লোভ : ক্ষুদীরাম দাস

লোভ
ক্ষুদীরাম দাস

ললিতা বিয়ের আগে মোটেও বুঝতে পারেনি সীমান্তের পরিবার সম্পর্কে। ললিতা খুবই আশ্চর্য হয় এই পরিবারের লোকজনের কাÐকীর্তি দেখে। কী অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ওরা। শুধু পেতে চায় অন্যের কাছ থেকে। বিয়ের দিন রাতেই আমাকে দিয়ে কাকাকে ফোন করিয়েছে, গায়ে হলুদের ট্রলিতে চিরুনী ও সিঁদুর পাওয়া যায়নি। সেটি কোথায় আছে, নিয়ে আসতে বল। নির্লজ্জের মতো কাকাকে ফোন করেছে ললিতা। ললিতা সবকিছুই গোপন করে রেখেছে মনের মধ্যে।

এদিকে ললিতার কাকা আশ্চর্য হয়ে যায়, ললিতার এমন আচরণে। কিন্তু এটা বুঝতে পারে যে, এটা ললিতা ইচ্ছার বিরুদ্ধে করছে। তাকে দিয়ে ফোন করাচ্ছে ওরা। তাকে হয়তো ফুঁসলিয়ে ফোন করাচ্ছে, নয়তো জোর করছে। ললিতার কাকাও এ বিষয়ে চিন্তিত। কিন্তু তার মাথায় এটা কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বাপ হারা মেয়েটার জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?

বিয়ের পরদিনই পরিবারের মানুষগুলোর অদ্ভুত আচরণ ললিতাকে ভাবিয়ে তুলেছে। জীবনে কী শিক্ষা পেয়েছে, আর এখানে এসে এসব কী দেখছে? ওরা বিয়ের উপহারগুলো নিয়ে এতো নাড়াচাড়া করছে কেনো? কেউ কেউ এসে বলছে, তোমার কাকা তোমাকে কী কী দিলো? কী কী দেয়া উচিত ছিলো। কেউ কেউ বলছে, কাকা তো, আর কতো করবে? বাবা হলে তো এসব ভুল করতো না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সবই করতো।

ললিতা ছোট একটা এনজিওতে চাকুরি করতো। চাকুরির টাকা সে নিজে খরচ করতো। আর কিছু টাকা পড়াশোনার জন্যে তার ছোট ভাইকে দিতো। ললিতার বাবা নেই, তাই নিজের মা ও ভাইয়ের দায়িত্ব নিজে নিয়েছিলো। কিন্তু সেই দায়িত্ব ললিতা ঠিকমতো করতো না। নিজের ইচ্ছামতো টাকা-পয়সা খরচ করতো। তাই ললিতার কাকা এসব জানতে পেরে তার ব্যাংকের চেক নিয়ে গিয়েছিলো। কারণ, ললিতার মাসিক বেতন ব্যাংকে জমা হতো মাস শেষে। যেন নিজের ইচ্ছামতো খরচ করতে না পারে সে জন্যে নিয়ে এসেছিলো। আর ললিতার খরচ যা লাগতো কাকা দিয়ে আসতো।

ললিতার বিয়ের পর তার শ^শুর বাড়ির লোকজন ভেবেছিলো, কাকাই ললিতার সমস্ত টাকা পয়সা নিয়ে গেছে। তারা আসা করেছিলো ললিতার ব্যাংকে অনেক টাকা আছে। আর সেই টাকা দিয়ে তারা কিছু একটা করবে। সত্যিকারে ললিতার কোনো টাকা ব্যাংকে ছিলো না। যেন ললিতার টাকাগুলো রক্ষা করতে পারে, সেজন্যে তার কাকা ব্যাংকের চেকটা নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু সেই চেক বেশিদিন তার কাছে রাখেনি। দেড়মাসের মাথায় দিয়ে দেয়। ব্যাংকের টাকার জন্যে ললিতার শ^শুর বাড়ির লোকদের অনেক লোভ ছিলো।

ললিতার বিয়ের পর তার শ^শুর বাড়ির লোকজন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জিজ্ঞাসা করেছিলো। এতে ললিতা খুবই অবাক হয়েছিলো। অদ্ভুত একটি পরিবারে তার বিয়ে হয়েছে। ললিতা এখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। কারণ, দুই ননদের বিয়ে হলেও তারা বাপের বাড়িতে থাকে। ললিতার শ^শুর মেয়েদের নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। তার শ^শুর মেয়েদের আয়ের টাকা খেয়েছে। কোনো পেশার সাথে জড়িত নয়, অনেকটা অলস প্রকৃতির। তেমনিভাবে ললিতার স্বামীও নিজের বাপের মতো হয়েছে।

কোনো কাজ কর্ম করে না। ছোট বোনরা যেখানে চাকুরি করে সেখানে বিয়ের আগে পর্যন্ত নির্লজ্জের মতো থাকতো। অনেকটা চালাকি করে ললিতার শ^শুর শাশুড়ি তার দুই মেয়েকে নিজের করে রেখেছে। স্বামীরা বাধ্য হয়ে শ^শুর বাড়িতেই থাকে। এসব কিছু ললিতার কাকা মোটেও জানতো না। তাছাড়া বিয়ের আগে বলেছিলো, ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। চাকুরি করে বিশ হাজার টাকা মাসে আয় করে। এরপর হঠাৎ একদিন শোনা গেলো ছেলের চাকুরি নেই। ললিতার কাকা আশ্চর্য হলো। বিয়ে হয়েছে মাত্র দুই মাস হলো, এর মধ্যে ছেলের চাকুরি নেই! এটা স্পষ্ট যে, ছেলে কোনো চাকুরি করতো কিনা সেটা সন্দেহ। একদিন ললিতার কাকা কৌশলে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার জন্যে একটা চাকুরি দেখছি, তুমি আগে যেখানে চাকুরি করতে সেখানে কতো টাকা বেতন পেতে সেটা জানালে, একটা ধারণা নেয়া যায়। সেই অনুযায়ী চাকুরি দেখা যেতে পারে। তখন সে বলেছিলো বার হাজার টাকা। এটা শুনে ললিতার কাকা আরো বেশি আশ্চর্য হয়। কোনো মিল খুঁজে পায় না। এতে আর সন্দেহ করার বাকি নেই যে, তারা সকলেই প্রতারণা করেছে।

ললিতার বাপের বাড়িতে একবার সকলে বেড়াতে গিয়েছে। তখন ললিতার শ^শুর বাড়ির লোকজনদের জিজ্ঞাসা করেছে, ললিতার বিয়ের সময় কতো টাকা আপনারা খরচ করেছেন। এটা শুনে তারা আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায়। এটা কী ধরনের কথা! তাছাড়া তারা আরো জিজ্ঞাসা করে যে, ললিতার ব্যাংকে কোনো টাকা নেই কেন? তার সমস্ত টাকা কোথায় গেলো। তখন ললিতার কাকা এটা বোঝাতে চায় যে, এসব কথা বলতে হয় না। এসব কথা বলে না, বলা উচিতও নয়। এটা অভদ্রতা! এসব নির্লজ্জের মতো আচরণ। এসব বলতে হয় না। কিন্তু এসবের অর্থ তারা বুঝতে চাইলো না। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলো অর্শিক্ষিত। তাই তাদের এসব কথাগুলোকে নির্লজ্জের আচরণ ছাড়া আর কিছু বলে গণ্য করা যায় না।

 

ললিতার কাকা নীরব থাকে। ওদের মতো মানুষদের বোঝানোর মতো পরিবেশ পরিস্থিতি নেই। তারা কোনো কথাই শুনবে না। তারা হলো লোভী প্রকৃতির মানুষ। মেয়ের চাকুরির টাকার প্রতি তাদের দারুণ লোভ ছিলো। তাই তারা মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। এরপর তারা বিভিন্ন কৌশলে ললিতার ভাইয়ের পড়াশোনার টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। এমনকি ললিতার মাকেও কোনো টাকা পয়সা দেয় না।

ললিতার কাকা স্পষ্ট বুঝতে পারে যে, এই পরিবারটা খুবই লোভী প্রকৃতির। এ ধরনের মানুষের কিছু খাওয়া উচিত নয়, এমনকি ওদের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। ওদেরকে খাওয়ানো উচিত নয়। ওদের সাথে থাকাও যায় না; ওদেরকে রাখাও যায় না। ললিতার ভাইকে পরিস্কার বলেছে, পড়াশোনা করতে পারলে নিজে নিজে করতে হবে। তবে তোমার বোনের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়ার দরকার নেই। তাহলে তুমি ভবিষ্যতে বিপদে পরে যাবে। তাদের কথা শুনতে শুনতে তুমি শেষ হয়ে যাবে।

একদিন ললিতার কাকা বলেছিলো, আপনারা একটা সোনার ডিম পাড়া হাঁস পেয়েছেন। এই মেয়ে আপনাদের পরিবারের আশির্বাদ; আপনাদের পরিবারের সম্পদ! তার বাবা নেই। সুতরাং তাকে কোনোভাবেই কষ্ট দেবেন না। আপনাদের জীবনের ঋণ সে শোধ করে দেবে। এরচেয়ে বড় আশির্বাদ আর কী হতে পারে। আপনাদের দারিদ্রতা সে দূর করবে। এই মেয়ে আপনাদের পরিবারের বড় অবলম্বন।