সুখ : ক্ষুদীরাম দাস

অঙ্কিতা সমস্ত গহনাগুলো খুলে ড্রয়ারে রেখে বাথরুমে ঢুকলো ফ্রেস হওয়ার জন্যে। বাথরুমটিও বেশ আধুনিক, কোনো কিছুর অভাব নেই। আর অভাব থাকারও কথা নয়।

স্বামী প্রচুর টাকার মালিক। তার ব্যাংকে কতো টাকা আছে, জিজ্ঞাসা করলে সাথে সাথে বলতে পারবে না। অবশ্য অঙ্কিতা কিছুটা জানে তার স্বামীর টাকা আয়ের উপায়গুলো, যা সে কোনোদিন কারো কাছে বলতে চায় না। কারণ, সেসব কথা গর্ব করে বলার মতো কিছু নয়।

অঙ্কিতার বান্ধবীরা তারপর উপর বেশ জেলাস ফিল করে। কারণ, অঙ্কিতার বিষয়ে হয়েছে কোটিপতির সাথে। তার তো কোনো কিছুর অভাব নেই। যখন যেটা চাইছে সেটা তার কাছে সাথে সাথে এসে হাজির হচ্ছে। মন যখন যেখানে ছুটে চলে সেখানেই তারা অনায়াসে যেতে পারে। এ কারণে অঙ্কিতার বান্ধবীর তার উপর বেশ হিংসে করে।

আজ অঙ্কিতার বেশ কয়েকজন বান্ধবী আসবে তার বাসায়। তাই কাজের লোক দিয়ে ঘরের সমস্ত কিছু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। বান্ধবীদের আসার কথা বলাতে অঙ্কিতার স্বামী দরজা জানালার পর্দাগুলো পরিবর্তন করেছে। যা’ না করলেও চলতো। অবশ্য অতিরিক্ত অঙ্কিতা মোটেও পছন্দ করে না। কেননা অঙ্কিতা এসেছে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। টাকা পয়সার অপচয় করা তার শিক্ষায় নেই। জীবনের বেশ কিছু মুহূর্তে দারিদ্রতা তাকে বাস্তবতা শিক্ষা দিয়েছে। যে বাস্তবতার কারণে তার স্বামীর এতো ব্যয়বহুল আচরণ তার কাছে মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু বলার নেই তার। অঙ্কিতা এটা বুঝতে শিখেছে যে, যাদের অতিরিক্ত টাকা পয়সা থাকে তাদের খরচের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা থাকে। তাদের মনমানসিকতাও আলাদা হয়েছে। তাছাড়া এতো টাকা পয়সা আয় করে খরচ তো অবশ্যই করতে হবে, আর তাই সীমাহীন খরচ ও অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো অঙ্কিতা দেখেও বলার মতো কিছু থাকে না।

সত্যিই টাকা পয়সার অভাব নেই, কিন্তু তবুও অঙ্কিতার মনে কোনো সুখ নেই। তার স্বামী পলাশ প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাবে সময় কাটায় আর মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে। এসবের কিছু দেখেও তার কিছু বলার থাকে না। এসব নিয়ে মাঝে মাঝে পলাশের সাথে কথা কাটাকাটিও হয়। কিন্তু কিছুতেই কোনো প্রতিকার করা সম্ভব হয় না। প্রতিউত্তরে তাকে শুনতে হয়, এসব কোনো বিষয় নয়। এগুলো ফ্যাশন বা বিলাসিতা। এসব না করলে তার কাছে মোটেও ভালো লাগে না। ব্যবসায়ীক কাজে সকলের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয়, সময় কাটাতে হয়। এসব না করলে তার জীবন অচল হয়ে যাবে। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা তার উপর অসন্তোষ্ট হবে। তাছাড়া প্রতিদিন নেশা করা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর অন্যান্য মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করাতো স্বাভাবিক বিয়। এসব অঙ্কিতার মোটেও ভালো লাগে না।

কিন্তু প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বান্ধবীরা মনে করে অঙ্কিতা বুঝি কতো ভালো আছে। অঙ্কিতার ভেতরটা ছিঁড়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, পুড়ে খান খান হয়ে যাচ্ছে-অথচ সে কাউকে এসব দু:খের কথা বলতে পারছে না, মুখে নির্মল হাসি সবসময়। আহা! সুখের তো নাই সীমা!

কিন্তু এই নির্মল হাসির আড়ালে যে নিরব কান্নায় ভেসে চলা অঙ্কিতা দু:খের ভেলা ভাসিয়ে চলছে তো চলছেই।

গভীর দু:খের ধ্যানমগ্ন অঙ্কিতা বিশাল বারান্দার এককোণে বসে আছে। একসময় গেইটে কলিংবেল চাপতেই দাঁড়োয়ান গেইট খুলে দিলো। এই বিশাল বাড়িতে ঢুকে যে কেউ প্রশান্তি ভরে নি:শ^াস নেয়। ইস! কী চমৎকার বাড়ি! কতো সুন্দর আর বিশাল বাড়ি! বাড়িতে ঢুকতেই অঙ্কিতার বান্ধবীরা থমকে দাঁড়ায়। একপলক ভালো করে বাড়ির চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেয় আর ভাগ্যবতী অঙ্কিতার দিকে তাকায়। অঙ্কিতার বান্ধবীদের মধ্যে নিহারীকা খুবই কাছের একজন। সে শাড়ির ভাজ ঠিক করকে করতে এগিয়ে এসে বলে, কী রে ভাগ্যবতী! চিরসুখী অঙ্কিতা, দিনগুলো তোর কেমন কাটছে রে?
অঙ্কিতা : বেশ ভালো তো দেখতে পাচ্ছিস!
নিহারীকা : অনেকদিন পর তোকে দেখে ভালো লাগছে। তোর রাজা কোথায় রে?
অঙ্কিতা : বাড়িতে নেই।
নিহারীকা : এটা কেমন হলো? আমরা তোর বাড়িতে আসলাম, আর তোর রাজাকে দেখতে পাবো না?
অঙ্কিতা : বলতো ঘন্টা খানেকের মধ্যে চলে আসবে।
নিহারীকা : খুব হিংসে হয় রে তোর সুন্দর জীবন দেখে। ইস! আমাদের যদি এমন সৌভাগ্য হতো। সবই কপাল। এমন ভাগ্য নিয়ে তো আমরা জন্মিনি রে ভাই। পৃথিবীর সব সুখ বুঝি অঙ্কিতার কপালে জুটলো।
অঙ্কিতার বুকটা ফেঁটে যায়। কিন্তু কোনোভাবেই মনের কথা কাউকে বলতে পারছে না। অঙ্কিতা মনে মনে ভাবে, তোরাই তো বেশ ভালো আছিস রে। টাকা পয়সাই কি জীবনের সবকিছু? আর তো কিছু আছে, যা আমি কোনোদিন পাবো না। টাকা পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। কেউ কিনতে পারেনি।
নিহারীকা : আজ তোকে খুব সুন্দরী লাগছে।

অঙ্কিতা : হুম! তোদের আশির্বাদে ভালো আছি। তোরা আশির্বাদে না করলে তো আমি বাঁচতে পারতাম না, সুখীও হতে পারতাম না।

নিহারীকা : আর আমরা তো কষ্টে চলছি। আমার স্বামীর বেতনের উপর সবকিছু নির্ভর করছে। সামান্য বেতনে চলতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়। খুব হিসাব করে না চললে আমরা বাঁচতে পারবো না। তোর মতো বিলাসিতা আমাদের হয় না রে। চাইলেই আমরা কিছু করতে পারি না। আমরা তো মধ্যবিত্ত গরীব, আমাদের অতো চাহিদা থাকতে নেই, আমাদের কোনো নেশা থাকতে নেই, সীমাবদ্ধ জীবনের মাঝে আমাদের বার বার ঘুরেফিরে আসতে হয়।

অঙ্কিতা : তোর কাছে কি মনে হয় আমি খুব সুখী আছি?
কথাটি শুনে নিহারীকার গলা শুকিয়ে গেলো! হা করে চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো অঙ্কিতার দিকে। ভাবছে, অঙ্কিতা এসব কী বলছে? অঙ্কিতার কোথায় সমস্যা? কোথায় তার কীসের এতো অভাব? ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো : কী বললি রে তুই এসব? আমি তো তোর কোনো কথার অর্থ বুঝতে পারছি না!

অঙ্কিতার মুখ কালো হয়ে গেলো। অঙ্কিতা বললো : তোরা আমাকে যতটা সুখী ভাবছি, আমি কি ততোটা সুখী নই রে! বাইরে থেকে তোরা আমাকে দেখছিস, আমি হাসছি, হাসি মুখে কথা বলছি, দামী শাড়ি পড়ছি, সোনার গহনা পড়ছি, বিলাসবহুল বাড়িতে বাস করছি, গাড়ি আছে, বাড়িতে কাজের লোক আছে, আরো কতো কি তোরা ভাবছিস! তোরা তো এসব বাইরে থেকে দেখছিস! তাই তোদের কাছে সবই সুন্দর লাগছে। মনে করছিস, আমি কতো সুখে আছি। সুখের সাগরে ভেসে চলছি আমি। আমার কোনো অভাব নেই, আমার সুখের অভাব নেই-এসব ভাবছিস তোরা। সত্যিকারে আমি এক জীবন্ত লাশ যেন!
নিহারীকা : মানে আমরা না জেনে তোকে কষ্ট দিচ্ছি!

অঙ্কিতা : সত্যিই তোরাই সুখে আছিস। হয়তো তোদের টাকা পয়সা নেই, কম আছে, হিসাব করেই চলছিস। তবুও সেখানে প্রকৃত আনন্দ আছে, সুখ আছে। টাকা পয়সাই সব সুখ আনতে পারে না। পলাশ সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তাদের কাজে কাজে দূরে দূরে থাকতে হয়। সে শুধু টাকার পিছনে ছুটছে। তার আরো টাকার দরকার। আরো টাকা চাই তার। প্রতিদিন নেশা করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে।

অঙ্কিতা আর কিছু বলতে পারে না। একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে, তারপর দু’হাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। নিহারীকা স্তব্ধ হয়ে যায়। অঙ্কিতাকে সান্ত¡না দেবার মতো ভাষা তার নেই।

অঙ্কিতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, আর বলে : আমি সুখে নেই রে! সুখ আমার কপালে নেই! তোরা যতটা সুখী ভাবছিস, তার কিছুই আমার কাছে নেই।

নিহারীকা : আমি দু:খি! বাইরে থেকে তোকে অনেক সুখী দেখছি তো। আর আমার জীবনের সবকিছু মিল করে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাবছি, তুই কতো সুখী! তোর সুখের কোনো অভাব নেই!

কিছুসময় পর বাড়ির কাজের লোক টেবিলে নাস্তা দিয়ে যায়। অঙ্কিতা সোফা থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকে চোখে পানি দিতে গেলো। অঙ্কিতার বান্ধবীরা বেশ কিছু সময় ধরে একেঅপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাদের মনে অনেক প্রশ্ন, যা’ তারা পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করতে পারছিলো না। তবে চোখের ভাষায় মনের দু:খ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে দামী দামী নাস্তা। যেগুলোর দিকে তারা সকলেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের ইচ্ছে করছে না এগুলো মুখে তুলতে। কারণ, এসব দামী খাবারে তারা অভ্যস্ত নয় মোটেও। প্রতিদিন এগুলো তারা চোখেও দেখে না। কেননা মধ্যবিত্ত গরীব পরিবারগুলো এসব খাবার থেকে অনেক দূরে থাকে। এগুলো স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। নিহারীকা ভাবছে, তার স্বামী যে পরিমাণ আয় করে সেই আয়ের টাকায় কোনোদিন এতো দামী খাবার কল্পনাও করা যায় না।

অঙ্কিতা বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে। অঙ্কিতা বললো : নাস্তা খাচ্ছিস না যে তোরা!

নিহারীকা একটা বিস্কুট হাতে তুলে নেয়। তারপর অন্যরাও একে একে নিতে থাকে। অঙ্কিতা সোফায় বসতে বসতে বললো : এটাই আমার জীবন। এভাবেই আমাকে জীবনের বাকিটা দিন পার করতে হবে। পলাশের মা বাবাও এখানে থাকে না। তারাও তার এ ধরনের আচরণ পছন্দ করে না। তারা অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করেছে। কিন্তু তার টাকার লোভ তাদের মোটেও ভালো লাগে না। তাই তারা দূরে দূরে থাকে। তাদের মনেও সুখ নেই।

অঙ্কিতা তার বান্ধবীদের নিয়ে নাস্তা করছে, এমন সময় পলাশ অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো। অঙ্কিতার বান্ধবীদের দেখে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানালো। তারপর নিজের রুমে ঢুকে গেলো। অসময়ে বাড়ি ফিরে আসায় অঙ্কিতা আশ্চর্য হয়ে গেলো। এভাবে সে কোনোদিন বাড়ি ফিরেনি। অন্তত রাত বারটার আগে কোনোদিন বাড়ি ফিরেছে বলে তার মনে পড়ছে না। অঙ্কিতা মনে মনে এসব চিন্তা করছে। কিন্তু অঙ্কিতার বান্ধবীরা নাস্তা করছে, আর বিভিন্ন বিষয়ে গল্পে গল্পে মেতে উঠেছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে আর কিছুক্ষণ পর। সূর্যটা ডুবে গিয়ে আলো বিতরণ বন্ধ করেছে। চারিদিক একটু একটু করে অন্ধকার হচ্ছে। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে দিনের আলো নিভে গিয়ে রাতের আঁধারের সূচনা হচ্ছে।

অঙ্কিতা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, বাইরে খট খট শব্দ হচ্ছে। জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দেখলো, বাইরে অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে। অঙ্কিতার গলা শুকিয়ে গেলো। তার হাত পা যেন অবশ হয়ে গেলো। বাইরে এতো পুলিশ কেনো? এতো মানুষ কেনো বাইরে? ওরা চারিদিক ঘিরে রেখেছে কেনো? তাহলে কি পলাশকে ওরা ধরে নিয়ে যেতে এসেছে?

ঘরের দরজায় টোকা দিতেই অঙ্কিতা সোফা থেকে উঠে দরজাটা খুলে দিলো। এদিকে পলাশও এসে অঙ্কিতার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো। পলাশকে ইশারা দিয়ে ডাকলো পুলিশ। তারপর ওরা পলাশকে ধরে নিয়ে গাড়িতো উঠালো।

অঙ্কিতা তাকিয়ে রইলো পলাশের দিকে। এভাবে অনেক সময় তাকালো। পুলিশের গাড়ি বাড়ির গেইট পার হয়ে চলে গেলো। অঙ্কিতার মুখে কোনো ভাষা নেই। নীরব নিথর দাঁড়িয়ে রইলো। অঙ্কিতার বান্ধবীরাও সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অঙ্কিতার পাশে এসে দাঁড়ালো।