ক্রেস্ট বা পুরস্কার সাহিত্যের মান যাচাই করে না

মিজানুর রহমান রানা :

কবি আল-মাহমুদের একটি প্রবন্ধের নাম দিয়েই এ প্রবন্ধের সূচনা। তিনি বলেন, প্রতিভাবান কবি-লেখককে কোনো পত্রিকার পৃষ্ঠা সম্পাদক অথবা যে কেউ কখনো অবদমন করে রাখতে পারবে না। যদি সেই কবি-লেখককের রচনা উৎকৃষ্টমানের হয় এবং লেখকের ধৈর্য-অধ্যবসায় থাকে।

বিষয় ছিলো, ‘কোনো কবি লেখককে কোনো পত্রিকার পৃষ্ঠা সম্পাদক বা যে কেউ কখনো অবদমন করে রাখতে পারবে না।’ কবি আল-মাহমুদের এই বক্তব্যটি চিরসত্যের কাছাকাছি।

এ লেখককেও এককালে বলা হয়েছিলো, লেখকের লেখা নাকি কোনো পত্রিকা ছাপাবে না। যারা ওই কথাটি বলেছিলো তারা আরও বলেছিলো, তাদের কথা ছাড়া কোনো পত্রিকা এ লেখকের লেখা ছাপাতে পারবে না। কথাটি এক সময় লেখকের কানে আসে। তিনি প্রথমে খুব খুব উত্তেজিত হন। পরে উত্তেজনা পরিহার করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এবং গভীরভাবে সাহিত্য সাধনা চালিয়ে যেতে থাকেন নীরবে-নিভৃতে। সাহিত্য সাধনায় সবসময় চেষ্টা করেন মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা বজায় রাখার।

বিধির কি খেলা। একদিন তার জন্যে আশির্বাদের পেয়ালা হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন কাজী শাহাদাত সাহেব। লেখক উৎসাহ ভরে তার জমিয়ে রাখা রচনাগুলো ওই পত্রিকায় প্রসব করতে লাগলেন একের পর এক। পুরস্কারও পেতে থাকলেন পর পর। তার সেই সমালোচনাকারীরা তো হতবাক। তাদের মুখ থেকেই কথা বেরুতে লাগলো, ‘সব পুরস্কার কি আপনিই একা ভোগ করবেন নাকি। আমাদের জন্যে কিছুই রাখবেন না?’

লেখককে এক সময় কাজী সাহেব চরণতলে, ছায়াতলে আশ্রয় দিলেন। লেখক তাঁর কথামত, উপদেশমত কাজ করতে লাগলেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে।

পরম ধৈর্য, ত্যাগ ও সাধনা-বলে আজ লেখক দুটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক।

তিনি চাঁদপুর টাইমস অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন দুই বছরের অধিককাল ধরে। চাঁদপুরের অনেক স্থানীয় পত্রিকার বিভিন্ন পদে থেকে কাজ করেছেন।

লেখক কর্মজীবনে এ পর্যন্ত কোনোদিন স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করেননি এবং ভবিষ্যতেও করার কোনো ইচ্ছে নেই তার। কাছের কোনো লোকের রচনা যদি উৎকৃষ্ট না হয় তাহলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন না। বরং যদি কারো উৎকৃষ্ট রচনা পাওয়া যায় তবে সেটা ১০ কিমি দূরেও থাকে তিনি কষ্ট করে গিয়ে হলেও নিয়ে আসতেন। এক্ষেত্রে তিনি তার মানিব্যাগ থেকে অর্থ খসাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। তবু চেষ্টা করেন একটি উৎকৃষ্ট রচনা উপহার দেয়ার জন্যে।

কিন্তু এর বিপরীতে যদি তিনি এমন কিছু মানুষের কাছ থেকে (যাদের তিনি কবি-লেখক হিসেবে জানেন) কোনো ধরনের আশাহীন অবাস্তব, উদ্ভট কথা উচ্চারিত করতে দেখেন (যা সত্যের অপলাপ) তাহলে তিনি মনে খুব কষ্ট পান। যদি লেখকের ‘লোভ-লালসা অর্থ যশ’-এর পেছনে থাকার ইচ্ছে থাকত তাহলে তিনি আরও অনেক আগেই সেটা করতে পারতেন এবং তাও প্রকাশ পেত জনসম্মুখে। লেখক বলেন, মহাকালের বিচারে ভবিষ্যত কর্মকান্ডই প্রমাণ করবে কে ‘মুর্খ-পন্ডিত!’ আর কে ‘ভালো মানুষ।’

এককালে লেখক সাহিত্যক্ষেত্রে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন বলে তিনি জানেন তার মতনই অন্য একজন লেখকের মনের কষ্টের কথা। সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে এক শ্রেণীর মানুষ। উপহাসও করতে ছাড়ে না। তাদের সাহিত্যচর্চার পথকে নানাভাবে কণ্টকাকীর্ণ করতে চায়।

মূলতঃ কবি-লেখককে অধ্যবসায়, ধৈর্যধারণ করতে হয় এবং উৎকৃষ্ট কিছু লেখার চেষ্টা-সাধনা করতে হয়। আর একজন কবি-লেখকের রচনা যদি মানসম্মত হয় তার মনে ধৈর্য-সাধনা থাকে তাহলে তো কবি আল-মাহমুদের কথাই সমভাবে প্রযোজ্য। কেউ তাদের অবদমন করে রাখতে পারবে না। আর অবদমন করে রাখতে চাইলেও সেটা হবে অবদমনের ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।

জেনে রাখবেন, ক্রেস্ট বা পুরস্কার সাহিত্যের মান যাচাই করে না। কারণ বর্তমানে নগদ নারায়ণ বা দক্ষিণা দিলে বহু অখ্যাত লেখকও ক্রেস্ট বা পুরস্কার পায়। আবার কিছু বিশেষ গোষ্ঠী আছে, যারা টাকা গ্রহণ করে নিজেদের লোকদেরকে সাহিত্যক্ষেত্রে সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট প্রদান করে থাকেন। মূলত এরা মানুষের প্রতিভা বা মেধাকে নষ্ট করে দিয়ে একজন লেখককে পঙ্গু করে দেয়।

সাহিত্যক্ষেত্রে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই সেটা সেই মানের হতে হবে, যা পাঠক তাকে চিরদিনের জন্যে মনে রাখবে। ভাঁড়ামো করে, জোর করে কখনো সাহিত্যক্ষেত্রে টিকে থাকা যায় না।