ছোট গল্প আপত্তি : ক্ষুদীরাম দাস

সোহেলীকে ছেলেপক্ষের লোকজন দেখতে এসেছে। দেখা শেষ হলে যখন ওরা বাড়ি থেকে চলে গেলো বাড়িতে কেনো জানি আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করেছে। ছোট কাকা তার মোবাইলটি পকেট থেকে বের করেই দূরের আত্মীয়স্বজনদের ফোন করতে লাগলো। সোহেলী তো কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলে পক্ষ এই প্রথম এসেছে, আর এসেই তাকে পছন্দ করে ফেলেছে। বিয়েটাও নাকি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, পরের মাসের পনের তারিখ। সোহেলী ঘরে গিয়ে ছেলে পক্ষের দেয়া আংটি দেখছিলো। খুবই সুন্দর আংটি; কিন্তু কেনো জানি সোহেলীর আংটি মোটেও ভালো লাগছে না। ছেলে পক্ষ এসেই তাড়াহুড়ো করে বিয়ের জন্যে আংটি পরিয়ে দেয়া, তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক করে ফেলা, সবই যেন যাদুর মতো মনে হচ্ছে। সোহেলী মোটেও এমনটি আশা করেনি যে, তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যাবে।

সোহেলীরা মোটেও ধনী নয়। আবার অভাবের সংসার সেটাও বলা যাবে না। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারে জনসংখ্যা বেশি বলে টানাটানির সংসার বলা যায়। সোহেলীর বাবা খরচের দিক থেকে খুবই হিসেবী। সে কারণে সংসারটি এখনো টিকে আছে। বেহিসেবী চলা তিনি মোটেও পছন্দ করেন না। হিসেব করে না চললে সংসার এতো দিনে ধ্বংস হয়ে যেতো। পড়াশোনাও মোটেও করা হতো না। একটি টাকাও মন চাইলেই ইচ্ছামতো খরচ করার উপায় নেই। ইচ্ছা মতো টাকা খরচ করে তারাই, যারা অনেক টাকার মালিক-আর তারা মন চাইলেই টাকা খরচ করতে পারে। মন চাইলেই কোনো কিছু করে দেখাতে পারে। গায়ের জামাটা পুরোনো হওয়ার আগেই নতুন আরেকটি জামা গায়ে জড়াতে পারে। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনরাও যে খুব ধনী সেটাও নয়। সোহেলীর বাবা আবার দয়ালু ব্যক্তি। মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভালোবাসেন। নিজের সংসার চলে টানাটানিতে, অথচ অন্যেরও উপকারের জন্যে টাকা বাঁচিয়ে খরচ করার প্রমাণ মিলেছে অনেকবার।

সোহেলীর মা এজন্যে অনেকবার তার বাবাকে বলেছেন, কিন্তু বেশি সুবিধা করতে পারেন না। কারণ, সোহেলীর মাও অনেক বেশি দয়ালু। সোহেলীদের বাসা থেকে একটু দূরে রিমিদের বাসায়। রিমির মা ঘরে বসে সেলাই মেশিনে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালান। কম ভাড়ার একটা বাড়িতে একরুমে সবাই মিলে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে তাদের তেমন কিছুই নেই। একদিন রিমির মা সোহেলীর মাকে কেঁদে কেঁদে মনের কথা বলেছেন। ব্যাস! হয়ে গেলো ষোলো কলা পূর্ণ। মা তো দুঃখের সাগরে ভেসে গেলেন। তাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন। সোহেলীর মা কিছু রান্না করলেই বাটিতে ভরে রিমিদের দেয়ার জন্যে চলে যান। কোনো অনুষ্ঠানে সোহেলীর জন্যে কিনলে, তাদের জন্যেও কেনা দরকার। মনে হয় যেন তারাও এই পরিবারেরই লোকজন।

সোহেলীরা ভাই-বোন দু’জন। অভাবের সংসার বলে অতি কষ্টে সোহেলীর পড়াশোনাটা এখনো ধরে রাখতে পেরেছেন। আর সোহেলীর বিয়েটা হয়ে গেলে ভাইয়ের পড়াশোনার জন্যে একটু বেশি খরচ করতে পারবেন বলে চিন্তা করছেন। তাই এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দেয়া। আর এদিকে ছেলে পক্ষ তো এসেই বিয়ের পাকা কথা দিয়ে দিলেন। সুতরাং সোনায় সোহাগা। এখানে আর দেরী করা চলবে না।

সোহেলীর সবচেয়ে বড় দুঃখ সহপাঠীদের সাথে সমানতালে চলতে পারে না। কারণ, ওরা অনেক ধনী। তাই অনেক সময় তাদেরকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সম্ভব হয়ে উঠে না। ওরা ভালো ভালো জামা কাপড় পরে, আর তার পরনে থাকে পুরোনো জামা এটা তার মনে বড় কষ্ট দেয়। তাই অনেক সময় বাবাকে বাধ্য হয়েই জোর করতে হয় নতুন জামার জন্যে। এজন্যে কয়েক সেট নতুন জামা, ভালো মানের লিপস্টিক, আর অন্তত সোনা না হোক ইমিটেশনের হলেও সমস্যা নেই। যাদের সাথে চলাফেরা তাদের সঙ্গে যদি অন্তত তাল মিলিয়ে চলতে গেলে এসব একটু দরকার হয়। সোহেলীর মা কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা না করলেও তিনি এসব জানেন। সোহেলীর বাবা যতোই হিসেবে হোক, সোহেলীকে হাত খরচের জন্যে প্রতিমাসে দুইশত টাকা তার মা দিয়ে থাকে।

সোহেলীর এ সময় বিয়ে করার মোটেও ইচ্ছা নেই। তবুও তাকে বিয়েতে রাজি হতেই হবে। তার ইচ্ছা ছিলো, পড়াশোনাটা অন্তত শেষ করে একটা চাকুরি করে মা বাবাকে সাহায্য করবে। কিন্তু বিয়ের বয়স যে হয়ে গেছে-সেটা তো আর থেমে নেই। সোহেলী তার মাকে অনেক দেখেছে, পরনের শাড়ি ছিঁড়ে গেলেও নিজ হাতে সেলাই করে পরে। একদিন তো রাগ করে সোহেলী মাকে বলেছিলো, আমরা কি এতোই গরীব হয়ে গেলাম যে, তুমি হাতে সেলাই করে শাড়ি পড়তে হবে? সেদিন তার মা বলেছিলো, আমি তো আর বাইরে বের হতে যাই না। কোথাও কি আমি যাই? সুতরাং ঘরে এমন শাড়ি পরলে কোনো সমস্যা নেই। কেউ দেখবেও না। আর তাছাড়া, ছোটবেলায় আমার মাকেও দেখেছি, এভাবে সেলাই করে শাড়ি পড়তে। সুতরাং আমরা পড়লে সমস্যা কোথায়? মায়ের সাথে সোহেলী সেদিন কথায় পারেনি। পরে অবশ্য ভেবেছিলো, তার মা ঠিকই বলেছেন। বুদ্ধিমান স্ত্রীরা এভাবেই সংসারকে বাঁচিয়ে রাখে। এটা যে সংসার বাঁচানোর কৌশল এটা সোহেলী পরিস্কার বুঝতে পারে। তাই অনেক সময় সোহেলীও নতুন পোশাকের জন্যে আব্দার করে না। তবে মনে মনে সোহেলী প্রতিজ্ঞা করেছিলো, বাবা মাকে নতুন জামা কাপড় কিনে দেবে একদিন। কিন্তু সোহেলীর সেই স্বপ্ন আর কোনোদিনও পূরণ হবে না। কারণ, তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

দুই.
পুরোনো বাড়ির পুরোনো ছাদ হলেও অন্যান্য বাড়ির তুলনায় বাড়িটা চমৎকার। আলাদা সৌন্দর্য বাড়িটার মধ্যে লুকিয়ে আছে। বাড়ির ছাদটা বিশাল। বিকেল হলে বাড়ির ছাদে সূর্যের আলো পড়ে না। পাশে থাকা গাছগুলো সূর্যকে ঢেকে দেয়। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই ধুলোবালির রাজত্ব নেই। ডুবু ডুবু সূর্যটা কিছুক্ষণ পরে আর আলো দেবে না পৃথিবীকে। অন্য রকম আলোয় চারিদিকে ভরে আছে। বাতাসটাও বেশ লাগছে। কিন্তু সেই বাতাসে সোহেলীর মনটা কেন জানি হু হু করে উঠলো। সোহেলী ছাদের পরিবেশটা একনজর দেখে নিলো। বড় বড় বালতিতে বিভিন্ন রকমের গাছগুলো সতেজ হয়ে রয়েছে। সেই গাছগুলোর পাশে লোহার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা তার বিষন্ন। কিছুক্ষণ আগে তার ছোট ভাইয়ের সাথে একটু ঝগড়া হয়েছে।

সোহেলীর ভাই শাওন প্যাকেট ভর্তি মিষ্টি এনে সোহেলীর সামনে রেখে বললো, দিদি তুই খেয়ে নেয়। মিষ্টিটা দারুণ খেতে। সোহেলী অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, এগুলো তুই খা রে ভাই। আমার ইচ্ছা করছে না।
শাওন : আমি অনেক খেয়েছি। এবার তুই খেয়ে নে। ভালো লাগবে। নতুন নতুন আমাদের ছেড়ে এসেছিস তো তাই তোর মনটা খুবই খারাপ লাগছে।
সোহেলী ঃ তুই কি কোনোদিন মিষ্টি খাসনি। খুবই বিরক্ত লাগছে।
শাওন : বুঝতে পেরেছি। তোর জামাই এনেছে বলে তুই এভাবে আমাকে কথা শোনাচ্ছিস? আমি আর খাবোই না।

সোহেলীর হাতে কতোগুলো ছবি দিয়ে শাওন দ্রæত চলে গেলো। সোহেলী বুঝতে পেরেছে এগুলো কিসের ছবি। সে ছবিগুলো বের করে একে একে দেখতে লাগলো।
সোহেলীর সঙ্গে রওনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সোহেলী যখন কলেজে যায়, তখন রওন তাকে একনজর দেখেছিলো। আর আজ সোহেলী দেখছে ছবিতে। রওনের মা বাবার খুবই আদরের সন্তান। সোহেলী ছবিগুলো একে একে দেখতে লাগলো। বেশ তো! চেহারায় নাদুনুদুস ভাব আছে। একটা ভালো কোম্পানীতে সে ভালো চাকুরি করে। পোশাক আশাকে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে চেহারাটা মোটেও ভালো নয়। কিন্তু টাকা পয়সা থাকলে বাজে চেহারাও ভালো হয়ে যায় পোশাক আশাক আর সাজগোছে। রওনকেও সে রকমই লাগছে। তবে ছেলেটির প্রতি সোহেলীর মোটেও ভালো লাগা জেগে উঠেনি।
তবুও সোহেলীর চোখে সে আজ থেকে জীবনসঙ্গী।

তিন.
কলেজে ভর্তির সময় সোহেলীর সঙ্গে অর্নবের পরিচয় হয়। ছেলেটা গরীব। প্রথম দিত যে শার্ট পরতে দেখা গেছে, সেই শার্ট এক বছরও দেখা যায়। মধ্যবিত্ত কিম্বা গরীবের সন্তানেরা এ রকমই হয়। নিত্য নতুন পোশাক তাদের কপালে জোটে না। যদিও ছেলেটা দেখতে কালো, তবুও সোহেলীর তাকে বেশ ভালো লেগে যায়। অর্নব একটু কথা বললেই কেন যেন ভালো লাগায় সোহেলীর মন ভরে যায়। এটা হয়তো প্রেম সোহেলী সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। কিন্তু এটা এক তরফা। তবে অর্নব জানিয়েছে, সে নাকি কোনোদিনও বিয়ে করবে না। এটা তার প্রতিজ্ঞা। সেটা জানার পর থেকে সোহেলী তার সাথে কম কথা বলতো। ছেলেটা নাকী আজীবনই বই পড়বে; তারপর একদিন মরতে চাইরে মরে যাবে।
তবে সে এমনি এমনি মরবে না। মা বাবাকে সুখী করতে করতে মারবে।

আর সোহেলী চিন্তা করে, সে যদি এখন বিয়ে করে তাহলে মা বাবাকে সে কোনোদিনও উপকার করতে পারবে না। তাদেরকে সুখী করা তার স্বপ্নই থেকে যাবে না, বাস্তবে তা কোনোদিনও পূরণ হবে না। মাঝে মাঝে সোহেলীর খুবই খারাপ লাগে যে, তার জন্যে মা বাবার অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। হয়তো করছে। কিন্তু তারা এমন একটা ভালো ছেলে মোটেও হাতছাড়া করতে রাজি নয়। সোহেলী মনে মনে চিন্তা করে, যদি কোনোদিন রওন তাকে ফোন করে তাহলে সে পরিস্কার জানিয়ে দেবে, সে বিয়ে করবে না। হয়তো তার মা বাবা তার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। কিন্তু না মানারই তো কথা। কারণ, এমন ভালো ছেলে, তাছাড়া তাদের নিজেদের সুখের জন্যে বিয়ে না দিয়ে সোহেলী সিদ্ধান্তে তারা মোটেও রাজি হবে না। রওনকে তার বিয়ে না করার আপত্তিটা জানাতেই হবে।

সোহেলী এসব ভাবছে, এমন সময় তার হাতের ফোনটি বেজে উঠে। ফোনটা রিসিভ করতেই রওন বললো : মনে হয় বিরক্ত করলাম।
সোহেলী : না না, বিরক্ত নয়।
রওন : তাহলে ফোনটা তুলতে দেরী হলো যে।
সোহেলী : ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিলো তাই।
রওন : ও তাই।
সোহেলী : তারপর কি বলতে চেয়েছো?
রওন : তোমাকে যে বইটা দিলাম সেটা তুমি পেয়েছো?
সোহেলী : কোন বইটা?
রওন : কেনো যেটা তোমার ভাইকে দিয়ে পাঠালাম সেটা তুমি পাওনি?
সোহেলী : না। সে তো এখনো আমাকে দেয়নি। হয়তো দেবে, ভুলে গেছে হয়তো বা।
রওন : হতে পারে।
সোহেলী : তোমাকে একটা কথা বলবো।
রওন : বলতে পারো।
সোহেলী: তুমি রাগ করবে না তো?
রওন : না, মোটেও রাগ করবো না।
সোহেলী : আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না। আমার মনে একটা স্বপ্ন আছে। সেটা আমি পূরণ করতে চাই।
রওন : আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি। তাহলে তো তোমার প্রতি ইচ্ছা জাগানো যায় না। সুতরাং তোমার প্রতি আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তুমি মুক্ত।
সোহেলী : একটু অপেক্ষা। ফোনটা রেখে দিও না।
রওন : আর কিছু বলার আছে?

সোহেলী : কী আশ্চর্য! এতো সহজে তুমি মেনে নিলে? আমি তো রীতিমতো অবাক হচ্ছি।
রওন : আমি মোটেও আশ্চর্য হইনি। এটাই বাস্তব। তুমি সরাসরি আমাকে মনের কথা বলেছো। এটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। যদি বিয়েটা হয়ে যেতো, তখন যদি এই কথা বলতে তাহলে আমার পরিবারের সম্মান যেতো। আর আমি চিরদিন কষ্ট পেতাম। সুতরাং বিয়ের আগেই তুমি তোমার বাস্তব কথা বলেছো, সে জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। এখন আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি আমাকে পছন্দ করোনি।
সোহেলী : আমার অন্য একজন ভালো লাগে।
রওন : তাহলে তো আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

রওন এ কথা বলেই ফোনটা কেটে দিলো। আর সোহেলী খুবই আশ্চর্য হলো। এমন অদ্ভুত মানুষ থাকতে পারে পৃথিবীতে! তারপর ছবিগুলো হাত থেকে টেবিলের উপর রেখে সোহেলী নিজের ঘরে চলে যায়। দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকে।
————— সমাপ্ত —————–