মান্তু’র কবি হয়ে ওঠা এবং অতঃপর

যুবক অনার্য :

সেই ছেলেটি আমার কাছে এসেছিলো গ্রাম থেকে- আলাভোলা রকমের ভলো মানুষ।সে কবি হতে চায়।আর্থিক সংকট , তাই বই কেনা সম্ভব নয়।আমার সংগে একই মেসে থাকে।

আমার যৎসামান্য যা বই ছিলো ওর পড়া শেষ হয়ে গেছে।আমি কিছু বই বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে ওকে পড়তে দিয়েছি।তবে ওর পড়ার তৃষ্ণা ব্যাপক।সে আরো আরো আরো পড়তে চায়।পড়তে পড়তে জন মিলটন হোরহে লুই বোরহেসের মতো অন্ধ হয়ে যেতে চায়! কিন্তু এতো বই পাই কোথায়!একদিন ওকে পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়ে গেলাম।

খুশিতে ওর চোখ চকচক করছে।সে লাইব্রেরিতে ব্যাপক পড়ে ফেল্লো।সাধারণত যা হয় ওর বেলাতেও ব্যতিক্রম ঘটেনি।প্রথমে রবীন্দ্র নজরুল প্রভাবিত হয়ে জীবন বাবুতে এসে ঠেকে। জীবন বাবু এমনই এক প্রভাবশালী কবি যে তার এ প্রভাব যেনো অবশ্যম্ভাবী।

আমি ওকে একটু একটু করে বুঝিয়ে দিলাম তোমাকে উনাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে নিজস্ব কিংবা স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর সৃষ্টি করতে হবে।সে চেষ্টা করে অনেকটাই সফল হল।হাংরি জেনারশন আর সুবিমলমিশ্র পড়ে সে কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে উঠতে চাইলো প্রতিষ্ঠানবিরোধী। দৈনিকের পাতায় লেখা দেয়া বন্ধ করে দিলো।বেশ তো।আমি সায় দিলাম।কিন্তু মুশকিল হলো অন্য জায়গায়।

এক সময় তাকে দেখলাম– বাংলাদেশ নিয়ে খুব চিন্তিত।এদেশের সব কিছুতেই সে দেখতে পাচ্ছে তুমুল অসঙ্গতি আর এ অসঙ্গতি সে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।সে এসব নিয়ে সরাসরি লিখতে চায় মানে তার লেখায় সে সরাসরি সবকিছু খুলেমেলে তুলে ধরতে চায়।

আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি- আপাতত বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে কিছু লিখো না।এসব না লিখেও প্রতিবাদের অন্যরকমের ভাষাও আছে।আমি তাকে নিকানোর পাররার “হুঁশিয়ার” কবিতার উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চাইলাম – যদি প্রতিবাদ করতেই হয় এরকম ভাবে লিখবার চেষ্টা করে দেখো।ইতোমধ্যে মনে হয় তার চোখ মুখ ফুটে উঠেছে। আমার উপর কিছুটা বিরক্তই, যেনো বা এরকম-” ধ্যাৎ , অবিনাশদা’ র মতো এরকম ভীতুর ডিম দিয়ে এ দেশের কিসসু হবে না।

চাই প্রতিবাদ মিটিং মিছিল সসস্ত্র সংগ্রাম আর ডাইরেক্ট অ্যাকশন – সেই সংগে হিংস্র আর প্রতিবাদী লেখা।”আমি বেশ বুঝে যাই এখন তার উপর আমার বিন্দুমাত্র প্রভাবও নেই।একদিন একটা কবিতা লিখে সে নিজেই আমাকে পড়ে শোনালো।দেখলাম তার কনফিডেন্স লেভেল খুব হাই।

বোল্লো – এবার বাজিমাত করে দেবো দাদা। আমার কাছে ওর এই অতি উচ্ছাস মোটেই নিরাপদ মনে হচ্ছিলো না।আমি কেবল বোল্লাম: যাই করো সেটা তোমার ব্যাপার, তুমি এখন আমার চাইতেও অনেক এডভান্স; তুমি অনেক ভালো জানো তোমার পড়াশোনাও আমার চাইতে ১০০০ হাজার গুণ বেশি।যা করবে একটু ভেবেচিন্তে কোরো- এর বেশি কিছু তোমাকে কিছুই বলার নেই।আমার কথা শেষ না হতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বোল্লো :দাদা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে,অনিমেষ ছবির হাটে অপেক্ষা করছে, আমাকে এখন উঠেত হবে।বোলেই সে ঝটপট চলে গেলো।আমার মনে হলো সে যেনো আমার কাছ থেকে কেটে পড়লো।ইদানিং আমার সান্নিধ্য সম্ভবত তার কাছে কিছুটা হলেও অর্থহীনভাবে সময়ের অপচয়!

সেই যে গেলো- সেদিনের পর সে আর মেসে ফিরে আসেনি।আমি এবং তার পরিবার অনেক খুঁজেও তার কোনো হদিস পেলাম না, এমনকি অনিমেষও কিছুই বোলতে পারলো না।

একদিন সকালে নাস্তা শেষ করে আদা চা খেতে খেতে আমার হঠাৎ মনে পড়লো -ওর কবিতায় একটা শব্দ ছিলো- ” রাণী মৌমাছি”।আমি ওকে অই শব্দটি কেটে বিকল্প কোনো শব্দ বসাতে বলেছিলাম।আমার কথা শুনে সে হো হো করে হেসে উঠেছিলো:”অবিনাশদা, তুমি মৃত্যুকে খুব ভয় পাও তাইনা?অথচ দ্যাখো এই আমি মানুষের মুক্তির জন্য নিবিড় করে বেড়াই মৃত্যুকে খুঁজে খুঁজে!” এরকম বোল্ড আউট টাইপের কথা যে সে আমার সংগেও বলতে পারবে -এটা আমি ধারণা করি নি।লজ্জায় আমি সেদিন কিছু বোলতে পারি নি।শুধু বোলেছিলাম- আমার তো কোনো ভাই নেই আমি তোমাকে আমার নিজের আপন ভাই মনে করি।সে বোলেছিলো:এটা আমি বুঝতে পারি অবিনশদা।তারপর সে( হয়তো আমাকে খুশি করার জন্য)বোল্লো : অবিনশদা, তুমি খুব ভালো মানুষ।আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে শুধু স্মিথ হেসেছিলাম।

চা পান করতে করতে আমার মনে হলো রাণী মৌমাছি যে কতো ভয়ংকর শব্দ এটা সম্ভবত সে বুঝতে পারেনি কিংবা পারলেও তার মধ্যে এক ধরনের বিপজ্জনক দ্রোহ কাজ করছিলো যা তাকে নাই হয়ে যাবার দিকেই ধাক্কা দিচ্ছিলো কিন্তু সে তা টের পায় নি ঘুণাক্ষরেও!

আমি মনে মনে বলি: মান্তু,সময়টা এখন রাণী মৌমাছির। তুমি হয়তো কবি হতে পেরেছো কিন্তু সময়টা ধরতে পারোনি।পরক্ষণেই মনে হলো-হয়তোবা সময়টা ধরতে চেয়েছিলো বোলেই মান্তু আজ নাই হয়ে গেছে।মান্তুরা নাই না হলে সময়টা চিরদিন থেকে যায়
রাণী মৌমাছিদের!