ই-অরেঞ্জে ১০ কোটি টাকা আত্মসাত, বিনিয়োগকারী সখীপুরের দুই শতাধিক যুবক হতাশ

মেহেদী হাসান রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট :

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ইছাদিঘী। ওই গ্রামের বাজারে চায়ের দোকান করেন আজাহার আলী। চায়ের আড্ডায় অনেকেই বলাবলি করেন, ই-অরেঞ্জ নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে দ্বিগুণ মুনাফা পাওয়া যায়। তাঁর চায়ের দোকানে একটি টেলিভিশনও রয়েছে।

ওই টিভিতে ক্রিকেটার মাশরাফির ওই ই-অরেঞ্জের প্রতি তাঁর আস্থা রয়েছে- এমন একটি বিজ্ঞাপন দেখেও আকৃষ্ট হন আজাহার। গ্রামের অনেক যুবক লাভবানও হয়েছেন। যুবকদের দ্বিগুণ লাভ পাওয়ার হাসি দেখে আজাহার তাঁর দুটি গরু বিক্রি করে এক লাখ ২০ হাজার টাকার পণ্য কেনার অর্ডার দেন। এখনও তিনি ওই পণ্য হাতে পাওয়া তো দূরের কথা আসল মূলধন পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন আজাহার। সারাদিন চা বিক্রি করলেও মনটা তাঁর ভালো না।

একই গ্রামের জাহানারা বেগমের স্বামী গত পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। কলা বাগানে শ্রমিকের কাজ করে তাঁর চার সদস্যের সংসার চলে। দ্বিগুণ লাভের আশায় সেও তাঁর জীবনের অর্জিত সঞ্চয় করা ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এভাবে ওই এক গ্রামেই দুই শতাধিক গ্রাহক ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করে প্রায় ১০ কোটি টাকা প্রতারিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সরেজমিন ওই গ্রামে গিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়া চায়ের দোকানি আজাহারের সঙ্গে কথা হয়। এরপর একে একে ওই চায়ের দোকানে প্রতারণার শিকার হওয়া ১৫ থেকে ২০ জন যুবক, কৃষক ও ব্যবসায়ী জড়ো হয়। তাঁরা তাঁদের প্রতারিত হওয়ার নানা গল্প বলতে থাকে। ওই সময় শুধু চায়ের স্টলে বসে ৩০ জনের তালিকায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রতারণার হিসাব পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে ইছাদিঘী গ্রামের বাসিন্দা ও গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কালাম আজাদ তোতা বলেন, আমাদের গ্রামের বেসরকারি হিসেবে দুই শতাধিক মানুষ আনুমানিক কমপক্ষে ১৫-২০ কোটি টাকা ওই প্রতিষ্ঠানে জমা দিয়েছেন।

কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, আমি জমি বন্ধক রেখে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় দুটি ডিসকভার মোটরসাইকেল পাওয়ার আশায় জমা দেই। চার মাস হলো মোটরসাইকেল কিংবা টাকা কোনটাই পাইনি।নাসিদুল ইসলাম একজন প্রকৌশলী। সরকারি চাকরির আশায় ঘুরছেন। তিনি গত এপ্রিলে পালসার মোটরসাইকেল কেনার জন্য ৯০ হাজার টাকা জমা দিলে জুন মাসে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের একটি মোটরসাইকেল পান তিনি। এরপর আরও কয়েকটি পণ্যের অর্ডার দিলেও মে মাস পর্যন্ত বেশ কয়েকটি পণ্য ঠিকমতো ডেলিভারী নিয়েছিলেন তিনি। এসময় তাঁর ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা আয় হয়। এক মাসের মধ্যে এমন লাভ তুলে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-কর্জ নিয়ে ২০ লাখ টাকার পণ্যের অর্ডার (ভাউচার) কেটেছিলেন তিনি। এরপর আর টাকা তুলতে পারেননি।

নাসিদুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, আমারসহ গ্রামের আরও ২০-২৫ জনের লাভ পাওয়ার কথা শুনে এ গ্রামের নারী-পুরুষরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেদার তাঁরা টাকা জমা দেয়। শুনেছি মালিকের নামে মামলা হয়েছে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী কারাগারে আছেন। এ অবস্থায় আমাদের গ্রামের প্রতারিতদের নিয়ে আমরা আইনের আশ্রয় নেব।

ওই গ্রামের যুবক সাজেদুল, রাইসুল, কায়সার বলেন, ‘আমাদের কাছে ক্রিকেটার মাশরাফী আদর্শ। আমরা তাঁকে ভীষণ ভালোবাসি। শুনেছি তিনি ই-অরেঞ্জের সঙ্গে রয়েছেন। বিজ্ঞাপনে তাঁকে দেখে আমরা টাকা জমা দিতে আরও উৎসাহী হয়ে উঠেছি। আমরা এমনভাবে প্রতারণার শিকার হবো তা কখনো ভাবিনি।

গজারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মিঞা আমার সংবাদকে বলেন, আমিও মেম্বারদের মাধ্যমে শুনেছি ওই ইছাদিঘী গ্রামের দুই শতাধিক লোক আনুমানিক ই-অরেঞ্জে ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ‘ধরা’ খেয়েছেন। তাঁদের অনেককেই আমি এ ধরনের ডাবল লাভের প্রতিষ্ঠানে টাকা না রাখার জন্য অনুরোধও করেছিলাম। তাঁরা তখন শুনেননি। এখন বুঝুক ঠেলা। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে সাইদুল হক ভুঁইয়া আমার সংবাদকে বলেন, পত্রিকায় ই-অরেঞ্জ, ই-ভ্যালির নাম শুনেছি। সখীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল ইছাদিঘী গ্রামে এত লোক প্রতারিত হয়েছে তা এখন আপনার কাছে শুনলাম। প্রতারিত হওয়া এমন কেউ এখনও থানায় লিখিত অভিযোগ দেননি।

উল্লেখ্য, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই–অরেঞ্জের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে-এমন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তাহেরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক গত মঙ্গলবার গুলশান থানায় মামলা করেছেন।

মামলায় ই–অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান, মালিক বীথি আকতার, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমানউল্লাহ চৌধুরী, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা কাওসার আহমেদসহ প্রতিষ্ঠানটির সব মালিককে আসামি করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবারই আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে যান সোনিয়া মেহজাবিন ও মাসুকুর রহমান। কিন্তু আদালত তাঁদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।