সংগ্রামী জীবন : ক্ষুদীরাম দাস

ক্ষুদীরাম দাস :

‘বোনাসের টাকা দিয়ে এবার কী কী করবেন দিদি।’
তনুশ্রী কথাগুলো বলতে বলতে জয়ীতার পাশ দিয়ে ঢুকলেন অফিসে।
জয়ীতার ভালো লাগে তনুশ্রীকে। অফিসের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনযাপনকারী একজন ভদ্র মহিলা তনুশ্রী। ছোট বেলা থেকে কষ্ট করে মানুষ হয়েছেন। অনেক দারিদ্রতার মধ্যে তার জীবন ছিলো। অনেক স্ট্রাগল করে বড় হয়েছেন। জীবনে যে কষ্ট করেছেন, সেই কষ্টকর জীবন থেকে তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে।

তনুশ্রী প্রায়ই জয়ীতাকে বলে থাকে ‘দারিদ্রতার মধ্যে বড় হয়েছি। অনেক সংগ্রাম করেছি। তাই জীবনে অপচয় করতে র্শিখিনি। অনেক হিসাব করে জীবনে চলি।’ এসব কথা জয়ীতার ভালো লাগে। কোনোদিন তার মুখ থেকে কারো সম্পর্কে সমালোচনা করতে শুনা যায়নি। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। অফিস শেষে বাড়তি আয়ের জন্যে সেলাই করা। একছেলে এক মেয়ে রয়েছে। তাদেরকে মানুষ করাই তার ভবিষ্যৎ চিন্তা।

জয়ীতাও মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তনুশ্রীর সহযোগিতায় ও সাহায্যে এই অফিসে তার চাকুরিটা হয়েছে। তনুশ্রী সাহায্য না করলে আজ তাকে অনেক কষ্টে জীবন পার করতে হতো। জয়ীতা তনুশ্রীর অনুসারিই বলা চলে। সবসময় তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েই চলে। তাই পরামর্শের জন্যে তনুশ্রীর পিছন পিছন অফিসে ঢুকলো। ‘এই তো দিদি ভালো আছি।’ বলেই অফিসে ঢুকে চেয়ারে বসলো জয়ীতা।

তনুশ্রী ঃ তারপর বোনাসের টাকা দিয়ে কী করবেন বললেন না তো।
জয়ীতা ঃ ভাবছি ঘরের জন্যে কিছু জিনিস কিনবো।
তনুশ্রী ঃ কী জিনিস?
জয়ীতা ঃ চেয়ার টেবিল আর সেলাই মেশিন।
তনুশ্রী ঃ সেলাই মেশিন কেন?
জয়ীতা ঃ একটু বাড়তি আয়ের জন্যে। তাছাড়া আমি তো একটু একটু সেলাই করতেই পারি। সুতরাং আমার কোনো সমস্যা হবে না। আর পাশাপাশি তো আপনি আছেনই।
তনুশ্রী ঃ খুব ভালো কথা। বুদ্ধিমানের কাজ করছেন। আমি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবো। আর কী করবেন শুনি?
জয়ীতা ঃ আর লোনের কিছু টাকা পরিশোধ করবো।
তনুশ্রী ঃ আচ্ছা আমি একটা বিষয় বুঝতেই পারি না, আপনারা কেন লোন করেন? মানুষ লোন করে উপকারের জন্যে। আয় রোজগার বাড়ানোর জন্যে। অথবা কোনো ছোটখাট বা বড় কোনো ব্যবসা করার জন্যে। যেন আয় করতে পারে। আর আপনি লোন করেছেন অন্যের কাছ থেকে আনা লোন পরিশোধ করবার জন্যে। মনে রাখবেন, কষ্ট হলেও লোন না করে চলতে পারলে লোন করবেন না। লোন করার আগে চিন্তা করবেন লোন পরিশোধ করতে পারবেন কি না। তা না হলে লোনের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে মরবেন।
একটা দীর্ঘশ^াষ ছেড়ে বললো জয়ীতা ঃ কী করবো দিদি! আমার স্বামী বলেছে লোন করবার জন্যে। এখন আমি কী করতে পারি।


তনুশ্রী ঃ আপনার স্বামী তো একটা অপদার্থ। নিষ্কর্মার ঢেঁকি! সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াবে। আর নির্লজ্জের মতো বউয়ের টাকায় ফুটানি দেখাবে। তার কথায় আপনি লোন করতে গেলেন কেন?
জয়ীতা ঃ উপায় ছিলো না। তাই লোন করতে হয়েছে।

তনুশ্রী ঃ আর লোন করবেন না। এ জন্যে আপনি উন্নতি করতে পারছেন না। লোনের বিপরীতে যে সুদ আসছে সেই টাকাই তো আয় করতে আপনাদের বারোটা বেজে যাচ্ছে। বেড়ার ঘরে এয়ার কন্ডিশন। যত আয় করবেন, সেই হিসেবে ব্যয় করবেন। ভবিষ্যতের কথা আগে চিন্তা করবেন। সঞ্চয় করার চেষ্টা করবেন। তাহলে বিপদের দিনে কারো উপর নির্ভর করতে হয় না।
স্বামী সম্পর্কে কথাগুলো শুনে জয়ীতার খুবই খারাপ লাগে। এসব কথা কাউকে বলতে চায় না জয়ীতা। কিন্তু এক কান দু’ কান করতে করতে সবার কানেই এসব কথা চলে আসে।

একবার এক সমিতির লোকজন লোনের টাকার জন্যে বাড়িতেই চলে এসেছিলো। দীর্ঘদিন লোনের টাকা পরিশোধ করেনি বলে বাড়িতে এসে যাচ্ছেতাই বলে চলে গেলো। সেই দিনই মানুষ জেনে গিয়েছিলো তাদের পরিবার সম্পর্কে। সেই দিন অনেক কথা উঠেছিলো জয়ীতার স্বামী কী কাজ করে? সে কেন লোনের টাকা পরিশোধ করতে পারে না? সে কেন কোনো কাজ করে না? জয়ীতার স্বামী যে অলস একথা কেউ বলতে আসে না।

একবার জয়ীতার বাবা এ বিষয়ে বলেছিলো জামাইকে। সেদিন শ^শুরকে আচ্ছামতো অপমান করে তাড়িয়ে দিলো। সেই থেকে শ^শুর আর কিছুই বলে না। ছেলের বাবাও ছেলের মতো অলস ধরনের। তাছাড়া ছেলেকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে। কেউ কিছু বললেই ছেলে পক্ষ হয়েই কথা বলে। বাবা হয়ে সবই দেখতে পাচ্ছে যে, তার ছেলে অন্যায় করছে। তারপরও বোকার মতো ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়েই যায়।

উচ্চকণ্ঠে ছেলের পক্ষ হয়ে বলে, ‘কার বাপের কী? আমার ছেলে চাকুরি করবে নাকি না করবে সেটা আমার ব্যপার। কারো নাক গলানোর অধিকার নাই।’ এসব কথা শুনে অনেকই ছি ছি করেছিলো! মুখ ফিরিয়ে নিলো জয়ীতার বাবা। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জয়ীতার বাবা সবই সহ্য করেছিলো। এ বিষয়ে কারো সাথে আলোচনা করে বুদ্ধিও চাইতে গেলো না। সেই দিন জয়ীতার বাবা বুঝতে পেরেছিলো যে, এক অপদার্থ ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে। মানুষ কিছু কিছু বিষয় যতই চাপা রাখতে চেষ্টা করুক না কেন তা একদিন প্রকাশ হবেই। যা প্রকাশ হয়েছিলো সেদিনই।

জয়ীতা একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললো ঃ এখন এর তো আর কোনো সমাধান হবে না। এভাবেই ধৈর্য নিয়ে চালিয়ে যেতে হবে।
তনুশ্রী ঃ আমরা বোন, মধ্যবিত্ত। আমাদের বুঝেশুনে চলতে হবে। অন্যের দিকে তাকিয়ে তার মতো চলার মতো ক্ষমতা আমাদের হবে না। অন্যের সাথে পাল্লা দেয়া উচিতও নয়। আমার পাশের ঘরের ভাড়াটিয়া ধনী ব্যক্তি। নিত্যনতুন শাড়ি কিনে। দামী শাড়ি পরে। সেজেগুজে ঘর থেকে বের হয়।

আমার তো আর সেই ক্ষমতা নেই। আমি যদি তার সাথে পাল্লা দিই, তাহলে তো আর আমি পারবো না। আমার ঘরের সামনে যে পরিবার থাকে তাদের ঘরে যদি হাতি দেখি, আর যদি আমি বলি, আমারও হাতি দরকার তাহলে তো চলবে না। এভাবে পাল্লা দিয়ে চলা মোটেও উচিত হবে না। আমার ক্ষমতা যতটুকু আমাকে সেভাবেই চলতে হবে। এই যেমন ধরুন, আমি বাড়িতে যাই বাসে চড়ে। আমার জন্যেও দশটাকা ভাড়া, আর যে ধনী ব্যক্তি তার জন্যেও ভাড়া দশটাকা। যদি এমন হতো, আপনি কম বেতন পাচ্ছেন আপনার জন্যে পাঁচ টাকা; আর উনি বেশি বেতন পাচ্ছেন বা আয় করছেন তার জন্যে পনের টাকা-সে রকম কোনোদিনই হবে না। হওয়ার কথাও নয়।


জয়ীতা ঃ আপনার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলো দিদি। কিন্তু আমরা ক’জনে সে রকম বুঝি দিদি! এই তো মাসখানেক আগে আমাদের ঘরে আত্মীয়েরা আসলো। আমার অলস স্বামীটা ইচ্ছা মতো তাদের জন্যে খরচ করলো। তাদের সবাইকে দামী দামী কাপড় দিলো। আমার কিছুই বলার ছিলো না। আমার স্বামীর কথা হলো, তারা আমাদের দামী দামী জিনিস দিয়েছে। সুতরাং আমাদেরও সেরকমই দিতে হবে।

তনুশ্রী ঃ এটা মোটেও ঠিক নয়। তার আত্মীয়দের অবস্থা ভালো। তাই বলে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে তোমাদেরও তাই করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এটা অবশ্য তোমাদের সেই আত্মীয়দেরও বোঝা উচিত।
জয়ীতা ঃ দিদি থাক সেসব কথা। এখন চলুন আমার জন্যে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিন। আজ সেলাই মেশিন কেনার জন্যে টাকা নিয়ে এসেছি।

বিকেলে তারা দু’জন একসাথে অফিস থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে বাজারে যায়। যাওয়ার সময় তনুশ্রী তার জীবনের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় জয়ীতাকে বলতে থাকে। দারিদ্রতা তনুশ্রীকে জীবনে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। জীবনের বাস্তবতার র্শিক্ষা দিয়েছে। বাঁচার মতো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পদ্ধতি শিখিয়েছে। দেখেছে জীবনে অনেক কিছু। শিখেছেও অনেক কিছু। না বুঝে মানুষ তাকে অনেক কথা বলেছে। তার দারিদ্রতাকে অনেক কটাক্ষ করে ব্যাঙ্গ করেছে। একদিন পুরোনো শাড়ি পড়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলো বলে কেউ কেউ আড়চোখে তাকিয়ে সমালোচনাও করেছে। কারণ, তারা সেই শিক্ষা পায়নি।

তাদের সেই জ্ঞান ছিলো না। ওদের মতো মানুষরা অন্যদের নিন্দা করে অসৎ আনন্দ খুঁজে পায়। তাদের সেই জ্ঞানশূন্য আচরণে মোটেও ভ্রƒক্ষেপ করেনি। তাই আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। প্রতিটি অর্জিত টাকা হিসাব করে খরচ করেছে। অপচয় করার মতো টাকা হাতে ছিলো না। আশপাশের কিছু মানুষদের ইচ্ছামতো খরচ করতে দেখেছে। এমনকি নিজের আত্মীয়রাও ইচ্ছামতো খরচ করেছে, চলেছে। তাদের সাথে পাল্লা দেয়নি কোনোদিন। এমনকি অনেক আত্মীয়েরা তার দারিদ্রতার কারণে তার বাড়িতেও আসতো না। খোঁজ খবরও নিতো না। এড়িয়ে চলতো। এসব ভাবলে তনুশ্রীর তখন খারাপ লাগতো, এখন আর খারাপ লাগে না। একসময় তারা দু’জন সেলাই মেশিনের দোকানে আসে এবং দরদাম করে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে।
সেলাই মেশিন কিনতে সহাযোগিতা করার জন্যে জয়ীতা কৃতজ্ঞতা জানায় তনুশ্রীকে। জয়ীতা আজ বড়ই খুশি। নিজের টাকায় সেলাই মেশিন কিনেছে। নিজের একটা সম্পদ করতে পেরেছে। প্রতিদিন তনুশ্রী সেলাই সম্পর্কে শিক্ষা দেয় জয়ীতাকে। অফিস থেকে ফিরে এসে বাড়তি টাকা আয়ের আশায় সেলাই মেলিন চালানো প্র্যাকটিস করে জয়ীতা। মধ্যবিত্ত পরিবার জয়ীতার ঘর থেকে ঠক ঠক ঠক ঠক শব্দ শোনা যায়। বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ধনী লোকের বেটিরা একে অপরের দিকে তাকায়, আর মুখ চেপে ধরে হাসে! কেউ কেউ একটু জোরে হাসে!