অনুতাপ

ক্ষুদীরাম দাস :

শুদ্ধ হতে হলে অনুতাপের আগুনে জ¦লতে হয়। এ জন্যে জ¦ালাতে হয়। আর জ¦ালাতে চাইলে তাকে সেভাবেই জ্ঞানের আলোয় নিয়ে আসতে হয়। তাহলে সে শুদ্ধ হতে পারবে।পাশের বাড়ির বুড়ি লোকটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে মাঝে মাঝেই বলতো এসব কথা। হয়তো, প্রতিবেশীদের ঝামেলা শুনলে মানুষের মুখ থেকে এভাবেই হয়তো বিড় বিড় করে বের হয়ে যায়।

মিতা মাসীমা মারা গেছে। তাই এতো লোকের ভীড়! মানুষ যেন মানুষের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে আর কি! নানা জনে নানান কথা বলেই চলেছে। কোথাও এরকম ঘটনা ঘটলে মানুষ এমনই করে থাকে।
‘কখন মারা গেছে কেউ তো জানতেই পারেনি, মনে হচ্ছে মাঝ রাতেই, গায়ে তো পিঁপড়েও হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ হয়েছে হয়তো মারা গেছে যে।’ ‘আরে ভাই, তুমি তো বুঝতে পারছো না।’ ‘তাহলে কী বলতে চাও?’
‘তিনি কি একা থাকতেন?’ পাশ থেকে একজন চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, একাই তো থাকতো, কী আর হবে? ছেলেপুলে নেই, স্বামী নেই এরকমই তো সবাই জানে!’ ‘আরে না না, বডি দান করে গেছে শুনলাম, ওসব কোন ঝামেলা নেই।’

ভিড়-এর মধ্যে টুকরো টুকরো কথাগুলো ভেসে আসছিল কানে, আজ বলার কোন ভাষা নেই সাগরের। সাগরদের আবাসনের পাশের উইংসে মিতা মাসিমা মারা গেছেন। বিয়ে করেননি উনি, তিন কূলে কেউ নেই, আজ কে কবর দেবে সেই নিয়ে পাড়ার লোকের বচসা লেগেছিল । স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন উনি, রিটায়ার করেছিলেন বহুদিন, পাড়ার লোকের সাথে সদ্ভাব কোনদিনই তেমন ছিল না, লোক আড়ালে ডাইনি অবধি বলতো। কেন জানি না, সাগরদের পরিবার পাড়ায় আসার পর থেকে শুনে শুনে ওনার সাথে না মিশেও ওনার প্রতি বিরূপ মনোভাবই পোষণ করতো। এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনাটাই, ক্ষমাটাও চাইতে পারেনি। তার সাথে বড় অন্যায় হয়েছে; সাগর চুপচাপ বসেই রইলো।

‘মিতা মাসীমার অন্তত কবর দেয়ার ব্যবস্থা তো করতে হবে।’ কেউ একজন বলে উঠলো। সাগরের মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। অতীতের পাতা থেকে টনক নড়ল সাগরের, সামনেই মিতা মাসীর মৃতদেহ । নাহ, ক্ষমা আর চাওয়া হয়নি, তার আগেই মানুষটা ফাঁকি দিয়ে চলে গেল, জানি না কেন আজ খুব অনুতপ্ত লাগছিল সাগরের মনের মধ্যে, নিজের না বলতে পারা কথাগুলো দলা পাকিয়ে আসছিল গলার কাছে, ভিতর থেকে কেউ যেন বলছিল, অন্তত শেষ সময়ে মানুষটাকে একটু সম্মান দে!

কবর দেয়ার সমস্ত দায়ভার নিজের কাঁধে নিলো। এটুকু করতে পেরেও যদি মনটা একটু হালকা হয়, জানি, লোকজন আড়চোখে দেখছে হাসছে, হাসুক, দেখুক । অন্তত মনটা একটু শান্ত হবে -এমনটাই ভাবছিলো সাগর।

সাগর ভাবছে, সব কাজ নিজেই করতেন, কাজের লোকও ছিল না। সুস্থই তো ছিলেন, হঠাৎ যে কী হলোৃ ভাবতে ভাবতেই চোখটা গেল বুক সেলফে রাখা ডায়েরিটায় শিক্ষিকা ছিলেন, ঘরে অনেক রকমের বই-এর মাঝেই ডায়রিটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, বহু পুরোনো মোটা একটা ডায়েরি, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হাত আটকাল সাদা-কালো ছবি দুটোয়। মিতা মাসীর ছবি একটা, কী অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু ইনি কে? বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে তো ! মনের মধ্যেকার জিজ্ঞাসাটা আর দমন করতে পারলো না, কয়েকটা পাতায় লেখা ক্ষুদ্রাক্ষর চোখে পড়েই গেল ।

এই মিতা মাসীমা শিক্ষিকা মানুষ ছিলেন, ভালোবেসেছিলেন একজন মানুষকে, লোকটার নাম জানা নেই সাগরের। তবে ভালবাসার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমাজ পরিবার, পরিজন, কেন? সেটা কারো জানা নেই। হয়তো বাধার কোনো কাঁটাতার ছিল যে। এজন্যে বাড়ি ছেড়েছিলেন, সমাজ ছেড়েছিলেন, পরিবার পরিজন ছেড়েছিলেন নতুন সংসার পেতেছিলেন ভালবাসার মানুষটার সাথে। ভাগ্য সহায় হয়নি, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় ভালবাসার মানুষটা ছেড়ে গেছিল মৃত্যুর কাছে হেরে গিয়ে, ভালবাসার চিহ্ন একমাত্র ছেলেটাও জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় পুকুরে ডুবে মারা যায়। একাকীত্ব পিছু ছাড়েনি মানুষটার, চলে আসেন এখানে, ছেড়ে আসা পথে আর বাড়ি ফিরে যাননি। সাগর কিছুই করতো পারলো না। সেজন্যে এতো অনুতাপ। অবশ্য সেই ছেলেটার জন্যে তার ভীষণ খারাপ লাগছিলো। কেননা ঐ ছেলেটির মৃত্যুর জন্যে দায়ী সাগরই, অবশ্য অন্যরাও দায়ী ছিলো। মানুষটার কাছে ক্ষমাটুকুও চাইতে পারেনি। এত অনুতাপ, এত গøানি, কাকে বলব এসব? কে বুঝবে?

কবর দেয়ার সব আয়োজন হয়ে গেছে। পাড়া-পড়শী নাক সিঁটকোচ্ছে, নানা কথাও বলছে হয়তো কিচ্ছু যায় আসে না তাতে। সমস্ত আয়োজনে সাগরই ছিলো। এতে যদি নিজের অপরাধ বোধটা একটু কমে, একটু যদি মানুষটার আত্মা শান্তি পায়। ক্ষমা চাওয়ার পথ আর নেই, যদি আগে ক্ষমা চাইতে পারতোম, যদি মানুষটাকে বুঝতো!

সাগর তার নিজের হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। মনের মধ্যে অনেক কথা জমে আছে। সবই অনুতাপের কারণে হয়েছে। সাগর এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার বন্ধুকে বলতে লাগলো, একজন দক্ষ শিকারি হিসেবে আমার বন্ধু রফিকের বেশ সুখ্যাতি আছে। সম্প্রতি ও চল্লিশ অতিক্রম করেছে। তবুও ওর চেহারায় সবসময় আনন্দের ছাপ স্পষ্ট, চোখ জোড়া তন্দ্রালু এবং চমৎকার হাসির অধিকারী। ও একজন রসিক ও প্রাণোচ্ছল মানুষ। তাছাড়া একজন সৎ, উদার, মৃদুভাষী ও দয়াশীল ব্যক্তি হিসেবে ওর যথেষ্ট কদর আছে। তবে পশুÑপাখির প্রতি ওর দয়ার নমুনা নিয়ে লোকজনের মুখে প্রায়ই মজার সব গল্প শোনা যায়। একবার ওর বিড়ালের পা ভেঙ্গে গেলে পুরো পরিবারকেই ও ত্যাজ্য করে দিয়েছিল প্রায়। কারণ ওর পরিবারের সবাই পরামর্শ দিয়েছিল বিড়ালটিকে নদীতে ফেলে দিতে।

যাইহোক, সেবার বিড়ালের পা ভাল না হওয়া পর্যন্ত ওটার সেবা-শুশ্রƒষাতে ওকে যথেষ্ট সময় দিতে হয়েছিল। আরেকবার ওর একটা মুরগী যখন অন্ধ হয়ে গেল ও নিজেই ওটার জন্য বিশেষ একটি খাঁচা তৈরি করেছিল। নিজ হাতে মুরগীটাকে ও খাওয়াতো, ওটার পছন্দের ঘাস এনে দিত আর প্রায় প্রতিদিনই খাঁচাটা পরিস্কার করতো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মুরগীটাকে ও জবাই করেনি বরং মৃত্যুর পর যথাযথ সম্মান ও ভাবগাম্ভীরে‌্যর সাথে ওটার সৎকার করেছিল। গুজব আছে, প্রিয় মুরগীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ও দীর্ঘক্ষণ কেঁদেছিল।
তার বন্ধু কখনোই তার শিকারের মাংস খায় না। জিজ্ঞেস করলে বলে, যাকে খুন করার জন্য আমার হাত নিশপিশ করে, আমার মুখ তার মাংস খেতে অস্বীকার করে।’

আমার বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র আমার বেশ ভালই জানা আছে। তাই ওর শিকারের চমকপ্রদ কাহিনী আর এমন অদ্ভুত স্ববিরোধী চরিত্র আমাকে খুব অবাক করে। ও একদিকে যেমন অন্ধ মুরগী ও খোড়া বিড়ালের জন্য ব্যথায় কাতর হয় আবার অন্য দিকে তিতির, খরগোশ কিংবা হরিণের প্রাণ বধ করে প্রচন্ড আনন্দ পায়। বার বার ব্যর্থ হওয়া সত্বেও ওকে শিকার থেকে নিবৃত্ত করতে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। ওকে সতর্ক করে বলেছি, জীবন ব্যথার বদলে ব্যথা ও আনন্দের বদলে আনন্দ ফিরিয়ে দেয়। আমি বারবার ওকে একটি পুরনো প্রবাদ মনে করিয়ে দিয়েছি, ‘চোখের বদলে চোখ আর দাঁতের বদলে দাঁত।’ অথচ ও নির্বিকার মাথা দুলিয়ে বলত, ‘শিকার করা হালাল। তাছারা অন্য কোন খেলায় আমি এত আনন্দ পাইনা।’

পাশ থেকে একজন বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলো, ‘এই তুমি চুপ কর। ও তো পাগল হয়ে গেছে। ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দে।’

তবুও সাগর বলতেই লাগলো, আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি, শিকারে ও কেন এত আনন্দ পায়। শিকার কি ওর কাছে পলাতক কিছুকে খুঁজে পাবার নেশা, বিদ্রোহীকে পরাভূত করার আনন্দ, নাকি দূরের কিছুকে নিজের করে নেবার সুখ? নাকি এটা এক ধরনের শরীর চর্চা? ও আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, জীবনের দুঃশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া আর মাটি, পাথর, মেঘ ও বাতাসের ঘ্রাণ নেওয়ার মত অসংখ্য অনুভূতি শিকারের মধ্যে কাজ করে। ও খুব দৃঢ় কন্ঠে বলেছিল, ‘একজন শিকারির কাছে শিকার হল ভোর ও সন্ধ্যার আনন্দ, নিজের ঘামে স্নান-সুখ লাভ আর শিকারের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের হৃদ-স্পন্দন উপভোগ করা।’ আমার বন্ধু কাঁধ ঝাকিয়ে বলেছিল, ‘আহা! শিকারিই কেবল শিকারের আনন্দ বুঝে। শিকারের অভিজ্ঞতা দেহ ও আত্মার এক বিপুল স্ফুর্তি। আমার এই দেহ যখন চার দেয়ালের ভেতর বন্দি হয়ে পরে তখন ঈশ্বর আমাকে এভাবেই সাহায্য করেন।’

দীর্ঘদিন পর জীবনকে পবিত্র করার কথা বলে আমার বন্ধু যখন পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল তখন এইসব আলাপচারিতার কথা আমার স্মৃতির দুয়ারে কড়া নেড়ে গেল। ওর মধ্যে আমি কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ওকে বললাম, বন্ধু, তোর চোখ কিছু বলতে চাইছে।’ থুতনিতে হাত রেখে ও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমার হাত ধরে প্রায় জোর করেই পাশে বসিয়ে গলা পরিস্কার করে বলল, ‘শোন। গতকাল আমি একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, একটা তিতির পাখিকে আমি হত্যা করেছি। কিন্তু ওটার কাছে গিয়ে দেখি মরেনি, যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি ছুরি দিয়ে ওটাকে জাবাই করলাম। এই স্বপ্ন দেখার পর সকালে আর শিকারে যেতে পারিনি। অবশ্য এমন মেয়েলীপনার জন্যে আমি নিজের কাছেই খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। তাই দুপুরের খাবার সেরেই শিকারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পরলাম।’

“কিন্তু বাইরে বের হবার আগেই বাবা! বাবা! বলে আমার বন্ধু আমার পথ আগলে দাঁড়ালো। আমি ওকে কোলে নিয়ে আদর করলাম; ওর চোখ, ওর কপাল আর থুতনিতে চুমু খেলাম। ওকে বললাম, ফিরার সময় তোমার জন্য কী নিয়ে আসবো বাবা। ও দুই হাত প্রশস্ত করে বলল, ‘এত্ত বড় একটা পাখি, সত্যিকারের পাখি।’ বললে কি তুই বিশ্বাস করবি বন্ধু, সারাটাদিন আমি এক পাহার থেকে আরেক পাহারে ছুটাছুটি করেছি কিন্তু একটা পাখিও মারতে পারিনি। অনেক তিতির আমার চোখে পরেছে, অন্তত দশটাকে লক্ষ্য করে গুলিও করেছি কিন্তু একটাও মরেনি। এ কথাগুলো আমি না বলে যদি অন্য কেউ বলতো, আমি নিশ্চিত তুই বিশ্বাস করতিনা। কারণ তুই জানিস, শিকারে আমি কতটা দক্ষ। জানিনা কেন এমন হল, তবে বুঝতে পারছিলাম আমার চোখ আর হাতের মধ্যে সেদিন কোন সখ্য ছিল না। ঐ স্বপ্নই আমার চিন্তা আর অনুভূতিকে নিষ্ঠুরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, আমাকে নিজের প্রতি বাক্রুদ্ধ করে তুলেছে। আমি বরাবরই তোর পরামর্শগুলো অবজ্ঞা করেছি। আমি বুঝতে চাইনি, জীবনেরও নিজস্ব একটা হিসাব আছে, এ হিসাব সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের ভেতরকার কোন এক অদৃশ্য শক্তি অনিচ্ছা সত্বেও আমাদের কিছু কিছু কাজ করতে বাধ্য করে আবার কিছু করা থেকে বিরতও রাখে। এখন বুঝতে পারছি, জীবনের এই কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।’

‘যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সব আশা-ভরসা ছেড়ে দিয়ে আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। ঐ মুহূর্তের পরাজয় আমার হৃদপিন্ডকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছিল আর ঐ অভিশপ্ত স্বপ্ন বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। জানিনা কেন, তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম ঐ স্বপ্নই আমার ব্যর্থতার কারণ। এরকম এক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে আমি যখন তাড়াহুড়া করে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছি ঠিক তখনই রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে একটা শিয়াল তীরবেগে আমার সামনে দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল। আমি সাথে সাথেই ওটাকে গুলি করে মেরে ফেললাম। ওটার লোমের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ ছিল না। কারণ তুই জানিস এই ঋতুতে শিয়ালের লোমের কোন মূল্য নেই। আমি শিয়ালটিকে হত্যা করেছিলাম শুধুমাত্র প্রকৃতি ও আমার নিজের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে, এতে যদি কিছুটা মানসিক শান্তি পাওয়া যায়! তাছারা আমার চোখ ও হাতের অসাধারণ দক্ষতার উপর আমি আবারো আস্থা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম আর সেই সাথে চেয়েছিলাম ঐ দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি।’

‘কিন্তু মৃত শিয়ালটার দিকে এগিয়ে যেতেই ছোট ছোট তিনটা শিয়াল ছানা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে ডাকাডাকি শুরু করল। আমার বুঝতে বাকি রইল না, আমি ঐ তিনটার মাকে হত্যা করেছি। এক অর্থে, আমি এক মার সাথে তার সন্তানদেরও হত্যা করেছি। কারণ মাকে ছাড়া ঐ বাচ্চা শিয়ালগুলোর পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তখন মনে হচ্ছিল, আমার হৃদপিন্ড ভেদ করে বর্শার ফলা ঢুকে গেছে আর কেউ লাঠি দিয়ে আমার মাথায় আঘাতের পর আঘাত করছে। কিন্তু মুহূর্তেই আমার ঐ যন্ত্রণা বিস্ময় ও আনন্দে রূপ নিল, যখন দেখলাম মৃত শিয়ালটির মুখে আধমরা একটি তিতির পাখি ছটফট করছে।’

সবাই হা করে সাগরের কথাগুলো শুনছিলো। কারো কারো কাছে ভালোও লাগছিলো, যদিও সাগর পাগলের মতো প্রলাপ বকছিলো। এদিকে সাগর বলেই চলছে।-‘ঐ মুহূর্তের অনুভূতি তুই কল্পনাও করতে পারবি না। আমি একটা ভয়ানক অন্যায় করেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঐ মা শিয়ালের কাছে তার ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ততোখানিই আদরের ছিল ঠিক যতোখানি আমার সন্তান আমার কাছে। হয়তো আমার ছোট ছেলের মত করেই ঐ শিয়ালের কোন এক ছানা তাকে বলেছিল মস্ত বড় একটা তিতির পাখি ধরে নিয়ে আসতে।’

‘হতে পারে, ঐ শিয়ালটিও আমার মত সারাদিন ঘুরে কোন তিতির পাখি পায়নি। আর যখন পেল তখন আমিও গিয়ে হাজির হলাম তার জীবনটা কেড়ে নেবার জন্য। এক মা ও তার সন্তানদের মুখের গ্রাস লুট করে নিজের সন্তানকে উপহার দেব বলেই হয়তো এমন নিয়তি! ঐ মা শিয়ালটা কি জানতো, মুখে করে সে যে আহার নিয়ে এসেছে তা তার সন্তানদের ভাগ্যে নয় বরং আমার সন্তানদের ভাগ্যে লেখা রয়েছে? পারলে তুই এ প্রশ্নের উত্তর দে।’

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমার বন্ধু এমনভাবে ওর ঠোট নাড়লো যেন খুব সুস্বাদু কিছু খাচ্ছে। ও বলল, ‘এ ঘটনা আমার বোধ-বুদ্ধির বাইরে। কারণ এখানেই সব শেষ নয়, আরো কিছু আছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। যদিও কষ্ট হচ্ছে তবুও বলছি, একটা পাখির জন্য আমার পুত্রের নিষ্পাপ আবদার আমাকে ঐ ভ্রমের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিল। আমি নিজেকে সান্তনা দিয়ে বললাম- আমি তো কোন অন্যায় করিনি, তাহলে নিজেকে অপরাধী ভাববো কেন। পুরো ঘটনাটিকে উদ্ভট কল্পনা হিসেবে মেনে নিয়ে আমার শিকারি জীবনের আরো একটা দিনের সফল সমাপ্তির জন্য আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। আমি ভুলে গেলাম কিংবা ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম, আমার ঝোলায় যে রক্তাক্ত সেটা আমার নয় বরং এক দুর্ভাগা মা শিয়ালের শিকার। কিন্তু তারপরও, পাখিটা হাতে পাবার পর আমার পুত্রের মধ্যে আনন্দের যে উচ্ছ¡াস আমি দেখিছি তার পুরো কৃতিত্ব আমার সাধু চিন্তায় ঐ শিয়ালটিরই প্রাপ্য বলে মনে হল।’

সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একজন প্রতিবেশি ছিলেন ডাক্তার। তার আপ্রাণ চেষ্টাতেই সে রাতে আমার ছেলেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। এখনো ঐ দৃশ্যের কথা মনে পরলে আমার বুক কেঁপে উঠে, আমি অসুস্থ হয়ে যাই।’ এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমার বন্ধু চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে আমার কাধে হাত রেখে বলল, “আমার সাথে বল ‘জীবন পবিত্র!’ আমাদের অজান্তেই জীবন আমাদের আলোকিত করে।”

আমি আরো একবার বললাম, ‘জীবন পবিত্র’। সেই সাথে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে কি তুই শিকার করা ছেড়ে দিয়েছিস?’ আমার বন্ধু বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল, ‘এত কিছু বলবার পরও তুই সন্দেহ করিস কিভাবে?’
পাশ থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিলো সাগরকে।

তারপর সাগর যেন একটা হুঁস ফিরে পেলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মিতা মাসীমা! তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাকে আমার অনুতাপ থেকে মুক্ত করো। আমি আর কারো সাথে অন্যায় করবো না।