অনেক কথা

আযাহা সুলতান :

ঐশ্বরিক—

‘‘আল্লাহ মহান আল্লাহ মহীয়ান

আল্লাহ রহিম ও রহমান

আল্লাহ বিধান আল্লাহ বিধিয়ান

আল্লাহ দরদি ও দয়াবান’’

“আমি বুঝি না কোনটে আবেদ

কোথা প্রভেদ—

ঈশ্বর প্রভু আল্লাহ খোদা গড ভগবান।

আমি জানি না উঁচুনিচু কী ভেদ

জাতীয় বিভেদ—

হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ ইহুদ খ্রিস্টান”

আমি স্রষ্টাকে যতটু ভালোবাসি, মা-বাবা ও সন্তান-সন্ততি বাদ—নিজেকেও অতটু ভালোবাসি না বোধহয়। স্রষ্টা আমাকে পৃথিবী দিয়েছে—দেখিয়েছে; পৃথিবীর আলো-বাতাস, ঝড়বৃষ্টি, তুফানহাওয়া, চন্দ্রসূর্য, গ্রহতারা, আসমান-জমিন এতদ্দ্বয়ের সমস্ত কিছু—সমস্ত প্রকৃতি আমার করে দিয়েছে—সে স্রষ্টাকে যদি তাঁর এ নগণ্য সৃষ্টি না পূজে, না মানে ও না ভালোবাসে তা হলে স্রষ্টার কিচ্ছু যায়-আসে না। তাই স্রষ্টার সঙ্গে বিদ্বেষ করা সৃষ্টির বোকামি। যাঁকে আমি কোনো দিন দেখিনি—দেখব না এবং আমার দেখার কোনো ক্ষমতাও নেই—অবলম্বনও নেই, তাঁর সঙ্গে আমার কীসের অভিমান বা বিদ্বেষ! তাঁকে আমি ডাকছি—এই যে ডাকার একটা আশ্রয় আমার আছে—হলো—এটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। আর এটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি এবং হতে পারে না। আমি কোথাও হুঁচোট খেলে বা ব্যথা পেলে বলে ওঠি, ওঃ আল্লাহ—মাগো।

তা হলে? এটাও তো আর এমনি এমনি আসে না, নিজের অজান্তেই কথাটা মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে—কারণ, প্রাণের সাথে স্রষ্টার সংযোগ। স্রষ্টার পরে মা এবং তারপরে বাবা। কেউ কিন্তু ব্যথা পেয়ে কোনো দিন ‘ও-বাবা’ ‘ও-দাদা রে’ বলে ওঠে না—ডাকে না। মাকে স্রষ্টাও তাঁর পরে স্থান দিয়েছে। দেখো, ব্যথা পেয়েছি পায়ে অথবা শরীরের কোনো অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে কিন্তু দরদ অনুভব করি—করছি অন্তরে! তাই কথাটা নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে সহজে। এরচেয়ে বড় নিদর্শন আর কী? জ্ঞানীদের জন্যে পুরো পৃথিবী বা সমগ্র বিশ্ব নিদর্শন হিসাবে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন। এখন জ্ঞানীগুণীরা যদি তা উপলব্ধি করতে না পারে কিবা খুঁজে না পায়, তা হলে তো সেটা তাদের ব্যর্থতা। সেখানে স্রষ্টার কিছু করার নেই।

জাতীয়ভাবে দেখলে দেখি তো, হিন্দু হলে বেশিরভাগ বলে—ভগবান। মুসলিম হলে—আল্লাহ। ইহুদি-খ্রিস্টান হলে বেশিরভাগ—ঈশ্বর বা গড। পার্সিয়ানেরা বেশিরভাগ—খোদা। এভাবে প্রত্যেক জাতি বা গোষ্ঠী তাদের স্রষ্টাকে একেক নামে সম্বোধন করে বা ডাকে। স্রষ্টার কোনেকটি নাম ছোট নয় এবং ছোট করে দেখতেও নেই এবং উচিতও না। যে যার ধর্মমতে, বিশ্বাসমতে এবং জাতীয়মতে ডাকবে বা পূজবে আর এবাদত-আরাধনা করবে এটাই স্বাভাবিক।

আমাকে একবার এক বন্ধু ভদ্রলোক হেসে ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন, আমি বেশিরভাগ ‘ঈশ্বর’ কেন বলি? মুসলিমের মুখে—ঈশ্বর! আমি বললাম, তাতে দোষের কী? ‘আল্লাহ’ আমরা প্রায়ই মুসলমানেরা এ কারণেই বলি—এটি একটি আরবি শব্দ, কোরান নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়; কারণ আমাদের নবির মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাই ‘আল্লাহ’ শব্দটা আরবিতে এসেছে।

তাই আমরা বেশিরভাগ মানুষ কোরান আরবিতে পড়ি এবং আরবি ভাষাকে আয়ত্ত করি আর ভালোবাসি। এটা আরবি-ভাষার কীর্তি বা গুণাবলি নয়। নবি মুহাম্মদ (স) আরবে জন্ম নিয়েছিলেন এবং ওনার ভাষা ছিল আরবি। তাই আরবের এত সম্মান বেড়েছে। নবিজি (স) যদি বাংলার মাটিতে জন্ম নিতেন তা হলে কোরান নাজিল হতো বাংলাভাষাতে আর এটা নিশ্চিত হতো। কারণ, নবিদের যেই ভাষা সেই ভাষাতেই স্রষ্টা ওহি পাঠান। আর তখন বিশ্বমুসলিম উম্মার কাছে বাংলাভাষা হতো সমাদৃত—সম্মানের ভাষা। কোরান বাংলাতে পড়তে তখন বাধ্য হতো সকলে। আমরা বাঙালিরা তখন বিশ্বে ‘হামবড়া’ ভাব নিয়ে চলতাম। সারা বাংলা হতো হয়তো নবির রওজা বা মাজার। নবিজি (স) এই পথ দিয়ে গিয়েছিলেন, এটা স্মরণীয় মাজার! নবিজি (স) অই পথের গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়েছিলেন, এই সম্মানে মাজার! নবিজি (স) এখানে তাঁবু গেড়ে কিছু সময় অবস্থান করেছিলেন, এটা এই স্মরণে মাজার! কত কত স্মরণীয়-বরণীয় বংশধর বের হতো, মাজারে মাজারে হয়তো ভরে যেত দেশ; কারণ নবিজি তো সঙ্গীসাথি—সহচরদের নিয়ে সারা বাংলা ভ্রমণ করতে না পারলেও আশপাশের কিছুটা প্রদেশ তো ভ্রমণ করতই। তখন ‘প্রভু’ শব্দ হতো মর্যাদা আর সম্মানের বুলি।

তখন আমরা বাঙালিদের সামনে দুনিয়ার কেউ যদি ভুলেও ‘প্রভু’ ছাড়া অন্য নাম নিত বা উচ্চারণ করত, তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে এরপর ক্ষান্ত হওয়া যেত কি না বলা মুশকিল। আল্লাহ সবচে বড় জ্ঞানী। আল্লাহ ভালো জানেন, কোথা কাকে পাঠালে তাঁর মর্যাদা রক্ষা হবে। তাই একজন নবিও বাংলার মাটিতে আসেননি বা পাঠাননি। এখন অনেকে বলবে, অসংখ্য ওলিওলামা, পিরমুর্শিদ ও সাধুসাধক তো এসেছেন বা পাঠিয়েছেন। এখন কীভাবে বলা যায়—কে প্রকৃত ওলি, প্রকৃত পির ও প্রকৃত সাধু! সময়ের পরিক্রমায় সব তো বিলীন হয় অথবা বিস্তীর্ণ হয়। আমি কোনো ওলিওলামা, পিরমুর্শিদ ও সাধুসাধকের বিপক্ষে নই।

বিপক্ষে—যারা প্রকৃত ওলিদরবেশ, পিরমুর্শিদ ও সাধুসাধকের নাম বদনামে পরিণত করছে আর বদনামে জড়াচ্ছে। মোদ্দা কথা—বিদায় হজের ভাষণে নবি মুহাম্মদ (স) যেই আদেশ-উপদেশ দিয়েছিলেন বা দিয়ে গেলেন সেই সে মুসলমান কি আমরা আছি? নাকি হতে পেরেছি? নাকি হচ্ছি? নাকি হব?

অন্ধধার্মিক আর অধার্মিকের মধ্যে ধরতে গেলে কোনো পার্থক্য নেই। হাঁ, পার্থক্য একটা হতে পারে—অন্ধধার্মিক কোনো কিছু না জেনে না বুঝে রতব্রত হয় আর অধার্মিক জেনেবুঝে বিব্রত বা বিরত থাকে। এমন ধার্মিক আর অধার্মিকের হয়তো গতি এক। ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার—ঠিক আছে। কিন্তু, চোখবুজে অন্ধের মতো সবকিছু ঠিক ভেবে মেনে নেওয়া ধর্মেরও বিরুদ্ধে যায়। তাই আমি অন্ধধার্মিকও হতে পারিনি এবং অধার্মিকও নই। ধর্মে আমিও ভীষণ বিশ্বাসী।

আমি জানি, আমার সৃষ্টির মালিক স্রষ্টা একজন আছেন। আমার জীবনমৃত্যু তাঁরই হাতে। আমার বিচারক তিনি। আমার আশ্রয়দাতা তিনি—মুক্তিদাতা তিনি। আমাকে চালাচ্ছেন তিনি। তাঁরই আদেশক্রমে আমি চলছি। কারণ, মন মানুষের হলেও মনের মালিক মানুষ নয়। তা হলে? কার থেকে আমি উপদেশ নেব? কাকে আমি উপদেশ দেবো? কে আমাকে পথ দেখাবে? কে বলতে পারে? কোথায় আমার গন্তব্য? কে দেবে সঠিক সন্ধান? চার দিকে ভণ্ড আর ভণ্ডামি! পিরের জায়গায় পির নেই! মুরিদের মধ্যে মুরিদ নেই! দরবেশের মুখে মুখোশের দাড়ি! মানুষ চিনব কী করে আমি? আমাকে দিশার পথ দেখাবে তুমি? তা হলে শুনি, তুমি কোন ওহিপ্রাপ্ত দিশারি? বন্ধু, নিজের নিজেকে নিয়ে ভাবো। আমার মধ্যে যখন দাজ্জালের ছায়া নেই, তোমার মধ্যে কীসের ঈসা-মেহেদি? আমি অন্যের পারের চিন্তা না করে, আমার নিজের পারের চেষ্টা করলে হয়তো হলেও হতে পারে আমার নিজের পথ সুগম। এই যে অসুন্দরের বোঝা সম্বল করে সুন্দরের ধর্মকে অন্তত আমি অসুন্দর করতে পারব না, আমার পরিণতির কথা পরে।

আমি সুন্দরের পৃথিবীতে অসুন্দর কায়েম করতে আসিনি। ক্ষমাপ্রার্থী। আমি এও জানি, যার যার ভার তার তার বোঝা। আমি আমার বোঝার ভারে নাহয় রইলাম পিছে। বন্ধু, তুমি তোমার শ্রীহীন কর্মকাণ্ডে থেকো না অপরাধীর কাতারে। কারণ, যারা সুন্দরকে ভেঙেচুরে অসুন্দর বানায় তারা সুন্দরের কাছে বড় দায়ী। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে বিবেকবুদ্ধি দিয়েছেন এবং প্রত্যেক মানুষকে দায়িত্বশীল করেছেন। প্রত্যেক মানুষেরই মনে করি—পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি এবং দশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ আছেই বা থাকা উচিত। তাই বলে মানুষের বানানো কোনো বিশ্রী জিনিসকে অবলম্বন করে ধর্মকর্মের পুণ্যে যোগ করে দেওয়া কি আদৌ পুণ্যের? মঙ্গল যার হয় জঙ্গলেও হয়। মঙ্গলের কাজ করতে হলে যে-কোনো উপায়ে করা যায়, তজ্জন্যে ধর্মকে আশ্রয় করতে হয় না। পুণ্য যে-কোনো ভালো কাজে আছে। সেটা ধর্ম হোক অথবা অধর্ম। সেটা যার যার সাধ্যমতো—যার যার অবস্থান থেকে করতেই হবে, নইলে আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচা দায়। নাফরমানির শাস্তি কখনো-না-কখনো মানুষকে ভোগ করতেই হয়।

অন্যের জন্যে কিছু করতে পারাটা মানে নিজের জন্যে কিছু করা। তাই বলে এই নয় যে, সংসার ছেড়ে গাঁট্টিগাঁঠুরি কাঁধে নিয়ে মসজিদে মসজিদে দ্বারে দ্বারে দেশবিদেশ ভ্রমণ করতে হবে! আল্লাহ দাম্ভিকতা, জালিমি ও কার্পণ্যকে যেমন পছন্দ করেন না, তদ্রূপ কোনোধরনের সন্ন্যাসব্রতও পছন্দ করেন না। আল্লাহ অতীব সুন্দর। তাই সুন্দরকে বিশেষভাবে ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন। তাই এমন অসুন্দরের থেকে অন্তত তিনি আমাকে পানা দিক। সোয়াবগুনা সম্পূর্ণটাই নিজের কাজের ওপর। সেটা কামাই করতে হলে কোনোধরনের ভ্রমণের দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না।

নাইবা রইলাম আমি গুমরাহ। কিন্তু যুক্তিটা বুঝে আসে না, তোমাকে কোন নবিরাসুল বা বার্তাবাহক করে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন? আমাকে নিয়ে বা দলবেঁধে তোমার হিজরত করতে হবে! তা হলে? দীনদুনিয়ার জন্যে তোমার এত দায়িত্ব বেড়ে গেল কেন? হেদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। যাকে তিনি হেদায়াত দান করবেন, সে ঠিকই সঠিক পথ খুঁজে নেবেন এবং পাবেন আর সেটা ওর জন্যেই হবে মঙ্গল। বাবা, তুমি তোমার কী মূলধন জোগাড় করতে পেরেছ সেটা ভালোভাবে হিসেব করে দেখ। আল্লাহর সাক্ষাৎ দূরে, সন্তুষ্টিও এত সহজ না। থাক গে, আমার ভাগ্যে নাই-ই মিলল মালিকের সাক্ষাৎ; তুমি সৌভাগ্যবান হও, শুনতে পাবে দাউদের কণ্ঠে মধুর কোরানপাঠ।

আমি কোনো ধর্মের বিপক্ষেও বলছি না—অসুন্দরের বিপক্ষে বলছি। সেটা হিন্দু হোক মুসলিম কিবা বৌদ্ধ হোক খ্রিস্টান এবং যে-ধর্মই হোক-না কেন, প্রত্যেক ধর্মে কিছু-না-কিছু বিশ্রী জিনিস যোগ আছে আর সেটা প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীকে বাদ দিয়ে সঠিক ও সুন্দরের পথটা বা কাজটা অবলম্বন করা জরুরি কিবা কর্তব্য। যেই স্রষ্টা হতে পারে সবচেয়ে সুন্দর, সেই স্রষ্টা আর যাই করুক, অন্তত ধর্মে এমন অসুন্দর কিছু যোগ করতে পারেন না। আমার মতো এক জনেরই যদি মনে হয়, এটা একটা বিশ্রী বা অসুন্দর কিবা অমার্জিত জিনিস অথবা পথ, তা হলে বুঝতে হবে, এটা স্রষ্টার সৃষ্টি বা আদেশ নয়। আমি যদ্দূর জানি, হতে পারে এটা আমার মনের ধারণা—আল্লাহকে পাওয়ার লক্ষ্যে দূরপাল্লার যাত্রার কোনো দরকার নেই।

আল্লাহ যদি কারও মঙ্গল করতে চান এবং কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, তা হলে সেটার জন্যে কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। হাঁ, মুসলিমদের জন্যে আল্লাহ মক্কার তাওয়াফ ও মদিনার জিয়ারত প্রসিদ্ধ করে রেখেছেন এবং সামর্থ্যবানদের জন্যে এটা ফরজ করে রেখেছেন। এরচেয়ে মুসলিমদের জন্যে বড় কোনো পুণ্যস্থান নেই এবং মহা কোনো সম্মেলন বা মিলনের জায়গাও নেই।

কতইনা সুন্দর সেই ডাক “লাব্বায়িক্‌ আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক্‌ লাব্বায়িক্‌ লাশরিকালাকা লাব্বায়িক্‌ ইন্‌নাল্‌হাম্‌দা ওয়ান্নিয়ামতা লাকাওয়াল্‌ মুল্‌ক্‌ লাশরিকালাক্‌” এরপরে কীসের লক্ষ লক্ষ পুণ্য এবং কীসের মহাসম্মেলন আর কীসের দূরপাল্লার যাত্রা বা চিল্লা! এর প্রতিষ্ঠাতা কে? কোনো নবিরাসুল? আমরা নবিরাসুলকে যেখানে অনুসরণ করতে পারিনি, সেখানে কোনো মোল্লামৌলবিকে (র.) রহমতউল্লাহ আলাই বা (রা.) রাদি-আল্লাহু আনহুর তকমা লাগিয়ে অনুসরণ করছি কেন? মানুষ আসলেই আজব জীব। ভালোমন্দ চিন্তা করবে দূরে থাক, হুজুকে ছুটবে, হুজুকে মাতবে, হুজুকে করবে—ভালোর সঙ্গ ছেড়ে ভালোকে করবে ঘৃণা এবং মন্দের সঙ্গ দিয়ে মন্দের পিছে দৌড়াবে! এটা মানুষের স্বভাব কিবা আদত—বুঝি না।

“আমরা যাই করি-না কেন, আল্লাহ যখন স্রষ্টা তখন তাঁর সৃষ্টিকে অবশ্যই ভালোবাসবে এবং মাফ করবেই। যেই সৃষ্টিকারক তার সৃষ্টিকর্মকে ভালোবাসবে না, সে সৃষ্টিকর্তা হতেই পারে না। আল্লাহ আছে বলে যখন আমাদের বিশ্বাস, তখন আল্লাহ অবশ্যই আমাদের মঙ্গল করবেই” না, তাতে কোনো যৌক্তিকতা নেই আর যুক্তি দিয়ে কখনো মুক্তিও মিলে না। তবু—মনে কর, কেউ কোনেকটা পণ্য বা সচল কিছু তৈরি করল, যদি সেটা প্রস্তুতকারকের মতে না চলে অথবা না হয়, তা হলে সেটার স্থান হয় ভেঙেচুরে আবর্জনায় অর্থাৎ—ডাস্টবিনে। তদ্রূপ…হাঁ, এটা ঠিক—ইমানের ওপরে কোনো পন্থা নেই। তাই বলে ইচ্ছেমতো করা যাবে না। এতে সামান্য প্রস্তুকারক যেরূপ অসন্তুষ্ট, সকল সৃষ্টির মালিক কী পরিমাণে অসন্তুষ্ট হতে পারেন চিন্তার বিষয় আছে কি নেই? তারপরেও আপনার অসুন্দরকে ভালো লাগছে বলে আমার লাগতে হবে কেন? আপনি আপনার সঠিক পথে বহাল থাকুন, আমি আমার ভুলপথে নাহয় চললাম।

আমি আমার চোখ দিয়ে যেভাবে দুনিয়াকে দেখছি সেভাবে হয়তো আপনার চোখে বেঠিক আর আপনি আপনার চোখ দিয়ে যেভাবে দেখছেন সেভাবে হয়তো আমার ঠিক মনে হচ্ছে না। তাই বলে এত অধঃপতনের বা অঘটনের কী আছে? সঠিক বিচারের মালিক তো একজন আছেন? আমি নিজেই যখন আমার নিজের সাহায্যকারী নই, তা হলে অন্যের সাহায্যের কল্পনা অবাস্তব। বাস্তবে নিজের আমলনামা দেখার যদি কোনো মাধ্যম থাকত, তবেই দেখা যেত বা বোঝা যেত কী মূলধন জমা হয়েছে বা হচ্ছে নিজের খাতায় অথবা দপ্তরে।

‘রব, আমাকে ক্ষমা করুন এবং দয়া করুন, আপনিই মহা ক্ষমাকারী এবং পরম দয়ালু।’ এই বিশ্বাসের ওপর সকলের নিঃশ্বাস চলা চাই। যে এই বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত—মনে করি, সে সকল শান্তির নিঃশ্বাস থেকে বিচ্যুত। যে যাই বলুক-না কেন এবং যেটাই ধারণা করুক-না কেন, স্রষ্টা আছে এবং চিরন্তন থাকবে। কেননা, স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। জগৎ আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা ক্ষুদ্র কিছু সৃষ্টি করতে গেলে কত কত গবেষণার দরকার পড়ে তারপর কিছু একটা পূর্ণতা লাভ করে।

তা হলে? এমনি এমনি কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না এবং হতে পারে না। স্রষ্টা বিশ্বাস আর নিঃশ্বাস। স্রষ্টার আকৃতি কল্পনা করা বোকামি। স্রষ্টাকে চিনতে হলে সৃষ্টিকে চেনা খুব জরুরি আর সৃষ্টিকে চিনতে হলে স্রষ্টার অস্তিত্বে অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকতে হয় এবং হবে। যেকাজে স্রষ্টার ওপর অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা নেই সেকাজে কোনো সফলতা নেই। আজীবন মরীচিকার পিছে দৌড়ে অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলে জীবনে শান্তি দূরে থাক, মরণে এতটু স্বস্তিও পাওয়া যাবে না। সুতরাং স্রষ্টাকে যে ভালোবাসে না, ভক্তি করে না তার চেয়ে বড় অধম পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না। বস্তুবাদ আর নাস্তিক্যবাদে কোনো গন্তব্য নেই।

‘আনাল হক’ ঘোষণা করে মনসুর প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলো বিশেষ। কিন্তু, কে জানে, হয়তো তাঁরই রূপ ধরে বিধাতা স্বয়ং ‘আনাল হক’ বলতে এল ভুবনে। কারও দর্শনের জ্ঞান দেখে আমরা বিস্মিত হই, কারওবা দেখার পাগলামি দেখে বিরক্তি; কিন্তু, কারও অন্তরের ভেদ কেউই আমরা জানতে পারি না বা দেখি না—হয়তো দর্শনে রয়েছে অযুক্তি এবং পাগলামিতে রয়েছে হকিকত।

জানি বিধি এক, বিধান এক ও কোরান-হাদিস নবিরাসুল এক; তবে সেই এককের বণ্টনে বায়াত্তর বা তিয়াত্তর ফেরকার ফন্দি এঁটে ইসলামকে দূষিত করছি মুসলিম আমরা! আমাদের দিনদুনিয়া হতে পারে উজালা? আমরা যে যেটাই করি, মনে করি আমার আমি ঠিক—বাদবাকিরা ভুল। আফসোস এই জাতির জন্যে। আফসোস এমন মনের মানুষের জন্যে। আফসোস! আফসোস!

“ভেস্তদোজখ বুঝি না আমি—

চিনি না হাশরের ময়দান

আমার মধ্যেই রয়েছে সবই—

আমাতে ভেস্তদোজখের স্থান।

আমায় করাও না প্রভু

একূলে এমন কিছু

যার জন্যে ওকূলে রয় না মান”

জানা, জানা এবং জানা। জানার কোনো শেষ নেই। আমি যতই জানছি ততই নিজেকে মনে হচ্ছে অজ্ঞ। অকূল সমুদ্রে সাঁতারে যেমন কূল পাওয়া যায় না, তেমনি জানার সমুদ্রে কোনো কূল নেই। তবু যদ্দূর পারা যায় অজানাকে জানা খুব দরকার। গুণী না হই, জ্ঞানার্জন করতে হবে। অন্ধকারে জন্ম হওয়া যায় তবে অন্ধকারে জীবন কাটা যায় না। বোকার সঙ্গে বাস করলে জ্ঞানের পরিধি লোপ পায়। হিংস্রতা আর জঘন্যতায় কোনো প্রসন্নতা নেই। কৃপণতাও মলিনতা। হিংস্রতা আর কৃপণতাকে আল্লাহও পছন্দ করেন না। অজ্ঞতা খোদার সৃষ্টি নয়—মানুষের। স্রষ্টা জ্ঞানী কিন্তু সমস্ত সৃষ্টিকে জ্ঞান অর্জন করার ক্ষমতা দিয়েছেন।

জ্ঞানোপার্জন একজন মানুষের মুখ্যবিষয় হওয়া প্রয়োজন। শুধু আরাধনা করলেই যে আরাধকের সান্নিধ্য পাওয়া যায়—কে বলে? যথার্থ বন্দেগিতে একটা জিন্দেগি আছে ঠিক তবে আজকাল যথার্থ বন্দেগি—কল্পনা করা কঠিন। সুন্দর কাপড় পরে ভালো মানুষ সেজে ধোঁকা দিচ্ছে অনেক। শয়তান আর ফেরেশতাকে চিনা আজ বড়ই কঠিন। তবে স্রষ্টাকে চিনার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। স্রষ্টা আছে আর সকল প্রাণসৃষ্টির মধ্যেই আছে এবং থাকে। হতে পারে এটাই স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ এবং এটাই হতে পারে আপনার আমার আমাদের প্রাণ বা প্রাণশক্তি।

অন্ধকার প্রাসাদে জীবন কাটার চেয়ে আলোর কুঠিরের পলেকবাস শ্রেয়। অন্ধকার জীবনের চারপাশে বেদনার পাহাড়। ক্ষুদ্র আত্মা ও মৃত জীবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অহংকারী রাজা আর কৃপণ ধনীর সম্পর্ক বড়ই ঠুনকো। ধনের চেয়ে মনের মালিক বড়। আভিজাত্য ও গাড়িবাড়ি আর অঢেল ধনসম্পদের মালিক তো আমরা অনেকেই হই তবে মনের মালিক খুব কম জনই হই। ধনের মালিকের চেয়ে মনের মালিক হওয়া নিতান্ত দরকার। কারণ, ধন দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় না, যা মন দিয়ে করা যায়। ধন সকলকে সুখ দিতে পারে ঠিক তবে শান্তি দিতে পারে না। সুখ আর শান্তি এক নয়। অতএব, মনের মালিক হতে পারলেই প্রকৃত ধনী। বিধানের কাছে ধনসম্পদের মূল্য থাকতে পারে তবে বিধির কাছে কোনো মূল্য নেই, মূল্য মাত্র মনের। কাজেই ধনবানের চেয়ে হৃদয়বান হওয়া খুববেশি জরুরি তবেই খোদার মকবুল বান্দা বা উৎকৃষ্ট মানুষ অথবা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

সৃষ্টিকে উত্তমরূপে জানতে পারলে স্রষ্টাকে জানা সহজ। অনুমানে পথচলা যায় তবে গন্তব্য মিলা বড় কঠিন। পরিষ্কার কাপড় পরলে কেউ ভালো মানুষ হয় না। সারা দিন সারা রাত অন্যকে ঠকানোর মালা জপে সফল হওয়া ভুল। অন্যের সমালোচনায় ও অনিষ্টের সাধনায় কপাল কালো করলে এবাদতি হওয়া যায় না। পরহেজগারদের আগের কাতারে সামিল হতে হলে ভালো মানুষের চেয়ে ভালো কর্ম করা দরকার। আমি পেটপুরে খেলাম এবং আরামে তেতলায় ঘুমালাম আর সময়ে সময়ে দৌড়লাম এবাদতখানায়! মনে করছি, আমার চেয়ে আল্লাহর খাঁটি বান্দা পৃথিবীতে আর কেউ নেই!

আমার ঘরের পাশে কেউ দিন কাটছে উপোস—রোগেশোকে কষ্ট পাচ্ছে কত—ভুলেও দেখছি না একবার—আমি খাঁটি বান্দা আল্লাহর! বলা যায়, এবাদতের চেয়ে উত্তম কোনো পন্থা বা কর্ম নেই। হাঁ, এবাদতই একমাত্র কাজ। তবে, শুধু এবাদত করলেই যে কেউ আল্লাহর খাস বান্দা হওয়া যায় যুক্তি কী? ঐকান্তিক বাসনা ছাড়া যেমন সাধনা পূর্ণ হয় না তদ্রূপ ঔদার্যকর্ম ছাড়া স্রষ্টার নৈকট্য লাভ বা আশা করা যায় না। নবি বলেছেন ‘সমস্ত এবাদতের মূলে রয়েছে প্রেম’

‘সাধনায় মিলে ঈশ্বর আরাধনায় ফল’ সকল আরাধনায় যে ফল মিলে এমন কথা বলা মুশকিল। কিছু কিছু এবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে অনেক প্রকারের এবাদত—শান্তি, সত্য, সততা, সুন্দর, লালিত্য, নমনীয় ও মহত্ত্ব ইত্যাদি—এরকম বিশেষকিছু গুণবাচক শব্দে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই মনে হয় শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা যেতে পারে। তবে, যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না সে মানুষ তো হয় কিন্তু—হয়তো আল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে পারে না।

এবাদতি আর খাঁটি আলাদা জিনিস। ‘শহিদের রক্তের চেয়ে বিদ্বানের কলমের কালি পবিত্র’ ‘মূর্খের এবাদতের চেয়ে জ্ঞানীর নিদ্রা উত্তম’ জ্ঞান থাকলেও আবার সকলে জ্ঞানী নয়। অমন জ্ঞানী হতে হলে কঠোর তপস্যার দরকার। সেই ভুলের ঊর্ধ্বে তপস্বী আজকের দুনিয়ায় শুধু মিলা বড় দায়ই নয়, কল্পনা করাও একেবারে ভুল। ভুলের প্রায়শ্চিত্তে মানুষের পৃথিবীতে আগমন। সুতরাং ভুলত্রুটি মানুষের হবেই তবে ভুল বুঝে ওঠাই আসল। মানুষ ভুল করবেই তাই বলে তাকে পরিহাস করা বা অযোগ্য ভাবাও ঠিক না। কেউ রূপেগুণে বিশ্রী হলে যে তার মনমানসিক কদর্য এমন ভাবা অযৌক্তিক।

মানুষ সুন্দর কেবল রূপের গুণে নয়, সুন্দর করণীয় যার কাম্য সে-ই একমাত্র সুশ্রী মানব। স্রষ্টা এ বলে মনুষ্য সৃষ্টি করেননি যে, তারা সব সময় হিংসানিন্দায় আর কুৎসাকীর্তনে লিপ্ত থাকুক। এ বলে সৃষ্টি করেন যে, সকল জড়তা ও অসুন্দরকে ভেঙেচুরে সুন্দর করণে হোক মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সাধনা। ভালোমন্দ মানুষের মনে বরং মানুষ চাইলে তৎক্ষণাৎ শয়তানে পরিণত হতে পারে, চাইলে আবার পলকে ফেরেশতা বনে যেতে পারে। অতএব কয়দিনের জিন্দেগি বা জীবন, যেভাবে আসা সেভাবেই তো যাওয়া। দুই হাত তো সব সময়ই খালি। কাজেই কু-মনোভাব ভুলে সুন্দর ও মঙ্গলের প্রার্থনায় ব্রতী হতে পারলেই সার্থক জীব ও জিন্দেগি।