পুনঃর্মিলন : যুথিকা বড়ুয়া

ছোট গল্প

পুনঃর্মিলন 

লিখেছেন : যুথিকা বড়ুয়া

(১)

সুপ্রিয় বরাবরই ধীর-স্থির-গম্ভীর, শান্ত প্রকৃতির। ঢোল পিটিয়ে মনের ভাব কখনো প্রকাশ করেনা। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথাবার্তাও বলেনা। একটু চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করে। কিন্তু যেমন বিদ্যান-বুদ্ধিমান, তেমনি অত্যন্ত ভদ্র-নম্র, মার্জিত ব্যবহার। পেশায় একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। অবসরে কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট কোচিং ক্লাস করায়। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেওয়া, রসিকতা করা, নেশাদ্রব্য সেবন করা, মেয়ে মানুষের গা-ঘেষা এসব ওর ধাতে নেই। কোনকালেই ছিল না। ব্যঙ্গ করে অনেকে “বালক ব্রহ্মাচারী” বলে ক্ষেপায়। কেউ কেউ পরিহাস করে বলে,-“কলিকালের বিদ্যাসাগর।”

আসলে ওর অতীত মোটেই পিছু ছাড়েনা। ভুলতে চাইলেও কিছুতেই ওর হৃদয় থেকে অপসারিত হয় না। সারাক্ষণ ছায়ার মতো ওকে অনুসরণ করে। পিছে পিছে ধাওয়া করে। ওর সদ্য প্রাপ্ত উচ্চপদস্থ মর্যাদাসম্পন্ন্ প্রতিষ্ঠিত জীবনেও সারাদিনের কর্মব্যস্ততা আর কোলাহলের পর একাকী নির্জন রাতে ফিরে চলে যায় অতীতের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের দুঃখ-দীনতার দিনগুলিতে। যখন ওর অস্থিতিশীল হৃদয়পটভূমির প্রচন্ড ঝড়ে বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কেইবা রাখে ওর সেই খবর। জীবন যার কাছে ছিল দূরপাল্লর দৌড়। মাথার ওপর বিধাব মা আর বোনের গুরু দায়িত্বের বোঝা। যেখানে দুঃখ-দীনতা, অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। এমতবস্থায় জীবনকে উপভোগ করার তার ফুরসৎই বা কোথায়! কিন্তু সুপ্রিয়র অবাধ্য মন চঞ্চল ভ্রমরের মতো কখন যে সুরভীত ফুলের উপর গিয়ে বসে, তা নিজেও টের পায়নি। যেদিন ওদের কলেজে নবাগতা ষোড়শী কন্যা ডালিয়ার আগমনে মিরাকলের মতো ওর মন-মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটে।

রোপণ করে ভালোবাসার বীজ। বাসা বাঁধে, ইচ্ছা-আবেগ আর অনুভূতি। যার অপার মহিমায় চুম্বকের মতো হৃদয়াকর্ষণে সুপ্রিয়র কল্পনা শক্তিকে প্রচন্ডভাবে উদ্দীপ্ত করে। ওকে সচেতন করে তোলে। যখন সুখের অণ্বেষণে গভীরভাবে কল্পনায় ডুবে গিয়ে জাগ্রত হয়, আবেগাপ্লুত অনুরাগের মধুর আবেশ। সে এক ব্যাখ্যাতীত অভিনব অনুভূতি। যখন রক্তের স্রোতের মতো শরীরের প্রতিটি অনু-পরমানুতে সঞ্চালিত হয়ে ওর হৃদয়কে সজেত ও সজীব করে তোলে। সঞ্চার হয় প্রেম রসের। যেদিন অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের শখের মতো আচমকা একটা ঝটকা লেগেছিল, আবেগ-অনুভূতিহীন সুপ্রিয়র দেহে, মনে। যেদিন ওর হৃদয়ের কোণে ঘুমিয়ে থাকা ভালোলাগা আর ভালোবাসার ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতির তীব্র জাগরণে ওর অন্ধকার জীবনে দেখতে পেয়েছিল, একফালি উজ্জ্বল আলোর রেখা।

যেদিন শরতের শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের প’রে মায়াবিণী স্বপ্নপরীর মতো রক্তে-মাংসের মানবীয় কন্যা ডালিয়ার উচ্ছলতা, সজীবতা, চঞ্চলতা ও প্রাণবন্ত পদচারণায় মোহিত সুপ্রিয়র নতুন করে জেগে ওঠে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। খুঁজে পায়, ক্রমাণ্বয়ে জীবন যুদ্ধে পথ চলার প্রেরণা শক্তি। বেঁচে থাকার একটি উপকরণ। যেদিন ধূসর মরুভূমির মতো ওর হৃদয়পটভূমিতে সুদর্শণা, লাবণ্যময়ী ডালিয়াকে প্রথম আবিস্কার করেছিল। আবিস্কার করেছিল, পৃথিবীকে কেন এতো বেশী সুন্দর লাগে। কেন এতো প্রাণবন্ত এবং আনন্দোৎচ্ছলসমারোহে পরিপূর্ণ। দৃঢ়ভাবে অনুভব করেছিল, পৃথিবীর সমগ্র নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই একে অপরের পরিপূরক, অনুপ্রেরণা শক্তি। শক্তির উৎস। কিন্তু এমন প্রাণশক্তিই বা সবাই পায় কোথা থেকে! বড়ই বিচিত্র ও রহস্যময় এ পৃথিবী।

সুপ্রিয় দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মনে-প্রাণে ডালিয়াকেই জীবন সঙ্গিনী করতে চেয়েছিল। স্ত্রীরূপে পেতে চেয়েছিল। ইচ্ছে ছিল, একমাত্র ডালিয়াকেই ওর হৃদয়পটভূমির বিশাল সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী করবে। ওর হৃদয়পদ্মে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে। যেদিন হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে জীবনে প্রথম অনুভব করেছিল, ডালিয়াকে সত্যিই সে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু বিধিই বাম। একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ হৃদয়পটভূমির মহা ঘূর্ণির প্রলয় মাতনে প্রচন্ড অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় সুপ্রিয়র। পারেনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। পারেনি হৃদয়গহŸরে সদ্য রোপণ করা ভালোবাসার বীজ ধারণ করতে। যা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেদিন তীরের মতো বিদ্ধ হয়ে ওর হৃদয় গভীরে একটা কঠিন আঘাত এসে লেগেছিল। যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ভাবতে পারেনি, ওর ভালোবাসার ফুল প্রস্ফূটিত হওয়ার আগেই অনাদরে ঝোরে যাবে।

এ কেমন বিধাতার দু’টি মানব-মানবীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে দেওয়ার নিষ্ঠুর প্রয়াস? মরীচিকার মতো মিছে মায়াজালে কেন নিজেকে ধরা দিয়েছিল সুপ্রিয়? আর কেনইবা রামধনুর মতো হৃদয়াকাশে আর্বিভূত হয়ে ওর কাক্সিক্ষত স্বপ্নপরী ডালিয়া একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবটাই কি ওর ছলনা, অভিনয়! সত্যিই কি তাই ঘটেছিল!

হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে জর্জরিত সুপ্রিয়, এতিমের মতো ওর নীরব ভালোবাসার যোগ-বিয়োগের কোনো উত্তরই খুঁজে পায় না। অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্যসম্পন্ন বড়লোক বাপের অনমনীয়, জেদী বেপরোয়া কন্যা ডালিয়ার অপ্রীতিকর-বিহেইভ ওর মনকে তিক্ত করে দিয়েছিল। ফলে শুধুমাত্র নারীজাতির সংস্পর্শ থেকেই নয়, পৃথিবীর সকল মায়া-মোহর বন্ধন থেকে সুপ্রিয় একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল ওর অতীতকে। ভুলে গিয়েছিল ডালিয়াকেও। যেদিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নিজের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। এগিয়ে গিয়েছিল নিজস্ব গতীতে। তারপর ওর ব্যক্তিগত জীবনে কত ঝড়-তুফান বয়ে গিয়েছে। কত উত্থান পতন, কত পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আদৌ কি ডালিয়াকে ভুলতে পেরেছিল সুপ্রিয়?


( ২ )

সাধারণতঃ প্রাত্যহিক জীবনে কম-বেশী প্রতিটি মানুষকেই ঘাত-প্রতিঘাতে এক প্রকার সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকতে হয়। বিশেষতঃ যারা মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যাদের একমাত্র গৃহকর্তার উপাজর্নে সংসার চলে। যেসব সংসারে বটবৃক্ষের মতো ছত্রছায়ায় নির্ভরশীল হয়ে থাকে স্ত্রী-পুত্র ও কন্যা। আর সেই ছত্রছায়া একদিন হঠাৎ মাথার উপর থেকে সড়ে গেলে তখনই গহীন অনুভূতি দিয়ে উপলদ্ধি করা যায়, রৌদ্রের খড়দ্বীপ্তের তাপমাত্রা কতখানি প্রকট ছিল।

ঠিক তেমনই যেদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে সুপ্রিয়র জীবনে নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়। তখন ওর মাত্র সতেরো বছর বয়স। অপ্রাপ্ত বয়স। হেসে খেলে আনন্দ করার বয়স। জীবন জোয়ারে ভেসে বেড়ানোর বয়স। কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বণায় সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যের ভার বজ্রাঘাতের মতো এসে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুপ্রিয়র ঘাঁড়ে। তাতে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়লেও কখনো ওর জীবন নদীর প্রবাহ থেমে থাকেনি।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিতার শূন্যস্থানে সরাসরি শিক্ষকতা করার দায়িত্ব নিয়ে সংসার নামের তড়ীখানা ভাসিয়ে দেয় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। এর পাশাপাশি নিয়মিত নাইট কলেজ করে নিজের পড়াশোনাও অব্যাহত রাখে। একাগ্রহে প্রায় সাতবছর নিরলস সাধনায় নিমগ্ন থেকে শুধু ডিগ্রিই নয়, হাসিল করে নেয় নিজের সক্ষমতা, পূর্ণতা। যখন একটানা সংসারের ঘানি টানতে টানতে ওর নিরবসর, নিঃসঙ্গ, নিরুচ্ছাস, নি¯েপ্রম ও নিরানন্দের জীবনে বিনা নোটিশে ধূমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়েই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ওর স্বপ্নপরী কিশোরী কন্যা ডালিয়া। যার কারণ অনুসন্ধানে মনের সমস্ত শক্তি যখন হারিয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনিই ঘুরে গেল সুপ্রিয়র ভাগ্যের চাকাটা। যা নিজেও কল্পনা করতে পারেনি।
একেবারে মিরাকলের মতো প্রথম প্রয়াসেই আশাতীত সাফল্যের চরম স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যায় সুপ্রিয়। তারপর ওকে পিছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি। একজন দক্ষ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এবং গ্রাফ ডিজাইনার সুপ্রিয় সরাসরি টরন্টো শহরে পোষ্টিং হয়ে জীবনের রঙই বদলে যায় ওর। বদলে যায় প্রাত্যহিক জীবনের কর্মসূচী, জীবনধারা।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও সুপ্রিয় পারেনি ওর মনের রঙ বদলাতে। পারেনি জীবনকে নতুন করে সাজাতে। আর পারেনি বলেই অর্থ-ঐশ্বর্য্যে পরিপূর্ণ জীবনেও প্রতিনিয়ত একটা শূন্যতা, অভাববোধ অনুভব করে। খাঁ খাঁ করে বুক। অবলীলায় অহেতুক টেনশনে আজকাল সিগারেটের নেশাও ধরেছে। কিন্তু কেন? কিসের জন্য? কিসের অভাব ওর? বছর তিনেকের মধ্যেই জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়ে আজ ওর শান্দার আলিশান বাড়ি. গাড়ি, অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য্য, ফ্যাশানাবল ফার্ণিচার সবই পরিপূর্ণ। অথচ সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ঔদাসিন্যতায় ওর দিন যায়, রাত পোহায়।

টরোন্ট শহরে রংএর ছড়াছড়ি। চতুর্দিকে নিত্য-নতুন চমকপ্রদ রঙের বাহার। অথচ কোনো রঙই সুপ্রিয়র মনকে রাঙ্গায় না। ক’দিন যাবৎ সহকর্মী রবীণের দৃষ্টিগোচর হয়, নৈঃশব্দে শিথিল ভঙ্গিতে অফিস ঘরে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকে সুপ্রিয়। গভীর নিমগ্ন হয়ে ভাবনার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে থাকে। আর একটার পর একটা ৫৫৫ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে টেনে টেনে ধোঁয়া ছাড়ে।

রবীণ মহারাষ্ট্রের ছেলে। কলিগদের মধ্যে সবার ছোট বয়সে। খুব রসিক। কথায় কথায় হাসায়। রঙ্গ-ব্যঙ্গ করে। সুপ্রিয়কে বড়ভাই এর মতো গণ্যমান্য করে। রাম-লক্ষণের মতো সব সময় সুপ্রিয়র পিছে পিছে ঘোরে। ওর সংস্পর্শে থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও বলতে পারে। হঠাৎ সুপ্রিয়কে কাঁপিয়ে দিয়ে বলে,-‘কি গুরু, উদাস কেন? মামলা ক্যায়া হ্যায়? কিসিসে ইস্ক হো গয়া হ্যায় ক্যায়া!’
ধপ্ করে সোফায় বসে বলে,-‘আরে ছোড়িয়ে! ইস্ক, ওভি তুমসে? কভি নেহি। হিম্মত চাহিয়ে।’

ফিক করে একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে সুপ্রিয় বলল,-‘ভালোবাসার ফুল ফুটতে দেখেছিস কখনো?’
কথাটা এমনভাবে বলল, যেন একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে প্রশ্ন করছে। রবীণ হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। হাসিটা বজায় রেখে বলল,-‘ভালোবাসার ফুল? ওতো বাগিচায় হর রোজ দেখতা হুঁ। আজকাল তুমিও দ্যাখো বুঝি!’

মুহূর্তেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেল সুপ্রিয়। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল,-‘শুধু তাই নয়রে রবী, ভালোবাসার ফুল ফুটে ঝোরেও যেতে দেখেছি!’

কথাটা শুনে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রবীণ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকে। সুপ্রিয়র আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বলল,-‘গুরু, তোমার আজ হয়েছে কি বলো তো? ভূতের মুখে রাম নাম। তোমায় তো কখনো ঐ গলিতে পা রাখতে দেখিনি। এয়াদ আছে, একদিন তুমিই বলেছিলে, নারীর সংস্পর্শ পুরুষের জন্য সর্বদা সুখদায়ক নয়, লাভজনক নয়, যদি সে ছলনা করে। আর তুমি তাদের হেট করো। ভুলে গেছো?’
হাতের কনুই দিয়ে সুপ্রিয়র পেটে একটা গুঁতো মেরে বলে,-‘কিউ জনাব, আখির হো গয়া না প্যায়ার! কবসে চল রাহা হ্যায় ইয়ে শিলশীলে? তুমি তো বড় গভীর জলের মাছ! পেটমে ভুক অউর মুপে লাজ! এ্যাঁ! কোন্ বর্শিতে ধরলে গুরু? ভেরী ইন্টারেষ্টটিং!’
পরক্ষণেই সিরিয়াস হয়ে বলে,-‘ছোড়ো ইয়ে বাতে। মরদ লোকের এতো ভাবনা কিসের। দুনিয়ায় মেয়ে মানুষের অভাব আছে না কি! বলো তো আমিই ফিট্ করে দিচ্ছি!’

গম্ভীর হয়ে সুপ্রিয় বলল,-‘এ্যাই, ফাইজলামি করিস না। বসে বসে আড্ডা দিচ্ছিস, কাজকর্ম নেই তোর? ম্যানেজারের কানে গেলে না!’ একটু থেমে বলে বলে,-‘খুব ইষ্ট্রিক্ট, দেবে সাসপেন্ড্ করে। কোনো এক্সকিউজ চলবে না।’
ববীণের গায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে,-‘তুই যা এখন। লাঞ্চ আওয়ারে আসিস।’
কথা শেষ না হতেই টেলিফোনটা ঝন্ঝন্ করে বেজে ওঠে। রবীণ দ্রæত রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলল,-‘হ্যালো’!

ওপাশ থেকে ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠস্বর। -‘হ্যালো’

তৎক্ষণাৎ আবেগের প্রবণতা বেড়ে যায় রবীণের। চোখেমুখে কৌতূহল চেগে ওঠে। রিসিভারটা হাতে চেপে ধরে ফিস্ ফিস্ করে বলে,-‘গুরু, কন্যা কুমারী। নও, ধরো শীগ্গির।’

রবীণের হাত থেকে রিসিভারটা ঝট্ করে টেনে নিয়ে সুপ্রিয় বলল,-‘ইয়েস, ক্যান আই হেল্প ইউ?’

হাঁপাতে হাঁপাতে জনৈক মহিলাটি বলল,-‘মিস্ জুলি ইস দেয়ার?’

-‘নো ম্যাম, উই আর অল মেল ওয়ার্কার হেয়ার।’

-‘হোয়াট?’

-‘ইয়েস ম্যাম। মে আই নো, ইওর নেইম, এ্যাড্রেস এ্যান্ড টেলিফোন নাম্বার?’

বিস্মিত কণ্ঠে মহিলাটি বলল,-‘নেইম, এ্যাড্রেস, টেলিফোন নাম্বার! হোয়াট ডু ইউ মিন? রাবিশ! আই এ্যাম নট যোকিং!’

মৃদু হেসে সুপ্রিয় বলল,-‘আই নো ম্যাম। বাট উই নিড ইট। ইট ইস আওয়ার ডিউটি।’

বিব্রোত কণ্ঠে মহিলাটি বলল,-‘ফর হোয়াট?’

-‘ম্যাডাম, দিস ইস আওয়ার সীষ্টেম।’

-‘হোয়াট ননসেন্স!’

একেই মহিলা কণ্ঠস্বর। তন্মধ্যে অহেতুক অজ্ঞাত মহিলার এ ধরণের বিহেইভ মোটেই এক্সপেক্ট করেনি সুপ্রিয়। অত্যন্ত বিব্রোতবোধ করে মনে মনে। কথা না বারিয়ে কর্কশ স্বরে বলে ওঠে,-‘ম্যাডাম, কাম টু দি পয়েন্ট!’

মহিলাটি এবার নরম হয়ে পড়ে। মার্জিত হয়ে বলল,-‘আই এ্যাম মিস্ ডালিয়া। কলিং, ফ্রম…!’

মহিলার নাম শুনে হকচকিয়ে গেল সুপ্রিয়। পড়ে যায় বিস্ময়ের ঘোরে। মনে মনে বলে,-ডারিয়া! এ আবার কে! মহিলাটিকে বাধা দিয়ে বলে,-‘ও.কে, ফাইন। গিভ মি ইওর এ্যাড্রেস এ্যান্ড টেলিফোন নাম্বার!’

তৎক্ষণাৎ গলার স্বর বিকৃতি করে মহিলাটি বলল,-‘ওঃ গড্! ইউ আর রিয়েলি ষ্টুপিড ম্যান!’

আচমকা থতমত খেয়ে গেল সুপ্রিয়। অস্বস্তিবোধ করে। অপদস্থ হয়। ক্রোধে ভিতরে ভিতরে ফুলতে থাকে। ইতিমধ্যে চোখে চোখ পড়তেই নিঃশব্দে হেসে ফেলল রবীণ। মৃদুস্বরে বলল,-‘কি হলো প্রিয়দা, খামোশ কিউ!’

ওপাশ থেকে মহিলাটি বলল,-‘হ্যালো, সে সামথিং।’

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে সুপ্রিয়।-‘হোয়াট রাবিশ!’ রবীণের দিকে তাকিয়ে বলে,-‘কি মুশকিলে পড়া গেল বল্ তো!’

মহিলাটি বলল,-‘আই ক্যান্ট হিয়ার ইওর ভয়েস। ইস ইট্ বিউটি সেলুন?’

বিব্রোত কণ্ঠে সুপ্রিয় বলল,-‘নো ম্যাম, ইট ইস কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী লিমিটেড। রং নাম্বার!’

-‘ওঃ শীট্!’ বলে মহিলাটি তক্ষুণিই লাইন কেটে দেয়।

রিসিভারটা হাতে নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে থাকে সুপ্রিয়। চেয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। অপ্রত্যাশিত আচমকা বিড়ম্বণায় প্রচন্ড রাগ হয় মনে মনে। ধপ্ করে রিসিভারটা রেখে সিগারেটের বাকি অংশটা ছুঁড়ে গার্বেজে ফেলে দেয়। আর রাগটা গিয়ে পড়ে রবীণের ওপর।-‘কি রে, গেলি না তুই! এখনো বসে আছিস। ডাকবো মিষ্টার রায়চৌধুরীকে!’

রবীণ নিঃশব্দে বেরিয়ে যেতেই ক্ষণপূর্বের অজ্ঞাত অপরিচিত মহিলার শ্রæতিকটূ তীক্ষè কণ্ঠস্বর বিষ ক্রিয়ার মতো শুধু দংশণই নয় মস্তিস্কের সমস্ত ¯œায়ূকোষে রক্তের স্রোতের মতো সঞ্চালণ হতে থাকে সুপ্রিয়র। কিছুতেই কাজে মন বসেনা। বার বার একই প্রশ্ন মনের মধ্যে উদয় হয়, কে এই মহিলা? কি তার পরিচয়? কিন্তু কি আশ্চর্য্য, ঠিক এই রকমই বিহেইভ করতো ডালিয়া। বিরল সেন্টিমেন্টাল ওর। অনমণীয় জেদ। কথায় কেউ পেরে উঠতো না। ইভেন কণ্ঠস্বর পর্যন্ত এক্সয্যাক্ট ডালিয়ার মতোই লাগছে। আই কান্ট বিলিভ! হাউ ইস দিস্ পসিবল? ইস সী হিয়ার? পরক্ষণেই ভাবে, না না, তাইবা কেমন করে সম্ভব! জগতে একই নামের বহু মানুষ থাকতে পারে। আননেসেসারি হেডেক্ নিয়ে টাইম ওয়েষ্ট করা। ফরগেট ইট!

( ৩ )

অফিস ছুটির পর প্রায় প্রতিদিনই প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর গ্রোসারী শপিং সেড়ে বাড়ি ফেরে সুপ্রিয়। কিন্তু আজ তেমন কোনো প্রয়োজন ছিলনা। ডেনফোর্থ রোড ক্রস করতেই মনে মনে বলে, নাঃ একবার ঘুরেই আসি। ঝিঙে-পটলের দাম যে হারে বাড়ছে, একেবারে আগুন। টাচ্-ই করা যায়না। দেখি, টাটকা শাক-সব্জী কিছু পাওয়া যায় কি না।
এইভেবে ডেনর্ফোথ রোডে গাড়ি পার্ক করতেই চমকে ওঠে সুপ্রিয়। বুকটা ধুক্ করে ওঠে। খানিকটা দূরত্বের ব্যবধানে হঠাৎ কার যেন পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে থমকে দাঁড়ায়। অনিচ্ছা সত্তে¡ও ওর অবাধ্য চোখের দৃষ্টি আর্কষণ করে সেদিকে। আর তক্ষুণি স্বগতোক্তি করে ওঠে,-‘কোথায় যেন দেখেছি ভদ্রমহিলাকে। চেনা চেনা লাগছে। হুবাহু সেই শুভ্র মসৃণ, সুদর্শণা, লাবণ্যময়ী চেহারা। নিখুঁত কোমড়ের গড়ন, নিতম্ভ, উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত ডাগর চোখের চাহনি। চঞ্চল প্রাণবন্ত, ছন্দময় ওর পদচারণা। কি আশ্চর্য্য, টোলপড়া গোলাপগালের সেই রহস্যাবৃত দুষ্টুমিষ্টি হাসি। জনৈক মহিলার বাঁ-পাশের গজ্দন্তটিও নজরে এড়ায় না সুপ্রিয়র। একটি শ্বেতাঙ্গ তরুণীর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপনে মর্শগুল হয়ে আছে। হাউ ইস দ্যাট্ পসিবল? হু ইস দিস লেডি? ইস সী ব্যাক্?’

আজও মনে পড়ে সুপ্রিয়র, একদিন কথা প্রসঙ্গে ওর এক্স-গার্লফ্রেন্ড ডালিয়া গর্ব করে বলেছিল, সুশীলসমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুপরিচিত একজন বিশিষ্ঠ প্রভাব-পতিপত্তিশীল ব্যক্তি ওর পিতৃদেব অমলেন্দু রায়চৌধুরী। প্রচুর অর্থ-ঐশ্বর্য্য,ে ধন-সম্পত্তির মালিক। স্বার্থের বিনিময়ে অসাধ্য সাধন করা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। তিনিই পারেন। যাকে স্বচোক্ষে দেখার কখনো সৌভাগ্য হয়নি সুপ্রিয়র। হয়তো সব তারই পূর্ব পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্র। কে জানে! সুপ্রিয়র মতো তৎকালিন একজন মিডল ক্লাসের হতভাগ্য দরিদ্রের সংর্স্পশ থেকে, ওর জীবন থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করার এটাই ছিল তার একমাত্র রিজন।

আজ দীর্ঘদিন পর ডালিয়া নামটি উচ্চারিত হতেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল সুপ্রিয়র। সেই মর্নিংএ অজ্ঞাত মহিলার ফোন কল্ রিসিভ করার পর থেকে বার বার ডালিয়া নামের মৌ মৌ গন্ধ্যে বুকের ভিতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। আবার পরক্ষণে ওর অতীত মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠতেই বিষাদে ভরে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছিল, জনৈক মহিলার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কৈফেয়ৎ চাইতে। জবাবদিহী করতে। ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে। কি অপরাধ করেছিল সুপ্রিয়? অহেতুক ওর হৃদয়ে এতবড় কঠিন আঘাত হেনে ওর জীবন থেকে কেন সড়ে গিয়েছিল? আর কেনইবা এতকাল আত্মগোপন করেছিল?

কিন্তু নাঃ, অদৃষ্টের দোহাই দিয়ে যে ভুল একবার সে করেছে, দ্বিতীয়বার আর নয়। তা’ছাড়া জনৈক মহিলা পরস্ত্রীও হতে পারে। আর যদি নাও হয়, এতকাল পর কিইবা এসে যায়। সুপ্রিয় হার মানতে শেখেনি। আজও মানবে না। পুরুষমানুষ হয়ে একজন মহিলার কাছে নত স্বীকার করবে! ভালোবাসা ভিক্ষে চাইবে! আত্মমর্যাদায় নতুন করে আঘাত হানবে! কেন করবে সুপ্রিয়? কেন নিজেকে ছোট করবে? আর প্রশ্রয় দেওয়া নয়। কিছুতেই নয়।

তবু অবুঝ মন কিছুতেই মানতে চায়না সুপ্রিয়র। দ্বিধা আর দ্ব›েদ্বর টানাপোড়ণে প্রচন্ড আলোড়ণ সৃষ্টি করে ওর মধ্যে। মরচে ধরা স্মৃতিরা সব চোখের সামনে এসে ভীঁড় করে। কানে বাজে, ভ্রমরের মতো গুনগুন সুরের ডালিয়ার মধুর গুঞ্জরণ। হাসি-কলোতান।

সুপ্রিয় পারলো না, নতুন করে ভালোলাগার মধুর আবেশে মনকে ধরে রাখতে। বাধা দিতে। এতো কিছু ঘটে যাবার পরেও আবেগের প্রবণতায় ভালোলাগা আর ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিগুলি এতকাল কোয়ায় যে ওর লুকিয়ে ছিল, পিছন ফিরতেই অস্ফুট একটা খুশীতে ভরে গেল ওর বুকটা।

ঠিকই অনুমান করেছিল। কিন্তু কখন যে গুটি গুটি পায়ে ডালিয়ার সন্নিকটে এগিয়ে যাচ্ছিল টেরই পায়নি। চোখ পাকিয়ে দ্যাখে, শরতের শিশির ভেজা সবুজ মখ্মলে ঘাসের প’রে চঞ্চল প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়ানো সেই প্রাণবন্ত দুষ্টুমিষ্টি কিশোরী কন্যা ডালিয়া আজ পূর্ণ যুবতী। রমণীও বলা যায়। কি শান্ত-¯িœগ্ধ-কোমনীয় ওর রূপ-রঙ। কি উদ্বিগ্ন যৌবনসম্পন্না অনন্যা। প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত, মমতাময়ী এক বিদূষী নারী। সেই অবিরল অবয়ব রূপে সশরীরে ষ্ট্যাচুর মতো জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে সুপ্রিয়র সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ওকে চেনার উপায় নেই। চেহারায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পরনে বøু-জিন্সের প্যান্ট আর কমলা রঙের টপ, হাফ্ জ্যাকেট। দারুণ মানিয়েছে ওকে। বেশ লাগছে দেখতে। শ্বেতাঙ্গদের মতোই দুধসাদা গায়ের রঙ, যেন ফেটে পড়ছে। কাতর চোখের দৃষ্টি মেলে কিছু বলার ব্যাকুলতায় ঠোঁটদুটো ওর কাঁপছে। সেই সঙ্গে লজ্জা আর অব্যক্ত আনন্দের সংমিশ্রণে অশ্রæকণায় চোখের তারাদু’টি মুক্তোর মতো চিক্চিক্ করছে। সুপ্রিয়কে দেখা মাত্রই ব্যগ থেকে সাদা রঙের একটা স্কার্ফ বের করে গায়ে-ঢাকা দেয় ডালিয়া। কিন্তু কেন? আজ ওর কিসের অভিনয়? কি জাহির করতে চায় ডালিয়া? কি বলতে চায়? কি চায় সে?

মনে মনে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় সুপ্রিয়। ক্ষণপূর্বে যে অকপট সারল্য ওর চোখেমুখে দেখা গিয়েছিল, তা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে যায়। ইচ্ছে হচ্ছিল, প্রকাশ্যে লোকালয়ে চিৎকার করে বলবে,-চিনতে আমিই ভুল করেছিলাম। তুমি ছলনাময়ী। হাজারটা রূপ তোমার। গিরগিটির মতো তুমি রঙ বদলাও। পিতার অবাধ স্বাধীনতা অপব্যবহার করে পুরুষের মন নিয়ে তুমি খেলা করো। এতেই তোমার একমাত্র সুখ, আনন্দ। সহৃদয়ে ভালো তুমি কখনোই বাসতে পারো না। প্রকৃত নারী তুমি নও। নারীজাতির কলঙ্ক, ভ্রষ্টাচারী!

কিন্তু সুপ্রিয় তা বলতে পারেনি। পারেনি ডালিয়াকে আপমান করতে। ওকে অপদস্থ করতে। ওর মাথাটা হেট করে দিতে। ওর নারীত্ব ক্ষুন্ন করে দিতে। বিবেকের তীব্র দংশণে নীরব নির্বিকারে সহে গেল সুপ্রিয়। মনকে শান্তনা দিয়ে বলল,-একান্তে নিভৃতে নিবিড় করে জীবনে নাইবা পেলাম। নাইবা হলো ওর প্রেয়সী, প্রিয়তমা, ঘরণী। ভালোবাসার অপর নামই তো বলিদান, সেক্রিফাইস। নিঃস্বার্থে প্রেম, ভালোবাসা জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য্য। মনকে করে পবিত্র, প্রভাবিত। আমারা কি বন্ধু হতে পারি না!’

কিন্তু মানুষের মন বড় বিচিত্র। সহজে পোষ মানে না। সুপ্রিয়র মনের অবস্থাও ঠিক তদ্রæপ। বিদেশের মাটিতে হঠাৎ এক্স-গার্ল ফ্রেন্ড ডালিয়ার মুখোমুখি দর্শণে ইমোশনাল হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। চোখেমুখেও একরাশ বিস্ময়, উচ্ছাস। চোখে চোখ পড়তেই মনে মনে বলে,-‘হোয়াট্ এ সারপ্রাইজ ডলি! আই কান্ট বিলিভ।’
বলে পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে যায়। কটাক্ষ দৃষ্টিতে ডালিয়ার মুখপানে একপলক চেয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে ওঠে।-অমন করে দেখছ কি! এতো মাসুম, ইনোসেন্ট হোওনা। ভাবছো ভুলে গিয়েছি। নো, নেভার। তোমার বিহেইভ কোনদিন ভুলবো না। একদিন তুমিই বিনা নোটিশে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলে আমার জীবন থেকে। কারণ জানতে চাইলাম, নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে। কি অপরাধ করে ছিলাম? বলো ডলি বলো! আজ চুপ করে থেকো না। একদিন এমন করেই ক্ষণিকের অন্ধমোহে বশীভূত হয়ে আমার মতো একজন অনভিজ্ঞ মানুষ নিজের ষ্ট্যাটাস, সামাজিক অবস্থান ভুলে গিয়ে বেমালুম বদলে গিয়ে ছিলাম। ছুঁতে চেয়ে ছিলাম আকাশের চাঁদ। আসলে সেটা যে মায়া মরীচিকা ছল, চোরাবালির চর। বেদনার উপত্যকায় বসে কল্পনায় শুধু স্বপ্নের জাল বোনা, সুখের তাজ গড়া। অথচ হাত বাড়ালে সব শূন্য। কিছুই স্পর্শ করা যায়না। চারদিকে কূয়াশার মতো ধোঁয়া, ধূসর মরুভূমি। যখন চোখে পথ দেখা যায় না। দিগি¦দিক নির্ণয় করা যায় না। আর সেটা বোধগম্য হতেই হৃদয় থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বিশ্বাস, ভালোবাসা। আশা-ভরসা। আজ পারবে তা ফিরিয়ে দিতে? পারবে নতুন করে আমায় ভালোবাসতে? বলো ডলি, বলো। জানি, আজ জাহির করার মতো তোমার কাছে কিছু আর অবশিষ্ঠ নেই।

কিন্তু কি বলবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ডালিয়া। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে গিয়েছে কল্পনায়। বুকের ভিতরে কি যন্ত্রণা নিয়ে আজও বয়ে বেড়াচ্ছে, তা সুপ্রিয়ইবা জানবে কেমন করে! কেমন করে জানবে, ডালিয়ার অপারগতার কথা। ওর ব্যথতার্র কথা। দুদিনের আন্তরিকতা ও কুশল বিনিময়ের অন্তরঙ্গ মুহূতগুর্লিকে মামুলি বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ডালিয়া নিজেই বিনা নোটিশে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেকথা আজও ওর মনে আছে বৈকি! অথচ পরিণত বয়সে তা ভালোবাসা নয় বলেও উড়িয়ে দিতে পারেনি। পারেনি অন্য কোনো পুরুষকে ওর কোমল হৃদয়ে প্রিয়তমার আসনে ঠাঁই দিতে। চেয়েছিল সারাজীবন সুপ্রিয়র হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল হয়ে থাকতে। সুপ্রিয়র পরিচয়েই পরিচিতা হতে। আজ নির্লজ্জ বেহায়ার মতো সেকথা ও’ বলবে কেমন করে! কিইবা মূল্য আছে তার। আজ এতবছর পর অভাবনীয়ভাবে আচমকা সশরীরে সুপ্রিয়র দর্শণে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠেছিল। বিশ্বাসই হচ্ছিল না নিজের চোখদুটোকে। বিস্ময়ে অভিভূতর মতো হাঁ করে থাকে। রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে ওর কণ্ঠস্বর। নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। কিছু বলার তাগিদে প্রচন্ড উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। অথচ মুখ ফুটে একটা শব্দ উচ্চারিত হয়না। মনে মনে বলে,-তুমি জানো না সপ্রিয়, মেয়েদের জীবন হাতে গড়া পুতুলের মতো। মেয়েরা সরীসৃপ প্রাণীর মতো আজীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল। অন্যের পরিকল্পনায় পরিচারিত হয় মেয়েদের জীবন। বিশেষ করে যাদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা থাকেনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবার মতো সাহস থাকে না। কত দুর্বল ওরা, কত অসহায়। কিছু বলতে পারে না। আর পারে না বলেই বিবাহ-বন্ধন সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সামাজিক স্বীকৃতিকে অপব্যবহার করে দোকানীর দ্রব্য-সামগ্রীর মতো মোটা কড়ির বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় হয় শত শত অসহায় অবলা নারী, নারীর জীবন। শ্রæতিকটূ হলেও কথা সত্য। যেখানে ভালোবাসার কোনো ঠাঁই নেই। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। যারা এতিমের মতো নিরবে নিঃভৃতে মাথাকূটে কেঁদে মরে। শুধু কি তাই, জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্ন দেখাও নিষিদ্ধ। জন্মাবধি চিরকাল পরাধীনতার শিখলে কারাবন্দী। অগত্যা, বোবা অনুভূতির গহীন অনুতাপ অনুশোচনায় দ্বগ্ধ হতে হতেই একদিন নিঃশ্ব হয়ে ঝোরে যায় অন্তরের অন্তরস্থলে প্রস্ফূটিত নিরব ভালোবাসার ফুল। সেখানে ডালিয়াও একজন। কিশোরী বয়স থেকেই মাতা-পিতার কঠোর শাসনের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে থাকা ডালিয়ার নিজের ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশ করবার স্বাধীনতাটুকুও কখনো ছিলনা, আজও অবধি নেই। তাই চেয়ে ছিলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে তোমার হৃদয়গহŸরে আশ্রয় নিতে। নিজেকে সঁপে দিতে। কিন্তু পারিনি। তুমি বিশ্বাস করো সুপ্রিয, আমায় চার-দেওয়ালের বদ্ধঘরের ভিতরে নজর বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কত অসহনীয় যন্ত্রণাময় মুহূর্ত আমায় যাপন করতে হয়েছিল। যেদিন স্বদেশ ত্যাগ করি, সেদিন নিরুপায় হয়ে ছুটে গিয়ে ছিলাম তোমায় জানাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, হন্যে হয়ে তোমায় খুঁজেছি, কোথাও তোমার দর্শণ মেলেনি। সেদিনই বুঝে নিয়েছিলাম, তোমার দেখা আর মিলবে না। তোমার নাগাল কোনদিন পাবো না। কিন্তু বিধাতার লীলা বোঝা ভার। সেদিন কি জানতাম, সাত-সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এতদূরে এসে আজ তোমার সাথে একেবারে মুখোমুখি দেখা হবে! এ তো কল্পনারও অতীত!

অথচ মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বের ব্যবধান। আজ কারো মুখে কথা নেই। দুজনই নিজ নিজ জগতে বিচরণ করছে। কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে, কিছুই স্থির করতে পারছে না। অবলীলায় নানা দ্বন্ধ-দ্বিধা, সংকোচ আর সংশয়ের সংমিশ্রণে চোখের পাতাদু’টো নূয়ে পড়ে ডালিয়ার। ক্রমাণ¦য়ে নিঃশ্বাস প্রঃশ্বাসের আনা গোনায় সময় বয়ে যায়। মনে মনে বলে, চেহারা আর বেশভূষা অনেক বদলে গিয়েছে সুপ্রিয়র। যেন কোনো এক অজ্ঞাত অপরিচিত কূলশীল ব্যক্তি। প্রচন্ড উৎসুক্য হয়ে ডালিয়ার অতীত সম্বন্ধ্যে অবগতর জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু আজ কিভাবে বলবে, পাত্রপক্ষ আগমন বার্তা পাঠিয়েছে। আগামী মাসের ফাষ্ট উইকে পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে আসবে। পিতা অমলেন্দুর মনোনীত পাত্র। কোনমতেই রিজেক্ট করা যাবেনা। কোনো অপিনিঅন চলবে না। কবুল করতেই হবে। পিতার আজ্ঞা অমান্য করা, লঙ্ঘন করা এতবড় স্পর্ধা ডালিয়ার নেই। কিন্তু এ বিবাহ ঠেকাবে কেমন করে? এতকাল পর সুপ্রিয়কে এতো কাছে পেয়েও ওকে আবার হারাতে হবে? এরপর দেখা হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই! তা’হলে? তবে কি সারাজীবন অনুতাপ অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে দ্বগ্ধ হয়ে একেবারে নিঃশ্ব হয়ে যাবে ডালিয়া?

ইতিমধ্যে হঠাৎ সেই পরিচিত সুপ্রিয়র দরাজ গুরু গম্ভীর কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে ডালিয়া। ওর সংবেদনশীল দৃষ্টি লক্ষ্য করে স্বাভাবিক হয়ে বলল,-‘কেমন আছো ডলি? এতকাল কোথায় ছিলে? এ্যাঁ! দ্যাখো তো, কেমন চিনে ফেললাম। ভারি মিষ্টি লাগছে তোমায়। কি, চুপ করে আছো, কথা বলবে না। দেখো, আমি কিন্তু অপরাধী নই। বলো সত্যি কি না! কি, বলছো না যে! আজ আর চুপ করে থেকো না ডলি! কিছু বলো!’

অপ্রত্যাশিত সুপ্রিয়র আবেগমিশ্রিত বাক্যশ্রবণে মনটা মোমের মতো গলে একদম নরম হয়ে গেল ডালিয়ার। ধীরে ধীরে ক্ষমা প্রার্থীর দৃষ্টিতে মুখ তুলে সুপ্রিয়র মুখের দিকে তাকায়। অস্তাচলে ঢলে পড়া কুসুমের মতো সূর্য্যরে নিস্তেজ কিরণে মুখখানা ওর আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ততক্ষণে ডেনফোর্থ রোডের চারদিক জনসমুদ্রে ছেয়ে গিয়েছে। সব পরিচিত মুখ। আশ-পাশ থেকে ভেসে আসছে বহু পরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর। বুকের ভিতরটা কেমন ধুক্ ধ্কু করছে ডালিয়ার। সাহসই হচ্ছেনা কিছু বলবার। হঠাৎ কেউ দেখে ফেললে মহা কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। পাত্রপক্ষের কানে একবার পৌছে গেলে আর রক্ষা থাকবে না।

ইতিমধ্যে বাতাসে হঠাৎ ডালিয়ার স্কার্ফটা সুপ্রিয়র মুখের উপর উড়ে এসে পড়তেই চোখে চোখ পড়ে যায় দুজনের। সুপ্রিয় লক্ষ্য করে, ভীত সন্ত্রস্ত্রে আড়ষ্ঠ হয়ে ষ্ট্যাচুর মতো হয়ে আছে ডালিয়া। কি যেন বলতে চাইছে।

ক্ষণিকের নিরবতা ভঙ্গ করে সুপ্রিয়। মুখ থেকে স্কার্ফটা সরিয়ে নিয়ে বলল,-‘অযথা ভয় পেওনা ডলি। তোমাকে জবাবদিহী করতে হবেনা। কোনো কৈফেয়ৎ আমি চাই না। টরোন্ট শহরে কবে এসেছ, কার সাথে এসেছ, কিছুই জানতে চাইবো না। শুধু এইটুকু বলো, বরমালা কার গলায় দিলে? কে সেই ভাগ্যবান পুরুষ?’

এতক্ষণ পর ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ডালিয়া। ঠোঁটের কোণে শুকনো একটা হাসি ফুটিয়ে বলে,-‘হুঁম, দিতে আর পারলাম কই! এখনো তো মালাই গাঁথা হলো না আমার!’

বিস্মিত হলেও ডালিয়া যে কুমারী, অবিবাহিতা, বুঝতে দেরী হলো না সুপ্রিয়র। খুশীও হলো মনে মনে। কিন্তু তা বুঝতে দিলো না। ইতিমধ্যে হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাক দিতেই ডিষ্ট্রাক্ট হয়ে যায় সুপ্রিয়। একটি জরুরী বিষয়ে জনৈক ব্যক্তির সাথে কনভারসেশনে মর্শগুল হয়ে পড়ে। কিন্তু ইত্যবসরে কখন যে ডালিয়া অদৃশ্য হয়ে গেল, খেয়ালই করেনি।

কিন্তু যে কথা সুপ্রিয়কে বলতে চেয়েছিল, তা তো বলাই হলো না! তা’হলে! বাড়িতে এসে কিছুতেই স্বস্তি পায়না ডালিয়া। রাতেও ঘুম হয়না ওর। সারারাত এপাশ ওপাশ করে বিছানায়। আর ভাবে, রাত পোহালেই দুঃস্বপ্নের মতো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে ডালিয়ার জীবন। কতগুলি অচেনা অপরিচিত মানুষের সম্মুখে পুতুলের মতো সেজে বসতে হবে। হুকুম করলেই হেঁটে চলে দেখাতে হবে। পাত্রীর সার্বিক গুনাবলীর নমুনা দেখাতে হবে। রিকোয়েষ্ট করলে, দু-একটা গানও গেয়ে শোনাতে হবে। -উফ্ঃ, অসহ্য!
রাগ হয় বিধাতার ওপর। বেশ ভালোই তো ছিল ডালিয়া। রাতের দুঃস্বপ্ন ভেবে এতকাল সুপ্রিয়কে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। মুছে ফেলেছিল স্মৃতির পাতা থেকে। তবে কেন সেই দুঃস্বপ্ন জলছবির মতো জীবন্ত হয়ে ওর জীবনে পুনরায় দেখা দিলে! কেন এমন হলো! এ কেমন বিধাতার অগ্নিপরীক্ষা? হে ঈশ্বর, এতো নির্দয়, কঠোর তুমি হোয়ও না। এতোবড় শাস্তি আমায় দিওনা। শুধু একটিবার সুপ্রিয়কে মিলিয়ে দাও।’

সারারাত ভেবে কূল পায়না ডালিয়া। এতো বড় শহর, চারিদিকে এতো মানুষজন, সুপ্রিয়কে কোথায় খুঁজবে। কোথায় খুঁজে পাবে। ও কোথায় থাকে, কার সাথে থাকে, ওর প্রফেশন কি, কিছুই তো বলে গেলনা। ওর ফোন নাম্বারটাও পাওয়া গেল না। তবে কি এ জনমে ওর দর্শণ কোনদিন আর পাবেনা ডালিয়া! ও’কি সত্যিই অন্যের ঘরণী হয়ে বিরাজ করবে।
ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো ডালিয়ার। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল মন-প্রাণ, সারাশরীর। ভালোবাসার সমস্ত ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতিগুলি অনুতাপের আগুনে পুড়ে যেন সব ছাই হয়ে গেল। মরে গেল ওর বেঁচে থাকার সাধ। অগত্যা, হৃদয়ের দুকূল অশ্রæজলে প্লাবিত করে জীবন্ত লাশের মতো পড়ে থাকে নির্জন অন্ধকার ঘরে।

( ৪ )

মাঘ মাস। কনকনে ঠান্ডা। হাঁড় কাঁপানো শীত। অথচ ঘেমে চুপসে যাচ্ছে ডালিয়ার সারাশরীর। সকাল থেকে উদাস মনে চুপটি করে বসেছিল। সময় যতো বাড়ছে, হৃদষ্পন্দনের গতীও ততো বাড়ছে। একসময় জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালায় মাথাটা ঠেকান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, দূর-নীলিমার প্রান্তরে উড়ে যাওয়া একঝাঁক মুক্ত বিহঙ্গের দিকে। আর জলছবির মতো মনঃচক্ষে ভেসে ওঠে, সুদীর্ঘ সাতবছর পর অপ্রত্যাশিত হঠাৎ সুুুপ্রিয়র দর্শণ, ওর আবির্ভাব, উপস্থিতি। দু’দিন আগেও যা কল্পনা করতে পারেনি।

ইতিমধ্যে গাড়ির শব্দে চমকে ওঠে ডালিয়া। গলা টেনে দ্যাখে, একজন বয়োঃজ্যাষ্ঠ ব্যক্তি সহ একঝাঁক যুবকের দল, একে একে গাড়ি থেকে নামছে। তন্মধ্যে একজন উজ্জ্বল সুঠাম সুদর্শণ তরুণ যুবকের চটকদারি পোষাষ-আষাকে একটু ব্যতিক্রম মনে হলো। সে একেবারে ফিল্মি হিরোর মতো পরনে জিন্সের প্যান্ট-শার্ট, চোখে দামী ফ্রেমের সানগøাস, পায়ে চমকপ্রদ হাইহিল শু-এর বাহারও চোখে তাক লাগার মতো। অন্যদের চাইতে একটু স্প্যাশালই লাগছে ওকে। একেবারে ভি.আই.পি -র মতো নামছে গাড়ি থেকে। স্বয়ং পাত্রই হবে নিশ্চয়ই। স্বগতোক্তি করে ওঠে ডালিয়া।

ইত্যবসরে পিতা অমলেন্দু আগুন্তুক অতিথিবর্গকে স্বাগতম জানাতে দ্রæত এগিয়ে আসতেই সদর দরজার গোঁড়ায় এসে থমকে দাঁড়ায়। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,-‘আরে রবীণ, সুপ্রিয়, তোমরা? তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না সুপ্রিয়! এদের সঙ্গে তোমরা এলে কোথা থেকে!’

একগাল হেসে অমলেন্দুর বিগ্ বস্ সত্যেন মিত্র বললেন,-‘অমল, ওইতো আমাদের শ্রীমান মুখপাত্র। তোমার হবু জামাতা। তুমি ভালো একটি পাত্রের সন্ধান চেয়েছিলে, আজ সঙ্গেই নিয়ে এসেছি। অফিসে তোমার জুনিয়ার, এ্যাসিসটেণ্ট। ইউ নো হীম বেটার দ্যান মী। আই এ্যাম হানড্রেড পার্সেট সিওর, তুমি রিফিইজ করবে না। সুপ্রিয় আমার নেইভার। আমরা একই কন্ডোতে থাকি। সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বলো তো!’

সবিস্ময়ে অমলেন্দু বললেন,-‘এ্যাঁ! বলো কি, আমাদের প্রিয়! হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! ভাবতেই পাচ্ছিনা। এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! যে কাজ আমি করতে পারিনি…….!’ একটু থেমে বললেন,-‘কিন্তু কাজটা কেমন হোলো বলো তো! কন্যার পিতা আমি, অথচ পাত্রটি কে, তাই-ই জানিনা। অন্তত একবার আমায় ইনফর্ম করতে পারতে!’

সত্যেন মিত্র বললেন,-‘আরে এতো ফর্মালিটির কি আছে! অফিসে তুমিই ওর বস্। তোমার বিশ্বস্থ এবং সজ্জন। তুমিই বেশী জানো ওকে। শুধু তাই নয়, ওকে তুমি ভালোবাসো, ¯েœহ করো। আর সেই হিন্টটা পেয়েই তো..!’ বলতে বলতে সানন্দে হেসে ফেললেন সত্যেন মিত্র। সগৌরবে দৃঢ় আশ্বাস দিয়ে বললেন,-‘হিরের টুকরো ছেলে। একদম হান্ডেড পার্সেন্ট পিওর। আই এ্যম শির্ও, টরন্টো শহরে কোথাও খুঁজে পাবেনা। সো, শুভষ্য শীঘ্রম!’

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে অমলেন্দু বললেন,-‘সবই তাঁর ইচ্ছা। কপালে লিখন থাকলে ঠেকায় সাধ্য কার! এসো, এসো, তোমরা ভিতরে এসো সবাই, কথা হবে!‘
অন্দর মহলের দিকে নজর বুলিয়ে বললেন,-‘কই গো, শুনছো, মা’মণিকে নিয়ে এসো শীগগির। ওরা এসে গিয়েছে।’

ওদিকে অস্থিতিশীলতায় হৃদয়পটভূমি তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে ডালিয়ার। হৃদস্পন্দন আরো দ্রæত গতীতে চলতে থাকে। অথচ তখনও মনস্থির করতে পারেনা, কি করবে। একে একে আগুন্তুক অতিথিবর্গের কুশল বিনিময়, সুপ্রিয়র বাপ-ঠাকুরদার পরচিয়, মত বিনিময় সবই শেষ। এবার ডালিয়ার পালা। মাতা রমলা দেবী দ্রæত এসে বললেন,-‘আয় খুকু, কিচেনরুমে চা -জল-খাবার ট্রে-তে সাজানো আছে। নিয়ে চল আমার সাথে!’

অগত্যা, ভারাক্রান্ত হয়ে মায়ের পিছু পিছু বৈঠকখানায় পা রাখতেই চমকে ওঠে ডালিয়া। বুক ধুক্ ধুক্ করে কেঁপে ওঠে। থমকে দাঁড়ায়।-এ কি, সুপ্রিয় এখানে! ও মাই গড্! ও এখানে এলো কোত্থেকে! চোখে একেবারে তাক লেগে যায়। নজর ফেরাতে পারেনা। আজ নতুন করে সুপ্রিয়র পুরুষোচিত চেহারা আর মিশ্রব্যক্তিত্বের মুগ্ধ আকর্ষণে দৃষ্টি স্থির ওর হয়ে যায়। পড়ে যায় বিস্ময়ের ঘোরে। চিনতে ভুল করছে না তো! বড় বড় চোখ পাকিয়ে দ্যাখে। মনে মনে বলে, হ্যাঁ, সুপ্রিয়ই তো! চেনাই যাচ্ছেনা ওকে। কিন্তু কি আশ্চর্য্য, রায়চৌধুরী পরিবারে ওর আগমন ঘটলো কি করে! এ তো আনবিলিভয়েবল! আনথিঙ্কেবল!’

চকিতে অব্যক্ত আনন্দ আর ভালোবাসার জোয়ারে হৃদয়ের দুকূল জুড়ে কানায় কানায় ভরে ওঠে ডালিয়ার। মেঘের আড়াল থেকে উদ্ভাসিত সূর্য্যরে উজ্জ্বল আলো মতো মুখখানা ওর চকিতে দ্বীপ্তিময় হয়ে ওঠে। ভিতরে ভিতরে পুলকে বিকশিত হয় ওর মন-মানসিকতা। এক অদ্ভুদ শিহরণে দোলা দেয় সারাশরীর।

একেই বলে বরাত। আবেগে অভিভূত ডালিয়া স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। চোখের পলক পড়ে না। জল-খাবারের ট্রে-টা টি-টেবিলে রেখে দ্রæত চলে যাচ্ছিল। অমলেন্দু বললেন,-‘আরে যাচ্ছিস কোথায়! আয়, বোস আমার পাশে। লজ্জা পাবার কি আছে। সুপ্রিয় আমার ছেলের মতো। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে আছি। ও’ আমার এ্যাসিসটেন্ট। বড় ভালো ছেলে। ওর মতো..!’
কথা শেষ না হতেই একটা ফোন কল্ আসে। অমলেন্দু এক্সকিউজ মী বলে ফোনটা রিসিভ করতে দ্রæত পাশের রুমে চলে যায়।
ইতিমধ্যে পাত্রীর মুখদর্শণে যেন আকাশ থেকে পড়ে সুপ্রিয়। বিস্ময়ে এতোটাই অভিভূত হয়ে পড়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে শ্বাশত লজ্জায় নূয়ে পড়া ডালিয়ার রাঙা মুখমালার দিকে। রুদ্ধ হয়ে যায় ওর কণ্ঠস্বর। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে না তো! এ তো স্বপ্নেরও অতীত। অবিশ্বাস্যকর ঘটনা। বিধাতার লীলাখেলা বোঝা ভার।

ভিতরে ভিতরে হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে হৃদয় সমুদ্রে তখন উথাল-পাথাল হয়ে যাচ্ছে দুজনের। কিন্তু তা কাউকে বুঝতে দিলো না। আগুন্তুক অতিথিগণও কেউ টের পেলো না। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হয়না ডালিয়ার। স্বপ্নের মতো মনে হয়। ভেবে কূল পায়না, এসব সম্ভব হোলো কেমন করে! ঘেমে অস্থির। সারাশরীর ওর ঘর্মসিক্ত হয়ে ওঠে। ওর ঐ ব্যতিক্রম চেহারা লক্ষ্য করে অমলেন্দু বললেন,-‘হোয়াট হ্যাপেন্ড মামণি? আর ইউ ও.কে?’

লজ্জা পেয়ে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফ্যালে ডালিয়া। জড়িয়ে ধরে মাকে। আকস্মিক অপ্রত্যাশিত একরাশ আনন্দ ও আবেগের সংমিশ্রণে মুক্তোর মতো অশ্রæকণায় চোখদু’টো ওর চিক্ চিক্ করে ওঠে। সাশ্রæনয়নে সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলে,-‘নাথিং ড্যাড। আই এ্যাম এ্যাবসুলোটলি ও.কে।’

সত্যেন মিত্র বললেন,-‘ও.কে, এভ্রিথিং ইস ফাইনাল। নাও উই আর গোইং আউট এক্সেপ্ট সুপ্রিয় এ্যান্ড মিস ডালিয়া। দে মাষ্ট নীড টু নো ইচ্ আদার।’

বৈঠকখানা ছেড়ে সবাই বেরিয়ে যেতেই কি যেন বলতে চাইছিল ডালিয়া। ইতিপূর্বে ওর হাতদুটো চেপে ধরে সুপ্রিয় বলল,-‘নো নীড টু সে এনিথিং ডলি! আজ আর আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।’
ওর কপালে একটা আলতো চুম্বন করে বলল,-‘মাই সুইট হার্ট, আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ্!’

মুচকি হেসে ক্ষীণ মৃদুস্বরে সুপ্রিয়র কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে ডালিয়া বলল,-‘মী টু!’
বলতেই সুপ্রিয় ওকে সজোরে প্রেমালিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে।

সমাপ্ত

যুথিকা বড়ুয়া: কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

jbaruajcanada@gmail.com