বিয়ের আগে বোঝাপড়া

ক্ষুদীরাম দাস :

রুদ্র নতুন চাকুরিতে যোগ দিয়েছে মাত্র দেড় মাস হলো। মাত্র ডিগ্রি পাস করেছে। তার ইচ্ছে ছিলো আরো বেশি পড়াশোনা করবে।

কিন্তু দারিদ্রতার কারণে সেটা হয়ে উঠলো না। বাধ্য হয়ে পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্যে চাকুরিতে যোগ দিতে হয়েছে। যদিও তার পড়াশোনা আর হয়নি, মনে দুঃখ থাকলেও পরিবারকে সাহায্য করতে পারছে সেটাই তার জন্যে বড় আনন্দের।

রুদ্রর বয়স এখন বাইশ বছর। তার বয়স যখন বার বছর তখন তার বাবা মারা যায়। সেই থেকে জীবন নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। সেসব কথা মনে পরলে রুদ্রর খুব কষ্ট লাগে। মায়ের প্রতি আলাদা সম্মান ও ভালোবাসা জেগে উঠে।

রুদ্র অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেক আলাদা। বলা চলে একশ জনের মধ্যে সে পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে। সুতরাং রুদ্রর সুনাম রয়েছে। তার দিকে দৃষ্টি সকলের।

রুদ্র বড় হয়েছে। সংসারের হাল ধরা দরকার। তার মা চায় যেন বিয়ে করে সংসারী হয়। কিন্তু রুদ্রর চিন্তা অন্য রকম। সে চাকুরির পাশাপাশি আরেকটু পড়াশোনা করবে। তবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্রতা। দারিদ্রতার কাছে যুক্তি হেরে যায়; অতএব পড়াশোনার ইতি টানতে হয় মন থেকে।

রুদ্রকে বিয়ে করানোর চিন্তা মাথায় চেপেছে তার মায়ের। তার জন্যে মেয়ে দেখা শুরু হয়ে গেছে। আগামীকাল সকালে রুদ্র তার মাকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যাবে। বয়স্ক বেশ কয়েকজনকে জানানো হয়েছে এবং তারাও তাদের সাথে যাবেন মেয়ের বাড়িতে।

যথাসময়ে সকলে মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত। মেয়ে দেখার সামাজিকতা শেষে রুদ্র ইচ্ছা প্রকাশ করলো যেন মেয়ের সাথে আলাদা কথা বলতে পারে। মেয়ে পক্ষ এতে সম্মতি জানায়।

ওরা দু’জন পরস্পর কথা বলার জন্যে আলাদা একটি জায়গায় উপস্থিত হয়।
রুদ্র : তোমার নাম আনিতা। নামটা আমার খুব ভালো লাগলো।

আনিতা : ধন্যবাদ।
রুদ্র : তোমার কোনো শর্ত আছে কিনা?
আনিতা : কী ধরনের শর্ত?
রুদ্র : বিয়ের পরে তুমি কী করতে চাও? এ ধরনের। অর্থাৎ জানতে পারলাম তুমি ইন্টার পাস করেছো।
আনিতা : আরো পড়াশোনা করে চাকুরি করতে চাই।

রুদ্র : আসলে চাকুরির জন্যে মানুষ পড়াশোনা করে না। পড়াশোনা করে নিজের শিক্ষার জন্যে। অতএব, পড়াশোনা করলেই যে চাকুরি করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
আনিতা : চাকুরি আর সংসার দু’টোই একসাথে করতে চাই।

রুদ্র : চাকুরি করলে টাকা উপার্জন হয় ঠিকই; কিন্তু সংসার হয় না। কারণ, তখন চসংসারে সময় দেয়া যায় না। বাড়িতে আমার মা আছে, তাকে তোমার দেখাশোনা করতে হবে। তার সেবা যতœ করতে হবে।
আনিতা : চাকুরি নয় কেন? তাহলে পড়াশোনা করে কী লাভ হলো?

রুদ্র : অবশ্যই লাভ হয়েছে। তোমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে গেছে। ভালো মন্দ তুমি বুঝতে শিখেছো। একটা সুন্দর জীবন তুমি উপভোগ করতে পারো। এজন্যে তোমাকে চাকুরি করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
আনিতা : কিছু না করলে তো হবে না!
রুদ্র : সেটা তুমি বাড়িতেও করতে পারো। তবে চাকুরি করাটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আর তাছাড়া আমি এর বিপক্ষেও বলছি না যে একেবারে চাকুরি করা উচিত নয়।

আনিতা : তাহলে আপনি এভাবে বলছেন কেনো?
রুদ্র : আমি বলছি, সংসার নিয়ে। চাকুরি করলে আমাদের টাকা হবে, কিন্তু সংসার নাও হতে পারে।
আনিতা : অনেকেই তো করছে।

রুদ্র : বেশ ভালো। তাদের জীবন গেঁটে দেখো, তাদের সমস্যার শেষ নেই। পরিবারে অশান্তি চলছে। কোনো পরিবারে পরকীয়ার ঘটনা ঘটছে। কোনো পরিবারে ডিভোর্সের মতো ঘটনাও ঘটছে। অর্থাৎ সুখী নেই ওরা। আবার কোনো কোনো পরিবারে অশান্তি থাকলেও যেহেতু তারা শিক্ষিত, তাদের অশান্তির কথা বাইরে প্রকাশ পায় না। সুখ নামক শব্দটা তাদের নেই। দু’একটা পরিবার হয়তো ভালো আছে, তবে সেটা নিতান্তই নগণ্য।

আনিতা : কেনো জানি তোমার কথায় অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছি।
রুদ্র : মানে সেটা কী রকম!
আনিতা : আমি বুঝতে পারছি না। তোমাকে কীভাবে বোঝাবো। যদি আমরা কাজের লোক নিই।
রুদ্র : সেটা সম্ভব নয়। এখন কাজের লোক পাওয়া যায় না।
আনিতা : কেনো?

রুদ্র : কারণ কাজের লোক রাখা ঠিক নয়। অনেক রকমের ঘটনা ঘটে। যা’ তুমি নিশ্চয় জানো। তাছাড়া কাজের লোক বর্তমানে পাওয়াও যায় না। আমার অনেক বন্ধুর স্ত্রীরা চাকুরি শুরু করেছিলো। কিন্তু সংসার সামলাতে গিয়ে তারা চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে। কারো কারো কাজের লোক চলে গেছে বা কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তারাও চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ একটা সন্তান হওয়ার পরে চাকুরি আর করতে পারেনি। মোটের উপর এসব নিয়ে সংসারে অশান্তি লেগেই ছিলো।
আনিতা : হুম! তোমার কথায় যুক্তি আছে!

রুদ্র : তোমার ইচ্ছাকে সম্মান জানাই। তুমি ইচ্ছা কিছু করতে পারো।
আনিতা : যেমন।

রুদ্র : আমরা গরীব হতে পারি। অবশ্যই আমাদের টাকার দরকার আছে। তবে টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে সবকিছু নষ্ট করতে পারি না। আমার বন্ধুরা অনেক কথা বলে।
আনিতা : বন্ধুরা কী বলে তোমাকে?
রুদ্র : বলা যাবে না।

আনিতা : হাসি পাচ্ছে আমার।
রুদ্র : কেনো?
আনিতা : তোমার কথা শুনে!

রুদ্র : এগুলো বাস্তব কথা। হাসি পাওয়াটা বোকামি অথবা নির্বুদ্ধিতার বিষয়।
আনিতা : সে রকম হাসি নয়। তোমার বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে।
রুদ্র : হতে পারে।
আনিতা : হুম!
রুদ্র : তোমার কথা বলতে পারো।

আনিতা : আগে তোমার বন্ধুদের কথা বলতে পারো। তারা কী বলে?

রুদ্র : ওরা বলে, সংসার ছেড়ে একবার যদি কোনো ঘরের বউ চাকুরি করে, আর টাকার গন্ধ পায়; তারা আর সংসার করতে পারে না। সংসার কী সেটা তারা জানে না। তাদের চিন্তা অন্য রকম হয়ে যায়। সংসার ধর্ম তারা বুঝে না। পুরুষদের মতো তাদের আচরণ হয়ে যায়।
আনিতা : এসব কথা কি সত্য নাকি?

রুদ্র : হয়তো সত্য। বাস্তবে না ঘটলে এসব কথা বলে কেনো?
আনিতা : তোমরা ছেলেরা এতো ভাব কেনো?
রুদ্র : এখন ভাবার সময় এসে গেছে। মেয়েরা এখন অন্যরকম হয়ে গেছে তো তাই। ওরা ছেলেদের মতো হতে চায়। তাই যার তার সাথে সংসার করা যায় না। এজন্যে অনেক ভেবেচিন্তে বিয়ে করতে হয়।
আনিতা : তোমার যতো অদ্ভুত চিন্তা!

রুদ্র : কোনো অদ্ভুত চিন্তা নয়। এগুলো সবই বাস্তব কথা।
আনিতা : মেয়েরা যদি এগিয়ে যেতে চায় তাহলে তোমাদের এতো বাধা কেনো?
রুদ্র : তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে।
আনিতা : আমি ভুল বুঝছি না হয়তো।

রুদ্র : তুমি তোমার বান্ধবীদের কথা চিন্তা কর। তাদের সবার জীবন কেমন চলছে। তারা কীভাবে বেঁচে আছে।
আনিতা : কারো কারো ডিভোর্স হয়ে গেছে?
রুদ্র : কেনো?
আনিতা : অন্যের পার্সোনাল বিষয় নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করি না কখনো।

রুদ্র : এটা ভালো গুণ। তবে নিজের জন্যে প্রকাশিত বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষা নিতে হয়। ভাবতেও হয়, বুঝতেও হয়।
আনিতা : হুম! তোমার কথা ঠিক বটে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

রুদ্র : কিছু মেয়েদের খামখেয়ালীপনার জন্যে তারা সংসারে টিকে থাকতে পারে না। আমি কিন্তু আমার মাকে নিয়ে থাকবো। তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক বা নাক হোক সেটার জন্যে আমি চিন্তা করি না।

আনিতা : এসব কথা বলছো কেনো? কেউ কি পরিবারের মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারে?
রুদ্র : অনেক মেয়েই তো আছে। যারা বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে বলে আমি যৌথ পরিবারে থাকতে পারবো না। আমরা আলাদা থাকবো।

আনিতা : এটা তাদের ব্যাপার!
রুদ্র : আর তোমার ব্যাপারটা কী?
আনিতা : আমি সেরকম মোটেও আশা করি না।
রুদ্র : তাই আমি তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমার মা আছে, তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, থাকা উচিতও নয়।
আনিতা হাসিমুখে বললো : যদি আমি সেরকম চাই!

রুদ্র : তাহলে তোমার জন্যে পরামর্শ হলো, এতিম কোনো ছেলেকে তুমি বিয়ে কর। সেটা তোমার জন্যে সবচেয়ে ভালো।
আনিতা : এটা কী তোমার উচিত কথা?
রুদ্র: অবশ্যই পরামর্শ, তাদের জন্যে যারা বিয়ের পর শ^শুড় শাশুড়িকে দূরে রেখে আলাদা থাকার কথা চিন্তা করে।
আনিতা : কথায় যুক্তি আছে বটে। ফেলে দিতে পারি না।

রুদ্র : আহা রে! আমরা দু’জনে কেমন নির্লজ্জের মতো অনেকগুলো কথা বলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, এর আগে আমাদের অনেক কথা হয়েছে, অনেক চেনাজানা আমরা! দূর থেকে মানুষ কী ভাবছে?

আনিতা : সেটা বড় কথা নয়। তোমার যত কথা ছিলো সব তুমি বলেছো। এটা ভালো। তবে তোমাকে বলতে হবে, আমার শিক্ষাটা আমি কীভাবে কাজে লাগাতে পারি?

রুদ্র : খুব সুন্দর প্রশ্ন! সংসার জীবনে কাজে লাগাতে পারো। সংসারকে আরো সুন্দর করতে পারো। ঘরোয়া অনেক কাজ আছে, যা তুমি করতে পারলে তুমি মনে প্রশান্তি অনুভব করতে পারবে। একটা কাজ করতে পারলেই তো হলো। সব মেয়েই যদি সংসার ত্যাগ করে চাকুরি করতে চায়, তাহলে সংসার সামলাবে কে?

আনিতা : হুম! এটা ভালো কথা বলেছো? আমার ভালো লাগলো তোমার কথাগুলো শুনে।
রুদ্র : তাহলে তোমার মতামত কী?

আনিতা : সমস্যা নেই। তবে আমার মা বাবার সাথে আরো কথা বলতে হবে।
রুদ্র : খুব ভালো। আর আমিও আমার মায়ের সাথে সববিষয় কথা বলি। আমার মা কী বলে এসব বিষয়ে। তবে আমি আমার মনের কথা তোমাকে বলে দিয়েছি। এখন হিসাব নিকাশ তোমার উপর।
আনিতা : ঠিক আছে।
কথা বলা শেষ করে ওরা দু’জন চলে আসে সকলের কাছে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তখন রুদ্র তার মায়ের কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে। রুদ্রর মা বললো : এতো কিছু বলার পর তো মেয়ে হয়তো কোনোভাবেই রাজি হবে না। তুমি এতো কথা বলতে গেলে কেনো?

রুদ্র : এভাবে কথা বলতে হয় মা। না বললে শেষে সমস্যা তৈরি হয়। যা রোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের আগে শুরুতেই বোঝাপড়াটা শেষ করতে হয়। তা না হলে কষ্ট বেড়ে যায়।
রুদ্রর মা : বাবারে আমাদের সময় এরকম ছিলো না।
রুদ্র : সেটা ঠিক তোমাদের সময় এ রকম থাকার কথাও নয়। তখন পরিস্থিতি একরকম ছিলো; এখন অন্য রকম পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। সবকিছু খোলামেলা কথা বলে নিতে হয়। তা না হলে সমস্যা তৈরি হয়। এখন আমাদের এসব ভাবতে হবে।
রুদ্রর মা : যদি মেয়েটা বিয়েতে রাজি না হয়।

রুদ্র : কোনো সমস্যা নেই। আমি তো বাস্তবতার বাইরে কিছু বলিনি। আগে বাস্তবতা, পরে যুক্তি নির্ভর কাজ। বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতেই হবে। আমি তো চাইলেই তাকে চাকুরিতে দিয়ে বাড়িতে কাজ করার জন্যে কাজের লোক রাখতে পারি না। সেটা হয়ে যাবে জমিদারী। তাছাড়া এখন আর কাজের লোক পাওয়াও যায় না। আর এদিকে তোমার কষ্ট হবে। ঘরের বউ তোমাকে সেবাযতœ করতে পারবে না। বর্তমানে কিছু কিছু পরিবারে অসুন্দরকে মানতে মানতে সেটাকেই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। অসুন্দর আর মানুষের চোখে পড়ে না।

একদিন রুদ্র আর তার মা বাড়িতে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। এমন সময় রুদ্রর মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। অপরচিত নাম্বার দেখে ভ্রæ কুচকালো। রিসিভ করে হ্যালো বলার সাথে সাথে বুঝতে আনিতা ফোন করেছে। রুদ্র তার মায়ের দিকে তাকালো।