বুড়িমা ও দাদাদের গল্প

যুবক অনার্য :

সেবার দাঙ্গা বেধে গেলো খুব।আমি তখন ষোড়শী। আমরা থাকতাম হিন্দু পাড়ায়।আশেপাশের অধিকাংশই মুসলমান পাড়া।আমি দেখতে ছিলাম যাকে বলে অপরূপা সুন্দরী। আমাদের পাড়ার দাদারা তো বটেই, মুসলমান পাড়ার দাদারাও আমাকে আদর করতো খুব।দেখা হলেই হাসি দিয়ে বোলতো – কেমন আছিস রে বুড়ি।তারপর কোলে করে নিয়ে মোড়ের দোকান থেকে কতো কিছু যে কিনে দিতো! দুর্গাপূজার সময়ও মুসলমান দাদারা আমাদের বাড়িতে আসতো পূজা দেখতে।আমাদের বাড়ির দুর্গা মা- ই নাকি সারাটা মহকুমায় সবচেয়ে সুন্দর হতো। যেমন চোখ তেমন নাক তেমন গ্রীবা – কী যে স্বর্গীয়….।

যা বলছিলাম- দাঙ্গা তো বেধেই গেলো।হিন্দু মুসলমান তুমুল মারামারি! কিছুদিন আগেই যারা একই দোকানে একসঙ্গে বসে চা খেতো আজ তারাই দাউ লাঠি চাপাতি নিয়ে শুরু করেছে খুন খারাবি!
এরই মধ্যে মুসলমান পাড়ার কয়েকজন দাদার সঙ্গে আমার দেখা।বলল: চল রে বুড়ি একটু বেরিয়ে আসি। বললাম: কোথায়?
: তুই তো আগে এভাবে প্রশ্ন করতিস না! আজ করছিস যে?
: না,মানে চারদিকে তো শুধু মারামারি! দিনকাল খুব সুবিধের নয় গো।
: আমাদের বুড়ি দেখি সত্যিই পেকে গেছে! চল চল,তোর দাদারা থাকতে ভয় কী! কোন শালা কী করবে,একদম পেড়ে ফেলবো,দেখিস।
অগত্যা আমাকে যেতেই হলো যদিও সেদিন যেতে কেনো যেনো আমার মন টানছিলো না।

দাদাদের সঙ্গে হেঁটে চলেছি।কোথায় যাচ্ছি তাও বলছে না।হাঁটতে হাঁটতে একদম নির্জন একটা চকের ধারে- চারদিক জনশূন্য যেন এক বিরামহীন আর বুকঝিম নৈঃশব্দ্য!- নিস্তব্ধতার কুয়াশা ছেয়ে আছে সমস্ত এলাকা জুড়ে।
হঠাৎ এক দাদা আমাকে পাঁজা কোল করে তুলেই মাটিতে শুইয়ে দিলো।আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না – ওরকম করবার মানে কী! যে দাদারা সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাকে এতো ভালোবাসে,তাদের মাথায় কোনো গোলমাল হলো নাকি! না তো – একদমই গোলমাল নয়।যা বুঝার আমি বুঝে গেলাম অচিরেই।ওরা কাজ সেরে চলে যাবার পর রক্তমাখা শায়া নিয়ে অনেক কষ্ট করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে সেদিন বাড়িতে ফিরতে পেরেছিলাম।বুঝলাম- একেই বুঝি বলে দাঙ্গা যখন দাদারা আর দাদা নয়,হয়ে ওঠে হিংস্র আর ধর্মীয় জানোয়ার!

আজ এই বুড়ো বয়সে এসেও নির্ভুল বুঝতে পারি- প্রাচীন পৃথিবীটা বদলে যায় নি কিছুতেই।এখনো দাঙ্গা বেধে গেলে- ভিন্ন ধর্মের হলেই হলো- দাদারা ঠিক ঠিক তুলে নিয়ে যাবে নির্জন কোনো বিরানায়।আর তারপর রক্তমাখা শায়া খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়িতে ফেরা কিংবা ফিরতে না পারা।

এবং বুঝতে পারি – যদি আমি
মুসলমান পাড়ায় থাকতাম আর আশেপাশে থাকতো হিন্দু পাড়া,সেইসব দাদারাও আমাকে নিয়ে যেতো বিরানায় আর তারপর পাঁজা কোল রক্তাক্ত শায়া খুড়িয়ে হাঁটা, ফিরতে এবং ফিরতে না পারা।এর ব্যতিক্রম হতো না কিছুতেই।

এই তো আমাদের চিরায়ত পৃথিবী যেখানে শুধু ধর্মই আছে- দাদা বোন বা মানুষ বোলে কিছুই নেই!