মঞ্চস্থ্য দৃশ্যহীনতা

যুবক অনার্য :

সাঁইজির আখড়া থেকে ফেরার পথে সেদিন আমার পাশে বিনি খুব ক্লান্ত আর ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ।গোপন দীর্ঘশ্বাস লুকোনোর মতো বাসনা নিয়ে আমি চাইছিলুম – সে তার মুখের পার্শ্বদেশ আমার অপেক্ষমাণ কাঁধে এলিয়ে দিক।চাইলেই কি সবকিছু হয়! যা চাই কখনো হয়ে ওঠে না,হয় নি সেদিনও। বিনি কিছু না বোলেই একদম পেছনে গিয়ে রিলেক্স ভঙিমায় মাইক্রোর সিটে নিজেকে এলিয়ে দিলো আর ঘুমিয়ে পড়লো কিছুক্ষণের মধ্যেই। মাইক্রোর অই জড় সিটটাকেও আমার ভারী ঈর্ষা হচ্ছিলো।না,সম্ভাব্য সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেদিন কিছুই হলো না।

মেয়েদের সঙ্গে একটু যেচে কথা বোলবার অভ্যেস আমার ততোদিনে রপ্ত হয়ে গেছে।ইচ্ছে ছিলো নদীর সঙ্গে হয়ে যাক না হয় আলতোরঙের খুনসুটি আজ।কলেজ করিডোর।বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছিলো নদী – আনমনে।আমিও কি ছিলাম অন্যমনস্ক কোনো কবি! ধাক্কাটা প্রায় লেগেই যাচ্ছিলো।সম্পুর্ণই দু’জনের অনিচ্ছেয়।ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগানো কোনো কাব্যিক কথা নয় বরং এক ধরনের অসভ্যতা।অনিচ্ছাকৃত লেগে গেলে দোষের কিছু নেই।

ইশ্ কেনো যে লাগলো না- ভাবলেই সকালটা মাটি হয়ে যায়। লেগে গেলে অন্তত একটা ছোটোখাটো মধুর স্মৃতি দাঁড়িয়ে যেতো, আটকে থাকতো স্মৃতির ফ্রেমে।হলো না! অগত্যা নদীকে বললাম: ডান হাতটা মেলে ধর।বুঝতে না পেরে বললো: বুঝি নি।বললাম : পেট্রোল ঢেলে হাতের তালু আগুনে পুড়িয়ে দেবো।মেলে ধর। কিছুমাত্র অবাক না হয়ে সে মেলে ধরলো কারণ ওর জানা ছিল আমি এইরকমই। ওর হাতের তালুতে আমি লিখে দিলাম ০৯৮৭৬৫৪৩২১। লিখবার সময় ওর ডান হাতটা আমার বাম হাতে ধরে আমার ডান হাত দিয়ে ডিজিটগুলো লিখে দিলে বেশ কেমন কেমন একটা অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়ে যেতো নিশ্চয়ই। শুধু আমার উদ্দেশে মেলে ধরা নদীর হাত ছুঁতে গিয়ে যেনো বা সংকোচ হলো।ছোঁয়াছুঁয়ি সংস্কার অতিক্রম করতে পারি নি তখনো। না ধরেই মুদ্রিত ক’রে দিলাম আমার ব্যক্তিগত সেল নাম্বার।মঞ্চস্থ্য হলো না কাঙ্খিত দৃশ্যের অনুভুতিমালা।নদীও আমাকে বাজায় নি মানে রিং করে নি কোনোদিন।

সেবার পিকনিক ঈঁশা খা লোক ও কারুশিল্প যাদুঘর। যাদুঘরের ভেতরে ঘরগুলো রহস্যময় সুরঙের মতো বহমান।আমি জরির পেছনে পেছনে যাচ্ছিলাম যেভাবে গোয়েন্দা বিভাগের লোক উদ্দিষ্ট কাউকে অনুসরণ করে সন্তর্পণে। জরি কি টের পাচ্ছিলো!আমার প্ল্যান – কোনো একটা ঘরে জরিকে একলা পেলেই আকস্মিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুব গাঢ় চোখে অনন্তকাল ধরে তাকিয়ে থাকবো ওর চোখের গভীরে কাচভাঙা পাথরের মতো। না,কোনো কক্ষেই জরি একলা নয়,কেউ না কেউ আমাদের বা অন্য দলের প্রতিটি কক্ষেই জরির সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিলো।যেনো সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে গোপন আর প্রকাশ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো।জরির চোখে তাকিয়ে থাকবার সেই প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে উঠলো না কিছুতেই।

পরের বার ময়নামতি। পাহাড়গুলো দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন একটা শূন্যতা দুলে ওঠে। মনে হয় কেউ একজন – যার ঠোঁটে ভেসে ওঠে মন্দিরের ফেলে আসা নিঃসঙ্গতা – যেনো কিছুতেই উঠতে পারছে না পাহাড়ি শরীর বেয়ে।আমি হাত ধরে একটু একটু করে তার- উঠিয়ে নেই,উঠে যাই পাহাড় চূড়ায়। তার পর পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে দু’জনে একসঙ্গে মরে যাই।মনিষা চাইছিলো পাহাড় বেয়ে উঠে যেতে- সঙ্গে কৃষ্ণা,তিথি আর আরো কেউ কেউ।একি! মনিষার সঙ্গে তো কেউ নেই।কোথায় গেলো সব? মনিষা যদি গড়িয়ে পড়ে যায়! অইতো হাতটা তো আমার দিকেই বাড়িয়ে আছে।নিশ্চয়ই মনিষা আমাকে ধরেই উঠতে চাইছে।আমি ছাড়া যে পাহাড়ের কোথাও কেউ নেই।

শুধু আমি আর শুধু মনি।মনিষাকে হাত ধরে তুলে আনবার জন্য অই মুহূর্তে আমার উপস্থিতিই একমাত্র যোগ্যতা। অন্য কোনো বিশেষণে তখোন যোগ্য হয়ে উঠবার সত্যিই কোনো প্রয়োজন নেই।বাহ্ আমি তো অবিকল এইভাবে চেয়েছিলাম-এমন আবহমান কাল ধরেই।একগুচ্ছ হাসির শব্দে আমার বিভ্রম ভেঙে গেলো। কল্পিত দৃশ্যসজ্জা ছিলো আমার অবচেতন- ঘোর।মনিষার সঙ্গে আছে সকলেই ঠিক পাঠশালার অই বাক্যটির মতো-” নুরু পশি আয়শা শফি সবাই এসেছে/ আম বাগিচার চলায় যেনো তারা হেসেছে”। আমাকে ওর দিকে স্ট্রেইট তাকিয়ে থাকতে দেখে ওরা হেসে উঠেছিলো।লজ্জা কাটানোর উপায় খুঁজে না পেয়ে মনে হচ্ছিলো পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে সত্যি সত্যি মরে যাই।মনিষা সেইদিন বা অন্য কোনোদিন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় নি। আসলে আমার উদ্দেশে বাড়িয়ে রাখবে হাত – পৃথিবীতে এমন কোনো মনিষা নেই।আমার কাঁধে এলিয়ে দিবে মুখ – এমন কোনো বিনি নেই।

নেই কোনো জরি যার চোখে প্রাগৈতিহাসিক আমার চোখ।মুঠোফোনে বোলবে না কোনো নদী: অবিনাশ,আজ বোলবো না কিছুই,শুধু লুট করবো সমস্ত দীর্ঘশ্বাস। আমাকে তুই এমন করে খুন করলি কেনো!