মনপুরায় প্রতিনিয়ত কৃষকের গরু-মহিষ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র 

  • নেশা জাতীয় খাবার কৃষককে খাইয়ে গরু চুরি 
  • থানায় জিডি করে প্রতিকার পাচ্ছেনা
    গত এক মাসে শতাধিক গরু-মহিষ চুরি

মনপুরা (ভোলা) প্রতিনিধি  :

ভোলার মনপুরায় প্রতিনিয়ত কৃষকের গরু-মহিষ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র । কোরবানী ঈদকে সামনে রেখে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে চক্রটি। গত একমাসে সংঘবদ্ধ চোর চক্রটি মনপুরার মূল ভূ-খন্ড ও বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে শতাধিকের ওপর গরু-মহিষ চুরি করে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কৃষক।

থানায় অভিযোগ ও জিডি করে প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে কৃষকের। এতে গরু-মহিষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন উপকূলের কৃষকরা।এতে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন এলাকার মানুষ। কখন গোয়াল ঘর থেকে গরু চুরি হয়ে যায়। প্রতি রাতেই কোনো না কোনো এলাকায় হানা দিচ্ছে সংঘবদ্ধ চোরের দল। ভূক্তভোগীরা জানান, চুরির ব্যাপারে থানায় মামলা করে কোনো লাভ হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে হাতে নাতে চোর ধরে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর কাছে দিলেও যাচাই-বাছাইয়ের নামে পাগল ও রাজনৈতিক বিবেচনায় চোর চক্রের সদস্যদের আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী ছেড়ে দেয় বলে অভিযোগ কৃষকের ।

তবে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কৃষকের অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, চোর ধরে থানায় দিলেও মামলা করতে রাজি হয়না, তাছাড়াও উপযুক্ত প্রমাণও দিতে পারে না কৃষক। তাই তারা চোরের বিরুদ্ধে আইনি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনা।

সর্বশেষ রবিবার (১৮ জুন) দিবাগত রাতে উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া  ইউনিয়নের দক্ষিণ সাকুচিয়া গ্রামের একটি বাড়ীতে গরু চুরির করার পরিকল্পনা করার সময় চারজনকে ধাওয়া করে এলাকাবাসী।

এতে তারা ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায়। সোমবার (১৯ জুন) সন্ধ্যা ৭টার সময় কোড়ালিয়া বাজারে গরু ব্যাপারি শাহাবুদ্দীনকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে হত্যার হুমকি দেয় চার সদস্য একজন মাফু বিশ্বাস (৫০)। পরে গরু ব্যাপারি শাহাবুদ্দিন স্থানীয় চেয়ারম্যান আলহাজ্ব অলিউল্লাহ কাজলকে অবগত করলে চৌকিদার দিয়ে মাফু বিশ্বাসকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।

এতে তিনি ১৮ই জুন রবিবার রাতের কথা স্বীকার করেন। এছাড়া অভিযুক্ত মাফু বিশ্বাস গতবছর গরু চুরি অভিযোগে এলাকা থেকে পালিয়েছেন। এবার ঈদকে সামনে রেখে আবার এলাকায় এসেছে বলে জানা গেছে। অভিযুক্ত মাফু বিশ্বাস উপজেলা দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের রহমানপুর গ্রামে বাসিন্দা উজির আলী বিশ্বাস এর ছেলে।

এছাড়াও এক সপ্তাহ আগে উপজেলা আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি একেএম শাহজাহান এর ২ টি গরু চুরি করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চোরেরা। ২টি গরুর মূল্য প্রায় তিন লক্ষ টাকা হবে।

স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে বলেন,পুলিশের নজরদারির অভাব আর রাত্রিকালীন টহল না থাকার কারণে চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না। সংঘবদ্ধ চোরের দল নানা কৌশলে একের পর এক চুরি করে যাচ্ছে।

কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা যায়, কৃষক নিজাম উদ্দিনের কৃষি খামার থেকে ২টি গরু, চরশাসুদ্দিন চর থেকে ফারুক মেম্বারের ২টি গরু, কৃষক জুয়েল দাসের বইসা চরের থেকে একটি গরু, হানু বাতানিয়ার একই চর থেকে একটি গরু, হেজু ব্যাপারির বাড়ি থেকে ৩টি গরু, কুদ্দুস ব্যাপারির বাড়ি থেকে ২টি ও কৃষক নেজাম উদ্দিনের বাড়ি থেকে ১টি। এছাড়াও উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের খালেক কারবারি বাড়ি থেকে ৪টি, একই গ্রামের খালেক হাওলাদারের বাড়ি থেকে ৬টি, নাজিম ফরাজীর বাড়ি থেকে ২টি ও শামসুদ্দিন দিদার বাড়ি থেকে ৩ টি, সালাউদ্দিন এর ২টি গরু চুরি করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চক্রটি।

এই ব্যাপারে কৃষক ফারুক মেম্বার জানান, চর শাসুদ্দিন থেকে এক দিনে ১৭ টি গরু চুরি করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চোর চক্র। তখন থানায় ৮ টি জিডি করা হয়। এখন পর্যন্ত এর সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ।

এছাড়াও উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউয়িনরে বাসিন্দা কৃষক খালেক কারবারী, খালেক হাওলাদার, শাসুদ্দিন দিদার গরু চুরি করে নিয়ে গেলে থানায় জিডি করে তারা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন চোর ও চুরি যাওয়া গরু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলার চারপাশে মেঘনা নদী থাকায় গরু চুরি বেশি বাড়ছে। রাতের বেলায় যেসব বেড়িবাঁধে আলো থাকে না কিংবা অনেকটা নির্জন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশি উন্নত না বিশেষ করে সেসব এলাকায় চুরির ঘটনা বেশি ঘটছে।

ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ব্যক্তি জানান, গরুর ঘর থেকে রশি কেটে অথবা খুলে গরু নদীর তীরে ট্রলারে  তুলে নিয়ে যায়। তবে এসব ঘটনায় গরু চোরদের গ্রেফতার করতে না পারায় একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটছে।

কৃষক ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সংঘবদ্ধ চক্রটি একসাথে তিন থেকে চার কৃষকের খামাড় বা বাড়িতে হানা দেয়। প্রথমে তারা রাতের খাবারের সাথে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে দেয়। সেই নেশা জাতীয় খাবার খেয়ে কৃষকসহ পরিবারের সদস্যরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন চোর চক্রের সদস্যরা প্রথমে বাঁধা গরুর রশি ছেড়ে দেয়। পরে অপর সদস্যরা গরু নিয়ে নদীর পাড়ে চলে যায়। নদীর পাড়ে আগে অবস্থান নেওয়া অপর সদস্যরা বোট চালু রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। যখন গরু নিয়ে চক্রের সদস্যরা নদীর পাড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ট্রলারে উঠিয়ে নিয়ে যায়। চুরি করা গরু ভোলা, চরফ্যাসন, নোয়াখালী, লক্ষীপুর নিয়ে বিক্রি করে বলে জানায় একাধিক কৃষক।

এই ব্যাপারে দক্ষিন সাকুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান আলহাজ্ব অলি উল্লাহ কাজল জানান, ইদানিং গরু-মহিষ চুরি বেড়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে বললেও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় চুরি মাত্রা বেড়ে গেছে ।এতে করে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ কৃষক ও গরু খামারের উদ্যোক্তারা।

একই কথা বলেন মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানত উল্লা আলমগীর ও হাজিরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন হাওলাদার ।

এই ব্যাপারে মনপুরা থানার সদ্য যোগদানকৃত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, গরুর চুরির থানায় জিডি ও মামলা রয়েছে।চুরিরোধ করতে বিট পুলিশ ও গ্রাম পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে । পুলিশ সংঘবদ্ধ চক্রটি ধরতে অভিযান পরিচালনা করছে।অতিদ্রুত চক্রটি ধরা পড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে নিজ নিজ গ্রামের মানুষদেরও সতর্ক থাকতে বলে দেওয়া হয়েছে।