির সামনের চেয়ারটায় বসল। নরম স্বরে বলল, অ্যানি স্কুলে যেতে চাইছে।

যাক। যাওয়াই তো উচিত।

মেয়র‍্যানদের মেয়ের মতো ওকেও যদি কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, তখন?

ভিকি বিরক্ত হয়ে বলল, মেয়র‍্যানরা হচ্ছে ইতালির সবচে ধনী পরিবার। ওদের মেয়েদের কিডন্যাপ করে দুকোটি লিরা মুক্তিপণ চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার কী আছে?

রুন গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার যে কিছু নেই তা তো আর যারা কিডন্যাপ করে তারা জানে না। আমি নিজেও তো জানতাম না তোমার এই অবস্থা।

ভিকি একটি সিগারেট ধরাল। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। রুনের সঙ্গে তর্ক করতে হলে মাথা শান্ত রাখতে হয়। ভিকি ধীরস্বরে বলল, রুন, যারা কিডন্যাপিং করছে তারা মাফিয়ার লোকজন, তা তো জান?

জানি।

মাফিয়ার সমস্ত খোঁজখবর রাখে। কার কী অবস্থা তা তাদের অজানা নয়, বুঝতে পারছ? কাজেই তুমি নিশ্চিন্তে অ্যানিকে স্কুলে পাঠাতে পার।

রুন উঠে দাঁড়াল। কী চমৎকার একটি শরীর। কে বলবে এই মেয়েটির বয়স চল্লিশ? সিলিঙের নরম আলো যেন ঠিকরে পড়ছে তার গায়ে। জলকন্যার মতো লাগছে। রুন গম্ভীর গলায় বলল, সুইজারল্যান্ডে একটি চমৎকার স্কুল আছে। জেনেভার কাছে। অনেক ইতালিয়ান ছেলেমেয়ে সেখানে পড়ে। আমি অ্যানিকে সেই স্কুলে দিতে চাই। টেয়ারদের ছোট মেয়েটি ভরতি হয়েছে সেখানে। চমৎকার স্কুল।

ভিকি স্তম্ভিত হয়ে গেল। এসব কী বলছে সে! দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলল, আসল জিনিসটাই তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা টাকা নেই। মেয়েকে সুইজারল্যান্ডে রেখে পড়ানো আমায় সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া অ্যানিরও ভালো লাগবে না। এত দূরে সে একা একা থাকতে পারবে না।

একা একা থাকবে কেন? আমিও থাকব। একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করব জেনেভার কাছে। তুমি হপ্তায় হপ্তায় এসে দেখে যাবে। প্লেনে মাত্র একঘণ্টা লাগে।

এতক্ষণ আমি কী বলেছি তা তুমি বুঝতে চেষ্টা পর্যন্ত করনি রুন। টাকা কোথায় আমার?

রুন পা দোলাতে দোলাতে বলল, এখানকার বাড়িটা বিক্রি করে ফ্যালো। এত সুন্দর বাড়ি, প্রচুর দাম পাবে। সেই টাকার অর্ধেক দিয়ে জেনেভায় একটা বাড়ি কেনা যায়।

ভিকি থেমে থেমে বলল, আমার এই বাড়িটাও ব্যাংকের কাছে মর্টগেজড। আমার ধারণা ছিল তুমি তা জান।

রুন উত্তর দিল না। উঠে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ভিকি বলল, অ্যানিকে মিলানের স্কুলেই যেতে হবে। এই হচ্ছে শেষ কথা।

বেশ, সে যাবে মিলানের স্কুলে। তুমি তার নিরাপত্নার ব্যবস্থা করো। নিরাপত্তার ব্যবস্থা–তার মানে?

ওর একটা বডিগার্ড রেখে দাও। এখন তো সবারই আছে। নিখমুদের দুমেয়ের জন্যেই বডিগার্ড আছে।

রুন, তুমি কি জান কত খরচের ব্যাপার সেসব?

আমি জানি না। জানতে চাই না। তুমি যদি অ্যানির বডিগার্ডের ব্যবস্থা না কর তা হলে ওকে আমি সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাব।

রুন, বডিগার্ড রাখা মানেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সবাই ভাববে, ওদের অনেক টাকাপয়সা।

রুন হাসিমুখে বলল, ভাবলে অসুবিধে কী?

রুন প্লিজ একটা জিনিস দ্যাখো। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ইতালিতে স্কুলে যায় যাদের বাবা-মা আমাদের চেয়ে অনেক ধনী, কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে কোনো বডিগার্ড নেই।

না থাকুক। আমার কিছুই যায় আসে না। ওরা তো আর আমার ছেলেমেয়ে না।

আমার অসুবিধেটা তুমি দেখছ না। একটা বাড়তি খরচ। শুধুশুধু একটা ঝামেলা।

রুন দৃঢ়স্বরে বলল, আজকাল সব ছেলেমেয়ের জন্যে বডিগার্ড আছে। এরেডোসের আছে, টুরেল্লার আছে, এমনকি কেয়োলিনদের পর্যন্ত আছে।

ভিকি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। বডিগার্ড একটি মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দামি একটা গয়নার মতো। রুন ভিকির গলা জড়িয়ে ধরল, তুমি একবার এতরার সঙ্গে কথা বলো। সে নিশ্চয়ই তোমার টাকাপয়সার ঝামেলা মেটাবার ব্যাপারে সাহায্য করবে। ও তো অনেককেই বুদ্ধি দেয়।

ভিকি উত্তর দিল না। রুনের এই দূরসম্পর্কের ভাইটিকে সে সহ্য করতে পারে না। তার ধারণা, রুনের সঙ্গে ঐ ভাইটির গোপন মেলামেশা আছে। এই ভাইটির কথা উঠলেই রুনের মধ্যে একটা গদগদ ভাব দেখা যায়। রুন আরেকবার বলল, বুঝলে ভিকি, তুমি এতরার সঙ্গে কথা বলো। সে তোমাকে চমৎকার বুদ্ধি বাতলাবে।

রুন এসে ভিকির কোলে বসে পড়ল। গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আর গম্ভীর হয়ে থাকার দরকার নেই। হাসো এবার।

ভিকি হাসতে পারল না। টেনে টেনে বলল, বডিগার্ডের ব্যাপারটি নিয়ে তুমি কি এতরার সঙ্গে কথা বলেছ?

উহু

ভিকির মনে ক্ষীণ একটা আশা হল। যদি এতরাকে দিয়ে রুনকে বোঝানো যায় তা হলে হয়তো কাজ হবে। এতরা যদি বলে বডিগার্ড রাখার ব্যাপারটি হাস্যকর তা হলে রুন নিশ্চয়ই শুনবে। ভিকি এটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

০২.

অ্যানির ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।

সে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিচে নেমে এল। কী আশ্চর্য, বাগানে বেতের চেয়ারে বাবা বসে আছেন। সে চেঁচিয়ে ডাকল, বাবা।

কীরে বেটি? এত সকালে ঘুম ভেঙেছে?

হু।

ভালো ঘুম হয়নি রাতে?

না। দুঃস্বপ্ন দেখেছি বাবা।

কী দেখেছিস?

অ্যানি জবাব দিল না। ভিকি মেয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, দেখেছিস একটা প্রকাণ্ড দৈত্য তাড়া করছে। তাই না?

অ্যানি হাসল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। সে যে-দুঃস্বপ্ন দেখেছে সেরকম দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলা যায় না। নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে হয়; সবচে প্রিয় যে বান্ধবী তাকেও বলা যায় না।

অ্যানির একটু মন-খারাপ হল। তার যত বয়স বাড়ছে ততই গোপন জিনিসের সংখ্যা বাড়ছে। যেমন এতরা চাচার কথাই ধরা যাক। ইদানীং এতরা চাচা তাকে দেখলেই আদর করার ছলে জড়িয়ে ধরেন। মুখে কী মিষ্টি মিষ্টি কথা, আরে আমাদের অ্যানির মনটা খারাপ কেন? কী হয়েছে আমাদের অ্যানির?

অ্যানি পরিষ্কার বুঝতে পারে এ সবই হচ্ছে ভান! এতরা চাচাকে এখন আর একটুও ভালো লাগে না। সেদিন এসে মাকে বলল, ওয়াল্ট ডিজনির একটা মুভি হচ্ছে, অ্যানিকে দেখিয়ে আনব বলে ভাবছি।

মা মহাখুশি। হাসতে হাসতে বলল, বেশ হয়। বেচারি একা একা থাকে। নিয়ে যাও।

অ্যানি বলল, সে যাবে না। তার মুভি দেখতে ভালো লাগে না। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি যেতে হল। মায়ের অবাধ্য হওয়ার সাহস তার নেই।

মুভিহল অন্ধকার হতেই এতরা চাচা তার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। অ্যানি স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ করল মাঝে মাঝে সেই হাত নিচে নেমে যাচ্ছে। এইসব কথা কাকে বলবে সে? মাকে? মা নিশ্চয়ই উলটো তার ওপর রাগ করবেন। কারণ এতরা চাচাকে মা খুব পছন্দ করেন। এটাও অ্যানির ভালো লাগে না। এতরা চাচা সময়ে অসময়ে আসে বাড়িতে। মা তাকে নিয়ে দক্ষিণে গেস্টহাউসে চলে যান। গেস্ট হাউসে গিয়ে দরজা বন্ধ করার কী মানে? এমন কী কথা তার সঙ্গে যা দরজা বন্ধ করে বলতে হয়?

ভিকি দেখল অ্যানি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সে হালকা স্বরে বলল, আমার মামণি এত গম্ভীর কেন?

অ্যানি চাপাস্বরে বলল, এখানে চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না বাবা। আমি স্কুলে যেতে চাই।

খুব শিগ্‌গিরই যাবে মা।

কবে?

তোমার মা চাচ্ছেন তোমার জন্যে একজন বডিগার্ড রাখতে। এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। যদি না রাখলে চলে তা হলে তুমি এই হপ্তা থেকে যেতে পারবে। আর যদি রাখতে হয় তা হলে একটু দেরি হবে।

অ্যানি মুখ উজ্জ্বল করে বলল, বডিগার্ড রাখলে খুব মজা হবে বাবা।

মজা কিসের?

ঐ লোকটি কেমন বন্দুক-টন্দুক হাতে নিয়ে থাকবে। ভাবতেই আমার মজা লাগছে, বাবা।

মামণি, এর মধ্যে মজার কিছু নেই। সমস্ত ব্যাপারটি হাস্যকর। খুবই হাস্যকর।

আমার কাছে তো বেশ লাগছে বাবা। ভিকি কিছু বলল না। অ্যানি বলল, তুমি কি চা খাবে? চা আনব তোমার জন্যে?

চা বানাতে পার তুমি?

হুঁ, খুব পারি।

বেশ তো, খাওয়া যাক এক কাপ চা।

অ্যানি হাসিমুখে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। ভিকির একটু মন-খারাপ হল। অ্যানি এখানে খুব নিঃসঙ্গ। ভিকি তাকে সময় দিতে পারে না। রুনও পারে না। মেয়েটির কোনো সঙ্গীসাথি নেই।

চা ভালো হয়েছে বাবা?

চমৎকার হয়েছে।

মনে হচ্ছে একটু বেশি কড়া হয়েছে।

আমার কড়া চা পছন্দ।

অ্যানি হাসিমুখে বলল, আমি যদি বলতাম চা বেশি হালকা হয়েছে তা হলে তুমি বলতে আমার হালকা চা পছন্দ–ঠিক না বাবা?

তা ঠিক। ভিকি, অ্যানি দুজনেই গলা ছেড়ে হেসে উঠল।

.

রেস্টুরেন্টটি ছোট কিন্তু শহরের নামী রেস্টুরেন্টগুলির মধ্যে এটি একটি। এতরা ইতালি শহরে সবচে ভালো প্রসকিউটু (কচি বছরের গোশত) রান্না করে–এ ধরনের একটা কথা চালু আছে। ভিকি প্রসকিঊটু পছন্দ করে না, কিন্তু তবু এখানে এসেছে। কারণ এ রেস্টুরেন্টটি এতরার খুব প্রিয়, সে প্রায় রোজই এখানে লাঞ্চ খেতে আসে।

ভিকি বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকবার পর এতরা এসে উপস্থিত। চমৎকার একটা নীল রঙের শার্টের উপর হালকা গোলাপি একটা টাই পরেছে এতরা। কে বলবে এই লোকটির বয়স চল্লিশের ওপর।

দেরি করে ফেললাম নাকি, ভিকি?

না, খুব দেরি না।

লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছ?

এখনও দিইনি। কী খেতে চাও তুমি?

এতরা হাসিমুখে বলল, আমরা বাধা মেনু ভিটেলো টনাটু, প্রসকিউটু এবং এক বোতল বারগুল্ডি।

বারগুভির গ্লাসে চুমুক দিয়ে এতরা ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, এখন বলো, তোমার সমস্যাটা কী?

ভিকি ইতস্তত করতে লাগল। নিজের সমস্যা অন্যের কাছে বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এতরার যত দোষই থাকুক, ওর মাথাটা খুব পরিষ্কার। তা ছাড়া, ওর ভালো কানেকশন আছে। প্রচুর লোকজনের সঙ্গে ওর চেনাজানা।

কী ব্যাপার, চুপ করে আছ যে? বলো।

তুমি বোধহয় জান না আমার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে।

ঠিক জানি না বললে ভুল হবে। তবে কতটা খারাপ তা জানি না।

বেশ খারাপ।

এত খারাপ হল কী করে?

ভিকি জবাব দিল না।

এতরা বলল, আমার কাছে ঠিক কী পরামর্শ তুমি চাও?

আমার যা দরকার তা হচ্ছে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা

মোটা অঙ্কের টাকা জোগাড় করা তোমার জন্যে কঠিন হবার কথা নয়। তোমার স্ত্রীর প্রচুর টাকা আছে।

আমি ওর কাছে হাত পাততে চাই না।

বুঝলাম। স্ত্রীর কাছে হাত না পাতাই ভালো, তাতে দাম কমে যায়।

এতরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি ব্যাংকে চেষ্টা করেছ? তোমার যা নামডাক তাতে ব্যাংক থেকে সহজেই মোটা টাকা লোন পাবে। ভরাডুবি না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক তোমাকে টাকা দেবে। তুমিও সেটা জান, জান না?

ভিকি উত্তর দিল না। এতরা বলল, তুমি কি চেষ্টা করেছ?

বিশেষভাবে করিনি।

তা হলে করো। টাকার সমস্যা কোনো সমস্যা নয়। অন্তত তোমার জন্যে নয়। তুমি চাইলে আমি দুএকজন ব্যাংকারের সাথে কথা বলতে পারি। অবিশ্যি আমি তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। তোমাকে সবাই চেনে।

আমাকে না। আমার বাবাকে চেনে।

একই কথা। তোমার বাবাকে চিনলেই তোমাকে চেনা হয়। এখন বলো, তোমার আসল প্রবলেম কী? তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তোমার মনে আরোকিছু আছে।

ভিকি আরেকটা বারগুরি অর্ডার দিয়ে চুপ করে রইল। যেন ভাবছে সমস্যাটি বলা ঠিক হবে কি না?

চুপ করে আছ কেন, বলে ফ্যালো।

ভিকি দীর্ঘ সময় নিয়ে বডিগার্ডসংক্রান্ত সমসাটি বলল। এতরা হাসিহাসি মুখে শুনল। তার ভাব দেখে মনে হল, সে খুব মজা পাচ্ছে। ভিকি বলল, এখন বলো, আমার কী করা উচিত।

একটা বডিগার্ড রাখো। এই একমাত্র সমাধান।

ভিকি বড় বিরক্ত হল। এতরা এই কথা বলবে সে ভাবেনি। তার ধারণা ছিল বডিগার্ড রাখার হাস্যকর দিকটি এতরার চোখে পড়বে। এতরা একটি সিগারেট ধরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, বডিগার্ডের ব্যাপারটি এখন রুনের একটি প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুনকে আমি যতটুকু জানি তাতে মনে হচ্ছে বডিগার্ড না রাখা পর্যন্ত সে শান্ত হবে না। একজন বুদ্ধিমান স্বামীর প্রধান কাজ হচ্ছে স্ত্রীকে শান্ত রাখা।

কিন্তু এত টাকা আমি পাব কোথায়?

রীতিমতো প্রফেশনাল লোক রাখলে অনেক টাকা লাগবে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু তোমার তো আর প্রথম সারির লোকের প্রয়োজন নেই, ঠিক না?

ঠিক।

কাজেই কোনোরকম একজন কাউকে কয়েক মাসের জন্যে রেখে দাও। রুন শান্ত হলেই ছাড়িয়ে দাও, ব্যস চুকে গেল।

এরকম লোক কোথায় পাওয়া যায়?

এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলেই পাওয়া যাবে। আমার ওপর ছেড়ে যাও। আমি জোগাড় করে দেব। আগামী হপ্তায় তুমি তোমার বডিগার্ড পাবে। ঠিক আছে?

ভিকি কিছু বলল না। এতরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আর কোনো সমস্যা আছে? থাকলে বলে ফেলো।

না, আরকিছু নেই।

তা হলে এই কথা রইল। সোমবার তুমি বডিগার্ড পাবে। এখন তা হলে উঠি। চমৎকার লাঞ্চের জন্যে ধন্যবাদ। আর শোনো ভিকি, তুমি মুখ এমন হাঁড়ির মতো করে রাখবে না। একটু হাসো। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি গভীর সমুদ্রে পড়েছ।

এতরা বেরিয়ে গেল। ভিকি নিজের মনে বলল, আমি গভীর সমুদ্রেই পড়েছি। অতলান্তিক জলে।

.

এতরা তার কথা রাখল। হপ্তা শেষ হবার আগেই একজন বিদেশী মানুষ এসে হাজির।

তোমার সঙ্গে বন্দুক আছে?

হ্যাঁ।

দেখাতে পার?

লোকটি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ছোট রিভলভার বের করল। ভিকি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল সেটার দিকে।

কী নাম এটির?

বেরেটা ৪৮।

ভিকি শিশুর মতো আগ্রহে রিভলবারটি হাতে তুলে নিল। কী সুন্দর। ছিমছাম! ছোট্ট একটি জিনিস।

এর লাইসেন্স আছে?

আছে।

এর মধ্যে কি গুলি ভরা আছে?

আছে।

তুমি এইজাতীয় রিভলভার আগে ব্যবহার করেছ?

করেছি।

কী সর্বনাশ! তুমি আগে বলবে তো?

ভিকি সাবধানে রিভলভারটি নামিয়ে রাখল। শুকনো গলায় বলল, তোমার কাগজপত্র কী আছে দেখি।

লোকটি কাগজপত্রের একটা চামড়া-বাঁধানো ফাইল নামিয়ে রাখল। ভিকি প্রথমবারের মতো পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল লোকটির দিকে।

লোকটি ইতালিয়ান নয়। বিদেশী। গায়ের চামড়া কালো। পুরু ঠোঁট। বড় বড় চোখ। অদ্ভুত একধরনের কাঠিন্য আছে। কোথায় সে কাঠিন্যটি তা ধরা যাচ্ছে না। ভিকি নিচুস্বরে বলল, তুমি কি কখনো মানুষ মেরেছ?

হা।

ভিকির গা শিরশির করে উঠল।

কতজন মানুষ মেরেছ?

এর উত্তর জানা কি সত্যি প্রয়োজন?

না-না, উত্তর না দিলেও হবে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

ভিকি ফাইল খুলল। নাম : জামশেদ হোসেন। বয়স : ৫৫

ভিকি অনেকক্ষণ নামটির দিকে তাকিয়ে রইল। কী অদ্ভুত নাম।

তোমার দেশ কোথায়?

ফাইলে লেখা আছে। ফাইল খুললেই পাবে।

হ্যাঁ লেখা আছে ফাইলে। পরিষ্কার সব লেখা। লোকটি কথাবার্তা বেশি বলতে চায় না। এটা ভালো। বডিগার্ড এরকমই হওয়া উচিত। ভিকি পড়তে শুরু করল।

জাতীয়তা : বাংলাদেশী।

সেটি আবার কোন দেশ?

ইন্ডিয়া ও বার্মার মাঝামাঝি ছোট্ট একটা দেশ।

তোমার পাসপোর্ট আছে? ইতালিতে যে আছ তার কাগজপত্র আছে?

আছে।

কী ধরনের কাগজপত্র

লোকটি গম্ভীর স্বরে বলল, আমি ফ্রেঞ্চ লিজিওনে দীর্ঘদিন ছিলাম। তারপর কিছুদিন ছিলাম ইতালিয়ানদের সঙ্গে জিরাল্ডায়, আলজিয়ার্সে। আমার কাগজপত্র সেই সূত্রে পাওয়া।

ভিকি অবাক হয়ে বলল, আলজিয়ার্সে কিসে ছিলে?

ফার্স্ট প্যারাট্রপ রেজিমেন্টে।

বল কী! তুমি বাংলাদেশের লোক হয়ে লিজিওনে ঢুকলে কী করে?

লোকটি জবাব দিল না। ভিকি বলল, লিজিওনে ঢোকার আগে তুমি কোথায় ছিলে?

অনেক জায়গায় ছিলাম। আমি একজন ভাড়াটে সৈনিক, মিঃ ভিকি। যে পয়সা দিয়েছে আমি তার জন্যেই যুদ্ধ করেছি। আমি কোথায় ছিলাম, কী ছিলাম সেসব জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমাকে যদি তোমার পছন্দ হয় তা হলে রাখতে পার। পছন্দ না হলে বিদেয় হব।

ভিকি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। এতরা এই লোকটিকে পাঠিয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে ঠিক লোক পাঠায়নি। অবস্থা যা তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই লোক খাঁটি পেশাদার লোক।

ভিকি নিঃশব্দে কাগজপত্র পড়তে লাগল।

অসাধারণ লিজিওনারি হিসেবে তাকে পরপর দুবার অর্ডার অব ভেলর দেয়া হয়।

ভিকি বড়ই অবাক হল। এতরা এই লোকটিকে পাঠানোর আগে আরো দুজনকে পাঠিয়েছিল। ভিকি তাদের সঙ্গে একটি কথা বলেই বিদেয় করে দিয়েছে। সে দুজন রাস্তার গুল্ডা ছাড়া কিছুই না। কেউ জীবনে কখনো বন্দুক ধরেছে কি না সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে। বডিগার্ড হিসেবে ওদের রাখলে রুন রেগে আগুন হত, বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই লোকটি অদ্ভুত। ভিকি বলল, তুমি কি কফি খাবে?

না।

খাও-না! খাও। ভালো কফি।

লোকটি চুপ করে রইল। ভিকি কফি আনতে বলে নিচুস্বরে জানাল, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু একটি কথার জবাব দাও। এত কম টাকায় তুমি কাজ করতে রাজি হচ্ছ কেন?

লোকটি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, মিঃ ভিকি, আমি একজন অ্যালকোহলিক। বডিগার্ড হিসেবে আমার কোনোই মূল্য নেই এখন। বয়স হয়েছে। শরীর নষ্ট হয়ে গেছে।

ভিকি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

মিঃ এতরা আমাকে বলেছেন তোমার যেনতেন একজন লোক হলেই চলে। প্রফেশনাল লাগবে না।

তা ঠিক। আসলে আমার স্ত্রীর চাপে পড়েই একজন বডিগার্ড রাখতে হচ্ছে। আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করার কোনো কারণ নেই। স্ত্রীদের চাপে পড়ে আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। ভালো কথা, তুমি কি বিবাহিত।

না।

ভালো, খুব ভালো।

লোকটি নিঃশব্দে কফি খেয়ে যাচ্ছে। ভিকি বলল, ইয়ে, তুকি কি বড়রকমের অ্যালকোহলিক?

না।

মাতাল হয়ে যাও?

না।

আরেকটি কথা তোমাকে বলা দরকার। এমন হতে পারে যে তিনমাস পর তোমাক আমার দরকার হবে না। এতরা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে সেটা?

হ্যাঁ, বলেছে।

আরেকটি কথা। তোমাকে রাখব কি না সেটি নির্ভর করছে আমার স্ত্রীর ওপর। বুঝতেই পারছ, ওর জন্যেই তোমাকে রাখা।

বুঝতে পারছি।

চলো, আমার স্ত্রী সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। অবিশ্যি তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমার নামটি যেন কী?

জামশেদ। জামশেদ হোসেন।

অদ্ভুত নাম। এর অর্থ কী?

আমার জানা নাই।

রুন অবাক হয়ে বিদেশী লোকটির দিকে তাকাল। লম্বা। রোগা। একটু যেন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল সাদা-কালো, ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। পরনে কালো রঙের একটি জ্যাকেট, জ্যাকেটের মাঝখানের বোতামটি নেই তবে জ্যাকেট এবং ট্রাইজার দুটিই বেশ পরিষ্কার। রুন কঠিন স্বরে বলল, তুমি তো ইতালিয়ান নও।

না।

ভিকি বলল, ইতালিয়ান না হলেও চমৎকার ইতালিয়ান বলতে পারে।

রুন বলল, তোমর বয়সও অনেক বেশি!

হ্যাঁ, পঞ্চান্ন।

ভিকি হড়বড় করে বলল, বয়স হলেও এই লাইনে সে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কাগজপত্র দেখলেই বুঝবে। আজকাল এই লাইনে অভিজ্ঞ লোক পাওয়া খুব মুশকিল।

রুন বলল, তোমার দেশ কোথায়?

বাংলাদেশ।

সেটি আবার কোথায়?

উত্তর দিল ভিকি, বার্মা এবং ইন্ডিয়ার মাঝামাঝি একটি ছোট্ট দেশ।

রুন, তুমি বরং মিঃ জামশেদের কাগজপত্রগুলো দ্যাখো।

রুন বলল, তুমি কি আজ থেকে কাজে লাগতে পারবে?

হ্যাঁ।

দোতলার একটি ঘরে তুমি থাকবে। অ্যানিকে স্কুলে নিয়ে যাবে এবং ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। তোমার সাঙ্গে বন্দুক আছে?

আছে।

এসো, তোমাকে ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।

রুন বেরিয়ে গেল। জামশেদ গেল তার পিছুপিছু। ভিকি সোফায় বসে ঘামতে লাগল। রুন ফিরে এসে একটা ঝগড়া বাধাবে, জানা কথা। এসেই চিৎকার শুরু করবে,

এই বুড়ো হাবড়াকে কোত্থেকে ধরে এনেছ?

কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। রুন ফিরে এসে শান্তস্বরে বলল, লোকটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে …

তবে কী?

লোকটির দিকে তাকালে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।

বিদেশী লোক, তাই।

না, তা নয়। অন্য একধরনের অস্বস্তি। অস্বস্তি ঠিক না, ভয় বলতে পার।

ভিকি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য, ভয় লাগবে কেন?

জানি না কেন। শুধু মনে হচ্ছিল একটা পেশাদার খুনি। কত লোককে যে মেরেছে কে জানে!

ভিকি চুপ করে রইল। রুন বলল, লোকটির চোখ দেখেছ। পাথরের তৈরি বলে মনে হয়। ঠিক না?

আমি বুঝতে পারছি না কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি!

ওর মনে দয়ামায়া রহম বলে কিছু নেই।

এরকম লোকই তো তুমি চেয়েছিলে, রুন।

রুন চিন্তিত মুখে বলল, তা অবিশ্যি ঠিক।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ভিকি। বড় ঝামেলা চুকেছে। মাস দুএক পর বিদেয় দিলেই হবে। এই টাইপের লোকদের নিজের ঘরে রাখা ঠিক না। তা ছাড়া বিদেশী লোক। বিদেশীদের বিশ্বাস করতে নেই।

মিস মারিয়াটা
মিস মারিয়াটা, আমাদের ঘরে যে নতুন একজন মানুষ এসেছে তাকে তুমি দেখেছ?

না।

আমিও দেখিনি। সে কিন্তু বিদেশী, মিস মারিয়াটা।

তুমি পড়ায় মন দিচ্ছ না অ্যানি।

আজকে আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছা না করলেও পড়তে হবে।

অ্যানিকে অ্যালজেব্রার বই খুলতে হল। সে দুতিনটা অঙ্ক শেষ করেই বলল, মিস মারিয়াটা, ঐ বিদেশী কিন্তু ভয়ংকর লোক। ফটফট গুলি করে মানুষ মারে।

মানুষ মারা যদি তার কাজ হয় তা হলে তো মারবেই। সবাই তার নিজের কাজ করতে হয়। ঠিক না?

হ্যাঁ ঠিক। ওর কাজ কিন্তু মানুষ মারা না। ওর কাজ হচ্ছে আমাকে দুষ্ট লোকের হাত থেকে রক্ষা করা। সেরকম কোনো লোক দেখলেই সে একেবারে শেষ করে দেবে। দ্রুম দ্রুম।

মিস মারিয়াটার মধ্যে কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। সে আবার পড়াতে শুরু করল। অ্যানি ছাড়া পেল সন্ধ্যার আগে-আগে। এবং ছাড়া পাওয়ামাত্র ছুটে গেল দোতলায়। লোকটির ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়েও অ্যানি কিছুই শুনল না। লোকটি অসময়ে ঘুমুচ্ছে নাকি অ্যানি দরজায় টোকা দিতেই ভারী গলায় লোকটি কথা বলল, কে

আমি কি তোমার ঘরে আসতে পারি?

খুট করে দরজা খুলে গেল।

আমার নাম অ্যানি।

কোনো উত্তর নেই। লোকটি তাকিয়ে আছে শুধু।

আমি কি তোমার ঘরে একা বসতে পারি?

লোকটি দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।

অ্যানি হাসিমুখে বলল, তোমাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। আমার কথা বলার লোক নেই।

লোকটি ভারীস্বরে বলল, বাচ্চাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না। বাচ্চাদের আমি পছন্দ করি না।

অ্যানি স্তম্ভিত হয়ে গেল। থেমে থেমে বলল, আমি বাচ্চা নই। আমার এপ্রিল মাসে বারো হবে।

লোকটি কথা বলল না। অ্যানি বলল, আমি যদি কিছুক্ষণ তোমার ঘরে বসি তা হলে কি তুমি বিরক্ত হবে?

হ্যাঁ।

অ্যানির চোখে প্রায় জল এসে পড়ছে। সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলাল। লোকটি মৃদুস্বরে বলল, একটি জিনিস তোমাকে বুঝতে হবে, অ্যানি। আমি নতুন কেনা কোনো খেলনা না। আমাকে রাখা হয়েছে তোমার নিরাপত্তার জন্যে, এইটুকুই আমি দেখব, এর বেশি না। যদি এ জিনিসটি পরিষ্কার বুঝতে পার তা হলে তা তোমার জন্যেও ভালো আমার জন্যেও ভালো।

অ্যানি ধরাগলায় বলল, তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছ?

হ্যাঁ।

অ্যানির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।

রুন এসে ঢুকল তার কিছুক্ষণ পর। সে ইতস্তত করে বলল, অ্যানি খুব কাঁদছে।

লোকটি জবাব দিল না। রুন বলল, আমার এই মেয়েটি খুব সেনসেটিভ, ওর সঙ্গে ভাব করতে হবে খুব ধীরে ধীরে। একবার ভাব হলেই বুঝবে খুব মিষ্টি মেয়ে ও।

মিসেস রুন, আমি তোমার মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে আসিনি। ওসব আমি পারি না। আমার দ্বারা ওসব হয় না।

ও।

তোমরা যে-কাজের জন্যে আমাকে রেখেছে সে-কাজ আমি ঠিকমতো করতে চেষ্টা করব, এর বেশি আমার কাছে কিছু আশা করবে না।

রুন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু লোকটি আর কথা বলল না। রুন ভাবল এই বিদেশী লোকটিকে রাখা হয়তো ঠিক হয়নি।

মিস মারিয়াটাও একই কথা বলল, বিদেশীদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, মিসেস রুন।

মিস মারিয়াটার অবিশ্যি সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সে গলা খাদে নামিয়ে বলেই ফেলল, কোনো একদিন হয়তো দেখা যাবে এই লোকই আপনাদের গুলি করে মেরে রেখে পালিয়েছে।

রুন বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমাদের মারবে কেন?

মিসেন রুন, ওদের কোনো কারণ-টারন লাগে না, ওরা হচ্ছে বর্ন কিলার। ওরা স্বাভাবিক মানুষ না, মিসেস রুন।

কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। ভাড়াটে সৈনিকরা অস্বাভাবিক মানুষ তা বলাই বাহুল্য। বন্য পশুর মতো জীবন কাটিয়ে হঠাৎ করে কেউ পোষ মানে না। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে।

মিসেস রুন, লোকটাকে বিদেয় করে দিন।

দেখা যাবে কী করা যায়। আমার কাছে তেমন কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না।

ভালোও তো মনে হচ্ছে না, ঠিক না?

রুনের মনে একটি কাঁটা বিঁধে রইল। অস্পষ্ট সন্দেহের একটি তীক্ষ্ণ কাঁটা।

.

হ্যালো, রুন?

হ্যাঁ।

আমি এতরা।

হ্যালো, এতরা।

নতুন বডিগার্ড কি কাজ শুরু করেছে।

হ্যাঁ, করেছে।

পছন্দ হয়েছে তোমার?

রুন জবাব দিল না।

এতরা বলল বললো, জবাব দিচ্ছ না কেন?

রুন ইতস্তত করে বলল, ভালোই তো।

অ্যানির পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ হওয়াহওয়ির কী আছে? বডিগার্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? স্কুলে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। ব্যস।

এতরা গলার স্বর একধাপ নামিয়ে ফেলল, শোনো, একটা প্রবলেম হয়েছে।

কী প্রবলেম?

আমি এজেন্সিতে খোঁজ নিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছে লোকটিকে রাখা ঠিক হবে না।

কেন?

ও একজন ডেঞ্জারাস লোক। আগে বুঝতে পারিনি।

রুন শান্তস্বরে বলল, এরকম কাজের জন্যে তো ডেঞ্জারাস লোকই দরকার।

তা দরকার, তবু আমার মনে হচ্ছে একে ছাড়িয়ে দেয়া ভালো। আমি সন্ধ্যাবেলা এসে আলাপ করব। তুমি থাকছ তো?

হ্যাঁ, সেও থাকবে।

এতরার মনে হল রুন খানিকটা নিরাশ হল।

আচ্ছা, আমি আসব সন্ধ্যায়।

.

লাঞ্চের সময় রুন দেখল অ্যানি অস্বাভাবিক গম্ভীর। কিছুই মুখে দিচ্ছে না।

রান্না পছন্দ হচ্ছে না তোমার, অ্যানি?

পছন্দ হবে না কেন! বেশ ভালো রান্না।

তবে খাচ্ছ না কেন?

আমার ভালো লাগছে না।

রুন খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল, লোকটা কি তোমাকে কোনো কড়া কথা বলেছে?

না।

ওর ঘর থেকে বের হয়ে তুমি খুব কাঁদছিলে, তাই জিজ্ঞেস করছি।

এমনি কাদছিলাম। ও আমাকে কোনো কড়া কথা বলেনি।

রুন অবাক হয়ে বলল, লোকটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে নাকি?

হা, পছন্দ হয়েছে।

অ্যানি স্পষ্টস্বরে আবার বলল, লোকটিকে আমার ভালুকের মতো লাগে মা। প্রকাণ্ড একটা বুড়ো ভালুক।

এই ভালুক কিন্তু তুলোভরা ভালুক না যে সারাদিন কোলে করে ঘুরে বেড়াবে। এই ভালুকের ধারালো নখ আছে।

অ্যানি খিলখিল করে হেসে ফেলল।

হাসছ কেন?

এমনি হাসছি।

কারণ ছাড়া হাসা এবং কারণ ছাড়া কান্না এস মোটেই ভালো লক্ষণ না। কাল থেকে তুমি রীতিমতো স্কুলে যেতে শুরু করবে। লোকটি নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে। ওর সঙ্গে বেশি মিশতে চেষ্টা করবে না। এই লোকটি মেলামেশা বেশি পছন্দ করে না।

তুমি লোকটি লোকটি বলছ কেন মা? ওর একটি নাম আছে। জামশেদ। মিঃ জামশেদ বলবে।

ঐসব বিদেশী নাম আমার মুখে আসে না।

চেষ্টা করলেই আসবে। বলো আমার সঙ্গে—জামশেদ।।

বলেছি ত বিদেশী নাম আমি উচ্চারণ করতে পারি না।

মা, ওকে যদি আমি বুড়ো ভালুক বলি, তা হলে কি ও রাগ করবে?

জানি না। তুমি বড় বাজে কথা বল।

মিস মারিয়াটা বলছিলেন, বুড়ো ভালুক নাকি ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে পারে।

এরকম বলার কারণ কী?

মিস মারিয়াটার এরকম মনে হচ্ছে। আমার কিন্তু তা মনে হয় না মা।

মনে না হলেই ভালো।

আমার কাছে মনে হয়, বুড়ো ভালুক খুব একটা চমৎকার মানুষ।

রুন উঠে পড়ল। বসে থাকলেই অ্যানির বকবকানি শুনতে হবে। বড় বেশি কথা বলছে সে। মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।

.

গাড়ি চলছে থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে।

পেছনের সিটে অ্যানি বসে আছে। তার সঙ্গে দূরত্ব রেখে বসেছে জামশেদ। জামশেদ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দুপাশের পথঘাট লক্ষ করছে। সুবিধাজনক জায়গাগুলি দেখবার চেষ্টা। যেসব জায়গায় হঠাৎ করে হামলা হতে পারে। অত্যন্ত ব্যস্ত রাস্তা। এখানে গাড়ির উপর হামলা চালানোর সম্ভাবনা খুবই কম। যদি কিডন্যাপিং-এর চেষ্টা হয় তবে তা হবে স্কুলের আশপাশে। ব্যস্ত রাস্তায় নয়। তবু রাস্তা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

জামশেদ তার হাঁটুর উপর মেট্রোপলিটান ম্যাপটি বিছিয়ে দিল। লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিতে লাগল থার্ড অ্যাভিনিউতে কটি এক্সিট আছে তার ওপর। পেট্রোল পাম্প কটি আছে তাও দেখতে হবে। বড় ভ্যানজাতীয় গাড়ি লুকিয়ে রাখার সবচেয়ে সহজ জায়গা হচ্ছে পেট্রোল পাম্প। নষ্ট হয়ে গেছে এই অজুহাতে প্রকাণ্ড একটা গাড়ি সেখানে দীর্ঘ সময় ফেলে রাখা যায়। এতে কারোর মনে কোনোরকম সন্দেহ জাগে না।

স্কুল পর্যন্ত তিনটি পেট্রোল পাম্প দেখা গেল। জমশেদ ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুলে যাবার তো অনেকগুলি পথ আছে। তুমি কি সবসময় থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে যাও?

হ্যাঁ। এই রাস্তায় ট্রাফিক কম।

এর পর থেকে কখনো পরপর দুদিন এক রাস্তায় যাবে না। আমাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ আগে থেকে বুঝতে না পারে আমরা কোন রাস্তায় যাব।

ঠিক আছে। আমি একেক দিন একেক রাস্তায় যাব।

জামশেদ ইতস্তত করে বলল, রওনা হবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে কোন রাস্তা। আমি বলে দেব। তুমি কিছু ঠিক করবে না।

ড্রাইভারটি আহত স্বরে বলল, আমি কুড়ি বছর ধরে এদের গাড়ি চালাচ্ছি। তুমি আমাকেও বিশ্বাস করছ না?

না। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।

যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না তার পৃথিবীতে বাস করা কষ্টকর। পৃথিবীতে বাস করতে হলে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়।

জামশেদ ছোট একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে তোমার পছন্দের রাস্তাতেই যাবে।

ধন্যবাদ।

তুমি আমাকে তা হলে বিশ্বাস করতে পারছ?

না। আমি তো বলেছি আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।

ও।

সিসিলিয়ান ড্রাইভার অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে পড়ল।

অ্যানি সারা পথে চুপচাপ বসে ছিল। একটা কথা জানবার জন্যে তার খুব ইচ্ছা করছিল। লোকটির হাতে এরকম একটা লম্বা কাটা দাগ কোত্থেকে হল? দুহাতেই গভীর দাগ। যেন কেউ একটা ধারালো কিছু দিয়ে কবজির নিচ থেকে দুটি হাত কেটে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। অ্যানি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেসই করে ফেলল, মিঃ জামশেদ, আমি কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

কোনো উত্তর নেই।

শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

করো।

তোমার হাতে কী হয়েছে?

আলজিয়ার্সে আমি একবার গ্রেফতার হয়েছিলাম, তখন হাত কেটে গিয়েছিল।

কারা তোমাকে গ্রেফতার করেছিল?

উত্তর নেই।

তারা কি তোমাকে মারধোর করেছিল?

হ্যাঁ, করেছিল।

অ্যানি ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে জামশেদের হাতের কাটা দাগ স্পর্শ করল। জামশেদ কঠিন ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিল। রুক্ষস্বরে বলল, কেউ আমার গায়ে হাত রাখলে আমার ভালো লাগে না। আর কখনো গায়ে হাত দেবে না। আর শুধুশুধু প্রশ্ন করবে না। মনে রাখবে কথাটা। আমার এসব ভালো লাগে না।

অ্যানি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। সে চায় না কেউ দেখে ফেলুক। কেউ দেখে ফেললে বড় লজ্জার বাপার হবে।

শোনো অ্যানি, কাঁদবে না। কাদার মতো কিছু হয়নি। অকারণে কান্না আমি সহ্য করতে পারি না।

অ্যানি ফেঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তুমি কখনো কাঁদ না?

উত্তর নেই।

যখন আমার মতো ছোট ছিলে তখনও কাঁদনি?

জামশেদ থেমে থেমে বলল, পৃথিবীটা খুব ভালো জায়গা নয়। অনেকরকমের দুঃখকষ্ট আছে পৃথিবীতে। এখানে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কেঁদে বুক ভাসালে হয় না।

তুমি যখন বড় হবে তখন জানবে অনেক কুৎসিত ও কদর্য ব্যাপার হয় এখানে।

অ্যানি ফোপাতে ফোপাতে বলল, তুমি আমাকে যত ছোট ভাবছ আমি তত ছোট না। আমি অনেক কুৎসিত ব্যাপারের কথা জানি কিন্তু আমি কাউকে সেসব বলতে পারি না। আমার কোনো বন্ধু নেই।

.

দোতলার লবিতে বসে জামশেদ কফি পাচ্ছিল। মারিয়া নামের যে-মেয়েটি কফি নিয়ে এসেছে সে কিছুক্ষণ গল্প জমাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু তা সঙ্গত কারণেই জমেনি। জামশেদের সঙ্গে কখনো গল্প জমে না।

জামশেদ চারদিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখছিল। বাড়িটি সেরকম সুরক্ষিত নয়। চারদিকের দেয়াল নিচু। যে-কেউ অনায়াসে দেয়াল টপকাতে পারবে। তার ওপর কোলাপসেবল গেটটিতে বেশির ভাগ সময়ই তালা থাকে না। ভিকির সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে। তিনটি জিনিস করা দরকার। দেয়াল কমপেক্ষ তিন ফুটের মতো বাড়াতে হবে এবং গেটে সর্বক্ষণ তালা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং একটি ভালো জাতের কুকুরের ব্যবস্থা করতে হবে।

জামশেদ কফি খেতে খেতে ভাবল, শরীর যদি আগের মতো থাকত তা হলে এসবের দরকার হত না। কিন্তু শরীর আগের মতো নেই, নষ্ট হয়ে গেছে। এখন একধরনের আলস্য বোধ হয়। দারুণ ক্লান্তি লাগে। মাঝে মাঝে দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। কেউ কি এখনও আছে যে তাকে চিনতে পারবে? এজাতীয় ভাবনা ইদানীং তার হয়। তখনই তাকে নেশা করতে হয়। সস্তা ধরনের নেশা, ঝাঁঝালো ব্ল্যাক নাইট কিংবা টক রাম। লিভার অতি দ্রুত পচিয়ে ফেলবার মহৌষধ। লিভারটি সুস্থ রেখেই-বা কী লাভ

জীবন ফুরিয়ে আসছে। ঘণ্টা বেজে গিয়েছে, কান পাতলে শোনা যায়। এ সময়ে কোনোকিছুর জন্যেই কোনো মমতা থাকে না।

জামশেদ উঠে দাঁড়াল। মারিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, কফিপটে আরো কফি আছে। খেতে চাইলে ঢেলে নাও। জামশেদ তার উত্তরে কিছু বলল না। সে নিজের ঘরে চলে এল। এ-ঘরের জানালাগুলো ছোট ছোট। অর্থাৎ ঘরটি ভৃত্যশ্রেণীর লোকদের জন্যে। তাতে কিছুই যায় আসে না। ঘরটি প্রশস্ত এবং লাগোয়া বাথরুম আছে। বাথরুমটি ঝকঝকে পরিষ্কার। তা ছাড়া বুকশেলফ আছে একটি, প্রচুর ইংরেজি পেপারব্যাক সেখানে। বই পড়ার তার তেমন অভ্যেস নেই। তবু মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

তুমি হাততালি দেবে, মারিয়া। তোমার হাততালির সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়াব। শব্দ করে হাততালি দেবে।

জামশেদ তাকিয়ে দেখল অ্যানি লনে দৌড়াতে শুরু করেছে। সিঁড়ির কাছে কোমরে হাত দিয়ে মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। জামশেদ অবাক হয়ে লক্ষ করল মেয়েটি বেশ ভালো দৌড়াচ্ছে। দেখে যতটা দুর্বল মনে হয় ততটা দুর্বল নয় সে। বেশ ভালোই ছুটছে। তবে স্টার্টিং হচ্ছে না। মেয়েটির রিফ্লেক্স অ্যাকশন ভালো না। অনেকখানি নষ্ট করছে শুরুতেই। জামশেদের হঠাৎ ইচ্ছে হল নিচে নেমে যেতে, আর ঠিক তক্ষুনি অ্যানি চেঁচিয়ে বলল, মিঃ জামশেদ, আমি স্কুল স্পোর্টসে নাম দিয়েছি। ওয়ান হানড্রেড মিটার।

জামশেদ জানালার পাশ থেকে সরে এল। তার এখন সুটকেস খুলে কনিয়াকের বোতলটি বের করার ইচ্ছা হচ্ছে। প্রবল ইচ্ছা। জামশেদ ঘরের দরজা বন্ধ করে সুটকেস খুলল। নিচে অ্যানি খুব হৈচৈ করছে। চেঁচিয়ে বলছে, মারিয়া, তোমাকেও দৌড়াতে হবে আমার সঙ্গে। একা একা দৌড়াব নাকি? উঁহু, তা হচ্ছে না। মারিয়া স্প্যানিশ ভাষায় কী যেন বলল। তার উত্তরে অ্যানি গলা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। জামশেদের কাছে মনে হয় অ্যানি মেয়েটি বেশ ভালো।

.

ভিকি একটা দুঃসংবাদ পেয়েছে।

ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজার টেলিফোন করে বলেছে এক কোটি লিরা ঋণ আপাতত দিতে পারছে না ওরা। তবে নতুন স্পিনিং মেশিন কেনা হলে সেই মেশিন বন্ধক রেখে কিছু দেয়া যেতে পারে।

ভিকি আকাশ থেকে পড়ল। খবরটি অপ্রত্যাশিত। ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে খোলাখুলি কথা হয়েছিল। যোগাযোগ এতরার করে দেয়া। ম্যানেজার বলেছিল, ঋণ পাবার কোনো অসুবিধা হবে না। হঠাৎ করে এরকম হল কেন কে জানে!

ভিকি কী করবে ভেবে পেল না। সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি বিক্রি করে দেয়াই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি; সিনথেটিক কাপড়ের ব্যবসাতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু তার জন্যে যে সাহস দরকার সে সাহস ভিকির নেই। তাদের তিন পুরুষের ব্যবসা হচ্ছে সিল্ক নিয়ে। সিল্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। ডুবলেও সিল্কের মধ্যেই ডুবতে হবে।

হ্যালো, এতরা?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার, এই সাতসকালে?

ওরিয়েন্ট মার্কেন্টাইল লোন দিচ্ছে না।

বল কী?

হ্যা। আজকেই কথা হয়েছে।

কীজন্যে দিচ্ছে না কিছু বলেছে?

না।

আচ্ছা, আমি জিজ্ঞেস করে জানব।

ভিকি ক্লান্ত স্বরে বলল, এখন আমার কী করণীয় সেটা বলো।

বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। ওদের হার্ট অনেক বড়। ঋণ চাইলে এত ধানাইপানাই করে না। তুমি আমেরিকান এক্সপ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করো। মিঃ অলিভার লরেন্স নামে এক ভদ্রলোক আছেন সেখানে। ওঁর সঙ্গে কথা বল।

দেখি।

দেখাদেখির কিছু নেই। আজকেই যোগাযোগ করো। আচ্ছা, একটা কথা, মিলান শপিং মলে তোমার একটা ঘর আছে না?

আছে।

সেটাও কি মর্টগেজড?

হা।

কোন ব্যাংক?

সিটি ব্যাংক।

তোমার অবস্থা তো করুণ বলেই মনে হচ্ছে। যাক, ঘাবড়াবার কিছু নেই। একটা কিছু হবেই। ব্যাংক ছাড়াও তো ঋণ দেবার লোক আছে।

ভিকি শঙ্কিত গলায় বলল, আমি ব্যাংক ছাড়া বাইরের কোনো লোন নিতে চাই না।

না চাওয়াই উচিত। ইন্টারেস্টের রেট খুবই চড়া।

সেজন্যে না। মাফিয়াদের সঙ্গে জড়াতে চাই না।

এতরা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, জলে নামলে কুমিরের সঙ্গে ভাব রাখাই ভালো।

এতরা, ভাব বেশি করতে চাই না।

আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভিকি!

শুনছি।

এই রোবারে বাচ্চাদের জন্যে একটা মেলা হচ্ছে। সার্কাস, ম্যাজিক-শো এইসব হবে, চিলড্রেন্স নাইট। একটা বড় জাহাজ ভাড়া করছে ওরা। জাহাজের মধ্যেই সব ব্যবস্থা। তুমি অ্যানি এবং রুন এদের নিয়ে ঘুরে আসো। মন ভালো থাকবে।

আমি এই কদিন কোথাও বেরুব না। অ্যানির ভালো লাগত। তুমি যেতে চাইলে অ্যানিকে নিয়ে যেতে পার। আমি কোথাও নড়ব না।

.

মিঃ অলিভার লরেন্স লোকটি অত্যন্ত মিষ্টভাষী। সে ভিকির ঋণের কাগজপত্র সব হাসিমুখে দেখল। কফি খাওয়াল। মিডল ইস্টের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে শেষ পর্যায়ে বলল, মিঃ ভিকি, ইতালিয়ানরা পারতপক্ষে বিদেশী ব্যাংকের কাছে লোন চায় না। এদিক দিয়ে তারা খুব জাতীয়তাবাদী। বিদেশী ব্যাংকের কাছে ওরা তখনই আসে যখন দেশী ব্যাংক ওদের ঋণ দেয় না। কথাটা কি ঠিক নয়?

হ্যাঁ, তা ঠিক।

আপনাকে স্থানীয় ব্যাংকগুলো লোন দিচ্ছে না কেন, মিঃ ভিকি?

ভিকি সরাসরি কোনো জবাব দিতে পারল না। লরেন্স অলিভার হাসিমুখে বলল, আমার মনে হয় পিওর সিল্ক থেকে আপনার সরে আসা উচিত। পিওর সিল্কের বাজার ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

ভিকি চুপ করে রইল। লরেন্স অলিভার বলল, আপনাদের যে পরিবারিক নামাক আছে তার ওপর নির্ভর করেই আমরা আপনাকে লোন দিতে রাজি আছি, তবে আপনাকে পিওর সিল্ক থেকে সরে আসতে হবে।

ভিকি ক্লান্তস্বরে বলল, তা সম্ভব নয়।

সম্ভব নয় কেন?

মিঃ লরেন্স, সিল্ক ব্যবসা আমাদের অনেক দিনের ব্যবসা। আমার দাদা ছিলেন রাস্তার ছোকরা। সিল্ক ব্যবসা করেই তিনি কোটিপতি হয়েছিলেন। তিন-পুরুষের সেই ব্যবসা আমি নষ্ট করব তা হয় না।

লরেন্স অলিভার মৃদু হাসল।

আপনি হাসছেন কেন?

হাসছি কারণ আপনি ব্যবসার জন্যে ফিট নন। আপনি সেন্টিমেন্টাল।

সেন্টিমেন্টাল হওয়া কি খুব দোষের? ভিকি চুপ করে গেল।

আমি দুঃখিত যে কিছু করতে পারছি না। তবে আপনি যদি ব্যবসার ধারা বদলাতে চান তা হলে আমরা সঙ্গে দেখা করবেন। আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করব।

ভিকি মৃদুস্বরে বলল, তা সম্ভব নয়।

.

রুন ত্রিশ হাজার লিরা দিয়ে নতুন একটা ড্রেস কিনেছে। অনেকটা জাপানি কিমানোর মতো দেখতে। হালকা সবুজ রঙের ওপর নীল নকশা। ঘরে আনার পর তার মনে হল, ঘন সবুজের ওপর ঘন নীল নকশার যে ড্রেসটি ছিল সেটিও সন্ধ্যাবেলার জন্যে চমৎকার। রুন সেটাও কিনে আনল। একই ডিজাইনের উপর আরো দুটো ড্রেস ছিল। সে দুটোও কিনে ফেলবে কি না এই বিষয়ে সে ঠিক মনস্থির করতে পারল না। সবগুলি কিনে ফেলবার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে তা হলে তাকে দেখে অন্য কেউ একই ডিজাইনের পোশাক সঙ্গে সঙ্গে কিনতে পারবে না। আর না কেনার পেছনে যুক্তি হচ্ছে, ভিকি রাগ করবে।

ভিকি অবিশ্যি রাগ করল না, ভাবলেশহীন চোখে তাকিলে দেখল। রুন হালকা গলায় বলল, খরচ একটু বেশি পড়ে গেল, কিন্তু দ্যাখো-না, এত চমৎকার ডিজাইন রোজ রোজ পাওয়া যায় না। আর সবুজ রঙের গাম্ভীর্যটুকু দ্যাখো। চোখ ফেরানো যায় না। তুমি খুশি হয়েছ তো?

হ্যাঁ, হয়েছি।

না, ঠিক খুশি হওনি। একটু রাগ তোমার মধ্যে আছে। কিন্তু আমি ড্রেসটা গায়ে দিয়ে আসি, দেখবে কী অদ্ভুত লাগে। ভালো কথা, ঐ লোকটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। খুব নাকি জরুরি।

কোন লোকটা?

আমাদের বডিগার্ড। ওর নাম মনে থাকে না আমার।

কী চায় সে?

আমি জানি না। আমাকে কিছু বলেনি।

বেশ, ডাকো।

.

ভিকি মন দিয়ে ওর কথা শুনল। লোকটি ঘরের চারদিকের দেয়াল তিনফুট উঁচু করতে চায়, একটি কুকুর রাখতে চায়।

মিঃ ভিকি, তোমার বাড়ি খুবই অরক্ষিত। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে তোমার বাড়িতেই ঘটবে।

জামশেদ, তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। আমার মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করবে না। তোমাকে আমি রেখেছি শুধু আমার স্ত্রীকে খুশি করবার জন্যে। তুমি তার কাছে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতীক।

এই কথা তুমি কিন্তু আমাকে আগে বলনি।

এখন বললাম। এখন থেকে জেনে রাখো

ও।

এখানে থাকতে তোমার কেমন লাগছে?

জামশেদ জবাব দিল না।

ভিকি বলল, অ্যানি অবিশ্যি খুব খুশি। তোমাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে।

জামশেদ অবাক হয়ে তাকাল। তাকে পছন্দ করবার তেমন কোনো কারণ নেই। বরং অপছন্দই হবার কথা।

তোমাকে ও কী বলে ডাকে জান? বুড়ো ভালুক।

বুড়ো ভালুক?

তোমাকে নাকি ওর বুড়ো ভালুকের মতো লাগে।

আমার মেয়েটিকে কেমন লাগে তোমার চমৎকার না?

শিশুদের আমি ঠিক পছন্দ করি না, মিঃ ভিকি। ওদেরকে কখনোই ভালো লাগে না।

তা-ই বুঝি?

হ্যাঁ

পছন্দ না করার কারণ কী?

আছে হয়তো কোনো কারণ। আমি ঠিক জানি না। কারণ নিয়ে কখনো ভাবিনি।

০৪.

রুন দারুণ বিরক্ত হল।

একজন লোক আগ্রহ করে নিতে চাইছে, কিন্তু মেয়ে যাবে না। এর মানে কী? কতরকমের মজার ব্যবস্থা আছে। সারারাত জেগে সার্কাস-টার্কাস দেখবে, তা না, অ্যানি মুখ গোজ করে আছে।

কেন যাবে না, অ্যানি?

আমার ভালো লাগে না।

ভালো না লাগার কী আছে এখানে।

বললাম তো আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।

সার্কাস দেখতে তোমার ভালো লাগে না?

অ্যানি চুপ।

পুতুলনাচ দেখতে ভালো লাগে না?

কোনো জবাব নেই।

তার ওপর প্যান্টোমাইম আছে।

অ্যানি টেনে টেনে বলল, তুমি যদি যাও তা হলে আমি যাব না।

রুন বিরক্ত স্বরে বলল, আমি তোমার কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। তুমি যাবে এবং হাসিমুখে যাবে। একটা লোক এত টাকা খরচ করে টিকিট এলেছে, না, সে যাবে না! দিনরাত ঘরে বসে থেকে এটা তোমার হয়েছে।

মা, আমি কোথাও যেতে চাই না।

এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাই না। তুমি তোমার কাপড় গুছিয়ে রাখো। সন্ধ্যাবেলা এতরা চাচা তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে।

অ্যানি তার বাবাকে গিয়ে ধরল, বাবা, আমি ঐ জাহাজে যেতে চাই না।

কেন মা?

আমার ভালো লাগছে না।

শরীর খারাপ?

না, শরীর ঠিকই আছে?

তা হলে কি মন-খারাপ? মন-খারাপ হলে তো যাওয়াই উচিত। তা হলে মন ভালো হবে। তা ছাড়া বহু টাকা খরচ করে তোমার এতরা চাচা টিকিট কেটেছেন। সেটা দেখতে হবে না?

আমার একটুও ইচ্ছা করছে না বাবা।

ইচ্ছে না করলেও আমাদের অনেক কিছু করতে হয়। তুমি না গেলে তোমার মা খুব রাগ করবেন। তোমার মা রাগ করলে কী অবস্থা হয় তা তো তুমি জানোই। জানো না?

জানি।

যাও মা, ঘুরে আসো। বেশ লাগবে তোমার। মনে হবে কেন যে আগে আসতে চাইনি!

.

রাত দশটার পর জামশেদ দরজা বন্ধ করে দেয়। আজকেও করে দিয়েছে। সুটকেস খোলা হয়েছে। হুইসকির পেটমোটা বোতল বের হয়েছে। বোতলের মুখ খোলবার আগেই দরজায় আলতো করে টোকা পড়ল।

কে?

কোনো উত্তর নেই। জামশেদ বোতলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল।

কে?

কোনো উত্তর নেই। জামশেদ দরজা খুলে দেখে ঘাসের স্লিপার পায়ে দিয়ে অ্যানি দাঁড়িয়ে আছে শুকনোমুখে।

কী ব্যাপার?

আমি তোমার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।

না।

কথাটা সকালে বললে হয় না?

এসো, ভেতরে এসে বলো।

অ্যানি নিঃশব্দে ভেতরে এল। জামশেদ দেখল মেয়েটির চোখ ফোলা। নিশ্চয়ই দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদছে।

কী বলবে বলো।

কাল সন্ধ্যায় এতরা চাচা আমাকে একটা জাহাজে নিয়ে যাবে। সেখানে সারারাত ধরে সার্কাস-টার্কাস হবে।

অ্যানি দম নেয়ার জন্যে থামল। জামশেদ কিছুই বলল না।

আমি সেখানে যেতে চাই না।

ও।

ঐ লোকটা ভালো না। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। আমি আগের মতো ছোট না।

তুমি তোমার বাবা-মাকে বলেছ?

বলেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি?

তুমি কি বলেছ এতরা চাচা লোকটি খারাপ?

না।

অ্যানি ফুঁপিয়ে উঠল। জামশেদ ভারী গলায় বলল, যাও, ঘুমুতে যাও। অনেক রাত হয়েছে। নাও, এই তোয়ালেটা দিয়ে চোখ মোছো।

অ্যানি চোখ মুছে শান্তস্বরে বলল, শুভ রাত্রি, মিঃ জামশেদ।

শুভ রাত্রি।

.

এতরা এসে পড়ল পাঁচটার মধ্যেই। তার গায়ে চমৎকার একটা সার্জের কোট। পিঠে বাটিকের কাজ-করা চামড়ার একটা ব্যাগ।

অ্যানি, তৈরি তো?

রুন বলল, হ্যাঁ, তৈরি হচ্ছে। আর ঝামেলার কথা বল কেন, হঠাৎ করে বলছিল সে যাবে না। তার নাকি ভালো লাগছে না।

কী আশ্চর্য, ভালো লাগছে না কেন? কোথায়, অ্যানি কোথায়?

সাজগোজ করছে।

যাচ্ছে তো এখন?

হ্যাঁ, যাচ্ছে।

যাক, তাও ভালো।

অ্যানি লাল রঙের একটি ম্যাক্সিজাতীয় ড্রেস পরেছে। ড্রেসটির জন্যেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক অ্যানিকে বেশ বড় বড় লাগছে। পনেরো-ষোলো বছরের তরুণীর মতো। রুন অবাক হয়ে বলল, বাহ, চমৎকার লাগছে তো? গালে কি তুমি রুজ দিয়েছ, অ্যানি?

নাহ।

রুজ ছাড়াই গাল এমন লাল দেখাচ্ছে? আশ্চর্য তো! এতরা, দ্যাখো, আমার মেয়েকে দ্যাখো। পরীর মতো লাগছে না?

হ্যাঁ, তা লাগছে। মেয়ে মায়ের মতোই হয়েছে।

গেটের পাশে জামশেদ দাঁড়িয়ে ছিল। এতরা অ্যানিকে নিয়ে গেটের কাছে আসতেই সে বলল, মিঃ এতরা, অ্যানিকে যে তুমি জাহাজে নিচ্ছ, সেখানকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি তো কিছু জানি না।

তোমার জানার কোনো দরকার আছে কি?

আছে। আমাকে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে অ্যানির নিরাপত্তার জন্যে। কাজেই অ্যানি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।

এতরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলে কী এই উজবুক। আমি একে নিয়ে যাচ্ছি এটা কি যথেষ্ট নয়?

না মিঃ এতরা, মোটেই যথেষ্ট নয়। আমি সঙ্গে যাচ্ছি।

এতরা দেখল, লোকটির কালো চোখ পাথরের মতো কঠিন। এ যাবেই সঙ্গে, এতে ভুল নেই।

অ্যানির ফ্যাকাশে ঠোঁটে যেন রক্ত ফিরে এসেছে। সে মনে হচ্ছে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসি গোপন করতে চেষ্টা করছে।

তোমাকে সঙ্গে নেয়ার জন্য কোনো বাড়তি টিকিট নেই।

তা হলে আজ যাওয়াটা বাতিল করতে হবে।

আমার মনে হয় একটা ছোট ব্যাপারকে এখানে অনেক বড় করে দেখা হচ্ছে।

আমার তা মনে হয় না মিঃ এতরা।

এতরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল।

জামশেদ শান্তস্বরে বলল, চেষ্টা করলে এখনও হয়তো আরো একটি টিকিট জোগাড় করা যেতে পারে।

এত সময় আমার নেই। আমি একজন ব্যস্ত মানুষ।

তা হলে বরং অন্য কোনোদিন হবে।

এতরা জবাব দিল না।

অমানুষ : হুমায়ূন আহমেদ (২য় পর্ব)