ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় পেঁপে পাতার রস

ডাঃ সিদ্দিকুর রহমান প্রামানিক :

পেঁপে আমাদের অতি পরিচিত একটি ফল । পেঁপে পাতার রসে রয়েছে অনেক গুণ। পেঁপে এমন একটি গাছ, যার প্রায় প্রতিটি অংশই ব্যবহার করা যায়। পেঁপের ইউনানী নাম পাপিতা বা আরাল্ড খরা, আয়ুর্বেদিক নাম অমৃততুম্বী, বাংলা-পেঁপে, আরবী-শাজারাতুল বাতিখ, হিন্দি-পাপাইয়া, পাপিতা, আড়ান কাকড়ি, উর্দু-আরাল্ড খর্যা, ফারসি-আম্বা হিন্দী, সংস্কৃত-অমৃত তুম্বী, পেঁপের বৈজ্ঞানিক নাম :Carica papaya),এরা Caricaceae পরিবারের সদস্য । একটি ফল যা মানুষ কাঁচা তথা সবুজ অবস্থায় সব্জি হিসেবে এবং পাকা অবস্থায় ফল হিসাবে খেয়ে থাকে। পেঁপেতে রয়েছে ভিটামিন ই, সি ও বিটা ক্যারোটিন। এর বীজে রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসিড। পেঁপে পাতারও উপকারিতা রয়েছে। বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু জ্বর ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এই ডেঙ্গু জ্বরে পেঁপে পাতার রসের ব্যবহার নিয়ে কিছু কথা বলবো।

ডেঙ্গুর ভাইরাস মূলত আমাদের রক্তের প্লেটিলেট কমিয়ে দেয়। সাধারণত প্লেটিলেটের জীবনকাল ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত। এরপরে আবার প্রয়োজন অনুসারে নতুন প্লেটিলেট উৎপাদন হয়। ডেঙ্গুর ভাইরাস শরীরে যতদিন কার্যকর থাকে ততদিন পর্যন্ত নতুন শরীরে নতুন প্লেটিলেট উৎপাদনের ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে ভূমিকা রাখে।

সাধারণত একজন সুস্থ মানুষের রক্তের স্বাভাবিক প্লেটলেটের পরিমাণ হলো প্রতি মাইক্রো লিটারে ১৫০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ পর্যন্ত। ডেঙ্গু হলে এই প্লেটিলেটের সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যেতে থাকে। প্লেটিলেট লেভেল ১০০,০০০ এর নিচে চলে আসলে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারেন। প্লেটলেট লেভেল যদি ৫০০০০ এ নেমে আসে তাহলে থ্রমবোসাইটোপেনিয়া হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় রোগীর মৃত্যু হতে পারে। তাই ডেঙ্গু হলে প্লেটিলেট পরীক্ষা করে দেখা হয়। প্লেটিলেট খুব কমে গেলে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।

প্লেটিলেটের পরিমাণ যখন অস্বাভাবিক কমে যায় তখন রক্ত জমাট বাধতে শুরু করে এবং হ্যামোরেজিং হতে পারে। এর ফলে শরীরের অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ হয় এবং রোগীর মৃত্যু ঘটে।

পেঁপে পাতার রসে থ্রম্বোসাইটিস (প্লাটিলেট) উৎপাদনে সাহায্যকারী উপাদান রয়েছে। পেঁপে পাতার রস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং তা ডেঙ্গু জ্বর খুব দ্রুত সারিয়ে তোলে। যেভাবে কাজ করে পেঁপে পাতায় কিমোপাপিন ও পাপেইন নামে দুটি এনজাইম আছে।

এই উপাদান দুটি প্লেটলেট উৎপাদন বাড়ায় এবং রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করে। এছাড়াও এগুলো ডেঙ্গুর কারণে লিভারের কোনো ক্ষতি হয়ে থাকলে সেটা ঠিক হতে সহায়তা করে। এছাড়াও পেঁপে পাতায় আছে প্রচুর পরিমাণে কমপ্লেক্স ভিটামিন যা বোন ম্যারোকে প্রচুর পরিমাণে প্লেটলেট উৎপাদন করতে সহায়তা করে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে কিভাবে খাবোপেঁপে পাতার রস ? পেঁপে পাতার রস খেতে হলে মোটামুটি কচি পাতা বেছে নেয়ায় ভালো। এরপর এই পাতা খুব ভালো করে ধুয়ে ব্লেন্ডারে দিয়ে অথবা বেটে রস বের করে ছেঁকে নিতে হবে। এর সঙ্গে কোনো চিনি কিংবা লবণ দেয়া যাবে না।

প্রাপ্ত বয়স্কদের দিনে দুবার ৮ ঘন্টার বিরতি দিয়ে ১০ মিলি লিটার পরিমাণ পেপের রস খাওয়া উচিত। ৫ থেকে ১২ বছর বয়সিদের ৫ মিলি লিটার ও ৫ বছরের ছোটদের ২.৫ মিলি লিটার পেঁপে পাতার রস খাওয়া উচিত। কখন খেতে হবে ডেঙ্গু জ্বর হলেই পেঁপে পাতার রস খাওয়া উচিত। রক্তের প্লেটলেট লেভেল ১৫০,০০০ এর নিচে নামতে শুরু করলেই পেপে পাতার রস দুই বেলা করে খাওয়া শুরু করতে হবে। তবে সেই সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শে অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাও নিতে হবে।

পেঁপে পাতা স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী, তেমনই ত্বকের জন্য। পেঁপে পাতায় রয়েছে পাপাইন, যা হজমে সাহায্য করে। পেট ফুলে যাওয়া এবং অন্যান্য হজমসংক্রান্ত ব্যাধি প্রতিরোধ করে। হজমের পাশাপাশি কারপেইনের মতো শক্তিশালী যৌগ খুশকি ও চুল পড়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর ভূমিকা নেয়।

ক্ষুধাবর্ধক, হাজিমাহ্-হজমকারক, কাসেরে রিয়াহ-বায়ু নাশক, মুদিরে বওল ওয়া হায়েজ-মূত্র ও ঋতু প্রবাহক, মুফাত্তিতে হাসাত-পাথর চূর্ণকারক, কাতেলে কিমে শেকম-পাকস্থলীর কৃমি নাশক, মুকাব্বিয়ে আম-সাধারণ শক্তিবর্ধক । রক্তকনিকা বৃদ্ধি করে, ব্রণ দূর করে।

এ ছাড়া ও পেঁপে সকল ধরনের মাংসকে নরম করে এবং মাংসের ক্ষতিকর বস্তু দূর করে। পেঁপের আঠা ঋতু প্রবাহক এবং গর্ভবতীর জরায়ুর মধ্যে প্রয়োগ করলে তাড়াতাড়ি গর্ভপাত হয়ে যায় । পেঁপে পাতায় থাকা এসিটোজেনিন যৌগ অ্যান্টি-ক্যানসার উপাদান। পেঁপে পাতায় থাকা এনজাইম লিভার ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার, অগ্ন্যাশয় ক্যানসার এবং স্তন ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

বহু গুনে গুনান্বিত পেঁপেকে যে ভাবে সংরক্ষন করতে পারেন ছোট ছোট টুকরা করে ছায়াযুক্ত রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ ও পাতা সংগ্রহ করে রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। ল্যাবরেটরীতে হার্বেরিয়াম লেবেলিংসহ ২৫-৩০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।

ভালভাবে শুকিয়ে রাখলে ০১-০২ বৎসর পর্যন্ত ঔষধি গুণাগুণ বিদ্যমান থাকে । পাতা, ফল, বীজ ও আঠা ঔষধে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পেঁপে বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে জন্মে এবং চাষাবাদ হয় । এ ছাড়া ও পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা জন্মে থাকে ৷ এছাড়াও আরো রাসায়নিক উপাদান সমূহের মধ্যে রয়েছে :

Papaine, Pepsin, Vitamin-A, Vitamin-B, Vitamin-C, Fatty Acid, Crude fibre, Protien, Phosphorus, Megnesium, Glucose, sugar, Iron, Glycoside, Alkaloids. Bioactivity : Antioxidents, Antibactirial, Antiviral, Anti-inflammatory, Laxative, Purgative, Anticancer, Digestive, Nutritive, Diuratic, Antihelmintic.

পেঁপের মিযাজ কাঁচা ১ম শ্রেণীর উষ্ণ ও শুষ্ক এবং পাকা ফল ১ম শ্রেণীর উষ্ণ আর্দ্র। এটি মিষ্টি স্বাদ যুক্ত হয় । কাঁচা ফল পাসে স্বাদের হয় পাকলে সুঘ্রান যুক্ত হয়ে থাকে। পেঁপে সঠিক মাত্রায় সেবনে কোন ধরনের প্রতিনির্দেশ পরিলক্ষিত হয়নি । অতিরিক্ত পেঁপে সেবন কিংবা পেঁপে বীজ অল্প বা বেশী মাত্রায় গর্ভবতীদের ব্যবহার বা সেবন নিষেধ । অতিরিক্ত সেবনে ডায়রিয়া হতে পারে ।

লেখক পরিচিতি :

বি ইউ এম এস , এম পি এইচ (নিউট্রিশন), (এইচ ইউ বি)

ডিইউএমএস- ( ঢাকা )

প্রভাষক, চাঁদপুর ইউনানী তিব্বীয়া কলেজ, পুরাণবাজার চাঁদপুর।