যারা মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে তারা অজ্ঞ ও মূর্খ

মিজানুর রহমান রানা :

মুসলমান মাত্রই শান্তির প্রতীক। একজন মুসলমানের প্রধান ও প্রথম কাজই হলো পৃথিবীতে অশান্তি দূর করে শান্তির বাণী অপরের কাছে পৌঁছে দেয়া, যা মহানবী (সাঃ) বিদায় হজ্জ্বেও বলে গেছেন। আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্ম ইসলাম। অথচ মুসলমানদের মধ্যে ক’জনই জানেন, ইসলাম কাকে বলে? এবং আমাদের ধর্মের নাম ইসলাম নামকরণ হলো কি করে?

পৃথিবীতে যতো ধর্ম ছিলো, বা এখনো আছে তার মধ্যে অনেক ধর্মের নামকরণ হয়েছে কোনো ব্যক্তির নামে বা বিশেষ কোনো জাতির নামে। ঈসায়ী ধর্মের নামকরণ হয়েছে হযরত ঈসা (আঃ)-এর নামে, বৌদ্ধ ধর্মমতের নাম রাখা হয় মহাতœা বুদ্ধের নামে, ইয়াহুদী ধর্ম জন্ম নিয়োছিল ইয়াহুদা নামে বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে।

http://picasion.com/

 

পৃথিবীতে এ ছাড়াও অন্যান্য যেসব ধর্ম আছে, এমনিভাবেই সেগুলোর নামকরণ হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ইসলাম ধর্মের আছে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তি বা কোনো বিশেষ জাতির নামের সাথে এর নামকরণের সম্পর্ক নেই। আমরা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, ‘ইসলাম’ শব্দার্থের মধ্যে একটি বিশেষ গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। সূতরাং নাম থেকে উপলব্ধি করা যায়, ইসলাম একক কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা কোনো একক জাতি-গোত্র, ধনী-গরীব-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ইসলাম অর্থ হচ্ছে শান্তি। ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, মানুষের মধ্যে ইসলামের গুণাবলী সৃষ্টি করা। পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে যুগে যুগে যেসব মানুষের মধ্যে নির্ভেজাল, সৎ, খোদাভীরু মানুষের গুণাবলী পাওয়া গেছে, তাঁরা ছিলেন ‘মুসলিম’। শান্তির প্রতীক এ ধরনের মানুষ যেমন সমাজে বর্তমান, তেমনি পরবর্তীকালসমূহে বিদ্যমান থাকবেন।

আরবী ভাষায় ‘ইসলাম’ বলতে বুঝায় আনুগত্য ও বাধ্যতা। মহান সৃষ্টিকর্তা আল­াহর আনুগত্য ও তাঁর বাধ্যতা স্বীকার করে নেয়া এ ধর্মের লক্ষ্য বলেই এর নাম হয়েছে ‘ইসলাম।” অথচ আজকের বিশ্বে কতিপয় লোক মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী, মৌলবাদী ইত্যাকার আখ্যা ঢালাওভাবে দিয়ে থাকে।

সন্ত্রাসী কাকে বলে- সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসমুলক কার্যকলাপ হলো সেটা, যা কোনো মানুষ বা দল নিজেদের ইচ্ছামতো দুনিয়াবী লাভের আশায় কোনো অসৎ এবং জনক্ষতিকর কার্যকলাপ করে থাকে, তাদেরকে সন্ত্রাসী এবং তাদের সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা যায়।

মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলা যায় কি না- আল­াহর প্রেরিত কিতাবে বলা হয়েছে : “শপথ মানুষের এবং যিনি একে সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে সৎকর্ম ও অসৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। অতএব যে নিজেকে পবিত্র করবে সে সফলকাম হবে, যে ব্যর্থ হবে সে নিজেকে কলুষিত করবে।”

কোরআন করিমে আরো বলা হয়েছে: “যুগের কছম, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকিদ করে সত্য এবং সবরের।” কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে যা বলা হয়েছে, তা হলো সত্য ও সুন্দরের এবং সৎকর্ম করার, পবিত্র হওয়ার, পাপ ও অন্যায় থেকে মুক্ত হওয়ার আদেশ। এই যদি কোরআনের বাণী ও আদেশ হয়, তাহলে যারা মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে তারা অজ্ঞ ও মূর্খ। কারণ তাদের ন্যায়-অন্যায় এবং বিবেককে সঠিক পথে পরিচালিত করার কোনো ইচ্ছা নেই। কারণ, কোরআনের বহু আয়াতে বলা হয়েছে- “জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে উপদেশ।” কিন্তু যারা মূর্খতাবশত নিজের হাতে গড়া মূর্তি, এবং দুই তিন গড-এর আরাধনা করে তারা প্রকৃত জ্ঞানী হবে কি করে, সৎ উপদেশই বা মানবে কেন? তারাতো শয়তানের ইবাদত করে, এবং তারা পথভ্রষ্ট। শয়তান তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছে। সূতরাং দুনিয়াতে মুসলমানদের কোনো প্রকার আর্থ-সামাজিক উন্নতি তাদের শরীর জ্বালা করে। এবং ছলে বলে, কৌশলে মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্যে তারা সুযোগ খোঁজে।

হযরত আবদুল­াহ ইবনে মাসউদ বর্ণিত-(রাঃ) রাসুলুল­াহ (সাঃ) বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে এমন কোনো লোক নেই, যার সঙ্গী হিসেবে এক জ্বীন ও একজন ফেরেশতা নিয়োজিত নয়?’

সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল­াহর রাসূল! আপনার সাথেও কি আছে?’ তিনি বললেন, আমার সাথেও আছে, কিন্তু আল­াহ্তায়ালা এর মোকাবিলায় আমাকে সাহায্য করছেন, তাই সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এজন্যে আমি তার ক্ষতিসাধন হতে নিরাপদে থাকি। এখন সে আমাকে কেবলই ভালো কাজের হেদায়েত করে। (মুসলিম)।

প্রকৃত আল­াহ্র বান্দা বা মুসলমানদের যখন পথভ্রষ্ট জ্বীন-শয়তানগুলো যখন পেরে উঠেনা, তখন তারা কাফেরদের ভিতর যেয়ে সুড়সুড়ি দেয়। কাফেররা শয়তানের প্ররোচনায় মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী মৌলবাদী বলে গালাগালি শুরু করে এবং মুসলমানদের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত হয়। ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের উপনিবেশিক কার্যকলাপ, পরদেশ লুন্ঠন, অন্যায় যুদ্ধ ইত্যাদি সম্পাদন ও প্রসারের জন্য যাচ্ছে তাই বলে মুসলমানদের ধন সম্পদ কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। তারা পেরে উঠছে এই জন্য, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিত্ব এমন মুসলমানদের হাতে দিয়েছে (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য) যারা আরাম আয়েশ,

ভোগ বিলাসিতায় মত্ত; তারা অনেকেই নামধারী মুসলমান, প্রকৃত মুসলমান কি না সেটা মহান রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন। যদি তারা মুসলমান বলে দাবী করে, তাবে তাদের উচিত শয়তানের প্ররোচনার তন্দ্রা থেকে জেগে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠা। সর্বোপরি, মুসলমানদের অঘোর ঘুম থেকে জাগ্রত করে মুসলিম উম্মাহর উম্মেষ ঘটানো।

আমাদের পরিচয়, আমরা মুসলিম, ধর্ম আমাদের ইসলাম, ইসলাম অর্থ শান্তি। আর প্রত্যেক মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। এটাই হবে আমাদের মূলমন্ত্র। আজ বড় প্রয়োজন, মুসলমানদের দৃঢ় প্রত্যয় বা ঈমানী শক্তির জাগরণ। শুধু সালাত, সাওম, হজ্জ্ব, যাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদিই একজন মুসলমান-এর দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়, একজন মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে- আল­াহর কাছ থেকে আমরা কি অংগীকার করে এসেছি? দুনিয়াতে আল­াহ আমাদের কি মহান দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা বারবার স্মরণ করা। সুরা ইয়াসিন-এ বলা হয়েছে-“পরিস্কারভাবে আল­াহর বাণী পৌঁছে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব।” সুরা ইয়াসিন-এ অন্যত্র বলা হয়ছে “অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় কামণা করেনা, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত।” বিবেকের কাছে বড় প্রশ্ন, আমরা শুধু কি উন্নত খাবার, ভোগ-বিলাস, আরাম- আয়েশ এবং চাকচিক্যে নয়ন ভুলাতে এসেছি? শুধু আল­াহর একটি আদেশ পালনই যথেষ্ট নয়, বরং আল­াহ-নবী (সাঃ)-এর সকল আদেশ-নিষেধ পালনই কর্তব্য।

উপরোক্ত আলোচনায় দেখা যায় যে, কোনো মুসলমান আল­াহর সৃষ্টিকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করতে পারেনা। যারা আল­াহর সৃষ্টিকে বিনা কারণে ঢালাওভাবে ধ্বংস করে, হোক তারা হরকাতুল, মরকাতুল, বাংলা অথবা ইংলিশ ভাই কিংবা ওসামা বিন লাদেন বা আলকায়দা, তারা কী মুসলমান-এর পর্যায়ে পড়ে? মুসলিম হতে হলে আল­াহর কোরআনের বিধান মোতাবেক হতে হবে। কোরআন ও হাদিস বর্ণিত সকল আদেশ নিষেধ মানতে হবে। কোরআনের অপব্যাখ্যা করে কতিপয় ব্যক্তি নিজ স্বার্থ পূরণের জন্যে দুনিয়াতে ফিতনা সৃষ্টি করে সর্বস্তরের মানুষদের হত্যা করলেই ইসলাম ও জেহাদ পালন হয় না এবং যারা দুনিয়াতে ফিতনা সৃষ্টি করে তারা কোনোক্রমেই মুসলমান নয়।

রাসুলুল­াহ (সাঃ) জিহাদ করেছেন। তাঁর সে জিহাদ ছিল আল­াহর আদেশ মোতবেক এবং সত্যের পথে অসত্যের বিরুদ্ধে জিহাদ। আমরাও তাঁর পথ অনুসরণ করবো, কিন্তু প্রথমে আমাদেরকে প্রকৃত ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান করতে হবে। ইসলামের নিয়ম-কানুন মানতে, শিখতে, শিখাতে হবে। অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের ধ্বজাধারী হতে হবে। শয়তানের কুমন্ত্রুণা থেকে নিজের ক্বলবকে পরিষ্কার করতে হবে। বর্তমান যুগে এটাই হচ্ছে প্রকৃত জিহাদ। কিন্তু এভাবে সর্বস্তরের জনসাধারণকে বিনা কারনে হত্যা, পঙ্গু করে, নির্যাতন করে যারা বলে, আমরা ইসলাম কায়েম করছি, আল­াহর কসম তারা মুসলমান নয়। নামে তারা মুসলমান হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে তারা মুসলমান নয়। আর যেহেতু এসব সন্ত্রাসীরা মুসলমান নয়, তাই ঢালাওভাবে সব মুসলমানদের মৌলবাদী, সন্ত্রাসী নামের গালাগালি করা সমীচীন ও যুক্তিসঙ্গত নয়।

মুসমানদের ওপর যারা কালিমা লেপন করে, যারা মুসলমানদেরকে নানা যায়গায় কষ্ট দেয়, নির্যাতন করে তারা শয়তান ও জ্বীন- এর অনুসারী। তাই পৃথিবীর বড় বড় দেশের এসব জ্বীন ও শয়তানের অনুসারীদের কথায় মর্মাহত না হয়ে মুসলমানগণ আল­াহ ও রাসুলের তরীকা মোতাবেক সৎপথের অনুসারী হয়ে বৃহৎ মুসলিম ঐক্য গঠণ করা উচিত এবং এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্য নিজের জান-মাল ত্যাগ করা উচিত।

আল­াহর রাসূল (সাঃ)-এর গমন পথে জনৈক বুড়ি কাঁটা বিছিয়ে রাখতো কিন্তু আল­াহর রাসূল তা পরিহার করে পথ চলতেন। তিনি মানুষকে অভিশাপ দেননি, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেননি। বরং যে বুড়ি রাসূল (সাঃ)-এর গমন পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো সেই বুড়ির অসুস্থতার খবরে তিনি নিজে যেয়ে তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। মানুষকে অন্তরের ভালোবাসা দিয়ে সত্যের পথে আহŸান ও শান্তির ডাক দিয়েছেন।

আল­াহ্ ও রাসুল (সাঃ)-এর প্রদর্শিত পন্থা অবলম্বন করলে আমাদের ওপর অবশ্যই শান্তি বর্ষিত হবে। অন্যথায়, অশান্তিই হবে আমাদের প্রাপ্তি।