কবি নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়

দুলাল পোদ্দার, সহকারী অধ্যাপক, নারায়ণপুর ডিগ্রী কলেজ, মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর :
১২ ভাদ্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৬তম প্রয়াণ দিবস। সাধারণত বাংলা ভাদ্র ইংরেজী আগষ্ট মাস, জাতীয় শোকের মাস। জাতীয় কবি ও জাতির জনক অর্থ্যাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীন বাংলদেশের বাস্তব¯্রষ্টা-এই দুই মহান মানবের মহা-প্রয়াণ দিবস। বাংলা জৈষ্ঠ্য ও ভাদ্র মাসের সাথে অনিবার্য একটি নাম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা মহান পুরুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে যিনি দিলেন নিরংকুশ স্বাধীনতার ডাক, তাঁর লেখনীতে আমরা খুঁজে পেলাম আমাদের জাতীয় চেতনা। আমাদের প্রেম, বিরহ কিংবা মিলনে অনিবার্যভাবেই আমরা আশ্রয় নেই নজরুলে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের কালজয়ী গান, কবিতা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বাংলা সাহিত্যোকাশের এই দিকপালকে।

জাতির জনক জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের রাষ্ট্রচিন্তা কে মনে-প্রাণে পরম শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছেন। আজ কবির ৪৬তম প্রয়াণ দিবসে বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে আলোচনা তুলে ধরবার চেষ্টা করে মহান কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করে তাঁকে স্মরণ করবোজাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে মিল আছে অনেক। স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রের উৎস ও প্রেরণ দাতা হলেন কবি নজরুল, আর স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রের নির্মাতা হলেন- বঙ্গবন্ধু। নজরুল ও বঙ্গবন্ধু দু’জনেই ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, সমাজতন্ত্রী ও গণতন্ত্রী।

নজরুল বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের মনের বাঁধন ছিন্ন করেছিলেন আর বঙ্গবন্ধু বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার যে শিকল তা ছিন্ন করেছিলেন। নজরুল ও বঙ্গবন্ধু উভয়েই কবি। একজন কবিতার, অন্যজন রাজনীতির। নজরুল ও বঙ্গবন্ধু দু’জনেই মনে প্রাণে বাংলা ও বাঙালির মুক্তি ও জয় চেয়েছিলেন। নজরুলের ‘বাঙালির জয়’ আর বঙ্গবন্ধুর ‘জয় বাংলা’ এক ও অভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে কাঁপা মহামানব দু’জনেই বাঙালি মুসলিম সমাজের প্রতিভূ। দু’জনেই বাঙালির হাজার বছরের সেরা প্রতিভাবান ও প্রতিবাদী, দ্রোহী।

বঙ্গবন্ধু ও নজরুল তুলনামুলক সাহিত্য আলোচনার বিষয় নয় বলে আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু দু’জনেই যে- বাংলা ও বাঙালির অ-কৃত্রিম বন্ধু এবং দু’জনেরই যে দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন-এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের দর্শন, চিন্তা ও সাহিত্যের প্রতি। তাই সদ্য স্বাধীন দেশে নজরুলের জন্মদিন পালিত হতেই হবে তাঁকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাধীন দেশে এনে সেবা করতে হবে, এমন নিষ্পাপ চিন্তাকে সালাম না জানিয়ে থাকা যায় না। এমনকি “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই”- নজরুলের সেই আকাংখাকেও পূর্ণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা একদিকে যেমন সাহিত্য অনুরাগী হিসেবে অন্যদিকে বাংলা ও বাঙালীকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেবার জন্য।

কবি নজরুল সাহিত্যের বাইরেও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু অকৃত্রিম সাহিত্যানুরাগী আমৃত্যু কল্যাণকামী রাজনীতির নন্দিত নায়ক। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বর্ষেই কবিকে এনে নজরুল জয়ন্তী পালন করা এটি ছিল কবি প্রেমের এক যুগান্তকারী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সদ্য স্বাধীন দেশের ক্ষমতাসীন দলীয় সংস্কৃতিক সম্পাদক প্রয়াত মোস্তফা সাওয়ার তাঁর এক স্মৃতিচারণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনার ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন-“১৩৮০র ১১ জৈষ্ঠ্য (১৯৭২) কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে আনার জন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি মিনি মন্ত্রীসভার বৈঠক ডেকে সরকারি ভাবে কবি নজরুলকে বাংলাদেশে আনার জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন বিভিন্ন দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে আমাকে কবি নজরুলকে আনার জন্য ভারতে প্রেরণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু “হে কবি” সম্বোধন করে কবি নজরুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ পত্রে স্বাক্ষর দিয়ে আমাকে বলেছিলেন আশা করি কবিকে ছাড়া খালি হাতে আসবে না।”

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এরকম প্রখর দৃষ্টিভঙ্গী এবং দুরদৃষ্টি দেখে আমরা অবাক বিস্ময়ে আবেগে আপ্লুত হই। এরকম নেতা পেয়ে আমরা ধন্য, গর্বিত। ঠিক তখনই মনে প্রশ্ন জাগে এমন নেতাকে খুন করবেন? কারা এই পাষান্ড, সীমার, কাপুরুষের দল? যে নেতার দিকে সরা বিশ্ব অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়? ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭৩তম জন্ম উৎসবে তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বাণীতে বলেন-
“নজরুল বাঙালির স্বাধীন সত্তার ঐতিহাসিক রূপকার। নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আতœা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। প্রচন্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের মত, লেলিহান অগ্নিশিখার মত, পরাধীন জাতির তিমির ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধূলায়। সাহিত্য সম্মানের সু-উচ্চ শিখরে নজরুলকে পথ করে উঠতে হয়নি, পথ তাঁকে হাত ধরে উর্ধ্বে তুলেছে। মহাঅভ্যাগতের মত তাঁর আগমন নন্দিত হয়েছে। সে এসেছে ঝড়ের মত মাতম তুলে, বিজয়ীর বেশে। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় নন্দিত হয়েছিল-
আয় চলে আয়রে ধুমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নি-সেতু,
দু’দিনের এই দূর্গ-শিখরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন
অলক্ষনের তিলক-রেখা
রাতের ভালো হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধ চেতন।

শুধু বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, শান্তি ও প্রেমের নিকুঞ্জেও কবি বাংলার অমৃতকন্ঠ বুলবুল। দু:খের বিষয়, বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোন আলোচনাই হলো না। শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে তাঁর অনন্য সৃষ্টি,আর জীবন্ত অবস্থায় পাথরের মুর্তির মত সকলের কৃপাপ্রার্থী ও অসহায়, বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সঙ্গীতকার।” আমরা সত্যিই জানিনা জাতির জনকের সাথে পর জনমে তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব আদরের ধন কবি নজরুলের দেখা হয়েছিল কি’না। কামনা করি এ দু’জন মহা-মানর বাংলার অ-কৃত্রিম বন্ধু যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন, পরম শান্তিতে থাকুন। দেশের বিশিষ্ট প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ডাক্তার নীলিমা ইব্রাহীম তাঁর এক লেখায় বলেছেন-“বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই মহাপ্রাণের মানব ভাবনায় ও চিন্তাকাশে আমরা অপূর্ব মিল দেখতে পাই। নজরুল ছিলেন মানবতাবাদী ও ধর্মান্ধতামুক্ত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমরা সর্বদা এই দুখী মানুষকে দেখতে পাই। তিনি তাদের জন্য আহার, বাসস্থান ও ব্যাধিমুক্তি চেয়েছিলেন। এই আদর্শেই গঠিত হবে তাাঁর সোনার বাংলা। এই ছিল তাঁর ইচ্ছা।”

নজরুলের মত তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল এক সুদৃঢ় হাতিয়ার। নজরুলের মত বঙ্গবন্ধুর কাছেও নর-নারীর কোন বিভেদ ছিল না। নজরুল লিখেছেন-
“কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখ আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।”

এই বৈষম্য বঙ্গবন্ধু উপলদ্ধি করেছিলেন। তাই নবলব্ধ রাষ্ট্রের সংবিধানে নর-নারীকে সম-অধিকার দেওয়া হয়েছে। নজরুল বীরাঙ্গনার প্রশান্তি পেয়েছেন। আর বঙ্গবন্ধু লাঞ্চিতা নারীকে সম্বোধন করেছেন-বীরঙ্গনা রূপে। এই দুই মহাপ্রাণ নারীকে একান্তভাবে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। আবার ধর্মান্ধতাকে উপহাস করে নজরুল কবিতা লিখেছেন আর বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছেন। বাংলা তথা বাঙালির জন্য উভয়ের শুভচিন্তা ও সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য তাঁরা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। কবি নজরুলের বিদায় ক্ষণে প্রতিটি বাঙালি পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি। যদিও কবি বলেছেন, “কেন আলো ফুল ভোর আজি বিদায় বেলা”-কিন্তু এ ছাড়া আমাদের কি’ই বা আছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সাহিত্য কর্মকে পরম শ্রদ্ধায় ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ ভালবাসার কারণেই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় এত বিরোধীতা সত্তে¡ও কবিকে ভারত সরকার ঢাকায় আনার সিদ্বান্ত দিয়েছিলেন। কবিকে ঢাকায় আনা হয় তাঁর ৭৩তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ২৪ মে (১০ জৈষ্ঠ্য ১৩৮০)। বিমান বন্ধরে দেখা গেল হাজার হাজার মানুষের ভীড়। কে কার আগে কবিকে ফুলের মালা দেবে তার প্রতিযোগতা। জনশ্রোতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যাচ্ছিল না বলে বিমানের দরজা খুলে জনতাকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ হয়। কারণ ততক্ষণ কবি গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বর্ষেই অসুস্থ্য কবিকে এনে জাতীয় কবির মর্যাদার আসনে বসিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর জন্মদিন পালন করা এবং কবির সেবা সুশ্রæষার ভার গ্রহণ করা- এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কবিকে ভালবাসায় চির কৃতজ্ঞতা বসে আবদ্ধ রাখার নিদর্শন। আর এ কাজটি শুধু বঙ্গবন্ধুর দ্বারাই সম্ভব। যার হৃদয় হিমালয়ের মত বিশাল। ভালোবাসাতো অন্তরের জিনিস। হৃদয়ে-হৃদয়ে অনুভব। বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয়ের ভালবাসা কবি নজরুল মুখে বলতে না পারলেও অবশ্যই অন্তরে অনুভব করেছেন। অনুভবের ছোঁয়া অবশ্যই লেগেছে কবির অন্তরে।

১৫আগষ্ট রাতে ঘাতকরা যখন বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে তখন কবি সরোয়ারর্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কবি কথা না বললেও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন এসব বর্বর, জঘন্য ঘটনা। তখন কবির কেমন লেগেছিল। কবিতো আরও একটি বছর বেঁচেছিলেন। সেই বছরটিই বা তাঁর কেমন কেটেছিল-মনে প্রশ্ন জাগে। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে জাতীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়েছিল। সে সংবর্ধনায় সভাপতির ভাষনে শ্রী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, “ফরাসী বিপ্লবের সময় প্রত্যেক মানুষ অতিমানুষে পরিণত হয়েছিল। আমার বিশ্বাস নজরুলের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হবে।”

নজরুল তাই বাঙালির মানস-সরোবরে ফুটে থাকা অবিনাশী পদ্মফুল। তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি আবারও বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।