১ মাসেও খোঁজ মিলেনি মনপুরার নিখোঁজ ২০ জেলের 

রাকিবুল হাসান, মনপুরা ভোলা প্রতিনিধি :
কেউ স্বামীর জন্য, কেউ সন্তানের জন্য, আবার কেউ কেউ বাবার জন্য অপেক্ষা করছে।বিছিন্ন দ্বীপ মনপুরা জনতা ঘাট থেকে গত ২২ অক্টোবর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ট্রলার নিয়ে সাগরে ইলিশ ধরতে গিয়েছিলেন ২০ জেলে । ১মাসেও ২০ জেলের খোঁজ মেলেনি। নানা দপ্তরে যোগাযোগ করে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারছেন না, নিখোঁজ জেলেদের অবস্থা সম্পর্কে। এ নিয়ে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।

দীর্ঘদিনেও সন্ধান না পাওয়ায় তাদের জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনরা । পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নানা সংকটে ভুগছে জেলে পরিবারগুলো। অনেকে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। অনেকের সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখা এই পরিবারগুলো আর্থিক সহায়তা চায়।

দ্বীপ জেলা ভোলা একমাত্র বসতি দ্বীপ মনপুরার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নে কান পেতে শুনি কান্নার শব্দ । বুক ফাটা আহাজারি । এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যায় আত্ময়ী, একই দৃশ্য- শোকের ছায়া ইউনিয়ন জুড়ে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ওই ইউনিয়নের এফবি-রিনা-১ নামে একটি মাছ ধরার ট্রলার নিখোঁজ হন ।এতে ট্রলাটিসহ ২০জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন । সকলেই প্রতিবেশী এবং একই এলাকার আত্মীয়-স্বজন। ফলে নিখোঁজ মানুষগুলোর খোঁজ নিতে গেলে সবার আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ।

অভাবের সংসারে পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোটাতে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন তাঁরা । সাগরে সেটিই ছিল তাঁদের শেষ যাত্রা। এরপর থেকে এক মাস পেরিয়ে গেছে, তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায়নি, পরিবারে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। তাঁরা বেঁচে আছেন নাকি সলিলসমাধি হয়েছে, তা বলতে পারছেন না স্বজনেরা। তবে তাঁরা জীবিত ফিরে আসবেন, এমন আশা তাদের ।গভীর সমুদ্রে ইলিশ ধরতে গিয়ে প্রতিবছর অনেক জেলে নিখোঁজ হন। এদের কারো লাশ ফিরে আসে পরিবারের কাছে, অনেকের পরিবার জানতেই পারে না নিখোঁজ জেলে বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। বহু বছর পরে কালেভদ্রে দু’একজন ফিরে আসে বলে হতভাগ্য পরিবারের সদস্যরা আশায় বুক বাঁধেন- হয়তো একদিন ফিরবে তার স্বজন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর তাদের শেষ হয় না । প্রতিদিন অধীর আগ্রহের সাথে থাকে কখন আসে ফোন বা ডাক যে নিখোঁজ জেলের সদস্য বলছে আমি বেঁচে আছি ।

ইলিশ বেড়েছে নাকি কমেছে?- সে হিসাব আছে অনেকের কাছেই ।কোন আড়দার কত জেলেকে টাকা দিতে পারছে।আর কেমন টাকা আদায় করতে পারছে সেই হিসাব কষছে । জেলে-আড়তদারদের কেউ লাভে, কেউ লোকসানে, এভাবেই চলছে বছরের পর বছর । আয়-ব্যয়ের এই হিসাব সবার কাছে থাকলেও ইলিশ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ কিংবা প্রাণ হারানো জেলেদের খবর রাখেন বা ক’জনে ? প্রশাসন জনপ্রতিনিধি বা পড়াপ্রতিবেশী ।
২০ জেলে নিখোঁজ হলেও নেই কারো কোন মাথা ব্যাথা। কিন্তু সাধারণের কী-ই বা করার আছে! সবাই খেটে খাওয়া মানুষ।

সাগরে কি ভাবে মাছ শিকার করতে হয় সেই গল্প শুনান সমুদ্রগামী বোটের মাঝি আলাউদ্দিন ।তিনি বলেন তীর থেকে যখন বাহির হই তখনি পৃথিবীর সব মায়া রেখে যেতে হয় । আবার কি আসিতে পারিবো এই তীরে এর কোন সম্ভাবনা থাকে না । প্রবল ঝড়ের মুখে তুফানের সঙ্গে যুদ্ধ করে ডুবে যাবে এক অবস্থা থেকে জীবিত ফিরে আসি। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন,ঘূনিঝর্ড় বুলবুল এর সময় সমুদ্রের অবস্থা খারাপ দেখে আমরা কিনারের দিকে ফিরছিলাম । আমাদের ট্রলার এর পাশ দিয়ে অপরিচিত একটি ট্রলারা যাচ্ছিলো । উত্তাল সাগর হঠাৎ পাশ থেকে একটি ঢেউয়ে ট্রলার উল্টে যায়। ট্রলার ধরে কয়েকজন বাঁচার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তাদের কে আমাদের ট্রলারে উঠানোর সম্ভব হয়নি । কারণ তখন নিজে বাচঁতে হিমসিম খেতে হয় ।পাশাপাশি ২ ভাইয়ের ট্রলার থাকলেও যখন সাগর উত্তাল হয় ।ভাইয়ের ট্রলাটি যদি দূর্ঘটনা ঘটে তা হলে সেখান থেকে ভাই কে তোলার মত অবস্থা থাকে না অপর ট্রলারে ।

সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ফিশিং ট্রলারসহ ২০ মাঝি-মাল্লা গত ১ মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। আহাজারিতে দিন কাটছে স্বজনদের। এ ব্যাপারে ট্রলার মালিক আক্তার হোসেন উল্টো ২০ মাঝি-মাল্লাকে অভিযোগ করে মনপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ্য করেন তাকে না জানিয়ে ২২ অক্টোবর রাতে জনতা ঘাট থেকে তার ইঞ্জিল চালিত ট্রলার এফবি রিনা-১ নিয়ে তারা সাগরে চলে গেছে । তবে নিখোঁজ জেলে পরিবারের সদস্যরা জানান,প্রত্যেক জেলেকে ২ হাজার টাকা করে দিয়ে বাসা থেকে নিয়ে গেছে নিষেজ্ঞার মাঝে সাগরে যেতে।

ট্রলার মালিক আক্তার হোসেন মনপুরা উপজেলা দক্ষিণ সাকুচিয়া রহমানপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত আমির হোসেন মাঝির বড় ছেলে ।

নিখোঁজ মাঝি-মাল্লারা হলেন: এফবি রিনা-১ ট্রলারের মাঝি জাহাঙ্গীর (৪০), শেখ ফরিদ (৫৫), সিদ্দিক (৪৫) ও শামীম (২৩) আলাউদ্দিন (৫৬), আবুল খায়ের (৬৫), বাতেন (৪০), ইয়াসিন (৩৫), জয়নাল আবেদীন (৭০), মিলন (৩৫), ইসলাম আলী (৫৫), ফিরোজ (৪৫), সোহাগ (৪৫), অলিউদ্দিন (৪১), সোহাগ আখন (৩৬), সুমন (৩০), আবুল কালাম (৬৪), আজাদ (৩৫), ইয়াকুব আলী (৬০), নুর সর্দার (৫৫) । সবার বাড়ি মনপুরা উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে।প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে দেখি কান্নার রোল। এখনও কেউ স্বাভাবিক হতে পারেননি।

গত ৩ নভেম্বর মনপুরা থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে ট্রলার মালিক আক্তার হোসেন উল্লেখ করেন, এফবি রিনা -১ নামের ট্রলারটি তাকে না জানিয়ে ২০ জন মাঝি-মাল্লা গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতের দক্ষিণ সাকুচিয়া জনতা বাজার মাছ ঘাট থেকে ২২ দিনের নিষেজ্ঞা অম্যান করে গভীর সাগরে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে । ২রা নভেম্বর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সবায় ফিরে আসলো এফবি রিনা -১ নামে মাছ শিকারের ট্রলাটি ঘাটে আসেনি । নিয়মানুযায়ী ১০ থেকে ১১ দিনের মধ্যে গভীর সাগর থেকে ট্রলারটি উপকূলে ফিরে আসার কথা।তবে গত ২৫ অক্টোবর সাগরে দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অন্য সব ট্রলার ফিরে আসলেও, এফবি রিনা-১ ট্রলারের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাঝি-মাল্লাদের অবস্থান নিশ্চিত না হওয়ায় নিখোঁজ পরিবারের পাশাপাশি তিনি নিজেও উৎকন্ঠায় আছেন।তাই তিনি ৩ নভেম্বর মনপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ।

তবে সচেতম মহল মনে করে ২২ অক্টোবর ট্রলাটি মালিক কে না জানিয়ে ২০ মাঝি মাল্লা সাগরে গেলেও মালিক কেন ৩ নভেম্বর সাধারণ ডায়েরি করেন ? এই নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগে ,তা হলে কি মালিক এই নিষেজ্ঞার মাঝে ট্রলাটি সাগরে পাঠিয়েছেন ।

তবে মালিক পক্ষ আক্তার হোসেন মাঝি বলছেন ট্রলারসহ মাঝি-মাল্লাদের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার জন্য নানাভাবে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে দেশের জলসীমা অতিক্রম করে বিদেশের জলসীমায় চলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই সরকারে সহায়তা চেয়েছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, নিষেধাজ্ঞা সময় মনপুরার উপজেলার প্রায় মাছ ধরার ট্রলার সাগরে ছিলেন।ঘূনিঝড় হামুনের প্রভাব শুরু হলে সব ট্রলার উপকূলে ফিরে আসলো এফবি রিনা-১ নামে ট্রলাটি আর ফিরে আসেনি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেন, নিষেধাজ্ঞার এই সময় মনপুরার ঘাটগুলো থেকে কিভাবে ট্রলারগুলো গভীর সাগরে গেলো..?? এতে করে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন অনেকে।

আবার অনেকে মনে করেন মনপুরা উপজেলায় মৎস্য বিভাগ থানা ও কোস্টগার্ড এর ছত্রছায়া এমনটা হয়েছে। তবে প্রশাসন বলছে নিষেধাজ্ঞা সময় কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে ।

কে নিবে এখন নিখোঁজ ২০ পরিবারের দায় । এই ২০ জেলের সাথে জড়িত আছে প্রায় শতাধিক মানুষের আহার।উপার্জনের একমাত্র ক্ষমকে হারিয়ে অনেকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।

নিখোঁজ জেলেদের মধ্যে আছেন একজন আবুল খায়ের । তিনি রেখে গেছেন ১ ছেলে ও ৬ মেয়ে ।২ মেয়ে ও ১ ছেলে বিয়ে হলেও এখনো রয়েছে ৪ মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পালা ।এখন তাদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার ।

সাকুচিয়া গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল্ল্যাহ পাটারীর ২ ছেলে ও ভাতিজা এই বোটে নিখোঁজ, শেখ ফরিদ ,সিদ্দিক ও সামীম ।সিদ্দিক ও সামীম নিয়ম অনুয়ায়ী সাগরে মাছ শিকার করলেও শেখ ফরিদ যায়নি কখনো সাগরে। সুন্দর সাজানো বাড়ি,বাড়ির প্রবেশ পথেই নিখোঁজ শেখ ফরিদ এর ঘর তার পাশে সিদ্দিক এর ঘর । বাড়িতে ঢুকতেই কান্নার গুনগুন কান্নার শব্দ । ২ ছেলে ও ভাতিযাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে বৃদ্ধি বাবা শহিল্ল্যাহ পাটাওয়ারী ।ঘরের ভেতর থেকে সিদ্দিকের স্ত্রী নিলুফার বেগমের আহাজারি কানে আসে। সিদ্দিক ও শেখ ফরিদ স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ গ্রহন করা ।কে দিবে ঋণ এই পরিবারের আর কেউ কর্মক্ষম নয়।

নাম প্রকাশ অনিশ্চুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ হওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়, এরা কতটা অসহায়! স্বাভাবিক অর্থে ট্রলার নিখোঁজ, জেলে নিখোঁজ সংবাদমাধ্যমের জন্য ছোট একটি খবর। কিন্তু ওই ছোট খবরের আড়ালে পরিবারের অসহায়ত্বের বড় খবরগুলো অন্তরালেই থেকে যায়। এদের খোঁজ কেউ নেয় না। নিখোঁজ জেলেদের পরিবারগুলো বেশি বিপাকে পড়ে। মৃত ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেলে সে হয়তো কোথাও থেকে সহযোগিতা পেতে পারে। কিন্তু লাশ পাওয়া না গেলে ওই ব্যক্তি যে প্রাণ হারিয়েছেন তার কোনো প্রমাণ পরিবার দেখাতে পারে না। তখন সব ধরনের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয় পরিবার।

নিখোঁজ শেখ ফীরদ এর স্ত্রী কুলসুম স্বামীর চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, কৃষি কাজ করতেন তাঁর স্বামী। কাজের অভাবে জীবনে প্রথম সাগরে মাছ শিকারে যান তিনি।সেই যাই তার শেষ যাত্র ।

এ ছাড়া নিখোঁজ হওয়া সংসারের উপার্জনক্ষম একমাত্র সদস্য মিলন (৩৫), ইসলাম আলী (৫৫), ফিরোজ (৪৫), সোহাগ (৪৫), অলিউদ্দিন (৪১), সোহাগ আখন (৩৬) অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল ধরা নিয়ে সংশয় রয়েছে পরিবারে।

প্রতি বছর ঘূণিঝড়ের প্রভাব বাড়ছে । সাগরে এখন জীবনের নিরাপত্তা নেই। ট্রলারের মালিক পক্ষ কিংবা সরকারের তরফে নেই কোনো জীবন বীমার ব্যবস্থা । আবহাওয়ার ওলটপালট খেলায় জেলেজীবনও আজ বিপর্যস্ত।

মনপুরা থানা অফিসার ইনর্চাজ জহিরুল ইসলাম বলেন, নিখোঁজ জেলেদের খোঁজতে আমাদের চেষ্টা অব্যহত রয়েছে। সম্ভাব্য স্থানগুলোতে আমরা খোঁজ নিচ্ছি । আমরা যে মেসেজ দিয়েছি সেই মেসেজ এখনো কোন উত্তর আসেনি । নিষেধাজ্ঞার মাঝে তারা কি ভাবে সাগরে গিয়েছে সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, রাতের আধারে তারা যেতে পারে , নদী হলে আমরা তাদেরকে ধরতে পারি কিন্তু এই ট্রলারগুলো গভীর সাগরে মাছ শিকার করতে রাতে আধারে চলে যেতে পারে ।