কথিকা : বিচিত্র জীবন!

ক্ষুদীরাম দাস :
সত্যিই আমাদের জীবন বড় বিচিত্র। এই বিবিত্র তখনই বোঝা যায় যখন জীবন নিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। তবে সেই উপলব্ধি থেকে আমরা বেশ দূরে থাকি বলে জীবনের বিচিত্র মুহূর্তগুলোকে মোটেও বুঝতে পারি না। অজানাই থেকে যায় চিরকালের জন্যে বিচিত্র জীবনের অনেক কিছু। হয়তো স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যায়; অথবা কোনো না কোনো সময় তা আবার জেগে উঠে যে কোনোভাবেই হোক!

এই দেখুন না, কারো জীবন থেকে হয়তো বাইশটি বছর পার হয়ে গেলো-স্মৃতিতে ভাসে ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা এখন হয়তো কোনো রিক্সাওয়ালার বউ। এটা কি ভ্র কুচকানো কোনো বিষয়? অবশ্যই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন সেই রিক্সাওয়ালার রিক্সায় চরে স্কুলে আসতো ছেলেটির সাথে। এভাবে আসা-যাওয়া করতে করতে কথা বলতে বলতে একসময় ওদের প্রেম হয়ে যায়। ভালোবাসার আবেগে ভেসে চলে। আর একসময় পালিয়ে বিয়ে করে।

এখন হয়তো সেই মেয়েটি বুঝতে পারে, জীবনে সে কতো বড় ভুলটাই না করেছে। অথবা ক্লাসের সেই সুন্দরী মেয়েটি এখন তিন সন্তানের জননী। এখন তার আর সেই রূপ যৌবন নেই। এখন আর কারো নজর কাড়ে না। কেউ তার দিকে তাকায়ও না। কিম্বা ক্লাসের যে ছেলেটাকে সবাই অবজ্ঞা করতো অঙ্ক না পারার কারণে, সবাই তাকে অবহেলায় টিটকারী দিতো; সে হয়তো এখন একজন বড় ব্যবসায়ী। হু হু করে অল্প কয়েকদিনেই প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে। অথবা ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটি বেকার হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার পরীক্ষায় নকল করে পাস করা ছেলেটা অনেক টাকার বেতনের চাকুরি করছে। অপরদিকে হতে পারে ক্লাসের বেস্ট বয় ছেলেটা মেধাবী স্টুডেন্ট প্রচুর পড়াশোনা করে পাস করা ছেলেটা এখনো বেকারই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার দেখুন কেউ কেউ স্টুডেন্ট লাইফে বন্ধুত্বের দুর্বলতার সুযোগে ঠকিয়ে চলে গেছে। অথবা জিদের বশবর্তী হয়ে অন্যের প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করে দিব্যি সংসার পেতেছে।

এটাই তো জীবন। হয়তো দেখা যায়, চির শত্রু দুই বন্ধু এখন একই সাথে ব্যবসা খুলে বসেছে। আবার ক্লাসের সবচেয়ে অহঙ্কার করা ছেলেটা এখনো চাকুরিই পায়নি। বাপের হোটেলে বসে বসে খাচ্ছে আর কথা শুনেই যাচ্ছে। অথবা বেহিসেবীভাবে খরচ করতে করতে এখন ফকির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হতে পারে লোনের বোঝা মাথায় নিয়ে রাতে ঘুমাতেই পারছে না। আবার দেখুন, যে ছেলেটা ক্লাসের ঠিক শেষ বেঞ্চে বসে থাকতো, আর খারাপ রেজাল্ট করতো, সেই ছেলেটা হয়তো মেডিকেলে পড়াশোনা করে এখন দেশের খ্যাতিমান একজন ডাক্তার। চারিদিকে সুনাম এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিম্বা যে ছেলেটা ক্লাসের সবাইকে অঙ্ক বোঝাতো সে হয়তো ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে।

কিম্বা যে মেয়েটা এতো সুন্দরী যে, তার পিছনে ঘুর ঘুর করতো প্রচুর ছেলে, হয়তো কাউকে পাত্তাই দিতো না। সে এখন অনিচ্ছা সত্তে¡ও অপছন্দের কোনো কালো বোকা গাধা ছেলের সাথে সংসার করে যাচ্ছে। কিম্বা সুন্দরী মেয়েটা ভুল করে কোটিপতির ছেলের হাত ধরে সুখের আশায় গিয়ে ডিভোর্স হয়ে এখন ঘরে বসে বসে কাঁদছে। এই তো বিচিত্র জীবন কারো কারো।

আর হ্যাঁ, সাত বছর আগেও ভালো বন্ধুত্ব গড়া দু’জন এখন ফেসবুকে পরস্পরের ব্লকলিস্টে। কেউ কাউকে খুঁজেই পাচ্ছে না, অথবা খোঁজার প্রয়োজনও মনে করছে না। হায় হায়, নিয়তির অলিখিত নিয়মে দশ বছর ধরে বার বার ধনীলোকের মেয়ের প্রেমিক পরিবর্তন করা ফর্সা সুন্দরী মেয়েটা বর্তমানে পাত্র পক্ষের কাছে বার বার রিজেক্ট! আর ধনী লোক বাবা কপাল চাপড়েও টাকা পয়সায় মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারছে না। এটাও কি অবস্তব নাকি যে, ত্রিশ বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করা জুটিটা যখন শুনতে পায় তাদের নিজেদের ছেলেমেয়ে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছে তখন তারাও বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আরে ভাই, সময় বড়ই নিষ্ঠুর, পাঁচ বছর আগে আড্ডা জমানো ছেলেটাকে বন্ধুত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া মানুষটা এখন নিজেই বন্ধুহীনতায় নিঃসঙ্গ ভুগছে দিনের পর দিন।

জীবনে হয়তো এটাও হয়ে যায় যে, ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ক্লাসমেট সাত আট বছর আগে ভালো চাকুরী করতো; কিন্তু হঠাৎ দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এসব দুর্ঘটনার কথা শুনে দীর্ঘশ^াস ছাড়তে হয়। অথবা এলাকার ধনী লোকটি অহঙ্কারে গলা উঁচিয়ে কথা বলতো যে অমানুষটা সে হয়তো লজ্জায় এখন মুখই দেখাতে পারছে না; কারণ, তার বউ চলে গেছে অন্যএকজন ধনী লোকের হাত ধরে।

আমরা এধরনের ঘটনা দেখে থাকি সিনেমায়, দেখি বাস্তবেও, ভবিষ্যতেও মানুষের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে না-এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কেউ দিতে পারে না। এজন্যে বলা যায় যে, মানুষের জীবনে কখন কী ঘটে যায় কেউ তা বলতে পারে না। কেউ হয়তো হঠাৎ করে টাকার মালিক হয়ে গেলো, আর এজন্যে হয়তো সাময়িক কিছুকালের জন্যে অহঙ্কারে টগবগিয়ে চলছে; কিন্তু সেটা যে চিরকাল বা তার ইচ্ছা আর কাজ অনুযায়ী চিরকাল চলবে এমনটা আশা করা একেবারেই ভুল হবে। সত্যিই, সময় কিন্তু সবার জীবনেই আসে। কারো কারো এক বছরে আসে; আবার কারো কারো বিশ বছর পরে হলেও আসে। আজ হয়তো কারো দুর্বলতায় তার উপর কটাক্ষ করলেন, এজন্যে আপনর মনে কোনো মায়ামমতার উদয় হলোই না; কিন্তু কয়েকদিন পরে যে অন্যে আপনার উপর করবে না তার কোনো গেরান্টি দেয়া যায় না। সত্যিই বলছি, কারো উপর অহঙ্কার করলে অন্তরে বিশ^াস রাখুন এমনই একদিন আপনার জীবনেও আসবে একই রকমের সিচুয়েশন আপনার জীবনেও আসবেই আসবে।

আপনার উপর কেউ জুলুম করেছে; দুঃখ লাগতেই পারে আপনার। হয়তো আপনাকে অবহেলা করেছে, কষ্ট পেতেই পারেন। হয়তো আপনাকে ছেড়ে আপনার আপনজন চলে গেছে আপনি আপনি হতাশ হয়ে আছেন। অপেক্ষা করুন সময় একদিন ঠিকই প্রতিশোধ নেবে। এটাই জীবন, বিচিত্র জীবন!

জীবনের আয়ু তো বেশি দিন নয়! এটা সবাই স্বীকার করবেন। সুতরাং অল্প ক’দিনের টাকা পয়সা রূপ গুণের শেষ ঠিকানা হয়ে যায় উপরওয়ারার ঈশারায়। সুতরাং এতো অহঙ্কার কেনো? কোথা থেকে আসে এতো অহঙ্কার-কেউ কি চিন্তা করবেন, অথবা চিন্তা করে পাশে থাকা বন্ধুকে, পরিবার ও আত্মীয়কে বুঝিয়ে পরিবর্তনের জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন।