আত্মঘাতী : ক্ষুদীরাম দাস

ছোটগল্প : আত্মঘাতী
লিখেছেন : ক্ষুদীরাম দাস

এক.
সর্বশক্তি দিয়ে পি. আর. সাহেব গাড়ির দরজাটি খুললেন। রানাকে সজোরে এক লাথি দিয়ে টেনে হেঁচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলেন। আর সেই সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে লাগলেন। আর দুই হাতে চরথাপ্পড় দিতেই চলেছেন। চিৎকার শুনে কারখানার সমস্ত লোকজন তাকিয়ে আছে। ভয়ে সকলেই কাঁপছে। কী জানি, হয়তো আজ তাদের কপালেও শনি আছে। কারণ, পি. আর. সাহেব একবার রেগে গেলে কাউকে ছেড়ে দেন না। এতে দোষ থাকুক, আর না থাকুক। পুরোনো বিষয় টেনে এনে হেনস্তা করতে থাকেন।


রানাকে সজোরে এক লাথি দিলেন। সাথে রানা ‘ওমা গো’ বলে মাটিতে বসে গেলো। প্রচÐ ব্যাথায় নাক চেপে ধরে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আর এদিকে চিৎকারে করে আর. পি. সাহেব হুঙ্কার দিতে থাকলেন। এক পা, দু’ পা করে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকলেন। একসময় রানার দিকে আবার তেড়ে আসলেন। রানার দুই কান টেনে ধরে তাকে দাঁড় করালেন। আর বলতে লাগলেন ঃ হারামি কোথাকার! ঠিক মতো গাড়ি চালাতে পারিস্ না? কয়েকদিন পর পর গাড়ির এটা ক্ষতি হয় ওটা ক্ষতি হয় কেন? গাড়ির তেল এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয় কেন? চুরি করিস্ নাকি? ধরতে পারলে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো রে তোকে!রানা অনুনয়ের সাথে বললো ঃ স্যার, আমি কোনোদিন তেল চুরি করিনি!

পি. আর. সাহেব আরো ক্ষেপে গিয়ে বলতে লাগলেন ঃ তোর এতো বড় সাহস, আমার মুখের উপর কথা বলিস?
এই বলে আবারো রানাকে চড়থাপ্পড় দিতে থাকলেন। রানার কাছে সবই অসহ্য লাগছিলো। এদিকে কারখানার লোকজন যে যার কাজে মনোযোগ দিলো। তবে কেউ কেউ উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সবই দেখতে থাকলো। এটা প্রতিদিনকার ঘটনা। আজ এর সাথে, কাল ওর সাথে ঘটনা ঘটেই থাকে। কারখানার মালিক বলে কথা! তাই পি. আর. সাহেবের কারখানায় মানুষ বেশি দিন টিকতে পারে না। কেউ কেউ হঠাৎ করে পালিয়েও চলে যায়। এটা মোটেও নতুন কিছু নয়।

হঠাৎ পি. আর. সাহেবের মোবাইলটি বেজে উঠে। তাই মোবাইল রিসিভ করে তাড়াতাড়ি অফিসের দিকে চলে গেলেন। কারখানার অন্যান্য কর্মচারীরা সহানুভূতি দিতে দিতে রানাকে নিয়ে গেলো। কেউ একজন এসে বললো ঃ পি. আর. সাহেব চলে গেছেন। একঘন্টার মধ্যে লন্ডন চলে যাবেন কোনো এক মিটিংয়ে যোগ দিতে।


এদিকে রানা অসুস্থ হয়ে গেলো। পি. আর. সাহেবের লাথির কারণে বুকে ভীষণ ব্যাথা অনুভব করছেন। দীর্ঘদিন কারখানায় কাজ করার সুবাদে কিছু লোকের সাথে বিশ^স্ত বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো। তারা তাকে প্রায় সময় এসে সান্তনা দিতে থাকে। একটা অটো বন্ধুরা ভাড়া করে এনে রানাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। খুব যতেœর সাথে রানাকে বন্ধুরা নিয়ে যাচ্ছে। একজন বন্ধু রানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সান্ত¡না দেয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। তখন রানা বলে উঠলো ঃ ইচ্ছে করছে আজই চাকুরিটা ছেড়ে দিই।

বন্ধু অনেকটা অভিমানের শুরে বললো ঃ তাহলে যাস না কেন? তোর উপর এতো অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারি না। তোর তো এখান থেকে এখনই পালিয়ে যাওয়া উচিত।

রানা ঃ চলে গেলো বাঁচবো কী করে ভাই! মাস শেষ হলে যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চালাই। একদিকে চাকুরির মায়া, তারপর সংসারের ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে সবই সহ্য করে যাচ্ছি। চাকুরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় যাবো। তাছাড়া বয়স এখন বিয়াল্লিশ। এই বয়সে তেমন একটা ভালো চাকুরি পাবো বলে মনে হয় না। তাই মুখবুজে সহ্য করছি।
বন্ধু ঃ মানুষ এতো খারাপ হতে পারে?

এক সময় রানা ঘুমিয়ে পড়লো কিছু সময়ের জন্যে। বন্ধুরা সকলে পি. আর. সাহেবের আচরণের জন্যে নানান কথা বলতে লাগলো। সকলের মুখেই পি. আর. সাহেবের উপর অভিশাপের সংলাপ। তাদের কথা শুনে মনে হবে এই মুহূর্তে তাকে কাছে পেলে সবাই মিলে ছিঁড়ে খাবে। একই রকমভাবে তাকেও রাস্তায় ফেলে মেরে ফেলবে। বুকে লাথি মারবে। বন্ধুরা একেকজন হুঙ্কার দিয়ে পরস্পরের সাথে কথা বলছে।

একসময় তার হাসপাতালে চলে আসে। রানাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় সকলে। ডাক্তার দেখিয়ে তার চিকিৎসার করায়। একজন বন্ধু ডাক্তারের প্রেসকিপশন দেখিয়ে ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনে আনে। পরে তারা সকলে ওয়েটিং রুমে কিছু সময়ের জন্যে বসে। সকলে চুপচাপ কিছুক্ষণ রইলো। একসময় বন্ধুরা সকলে পরস্পরের দিকে তাকায়। কয়েকজন বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক পায়চারি দিকে থাকে। সকলেই যে যার মতো ভাবছে। একজন বন্ধু এক গøাস পানি এনে রানাকে ঔষধ খাইয়ে দেয়। রানা কিছু সময় আরাম করে চেয়ারে বসে থাকে।

কিছু সময় পর রানা সবাইকে বললো ঃ এই অমানুষটা সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে তো তাই আমাদের মতো গরীবদের দুঃখ বুঝতে চায় না। টাকা আছে বলে যাচ্ছেতাই করছে। গরীবের উপর অত্যাচার সৃষ্টিকর্তা সইবে না।
একজন বন্ধু বললো ঃ সে তো আমাদের উপর দিনের পর দিন অত্যাচার করছে।
ঃ তাহলে আমরা কী করবো? আমাদের কী করা উচিত?
ঃ আমরা সকলে চাকুরি ছেড়ে চলে যাই।


ঃ না না সেটা আমাদের ভীষণ বোকামী হবে।
ঃ আমাদের চাকুরি ছাড়া যাবে না। চাকুরি আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। আর আমরা গরীব বলে তাদের মতো মানুষের কর্মচারী হয়ে রয়েছি।
ঃ তাই বলে এভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করবে?
ঃ টাকাওয়ালারা এভাবেই আমাদের মতো অসহায়দের উপর অত্যাচার করে।
ঃ ঠিক বলেছিস্। এটা মোটেও নতুন কিছু নয়।
ঃ ওদের মনের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ বলতে কিছুই নেই। নৈতিক শিক্ষা ওদের নেই। তাই ওদের মনের মধ্যে পশুত্ব কাজ করে। আমাদের মতো মানুষদের মানুষ বলে গণ্য করে না।
ঃ ওরা ধনী লোক। ওদের জীবনই আলাদা।
ঃ তাই বলে কি আমরা মানুষ নই? আমাদের উপর এভাবে অমানসিক নির্যাতন চালাবে? এভাবে আর কতোদিন।

রানা বন্ধুদের সব কথা শুনছিলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চায়। মনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত বাসা বেঁধেছে। সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে তাকিয়ে দেখলো, লেখা আছে, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। তবুও মানুষ এই বিষয় পান করে। আমরা সকলেই বিষয় পান করি। সুতরাং বিষের জ¦ালা আমাদের শরীরে রয়েছে। আমরা গরীব বলে কম দামী পান করি। আর ধনী বলে পি. আর. সাহেব দামী দামী সিগারেট পান করে।

ওরা সকলে উঠে দাঁড়ায়। আর তারা হাসপাতাল থেকে সকলে চলে যায়। কিছুদিন পর রানা সুস্থ হয়ে উঠে।
বেশ কিছুদিন দিন পি. আর. সাহেব লন্ডন থেকে ফিরে আসে। তার কিছুদিন পর আবারও রানাকে মারধর করে। সেই সাথে আরো কয়েকজন কর্মচারীকেও মারধন করেছিলো। কাউ কাউকে গালাগালি করেছিলো। এভাবে অত্যাচারিত হতে হতে দিন চলে যেতে থাকে।

একদিন এক বয়স্ক দাড়োয়ানকে জুতা দিয়ে পেটালো। এটা দেখে কারখানার বয়স্ক কর্মচারীরা এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু তারা পি. আর. সাহেবকে কিছুই বলার মতো সাহস করলো না। বয়স্ক লোকটি জুতা পেটা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অফিসের দিকে চলে গিয়েছিলো। একজন সহকর্মীকে বলেছিলো ঃ এই পি. আর. কে আমি ছোট বেলা থেকেই দেখছি। তাকে আমিও কোলে নিয়েছিলাম। কোলে করে নিয়ে তাকে গাড়িতে বসিয়েছিলাম। তাকে আমি অনেক আদর যতœ করতাম। তার বাবা আমাকে প্রচÐ ভালোবাসতেন। অনেক শ্রদ্ধা করতেন। আর আজ আমি তার দ্বারা অপমানিত হলাম। আমার গায়ে এভাবে হাত তুললো! বয়স্ক লোকটি এর কিছুদিন পর মারা যায়। সকলেই বলতে থাকে, পি. আর. সাহেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে বয়স্ক লোকটি মারা গেছে। সকলেই লোকটির জন্যে হাহুতাশ করেছিলো।

দুই.
একদিন শহর ঘুরতে রানা পি. আর. সাহেবের ছেলেমেয়ের নিয়ে বের হলো। সারাদিন তাদের নিয়ে ঘুরলো। একটি বাসের সাথে গাড়ির ঘষা লাগে। এতে সাদা গাড়ির একপাশ দাগ হয়ে যায়। দাগটি বিশ্রী রকমের হয়ে গেছে। গাড়ির সৌন্দর্য আর আগের মতো নেই। ছেলেমেয়েরাও আপসোস করছে; আর ঠিক বাবার মতোই রানাকে গালাগালি করতে লাগলো। তারা বললো ঃ আজ আমরা সকলেই বাবার কাছে আপনার কথা বলবো। আপনি ইচ্ছে করেই গাড়ির এই ক্ষতি করলেন। বাবা আপনাকে আবারও মারবে।
রানা ঃ আরে বাবা আমি তো আর ইচ্ছে করে এ রকম করিনি। এটা হয়ে গেছে। এটা দুর্ঘনা।
ওরা হুঙ্কার দিয়ে বললো ঃ আবার মুখে মুখে কথা বলছেন। আবার সাহস তো কম নয়। আজ বাবাকে অবশ্যই নালিশ করবো আপনার নামে।
রানা ওদের সাথে কোনো কথাই বললো না। শুধু মনে মনে ভাবলো, কপালে যা হবার তাই হবে।
গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় বাড়িতে চলে এলো। দাড়োয়ান গেইট খুলে দিলেন। আর রানা গাড়িটি নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। সাথে সাথে পি. আর. সাহেবের ছেলেমেয়েরা দৌঁড় দিয়ে বাবার রুমে গিয়ে রানার নামে বলে দিলো। সাথে সাথে পি. আর. সাহেব একটা লাঠি হাতে নিয়ে ছুটে এলো। আর রানাকে দেখতে পেয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে লাগলো। আর বলতে লাগলো ঃ ছোট লোকের জাত। তোদের তিন পুরুষের এমন গাড়ি ছিলো নাকি রে। তোরা দেখেছিস এমন গাড়ি। আমার গাড়ির উপর অত্যাচার করিস। তোরা টাকা পয়সার মুখ দেখেছিস রে।
পি. আর. সাহেবের ছেলেমেয়েরা এসব দেখছিলো। তারা রানাকে আরো বেশি করে মারার জন্যে উসকে দিতে লাগলো। বলতে লাগলো ঃ আরো মারে দুষ্ট লোকটাকে, আরো বেশি করে মারো। যে চিরজীবন মনে থাকে।
রানা সমস্ত লাঠির আঘাত সইতে লাগলো। কিন্তু আজ অন্যদিনের মতো কিছুই করেনি রানা। শুধু দু’চোখের জল ফেলতে লাগলো। পি. আর. সাহেব ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রানাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো।
হাঁপাতে হাঁপাতে পি. আর. সাহেব ঘরে ঢুকে গেলেন।
কেটে গেলো বেশ কয়েকটি মাস।

তিন.
ডিসেম্বর মাস। শীতকাল। কনকনে ঠাÐা। পিকনিক আর ভ্রমণের যাবার উপযুক্ত সময়। পি. আর. সাহেব চিন্তা করলেন কয়েক দিনের জন্যে কক্সবাজার সমুদ্র সৌকতের দৃশ্য দেখা দরকার। এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন স্বপরিবারে কক্সবাজার যাবেন।
এজন্যে ফোনের মাধ্যমে কক্সবাজার সমুদ্র সৌকতের নিকটবর্তী হোটেল ভাড়া করলেন এক সপ্তাহের জন্যে। এ খবর শুনে পি. আর. সাহেবের পুরো পরিবার খুশিতে গদগদ। অপেক্ষা করছে কবে সেই কাক্সিক্ষত দিন আসবে।
পি. আর. সাহেব রানাকে খবর পাঠালেন কক্সবাজার যাওয়ার জন্যে গাড়ি প্রস্তুত করতে।

রানা জানতে পারলো এবার পি. আর. সাহেবের পুরো পরিবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে একই গাড়িতে করে যাবে। আর তাকেই সেই গাড়ি চালাতে হবে।

আঘাত করার সীমা আছে। কষ্ট দেবারও সীমা আছে। অসহায়েরা নীরবে সবই সহ্য করে। কিন্তু থেকে যায় তাদের মনে আঘাতকারীদের উপর প্রচÐ ঘৃণা। সেই ঘৃণা থেকে জন্ম নিতে পারে তিক্ততার মহাপরিকল্পনা। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেলে যা হয় সে রকমই কিছু একটা। অন্য কোনো উপায় না থাকলে অসহায়রাও একসময় তীব্র আঘাতের পরিকল্পনা করে। দুর্বলদের রোষানলে পড়ে গেলে যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন তাদের নিস্তার নেই। আর এই রোষানল জ¦লতে থাকে ঘৃণা থেকে। আক্রোশ তখন বেড়েই চলে। রানার মনের মধ্যে যেমন সেই আক্রোশ বেড়েই চলছে। এই আক্রোশ সুযোগ খুঁজছিলো দীর্ঘদিন থেকে।

একদিন রানা রাতের বেলায় বিছানায় ঘুমাতে ঘুমাতে চিন্তা করলো, এই সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। তীব্র আঘাত করবো। আত্মঘাতী আঘাত! এই আঘাত থেকে তার পরিবারের কেউ রক্ষা পাবে না। আমি আর বাঁচতে চাই না। এভাবে জীবনকে বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। এই অমানুষের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। আর সহ্য করবো না। আর কষ্ট দেবার সুযোগ দেবো না। সমস্ত প্রতিশোধ নেবো। আর সেই প্রতিশোধ হবে দৃষ্টান্তমূলক। এখন শুধু সেই দিনের অপেক্ষা। আরাম করে নে, যত পারিস। তোর আর বেশি দিন নেই। আত্মঘাতী! আত্মঘাতী!! আত্মঘাতী প্রতিশোধ।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রানা ¯œান করে নেয়। তারপর ফুরফুরে মেজাজে পি. আর. সাহেবের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে ঢোকে। তার পরিবারের সকলে কক্সবাজার যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। বেশ সেজেগুজে রয়েছে সকলে। একে একে সকলে গাড়িতে বসলো। রানার পাশে পি. আর. সাহেব বসলেন।

রানা বললো ঃ আমরা কি রওনা দিতে পারি?
পি. আর. সাহেব ঃ হুম! খুব সাবধানে চালাও গাড়ি। দুপুর ১টার দিকে একটা ভালো হোঁটেলে থামিয়ে নিও। খাবার দাবার সেরে নেবো।
রানা মনে মনে চিন্তা করলো, সেই সুযোগ আর হবে না পি. আর. সাহেব। রানা গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে খুবই সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাতে লাগলো। রানা আগেই ঠিক করে রেখেছিলো কোথায় ঘটনা ঘটাবে। নিজের জীবন আজ নিজে শেষ করে দেবে। ক্ষোভের আগুণে জ¦লছে প্রতিটি মুহূর্ত। গাড়ি চলছে তো চলছে। একসময় ফাঁকা জায়গা দেখলো রানা। এখানে সামনে অথবা পেছনে কোনো লোকাল জায়গা বা কোনো বাজার নেই। গাড়িতে বসে থাকা প্রাণীগুলো বেশ মজা করছে। চারিদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। রানা দেখলো, পি. আর. সাহেব একটু ঘুম ঘুম ভাবের মধ্যে রয়েছেন। পেছনে সকলে হৈচৈ করছে। রান মনে মনে বললো, ঘুমাও বাছাধন ঘুমাও। রানার উপর রানা দেখলো সাহেবের অত্যাচারের ঘটনাটিগুলো একে একে মনে পড়তে লাগলো। আর রানা ফুঁসতে লাগলো। গাড়ি গতিও বাড়াতে লাগলো তীব্র থেকে তীব্র গতিতে। রানা দেখতে পেলো তার গাড়ির গতি অস্বাাভাবিক বেড়ে গেছে। আর বিপরীত দিক থেকেও গাড়িগুলো তীব্র গতিতে ছুটছে। একটি বড় লাল রঙের ট্রাক ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে। রানাও গাড়িটির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো। রানা দেখলো সাহেবের স্ত্রী বুঝতে পারলেন গাড়ির গতি বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক গতিতে। তিনি রানাকে এতো জোরে গাড়ি চালাতে নিষেধ করছেন। চিৎকার করে বলছেন যেনো গাড়ির গতি আরো কমানো হয়। কিন্তু না, রানা তার কথা শুনলো না। বরং জানিয়ে দিলো এটাই আপনাদের জন্যে শেষ গতি। আর রানা ডান দিকে হালকা মোড় নিয়ে লাল রঙের বড় ট্রাটের নিচে ঢুকিয়ে দিলো।

দূর থেকে মানুষজন বিকট আওয়াজ শুনতে পেয়ে ছুটে এলো। রানার গাড়ির অস্তিত্ব রইলো না। গাড়িটি টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে পরে রইলো। গাড়িতে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের দেহের টুকরো রাস্তার উপর, রাস্তার পাশে জমিতে পড়ে রইলো। কোন মাথা কোনদিকে ছুটে গেছে বোঝা যাচ্ছে না। লাশের টুকরোগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। পিছঢালা রাস্তায় লাল রক্তের বন্যা বইয়ে গেছে যেনো। কুকুরের দল মাংসের টুকরোগুলো কাড়াকাড়ি করে খেয়ে নিচ্ছে। আর কুকুরগুলোর মধ্যে তুমুল ঝগড়া আর মারামারি শুরু হয়ে গেলো। কয়েকজন লোক লাঠি হাতে ওদের তাড়া দৌড় দিলো। তার আগেই মানুষের মাংসের বেশ কিছু টুকরো ঘাপাঘাপ খেয়ে নিয়েছে।

‘আহা! সে কী করুণ দৃশ্য! আহা রে কীভাবে হলো দুর্ঘটনা। দু’দিনের দুনিয়াতে কতোদিন আর মানুষ বেঁচে থাকে। আজ আছি তো কাল নাও থাকতে পারি। নিঃশ^াসের কী আর বিশ^াস আছে। কে কখন মারা যাবো, আমরা সেটা বলতে পারি না।’-এভাবে অনেক কথা মানুষের মুখে মুখে। কেউ আবার চোখের জলও ফেলেছে। দুর্বলচিত্তের মানুষগুলো ধারে কাছেও আসেনি। এমন করুণ দৃশ্য তাদের সহ্য হবে না বলে তারা দূরে থেকেই সব খবর শুনেছে। সাংবাদিকরা ছুটাছুটি করছে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে। পি.আর. সাহেবের কিছু পোষা সাংবাদিকও ছিলো। যারা তার পক্ষেই সাফাই গাইতো।

কিন্তু দুর্ভাগ্য! রানা সম্পূর্ণ জীবিত; তবে অজ্ঞান হয়ে ধানক্ষেতে চিৎ হয়ে পরে আছে। এদিকে ট্রাকটিও রাস্তার পাশের গাছের সাথে ধাক্কা লেগে কাৎ হয়ে রয়েছে। ড্রাইভার আহত হয়েছেন। ট্রাকে থাকা জিনিসপত্র রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে রানা ও ট্রাক ড্রাইভারকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো।

পি.আর. সাহেব একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তাই সেখানে দুর্ঘটনার খবর খুব দ্রæতই ছড়িয়ে পড়লো। দুর্ঘটনাস্থলে মানুষে পরিপূর্ণ হলো। সকলেই হাহুতাশ করতে লাগলো। পুলিশের লোকজন বাঁশি দিয়ে মানুষকে সরে যেতে বলতে লাগলেন।

দুর্ঘটনার কথা কারখানার কর্মচারীদের কানে যেতে বেশি সময় হলো না। ওরা শুনতে গেলো রানাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আর তাই দুর্ঘটনা স্থলে যাওয়ার আগে তারা সকলে রানাকে দেখার জন্যে হাসপাতালে রওনা দিলো।
হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে রানা বুঝতে পারলো বাম পা থেতলে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছু হলো না। রানা তাকিয়ে দেখলো, তার চারিদিকে কারখানার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে।
একজন রানার গায়ে হাত রেখে বললো, কেমন আছিস রানা?
রানা তার দিকে তাকালো। এরপর সকলের তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।