ধূসর ধূলির আড়ালে রয়ে গেল যে উপখ্যান : প্রকৌ. মো. দেলোয়ার হোসেন

প্রকৌ. মো. দেলোয়ার হোসেন :

মহান মুক্তিযুদ্ধের মহাসমুদ্রে গুটিকয়েক দ্বীপসম মানুষ জেগে উঠেছিলেন উনিশশ’ একাত্তর সালে। সে দ্বীপগুলো দারুণ সজবি ছিলো সে সময়। আমরা যারা সে সময় আনাড়ি নাবিক ছিলাম দুরন্ত একাত্তরে তারা এপাড়ে ওপাড়ে পাড়ি জমাতাম যুদ্ধাস্ত্র বহন করতাম, যুদ্ধ করতাম অসম শক্তির বিরুদ্ধে তাদের আকর্ষণ ছিলো এসব দ্বীপসম মানুষেরা।

আজ এই দ্বীপ সম মানুষেরা হারিয়ে যেতে বসেছেন। নতুন প্রজন্ম তাদের পরিচয় জানে না। আমরা মনো করি তাঁদের পরিচয় জানানো আমাদের শুধু কর্তব্যই নয় ঐতিহাসিক দায়িত্ব। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর নয়টি মাস আমরা অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে ছিলাম এখন এঁদের ত্যাগ-তীতিক্ষা, মেধা-মনন আমাদের সম্মুখে এগিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছে, যুগিয়েছে প্রেরণা। ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, শুরু করেছিলো পাকিস্তানী বর্বরবাহিনী। নয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর একাত্তরে উড়লো বিজয়ের পতাকা।

২৬ মার্চ-১৬ ডিসেম্বর দুটি ঐতিহাসিক দিন। ঐতিহাসিক ঘটনা। যে ঘটনা কোনো জাতির ইতিহাসে গতিধারায় পরিবর্তন আনে তাই ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে জাতীয় জীবনে গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ছাব্বিশ মার্চ উনিশ শ’ একাত্তর উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি নূতন স্রোতের সৃষ্টি হয়। একটি নূতন দেশের জন্ম ঘোষিত হয়। এই দিনটির তাৎপর্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বেশি বিচার্য।

স্বাধীনতা দিবস শুধু কিছু ঘটনার সূত্রপাত নয়। বাঙালি জাতির বৃহত্তর অর্থে মুক্তিকামী মনুষ্যজাতির আত্মার স্বাধীকারকে উন্মোচন করেছিলো। স্মরণীয় যে, ২৬ মার্চ, ১৯৭১ বাঙালি জাতির চলার পথে এবং ইতিহাসে একটি দিক নির্দেশনা। এই নির্দেশনায় দাঁড়িয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে, কোন পথ ধরে আমরা এখানে এসেছি, কেনই বা এখানে আসলাম। আমাদের ভবিষ্যৎ চলার পথ কী এবং কোনদিকে। যদি দিক নির্দেশনায় ভুল থাকতো তবে জাতির জন্যে তা’ ডেকে আনতো চরম বিপর্যয়। অতীতকে রোমন্থন করে চলার পথের নির্দেশিকা স্থাপনে চেষ্টা করতে হবে।

এই দিনে আমাদের স্মরণ করতে হয় কি এক আশ্চর্য সময় এসেছিলো আমাদের জীবনে, আমাদের ইতিহাসে। এক সুসময় আর কখনও আসেনি। এত দুঃসময় আর কখনও দেখিনি আমরা। বর্বরের নিষ্ঠুর আঘাত যখন অকস্মাৎ নেমে এসেছিলো বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে তখন কি অশ্র“ আর রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলো বাংলার বুক? বিন্দু বিন্দু স্বেদধারা নেমে এসেছিলো কঠোর শ্রমে। শক্ত হয়েছি দেহের পেশী সংকল্পে ও দৃঢ়তায়। রাত্রির অন্ধকারে নিজ হাতে কবর খোঁড়ে স্বামীকে শুইয়ে দিয়েছিলো স্ত্রী। মা সাজিয়ে দিয়েছিলো তার সন্তানকে রণসজ্জ্বায়। ধর্ষিতা বোনোর স্তব্ধ চোখে চোখ রেখে নীরব প্রতিজ্ঞায় জ্বলে উঠেছিলো ভাই। লাউয়ের সবুজ মাচা, নদী-মাঠ, আর কলাইয়ের ক্ষেত, পুকুর পাড় ও মাঠ পেছনে ফেলে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ ছুটেছিলো নিরাপত্তার সন্ধানে। কলম ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো ছাত্র, লাঙ্গল ফেলে চাষী, কোদাল-গাঁইতি ফেলে শ্রমিক। আর নারী তার কোমল হাতে শক্ত করে ধরেছিলো লাল-সবুজের সেই পতাকাÑ যা শোকের অশ্র“ মুছে দেবে, একত্র হবার জায়গা করে দেবে। কখনও নত হবে না যা। সেই দুরন্ত উত্তেজনাময় শোকাবহ সৃষ্টিচঞ্চল দিনগুলোর গাঁথা লেখা আছে ফসলের দগ্ধ ক্ষেতে, গৃহের ভগ্ন¯ত‚পে, গাছের গুলিবিদ্ধ পাতায় আর ভাঙ্গা পুলের গোড়ায়। যে কথা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ঝোঁপে-ঝাড়ে, বৃক্ষরাজির পাতায় পাতায়Ñ সর্বস্তরে। শত্র“ হননের যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর নব প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা শপথ করেছিলো মহান একাত্তরে। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর শহীদের রক্তে ভিজে সংহত হয়েছিলো বাংলার সবুজ প্রান্তর।

স্মরণ করে শিউরে উঠি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কতভাবেই না চেষ্টা করেছিলো বাংলার মূল চেতনা প্রবাহকে বিপথগামী করতে। বাঙালির সহস্র বছরের ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোতকে চেয়েছিলো মন্থর করতে, চেয়েছিলো স্তব্দ করতে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, ত্রাস, লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন বাংলার সশস্ত্র জাগরণ ঘটিয়েছে। জাতীয় এই জাগরণের ভেতর ছিলো আপামর বাঙালির সার্বিক ঠিকানা। নিজস্ব আবাসভূমি নির্মাণ এবং ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের শৃঙ্খল মোচনের জন্যে যুদ্ধ করেছিলো দেশপ্রেমিক বাঙালি।

সেদিন আমাদের জেলা চাঁদপুরও পিছিয়ে থাকেনি। আজ ঊনচলি­শ বছর ধরে ধূলো জমে জমে বৈরী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ধূসর হয়ে গেছে অনেক গৌরবজনক স্মৃতি। আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের বীর সন্তানদের। সে সব মেধাবী সন্তান যারা তাঁদের মেধা-শ্রম, ঘাম আর রক্ত দিয়ে আমাদের জন্যে নির্মাণ করে গেছেন সূর্যের নিচে এক টুকরো ভূমি। পবিত্র ভূমি। স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশ। এই প্রবন্ধে আমরা তেমনই ক’জন অমৃতের সন্তানকে স্মরণ করবো।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার পর বাঙালিরা অশনি সংকেত ও সাথে সাথে দিক নির্দেশনা পেয়ে যায়। পাকিস্তান সরকারও বুঝে যায় বাঙালিরা আর তাদের পদাবনত রইবে না। ২৫ মার্চ রাতে ইতিহাসের জঘণ্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়। আলোচনার আড়ালে প্রস্তুতি গ্রহণ করা বর্বর পাকসেনারা কাপুরুষের মতো হামলা করে বসলো। সেনা চাউনিসহ সর্বত্র প্রতিরোধ শুরু হলো। যশোহর সেনানিবাসে ছিলো বাঙালি সেনাদের গর্ব ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনে দ্বিধা ছিলো তারা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিলেন না। কিন্তু নদীর স্রোত ও জনমানুষের বিপ্লব কখনও থেমে থাকে না। একজন সাহসী তরুণ সেনা কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। বাইশ বছর বয়সী এই তরুণ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কৃতী ছাত্র। সত্তর সনে পাকিস্তানের কাবুল মিলিটারী একাডেমী থেকে লং কোর্স সমাপ্ত করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লে. হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। শাহরাস্তি উপজেলার সোনাইমুড়ি গ্রামের পাটওয়ারী বাড়িতে জন্মেছিলেন তিনি। পিতা পুলিশ কর্মকর্তা আ. হক। মাতা নূরজাহান বেগম। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ২৯ মার্চ সম্মুখ সমরে শহীদ হন এই তরুণ সেনানায়ক। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রিয় সন্তানের রক্তমাখা পোশাক বুকে জড়িয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তাঁর অপ্রকৃতস্থ মা। আমি শহীদ লে. আনোয়ার হোসেন বীর উত্তম-এর কথা বলছি। তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়ে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ আনোয়ার কলেজ স্বীয় অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদপুর জেলাবাসী ক’জন সে কথা জানি! মানুষের প্রথম পরিচয় তাঁর নাম। দ্বিতীয় পরিচয় তাঁর ধাম। তাই নাম-ধাম তাঁর পরিচয়। স্বজনদের সাথে মানুষের যোগাযোগ নাম-ধামের মধ্য দিয়েই। তাই অবশ্যই আমাদের কৃতী সন্তানদের কথা জানতে হবে।

২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। রণাঙ্গনে বিক্ষিপ্ত প্রতিরাধ যুদ্ধ চলছে। অনেকেই জানেন না ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ আগরতলা সার্কিট হাউসে প্রথম প্রবাসী মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আমবাগানে ১০ এপ্রিল গঠিত মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস দলটি সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রীসভার ডাকে সশস্ত্র সালাম প্রদান করেছিলো তার অধিনায়ক ছিলেন আমাদের সন্তান ফরিদগঞ্জের লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। তাঁর বীর উত্তম খেতাব পাওয়ার কথা ছিলো। রাষ্ট্রের কিছুসংখ্যক কুচক্রীর ক‚টচালে বীর আবু ওসমান চৌধুরী তার সে খেতাব পাননি। আমাদের আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন ড. আবু ইউসুফ হাবিবুর রহমান। ড. হাবিবুর রহমান মেঘনার পূর্ব পাড়ের প্রথম ডিএসসি (ডক্টর অব সায়েন্স)। ড. হাবিবুর রহমান আমেরিকার কলেরোড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রিলাভ করেছিলেন।

বিতর্কিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা রয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতর ও বাইরে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন তাঁদের কোনো তালিকা আজো প্রণীত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে প্রশাসনিক ও যুব শিবির কাঠামোতে জড়িত সামান্য কয়েকজন সংগঠকের কথা লিপিবদ্ধ করা আছে। নামের বিভ্রান্তির কারণে সকলকে সনাক্ত করা কষ্টকর। কারণ যুদ্ধকালীন সময়ে আসল নামের পরিচয় ঢাকা পড়েছিলো ছদ্মনাম দ্বারা। তাঁদের আসল নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করা না হলে ধূসর ধূলির আড়ালে রয়ে যাবে প্রকৃত নাম ও উপখ্যান। এমনই এক নাম ড. আবু ইউসুফ হাবিবুর রহমান। এ নামের প্রথম অংশ ড. আবু ইউসুফ ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে। দ্বিতীয় অংশ যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে ড. হাবিবুর রহমান। তাঁর বাড়ি হাজীগঞ্জ উপজেলার (অস্পূর্ণ}

লেখক পরিচিতি :

প্রকৌশলী মোঃ দেলোয়ার হোসেন :

২নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন
এফএফ কমান্ডো লিডার হিসেবে
লেম্বুছড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেন।