অতিথি : হুমায়ূন আহমেদ

তিন বছর পর সফুরা দেশে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে সে যে একনাগাড়ে এতদিন পার করে দিয়েছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে নি। এই তাে মনে হয় সেদিন মাত্র এসেছে। এক শীতে এসেছিল, মাঝখানে দুটা শীত গিয়ে এখন আবার শীতকাল। প্রথম দিন ভীতমুখে বারান্দায় বসে ছিল।

বেগম সাহেব তাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। দুটা সুন্দর-সুন্দর বাচ্চা— রূপা, লােপা; পাশেই খেলছে, অথচ তার দিকে তাকাচ্ছে না। এক সময় সফুরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কী নাম তােমার ভইন?

রূপা তার দিকে না তাকিয়েই বলল, আমাকে ভইন’ ডাকবে না।
সফুরা চুপ করে গেল । সময় কাটতেই চায় না। এরা তাকে কাজে বহাল করবে কি-না তাও বােঝা যাচ্ছে না। তার খুব পানি পিপাসা হচ্ছে— কার কাছে পানি চাইবে?
এক সময় বেগম সাহেব চায়ের কাপ হাতে তার সামনে বসলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী নাম?
‘সফুরা ।
‘ঘরের কাজকর্ম জানাে ?
সফুরা কী বলবে বুঝতে পারল না। ঘরের কাজকর্ম সে তাে অবশ্যই জানে। ভাত রাঁধা, বাসন ধােয়া, কাপড় ধােয়া …. কিন্তু ঢাকার এইসব বাড়িতে কাজকর্ম কী রকম কে বলবে ।
‘আগে কখনাে বাসায় কাজ করেছ? ‘জে-না।’
ঢাকায় কী এই প্রথম?
‘জে।’
বেগম সাহেব কঠিন মুখে বললেন, হাত ধরে-ধরে কাজকর্ম শেখাব, তারপর পাখা গজাবে । উড়ে চলে যাবে অন্য বাসায়। তােমাদের আমার চেনা আছে।
“আমি কোনােখানে যামু না।’
‘খামােকা এইসব বলবে না। আগে অনেকবার শুনেছি। বেতন চাও কত?
সফুরা চুপ করে রইল । যে তাকে নিয়ে এসেছে সে বারবার বলে দিয়েছে— বেতনের কথা বললে চুপ কইরা থাকবা। আগ বাড়াইয়া কিছু বলবা না। চুপ করে আছে। কিছু বলছে না।
‘কী, কথা বল না কেন? কত চাও বেতন?
‘আপনের যা ইচ্ছা।’
‘কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছ?
সফুরা লজ্জা পেয়ে গেল । কাপড়চোপড় আনবে কী? একটা শাড়ি ছিল সেটাই নিয়ে এসেছে। যার কাপড়চোপড় আছে সে কি আর ছেলেপুলে স্বামী ছেড়ে ঢাকায় কাজ করতে আসে?
বেগম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তােমাদের এই আরেক টেকনিক । এক কাপড়ে উপস্থিত হবে। যাতে সঙ্গে-সঙ্গে একটা শাড়ি কিনে দিতে হয়।
সফুরা মাথা নিচু করে রাখল।
‘তােমার কী নাম যেন বললে?
‘সফুরা ।
“শােন সফুরা, থাক এইখানে। কাজ কর। কয়েকদিন কাজ দেখি। যদি কাজ পছন্দ হয় বেতন ঠিক করব। আমার সংসার ছােট। কাজকর্ম নেই বললেই হয় । মেয়েদের কখনাে নাম ধরে ডাকবে না । আন্টি ডাকবে। একজন বড় আন্টি, একজন ছােট আন্টি । মনে থাকবে?
‘জে।
‘আমাদের আলাদা বাথরুম। ঐ বাথরুমে কখনাে ঢুকবে না । মনে থাকবে?
‘জে।
‘তােমাকে আলাদা থালা, গ্লাস দেয়া হবে। সব সময় সেগুলি ব্যবহার করবে। আমাদের থালা গ্লাস কখনাে ব্যবহার করবে না।’
‘জে আইচ্ছা।’
‘সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। গ্রাম থেকে এসেছ, পেট ভর্তি কৃমি। কৃমির ওষুধ খাইয়ে দেব । মাথায় উকুন আছে?”
‘জে।
‘উকুনের ওষুধ দেব। লরেকসিন চুলে মেখে গােসল কর।’
‘জে আইচ্ছা।’
দুদিন পরপর দেশের বাড়িতে যাওয়া। এর অসুখ তার অসুখ এইসব চলবে না। দেশে যাবে বৎসরে একবার । দেশের বাড়ি থেকেও প্রতি সপ্তাহে তোমাকে দেখতে লােক আসবে তাও চলবে না। বেতনের টাকা মাসের দু তারিখে দিয়ে দেব। মনি অর্ডার করে কিংবা কারাে হাতে পাঠিয়ে দেবে।’
‘জে আইচ্ছা।’
কাচের থালা-বাসন ধরবে খুব সাবধানে। টেবিলের উপর কাচের যে বাটিটা। দেখছ, যেখানে ফল রাখা—ঐ বাটিটার দাম তিন হাজার টাকা।
একটা বাটির দাম তিন হাজার টাকা? সফুরার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল । তিন হাজার টাকায় একটা গরু কেনা যায়। সামান্য একটা বাটি, তার দাম তিন হাজার? বাটিটা একবার ছুঁয়ে দেখতে হবে ।

সফুরা কাজে বহাল হল । যা-কিছু শেখার ছিল, সাতদিনে শিখে গেল । বেগম সাহেব যে তার কাজে খুশি তাও সে ন’দিনের দিন জেনে গেল। মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে সে শুনল বেগম সাহেব টেলিফোনে কাকে যেন বলছেন,
আমার কাজের মেয়েটা চটপটে আছে। কাজ ভালােই করে। শেখার আগ্রহ আছে। তবে টিকবে না। কাজ শেখা হলে অন্য বাড়িতে কাজ খুঁজবে। এদের চেনা আছে।
বেগম সাহেবের কথা সত্যি হয় নি। সে কোথাও যায় নি। এ বাড়িতে আছে। গত তিন বছরে দেশেও যায় নি। কয়েকবারই যাওয়া ঠিকঠাক হল। তার এমনি কপাল—যখন দেশে যাওয়া ঠিকঠাক হয় তখনি এ বাড়িতে একটা কিছু ঝামেলা লেগে যায়। প্রথমবার ছােট আন্টির ফ্লু হল । অসুস্থ মানুষকে রেখে যাওয়া যায় না। পরের বার জাপান থেকে কারা যেন বেড়াতে এল। এ বাড়িতে থাকল এক সপ্তাহ। বাড়িতে মেহমান ফেলে সে যায় কীভাবে? তবে ঐ মেহমানরা যাবার সময় তাকে একটা ঘড়ি দিলেন। কী আশ্চর্য কাণ্ড, তার মতাে মানুষকে কেউ ঘড়ি দেয়? ঘড়ি দিয়ে সে কী করবে? ঘড়ির সে কী বুঝে? বকুলের বাবা যখন পরের বার টাকা নিতে এল তখন টাকার সঙ্গে ঘড়িও দিল। মানুষটা অবাক। ‘ঘড়ি পাইলা কই?
আমারে খুশি হইয়া দিছে।
কও কী তুমি!
‘যা সত্য তাই কইলাম।’
‘বেজায় দামি জিনিস বইল্যা মনে হয়।
‘ বেইচ্যেন না।।
‘আরে না, বেচব কী! ঘড়ির একটা প্রয়ােজন আছে না? ঘড়ির ইজ্জতই আলাদা।
বকুলের বাবা ঘড়ি হাতে পরে আনন্দে হেসে ফেলল। লােকটা বেজায় শৌখিন। টাকা নিতে যখন আসে মনে হয় ভদ্রলোেক। মাথার চুল বেশির ভাগই পেকে গিয়েছিল । একবার এল— সব চুল কুচকুচে কালাে। চুলে কলপ দিয়েছে। পাচ দশ টাকা নিশ্চয়ই চলে গেছে। লােকটা এইসব দেখবে না। বড় শৌখিন। সফুরা বড় ইচ্ছা করে এই শৌখিন মানুষটাকে চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে চারটা ভাত খাওয়ায়। তিন হাজার টাকা দামের বাটিতে করে সালুন এনে দেয় তা তাে সম্ভব না। বেগম সাহেব বলে দিয়েছেন, তােমার স্বামী যে দুদিন পরপর ফুলবাবু সেজে চলে আসে খুব ভালাে কথা। আসুক। তাকে ঘরে ঢুকাবে না। বাইরে থেকে বিদায় দেবে। একবার ঘরে ঢুকলে অভ্যাস হয়ে যাবে।
বেগম সাহেবের কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। তার অন্তর ভালো। তিন ঈদেই তার ছেলেমেয়ের জন্য টাকা দিয়েছে। গত ঈদে বেতনের বাইরেও পাঁচশ টাকা দিলেন। একটা গায়ের চাদর দিলেন । তার বেতন ছিল দেড়শ। তাকে কিছু বলতে হয় নি, বেগম সাহেব নিজেই বেতন বাড়িয়ে করেছেন দু’শ। তা ছাড়া লােকজন এ বাড়িতে বেড়াতে এলে যাবার সময় হাতে পঞ্চাশ, একশ টাকা সব সময়ই দেয়। প্রতিটি পাই পয়সা সফুরার কাজে লাগে। বেতনের বাইরের টাকাটা সে জমা করে রাখে। দেশে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের জন্যে এটা-সেটা নিজের হাতে কিনে নিয়ে যাবে। তার এত কষ্টের টাকা।

বকুলের বাবা এসেছে সফুরাকে নিয়ে যেতে। বাবু সেজে এসেছে। হাতে ঘড়ি। চোখে কালাে চশমা। গম্ভীর মুখে বারান্দায় বসে আছে। সফুরা বেগম সাহেবের কাছে বিদায় নিল। কদমবুসি করল এবং কেঁদে ফেলল। তিন বৎসর ছিল। মায়া পড়ে গেছে। যেতেও কষ্ট হচ্ছে। বেগম সাহেব বললেন,

তােমার কাজে-কর্মে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার বাচ্চারাও তােমাকে পছন্দ করে। বেশিদিন থেকো না, চলে এসাে। আজ থেকে তােমার বেতন আমি তিনশ করে দিলাম। ফিরে এসে এই বেতনেই কাজ করবে।
আপনের অনেক দয়া আম্মা ।

বেগম সাহেব বেতন ছাড়াও–যাওয়া-আসার গাড়িভাড়া বাবদ দু’শ টাকা দিলেন। একটা প্রায়-নতুন শাড়ি দিলেন । একজোড়া পুরানাে স্যান্ডেল দিলেন। উদাস গলায় বললেন, তােমার সাহেবের একটা কোট আছে। এখন আর পরে না। নিয়ে যাও—কাউকে দিয়ে দিয়াে।
বকুলের বাবা সেই কোট সঙ্গে-সঙ্গে গায়ে দিয়ে বলল, ভালাে ফিট করছে বউ। মাপ মতাে হইছে। চল এখন গাবতলি বাসস্টেশন গিয়া বাস ধরি।
সফুরা বিস্মিত হয়ে বলল, পুলাপানের জন্যে সদাই করমু না? এতদিন পরে দেশে যাইতেছি।
‘কী সদাই করবা?
‘চল গিয়া দেখি—-জামা জুতা। রিকশা লও।
বকুলের বাবা সিগারেট ধরিয়ে বাবু সাহেবের মতাে টানতে-টানতে খালি রিকশা দেখতে লাগল।
সফুরা বলল, আপনেরে চিননের আর উপায় নাই। বাবু সায়েবের মতাে লাগতাছে। চউক্ষে চশমা দিছেন— কত দাম চশমার?
‘শস্তায় কিনছি। রইদের মইধ্যে চউক্ষে দিলে খুব আরাম হয়।
‘আপনে অখন একজোড়া জুতা কিনেন। বকুলের বাবা উদাস গলায় বলল, চল যাই । শস্তায় পাইলে একজোড়া কিনব।
রিকশায় উঠে বকুলের বাবা ক্ষীণ স্বরে বলল,
একটা বিষয় হইছে, বুঝলা সফুরা। তোমারে আগে না বললে বাড়িতে গিয়া হই চই করব। হই চই করনের কিছু না।
সফুরা আতঙ্কিত গলায় বলল, কী বিষয়?
বকুলের বাবা নিচু গলায় বলল, তুমি ঢাকায় চইল্যা আসলা, বাড়ি হইল খালি। ঘরের শতেক কাজকর্ম । সংসার ভাইস্যা যাওনের উপক্রম। গেরামের দশজনে তখন বলল ….
‘আপনে কী বিবাহ করছেন?
‘উপায়ান্তর না দেইখ্যা গত বাইস্যা মাসে …’
আমারে তাে কিছু খবর দেন নাই।’
বকুলের বাবা চুপ করে গেল। সফুরার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। লােকটা বাইস্যা মাসে বিয়ে করেছে। ঈদের পরপর। বেগম সাহেব জাকাতের টাকা থেকে যে পাঁচশ টাকা বাড়তি দিয়েছেন সেই টাকাটা খরচ করেছে বিয়েতে। জাকাতের টাকাটাই তার কাল হয়েছে।
রাগ করলা নাকি সফুরা? ভালাে মতাে বিবেচনা কর । মেয়েমানুষ ছাড়া সংসার চলে? তুমি পইরা আছ ঢাকা শহরে।
নয়া বউ-এর নাম কী?
‘সুলতানা।
দেখতে কেমুন?
‘আছে মােটামুটি।’
‘গায়ের রং কেমন?”
‘ধলা।’
আবার সফুরার চোখে পানি এসে গেল। চিৎকার করে তার কাঁদতে ইচ্ছা। করছে। ইচ্ছা করলেও তা সম্ভব না। তা ছাড়া কী হবে চিৎকার করে কাঁদলে? কিছুই হবে না ।
ঘুরে-ঘুরে অনেক কিছু কিনল সফুরা । ছেলেমেয়েদের জন্যে জামা-জুতা, স্নাে-আলতা। একটা মশারি । চিনি, পােলাউয়ের চাল, এক ডজন কমলা। সবার জনেই কিছু-না-কিছু কেনা হয়েছে, শুধু নতুন বউয়ের জন্যে কেনা হয় নি । বেচারি মন খারাপ করবে। তার তাে কোনাে দোষ নাই। তাকে বিয়ে করেছে বলেই সে এই সংসারে এসেছে।
সফুরা নয়া বউ-এর জন্যে একটা লালপেড়ে শাড়ি এবং কাচের চুড়ি কিনল । বকুলের বাবা বলল, লাল ফিতা কিনাে তাে বউ । ফিতার কথা বলছিল। সফুরা লাল ফিতাও কিনল।

দুপুরের দিকে তারা গাবতলি বাসস্টেশন থেকে বাসে উঠল। বকুলের বাবা মিষ্টি পান কিনেছে। সে বসেছে জানালার পাশে। জানালার পাশে ছাড়া সে বসতে পারে না। তার মাথা ধরে যায়। বাস ছাড়ার মুহূর্তে সে ঘড়িতে সময় দেখে গম্ভীর গলায় বলল,

রাইত আটটা বাজব। শীতের দিন বইল্যা রক্ষা। আরামে যাইবা। গরমের সময় হইলে খুব কষ্ট হইত। এইটা খিয়াল রাখবা বউ, শীতকাল ছাড়া দেশে আসবা না। বেড়াইবার সময় হইল তােমার শীতকাল।

সফুরা জবাব দিল না। শীতকালের পড়ন্ত রােদে সে বেড়াতে যাচ্ছে। পাশে স্বামী । কতদিন পর দেখবে ছেলেমেয়েদের । আনন্দে তারা চিক্কার করে কাঁদবে । সারারাত হয়তাে ঘুমাবে না। নয়া বউ লালপেড়ে শাড়ি পরে তাকে এসে কমবুসি করবে। সে নয়া বউকে বলবে আমার অনেক কষ্টের এই সংসার । দেখেশুনে রাখ । বলতে বলতে.সে হয়তাে কেঁদে ফেলবে। আজকাল অকারণেই তার চোখে জল আসে। কত আনন্দ করে সে বাড়ি যাচ্ছে। এখন কাদার কোনাে কারণ নেই। অথচ কী কাণ্ড! সে কেঁদেই যাচ্ছে। অনেককাল আগে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়ও সে এইভাবেই কাদছিল ।