শ্রমচুরি করে ধনী হওয়া : ক্ষুদীরাম দাস

(মূল পাঠ : লেবীয় ১৩: ১৯ পদ ও যিরমিয় ২২: ১৩ পদ)
শ্রমচুরি হলো-কম মজুরিতে বেশি খাটিয়ে বাড়তি অর্থ সঞ্চয় করে যারা। এরাই তো শ্রমচোর। বড় বড় চুরির তালিকার শুরুতে থাকে শ্রমচুরি। কিন্তু এই চুরির জন্যে কোনো মামলা হয় না, বিচার হয় না, বা এবিষয়ে কেউ সেভাবে মাথাও ঘামায় না। মানুষের অজান্তে বা অজ্ঞাতেই শ্রমচুরি হয়ে থাকে। অবশ্য চুরি করে সে নিজেও বুঝতে পারে না বা যারা বুঝে তারাই বড় রকমের চুরি করতে পারে। শ্রমচুরির কারণেই কেউ কেউ সর্বহারা হয়েছে। তারা এসব চোরদের কারণে সর্বস্ব হারিয়ে হা-হুতাশ করছে। তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয় কারা?

গমাজের জমিদার, জোতদার, সমাজের সর্দারেরা। ওরাই তো কৌশলে সব কেড়ে নিয়ে সর্বহারা। করে দেয়। ফলে সমাজের ৩০% অংশ মানুষের কাছে সম্পদের ৭০% অংশ চলে গেছে। তারা ভোগ করছে দিনের পর দিন। আবার সমাজের ৭০% মানুষ মাত্র সম্পদের ৩০% অংশ ভোগ করছে। তারা ক্ষুধা দরিদ্রতায় দিনাতিপাত করছে। এভাবে যারা ধনী হয়ে বিলাসে জীবন কাটায়, তারাই সমাজশত্রæ। এদেরই বুর্জোয়া বলে থাকি আমরা। এসব বুর্জোয়া বা ধনপতিরা সমাজে অন্যায় কাজ করছে, তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না। অপরদিকে পাতি ব্ুের্জায়া হলো বুর্জোয়ার উচ্ছিষ্টভোজী শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা। ওরা ভোগ করছে সবকিছু। অন্যদিকে ক্ষুধার তাড়নায় দিনাতিপাত করছে গরীবের দল। তারা ‘জোটাবো অন্ন দুবেলা কী করে হায়’- বলে হা-হুতাশ করতে থাকে। ৭০% অংশ মানুষ অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, স্বাস্থ্য-শিক্ষা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছে না। তাদের দিন কাটে না, যদি তারা এসব না পায়। সমাজপতিরা ক্ষমতার স্বাদ পেলে তারা গদী ছাড়তে চায় না। গরীবরা তাদের কাছে অবহেলার দৃষ্টিতে থাকে। গরীবের শ্রমের প্রতি তাদের কুদৃষ্টি পড়লে গরীব আর রক্ষা পায় না। কৌশলে আদায় করে নেয়, আর লুটেপুটে খাবে। এতেও সে ক্ষান্ত হয় না। তার আরো চাই; অর্থের ভাÐার কব্জায় রেখে ভাÐারের পাহাড় গড়তে চায় শ্রমিকের শ্রম চুরি করে। ওরা চড়বে নিত্যনতুন গাড়িতে, আমজনতা দেখলে স্যালুট ঠুকে দেবে-আহা! সে কী ভালো মানুষ! তার মতো পরোপকারী আর কেউ হয় না! সমাজসেবক হয়ে মানুষের হৃদয়ে আসন করে নেয়। কাঁপিয়ে গলা চিরে উঁচু করে লেকচার দেবে। বোঝাবে-আমরা কারো কিছু চুরি করি না।

আমরা দেখবো, শ্রম সম্পর্কে পবিত্র বাইবেল আমাদের কী নির্দেশনা প্রদান করে। আদিপুস্তক ৫ অধ্যায় ২৯ পদে রয়েছে, ‘কেননা তিনি কহিলেন, সদাপ্রভু কর্তৃক অভিশপ্ত ভূমি হইতে আমাদের যে শ্রম ও হস্তের ক্লেশ হয়, তদ্বিষয়ে এ আমাদিগকে সান্ত¡না দিবে।’ অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকেই শ্রমের বিষয়টি আমাদের জীবনের সাথে জড়িত; শ্রম না করলে আমরা জীবনের ধারনের জন্যে খাবার পাবো না। যাত্রাপুস্তক ২০ অধ্যায় ৯ পদে সপ্তাহের মধ্যে ছয়দিন আমাদের কাজ করার কথা রয়েছে, ‘ছয় দিন শ্রম করিও, আপনার সমস্ত কার্য করিও;’ দ্বিতীয় বিবরণ ৫ অধ্যায় ১৩ পদে রয়েছে, ‘ছয় দিন শ্রম করিও, আপনার সমস্ত কার্য করিও;’ আমাদের জীবনে যদি আমরা শ্রমের মাধ্যমে কষ্ট পাই; তাহলে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলে আমরা তার দয়া পেতে পারি। তিনি আমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন। দ্বিতীয় বিবরণ ২৬ অধ্যায় ৭ পদে রয়েছে, ‘তাহাতে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর কাছে ক্রন্দন করিলাম; আর সদাপ্রভু আমাদের রব শুনিয়া আমাদের কষ্ট, শ্রম ও উপদ্রবের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।’ এমনও আশীর্বাদ আমরা পেতে পারি, তা হবে আমাদের জন্যে ঈশ্বরের দেয়া অনুগ্রহ। আমরা শ্রমের দ্বারা কষ্ট না করেও ফল পেতে পারি। যিহোশূয় ২৪ অধ্যায় ১৩ পদে রয়েছে, ‘আর তোমরা যে স্থানে শ্রম কর নাই, এমন এক দেশ, ও যাহার পত্তন কর নাই, এমন অনেক নগর আমি তোমাদিগকে দিলাম; তোমরা তথায় বাস করিতেছ; তোমরা যে দ্রাক্ষালতা ও জলপাইবৃক্ষ রোপণ কর নাই, তাহার ফল ভোগ করিতেছ।’

আমরা জানি যে, ক্ষুধা নির্বারনের জন্যে বর্তমানে মানুষজন কঠোর পরিশ্রমে সময় অতিবাহিত করে। কিন্তু সে অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য তারা পায় না। তাদের শ্রমের ফল মহাজন ভোগ করে। গীতসংহিতা ১০৪ অধ্যায় ২৩ পদে রয়েছে, ‘মনুষ্য আপন কার্য্যে বাহির হয়, আর সায়ংকাল পর্যন্ত শ্রম করে।’ সত্যিকারে যারা পরিশ্রম করে তারা ভালো ফল ভোগ করে। গীতসংহিতা ১২৮ অধ্যায় ২ পদে রয়েছে, ‘বাস্তবিক তুমি স্বহস্তের শ্রম-ফল ভোগ করিবে, তুমি ধন্য হইবে, ও তোমার মঙ্গল হইবে।’ কিন্তু বাস্তবিক শ্রমিকের প্রকৃত মজুরী অনেক সময় শ্রমিক পায় না, ভোগ করতে পারে না। তবে তারা ধার্মিক তারা মানুষকে ঠকায় না; ঠকাতে পারে না। হিতোপদেশ ১০ অধ্যায় ১৬ পদে রয়েছে, ‘ধার্মিকের শ্রম জীবনদায়ক, দুর্জনের উপস্বত্ব পাপজনক।’ আমরা সমাজে দেখতে পাই যে, দুর্জন ব্যক্তিরা মানুষকে দিনের পর দিন ঠকিয়ে শ্রমচুরি করে। তাদের উপস্বত্ব পাপজনক। কেননা তারা পাপ করে। আবার আমাদের সমাজে কিছু মানুষ রয়েছে যারা পরিশ্রম করতে পারে না; বা তারা পরিশ্রম করতে চায় না। হিতোপদেশ ২১ অধ্যায় ২৫ পদে রয়েছে, ‘অলসের অভিলাষ তাহাকে মৃত্যুসাৎ করে, কেননা তাহার হস্ত শ্রম করিতে অসম্মত।’ যিশাইয় ৪৭ অধ্যায় ১২ পদে রয়েছে, ‘যে বিবিধ ইন্দ্রজালে ও মায়াবিত্বের বাহুল্যে তুমি বাল্যকালাবধি শ্রম করিয়া আসিতেছ, এখন সেই সকল লইয়া দাঁড়াও; দেখি, যদি উপকার পাও, দেখি, যদি ভয় দেখাইতে পার।’ বাস্তবিক জীবনের উদাহরণ আমরা শ্রম থেকেও পেয়ে থাকি। যোনা ৪ অধ্যায় ১০ পদে রয়েছে, ‘সদাপ্রভু কহিলেন, তুমি এই এরÐ গাছের নিমিত্ত কোন শ্রম কর নাই, এবং এটা বাড়াও নাই; ইহা এক রাত্রিতে উৎপন্ন ও এক রাত্রিতে উচ্ছিন্ন হইল, তথাপি তুমি ইহার প্রতি দয়ার্দ্র হইয়াছ।’

জগতে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যাদের সম্পদের পরিমাণ পর্যাপ্ত। তবুুও তাদের আরো সম্পদ চাই-চাই। এ জন্যে তাদেরকে বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে মানুষ মানুষের শ্রমচুরি করে। ঠকিয়ে, জোরপূর্বক আদায় করে, অথবা কৌশলে আদায় করে, ওপেন সিক্রেটে দখল করে নিয়ে মানুষ আরো সম্পদ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে। সেটা করতে গিয়ে মানুষ পাপ কাজ করে। কিন্তু পিতা ঈশ্বর আমাদের জগতের ধনসম্পত্তির প্রতি আসক্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদের সান্ত¡না দিয়ে পথি ৬ অধ্যায় ২৬ পদে বলেছেন, ‘আকাশের পক্ষীদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর; তাহারা বুনেও না, কাটেও না, গোলাঘরে সঞ্চয়ও করে না, তথাপি তোমাদের স্বর্গীয় পিতা তাহাদিগকে আহার দিয়া থাকেন; তোমরা কি তাহাদের হইতে অধিক শ্রেষ্ঠ নও?’ অতএব, আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আমরা পিতা ঈশ্বরের কাছে অধিক শ্রেষ্ঠ! আবার মথি ৬ অধ্যায় ২৯ পদে রয়েছে, ‘সেই সকল শ্রম করে না, সূতাও কাটে না; তথাপি আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, শলোমনও আপনার সমস্ত প্রতাপে ইহার একটির ন্যায় সুসজ্জিত ছিলেন না।’ লূক ১২ অধ্যায় ২৭ পদে রয়েছে, ‘কানুড় পুষ্পের বিষয় বিবেচনা কর, সেইগুলি কেমন বাড়ে; সেই সকল কোন শ্রম করে না, সূতাও কাটে না, তথাপি আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, শলোমনও আপনার সমস্ত প্রতাপে ইহার একটির ন্যায় সুসজ্জিত ছিলেন না।’ যোহন ৪ অধ্যায় ৩৮ পদে রয়েছে, ‘আমি তোমাদিগকে এমন শস্য কাটিতে প্রেরণ করিলাম, যাহার জন্য তোমরা পরিশ্রম কর নাই; অন্যেরা পরিশ্রম করিয়াছে, এবং তোমরা তাহাদের শ্রম-ক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছ।’ আমরা অনেক পিতা ঈশ্বরকে ভুলে যাই ও জগতের দিকে মনোনিবেশ করে আসক্তি হয়ে পড়ি। আমরা সুখী হওয়ার জন্যে ও আরো সম্পদক বাড়িয়ে আরাম-আয়েসের জন্যে দৌড়াতে থাকি। কিন্তু পবিত্র শাস্ত্রে যোহন ৬ অধ্যায় ২৭ পদে রয়েছে, ‘নশ্বর ভক্ষ্যের নিমিত্ত শ্রম করিও না, কিন্তু সেই ভক্ষ্যের জন্য শ্রম কর, যাহা অনন্ত জীবন পর্যন্ত থাকে, যাহা মনুষ্যপুত্র তোমাদিগকে দিবেন, কেননা পিতা ঈশ্বর- তাঁহাকেই মুদ্রাঙ্কিত করিয়াছেন।’ কিন্তু হায়! আমরা ঈশ্বরের বাক্যের অর্থ অনেক সময় বুঝি না। কিন্তু যে যেমন কর্ম করবে; সে তেমনই ফল পাবে। ১ করিন্থীয় ৩ অধ্যায় ৮ পদে রয়েছে, ‘আর রোপক ও সেচক উভয়েই এক, এবং যাহার যেরূপ নিজের শ্রম, সে তদ্রূপ নিজের বেতন পাইবে।’ প্রকাশিত বাক্য ১৪ অধ্যায় ১৩ পদে রয়েছে, ‘পরে আমি স্বর্গ হইতে এই বাণী শুনিলাম, তুমি লিখ, ধন্য সেই মৃতেরা যাহারা এখন অবধি প্রভুতে মরে, হাঁ, আত্মা কহিতেছেন, তাহারা আপন আপন শ্রম হইতে বিশ্রাম পাইবে; কারণ তাহাদের কার্য সকল তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে।’

‘অধিকার’ বলে একটা কথা আছে। যে অধিকার প্রত্যাশায় আমরা পরিশ্রম করি, সেই অধিকার অনেক সময় আমাদের অর্জিত হয় না। আমরা জানি, ভোগ করতে হলেই শ্রম প্রয়োগ করতেই হবে। সেটা না করলে ভোগ করা যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে কেউ কেউ রয়েছেন শ্রম প্রয়োগ না করেই অন্যের শ্রমচুরি করে বড় বনে গেছে। তাহলে এটাই বা কেমন ভোগ করা! শ্রমমূর্তনার মাধ্যমে তাতে শ্রমমূল আসে। কিন্তু এই মূল্যের অধিকার নিয়েই শুরু হয় সংগ্রাম। তবে সেই সংগ্রামের জন্যে যে মানবতার জেগে উঠা উচিত সেটা আর হয়ে উঠে না। কেননা শ্রমচুরি করে দখলদারিত্বের চোরাই শেকড় বসিয়ে রেখেছে সমাজসেবকবেশী সমাজপতিরা। মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করে নিজের ঘরে নিজেই সিঁধকাটা। ওরা মানবতার উপর দাপট ও চিকন দাপট চালাতেই থাকে আমৃত্যু। ওদের নানান অপকর্ম আলোচনায় আসে না। অথবা আসলেও কেউ এসব নিয়ে ভাবে না বা সাহসও পায় না। অথচ সমাজে ওরাই অত্যাচার করে, খবরদারি করে ও অশান্তি ঘটায়। কোনো কোনো মানুষ জন্ম থেকেই আত্মকেন্দ্রিক, জড়াকাঙ্খী ও স্বার্থপর। সুতরাং ওরা তো দুর্বলের শ্রমচুরি করবেই। ওরা তখন ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে। অপরদিকে দরিদ্রদের জীবনে না থাকে ছন্দ, না ওঠে সুর। জীবন সেখানে বড়ই জ্বালাময়। দরিদ্রদের ঘরে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’; আর ধনীদের অতি বিলাসিতায় আত্মহারা হয়ে যায়। অপরদিকে দরিদ্রদের জীবন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। পরিস্থিতি যেভাবে চালায়, মানুষও সেভাবে চলে। এভাবেই জীবনের সহজ-সরল পথটা এঁকেবেঁকে ঘূর্ণির পাকে আবর্তিত হতে হতে ইন্দ্রিয়গুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যে ক্লান্তিতে মানুষ তখন বলে, সবই তো ¯্রষ্টার ইচ্ছা। তিনি যেমন চালাচ্ছেন, তেমন চলছি- এই ধরনের অলৌকিক ধারণার অন্ধকারের গহŸরে নিজেকে নিমজ্জিত করে। যে মূল্য মানুষ তথা শ্রমিক ভোগ করবে মানে তার প্রয়োজনীয় চাহিদার পূরণ ঘটাবে; সেটা আর হয় না; বরং জীবন ভোগান্তিতেই কেটে যায়।

এই যে আমরা ‘মে দিবস‘ পালন করি, বছর ঘুরে ফিরে আসা খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন সার্থকতার দিন তো শ্রমিকরা টেরই পায় না। ওই দিন সরকারি ছুটি থাকে বলেই শ্রমের ক্লান্তি দূর করতে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা বউ বাচ্চা নিয়ে একটু ঘুরতে টুরতে বেরোয়। পয়লা বৈশাখের মত পান্তা ইলিশের জবজবানি নেই। ভ্যালেন্টাইন দিবসের মত রংচঙা কাপড় চোপড় পরে একে অপরকে খামোখা ভালোবাসার ছেনালি দেখাবার সুযোগও নেই বা তাদের সেই সামর্থও নেই। তাই ওদের ক্লান্তি দূর করতে ঘুরে আসার আনন্দে সবই ভুলে যায়। অথবা কেউ কেউ খুব সকালে মাথায় লাল পট্টি বেঁধে বিনা ভাড়ার বাসে-ট্রাকে মিছিল করে হৈহুল্লোড় করবে। নেতা-নেত্রীরা এখানে-ওখানে ভাষণ দিলে তা‘ বুঝে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে আসবে। অন্যদিকে সমাজপতিরা আরোপিত শ্রমিক দরদি কাসুন্দি বেটে দর্শককে খাওয়ানোতে সময় পার করবে। পত্রিকাওলারা প্রথম পাতার কোণায় এক ইট ভাঙ্গা শ্রমিকের বা নারী শ্রমিকের ছবি ছেপে ক্যাপশন লিখবে ‘আজ ঐতিহাসিক মে দিবস’! এ পর্যন্তই। রাতটা ফুরোলেই ঐ মহান মে দিবসের সমাপ্তি টানা হবে।

আরেকটু বলতে চাই, যে শিশুশ্রমিক গাধার খাটনি খেটে চলেছে সারাটি রাত; এবং খুব ভোরে উঠে যার দিন শুরু হয় শ্রম দিকে দিতে-তার জন্যে আট ঘণ্টার মহান মে দিবস নেই বললেই। অথবা সে জানেও না আট ঘণ্টা মানে কত ঘণ্টা? ট্যানারির নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যাওয়া গন্ধময় পরিবেশে যে শ্রমিকরা কাজ করছে, তাদের সাথে যে শিশু শ্রমিকরা নোংরা ময়লা ঘেটে জীবনের সুকুমার শৈশবকে মাটি চাপা দিচ্ছে, বয়লারের পাশে গনগনে আগুনের পাশে দাঁড়ানো যে শ্রমিকটির মুখ সারাক্ষণই লাল হয়ে জ্বলছে, শহরের বাইরে মায়ের সাথে ইট ভাঙ্গছে যে কচি শিশুটি তার কাছেও মে দিবস কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সে জানে তার হাতে ধরা হাতুড়ি একটু বেসামাল হলেই আর এক হাতে পড়বে! চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবে। সুতরাং সেই বা কেমন করে মে দিবসের অর্থ বুঝবে! সমাজপতি সাহেবদের বাজার মাথায় নিয়ে বাড়ি পৌছে দেয়া শত শত কচি ছেলেমেয়েগুলো সেই কাকডাকা ভোরে উঠে বাজারে আসে। ওরা ওখানেই খায়, ওখানেই ঘুমায়। ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করে তাদের কারো হাতে গøাভস নেই। হরেক রকম জটিল রাসায়নিকে ভিজে তাদের হাতগুলো থ্যাকথেকে সাদা সাদা হয়ে আছে। সেই দগদগে ঘা কখনোই শুকোয় না। ঝাল মরিচে রান্না তরকারি দিয়ে ভাত খেতে গেলেই অন্তরাত্মা পর্যন্ত জ্বলে উঠে। চোখের পানি গাল বেয়ে ঠোঁটের কোণা দিয়ে মুখে চলে যায়। ওভাবেই দিন শুরু আর দিন শেষ! বড় কষ্ট লাগে, বোঝাই রিক্সা ঠেলে ঠেলে ব্রিজ পার করা যেসব শিশুদের নিত্যদিনের কাজ; সেখানে আট ঘণ্টা নামক কোনো ব্যাপার নেই। আবার শহরে শ্যেন দৃষ্টি মেলে আরো হাজার হাজার শিশুর দিন শুরু হয়-তারা কাগজ কুড়োয়। অথবা এক হাতে পলিথিনের বস্তা; আর এক হাতে ক্রমাগত কাগজ কুড়িয়ে চলে। ওদেরও শ্রম দিবস মানে বার থেকে ষোল ঘণ্টা। ঠিক কতো লাখ শ্রমিক, কতো লাখ অপ্রাপ্ত বয়সের শিশু শ্রমিক তার কোনো হিসেবে কারো কাছেই নেই। এভাবে কতো হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম শোষণের শিকার তার কোনো হিসেব নেই। এদের কেউ তার কর্ম জীবনে আট ঘণ্টা বলে যে একটা শব্দ আছে সেটাই জানে না, বোঝেনি, তাদের জানতে বা বুঝতে দেয়া হয়নি। তারা শুধু জানে, পরিশ্রম না করলে পেটে ভাত জুটবে না। আট ঘণ্টা এখানে বিষয় নয়; এখানে বিষয় হলো- বেশি কাজ করতে পারলে একটু ভালোভাবে চলা যায়। আমাদের বুদ্ধিজীবী বা সৃজনশীল সমাজও শ্রমচুরির বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে অথবা লিখতে লিখতে অথবা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। শ্রম শোষণ বা শ্রমচুরির মতো অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়ে নেতা-খ্যাতা বা ছোট-বড় হেন-ত্যান দল ও বুদ্ধিব্যাপারিদের কোনো মানবিক চিন্তা নেই। সুতরাং কোটি কোটি গতরখাটা শ্রমিকের সিংহভাগই শ্রমচুরির শিকারে পরিণতিতে রয়েছে। আজো অজ পাড়াগাঁ থেকে শুরু করে এই তিলোত্তমা শহরেও বেশুমার সেই শ্রম শোষণ আর শ্রমচুরি চলছে। শ্রমচুরির সাথে জড়িত সরাসরি দুষ্ট বিত্তবান, দুষ্ট মধ্যবিত্ত এবং দুষ্ট ক্ষুদে বিত্তের মালিকগণ।

শিশুশ্রমকিদের খাটানো নাকি আরো সহজ। তাদেরকে ঠকানোও যায়। সুতরাং তারাও শ্রমচুরির শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। দুষ্ট সামন্ত প্রভুদের জুতো মোজা খুলে দেয়ার জন্যে, পানি এনে দেয়ার জন্যে, মাথায় ছাতা ধরার জন্যে, ভেতর বাড়ি থেকে পান-সুপারি এনে দেয়ার জন্যে একটা ‘পিচ্চির’ দরকার হয়। আর সামন্তপ্রভুর কাছে শ্রমের বিনিময় মূল্য স্রেফ পেটেভাতে! পেট পুরে ভাত দেয়া হয়, এটাই সামন্তবাদের মহান বদান্যতা! শ্রমচুরির আরেকটি কৌশল যে, চামচারা এক গাল হেসে উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘স্যার ও দেখতে ছোট, কিন্তু লইতে পারে’। অথচ সেই ১৮৮৬ সালের পয়লা মে শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকদের জীবনের মূল্যে যে আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি তা’ আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাস্তবায়ন হয়নি। এই একশ পনের বছর পৃথিবী তার কক্ষপথে নিয়ম করে ঘুরেছে। এখনো শ্রমিককে তার সেই আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়। আট ঘণ্টার বদলে দশ ঘণ্টা এমনকি বার ঘণ্টা কাজ করিয়ে সেই আট ঘণ্টার হিসেবেই মজুরি দেয়া হয়। এটা কি শ্রমচুরি নয়! তবুও এই একটি দিনেই যেন সারা বিশ্বের শ্রমিক তার মুক্তির দিন মনে করে ক্ষণিকের উল্লাস করে। আসলেই কি শ্রমিকের মুক্তি ঘটেছে? শ্রমিক কি তার প্রাপ্য মজুরি পেয়েছে, বা পাচ্ছে? বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা নয়, এই বাংলাদেশে কি শ্রমিক আজও তার ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে? না, পাচ্ছে না। মোট কথা হলো, সেই হতভাগা শ্রমিকরা কাজ করে তারা নির্ভেজাল দাস। সেই দাসদের যতদিন সম্ভব শ্রম শুষে নিতে হবে। যখন তার শ্রম সসীম হয়ে যাবে, অর্থাৎ তাকে দিয়ে আর আগের মত গাধার খাটনি খাটানো যাবে না তখন তাকে বা সেই শ্রমিক গোষ্ঠিকে ছাঁটাই করা হবে।

দুর্বল অসহায়দের শ্রমচুরির কারণে তারা দিনের পর দিন বিভিন্ন রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মালিকদের শ্রমচুরি ও কম মজুরী প্রদানের ফলে শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়। এর ফলে তাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে পারিবারিক চাহিদা পূরণের অভাবে পারিবারিক সহিংসতা, সামাজিক দ্ব›দ্ব ও অস্থিরতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ক্ষুধা নির্বারণ করতে পারে না; এমনকি তারা স্বাভাবিক রোগেরও চিকিৎসা করাতে পারে না। পারিবারিক মৌলিক চাহিদাগুলো স্বপ্নেই থেকে যায়। অর্থাভাবে পারস্পরিক সম্পর্কে টানাপোড়েন, মানুষের প্রতি মানুষের উদাসীনতা ও অবহেলা বেড়েছে বহুগুণ। যার ফলে কোনো একটি পরিবারের সকল সদস্য কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে। অর্থাভাবে গরীব দেশগুলো তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। ক্ষুধা মোকাবেলায় লড়াই করে যায় দরিদ্র মানুষগুলো, ক্ষুধার তীব্র সঙ্কটের মধ্যে দিনযাপন করছে পৃথিবীর বহু মানুষ। মিডিয়াগুলো ৭০% গরীব মানুষের পিছনে ছুটে না। তাই আলোঝলমল প্রাসাদের পাশের বস্তিবাসী কিংবা কর্মহীন মানুষের খবর প্রতিদিন আমরা ক’জন-ই বা নিতে পারি? অসহায়, ভিক্ষুক, দরিদ্র রোগী, বেদনার্ত প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর নেয়ার সময় আমাদের নেই। শুধু ক্ষুধার কারণে মৃত্যুঝুঁকিতে লক্ষ মানুষ-এই কথাটি আধুনিক সভ্যতার ধ্বজাধারী বিলাসী মানুষদেরকে কি কোনো নির্মম পরিহাসের বার্তা শোনায় না? প্রশ্ন থেকেই যায় যে, কেনোই বা ৭০% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে এখনো! একদিকে শ্রমচুরি; অন্যদিকে ৩০% মানুষ অপচয় করেই চলেছে। দরিদ্রদের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে শ্রমচুরির মাধ্যমে। সেই সাথে শান্তি নষ্ট করা হচ্ছে; আর অপচয় করেই চলেছি আমরা। ধনীক শ্রেণীরা মে দিবসের অর্থ খুঁজতে যায় না। আর দরিদ্র শ্রমিকরা মে দিবস কী-জানেই না। ফলে তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা এখনো রয়েছে অন্ধকারে। তারা শুধু জানে মে দিবস মানে দল বেধেঁ মাথায় লাল কাপড় বেধেঁ গাড়ীর শ্রমিকদের মিছিল করা আর সংগঠকদের দেয়া নাস্তা খাওয়া। টানা ষোল ঘন্টা কাজ করতে হয় তাদের। মালিকপক্ষের খুব শ্রমচুরির চালাকি-তাদের নেই কোনো নিয়োগপত্র, নেই কোনো কর্মঘণ্টা, নেই কোনো সাপ্তাহিক ছুটি, নেই শ্রমিক রেজিস্টার, নেই ছুটির রেজিস্টার, নেই ছুটির বহি, নেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ, নেই কোনো নিয়মের বালাই। নিয়ম কিছু আছে-যা’ লোক দেখানো। একদিকে কৌশলে শ্রমচুরির মহোৎসব চলে; অন্যদিকে তাদের মুখ থেকে আক্ষেপ শোনা যায় যে, ‘এসব দিনের কথা ভেবে যদি আমাদের কাজ বন্ধ করে দেই, তবে আমাদের একদিনের আয় বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এসব দিবসগুলো নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা বরং এটা ভাবি যে, একবেলা কাজ করতে পারলে একবেলা খেতে পারবো।’ যেহেতু সেই ১৮৮৬ সালের পয়লা মে শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকদের জীবনের মূল্যে যে আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি তা’ আজো বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাস্তবায়ন হয়নি; সেহেতু শ্রমচুরি চলছে তো চলছেই। ‘আমরা কী করবো’-এই কথায় চিন্তা বা পদক্ষেপ শেষ করা হচ্ছে। শুধু দিবস পালনই যথেষ্ট; আর পৃথিবী তার কক্ষপথে নিয়ম করে যেমন ঘুরছে; তেমনি শ্রমিকদের ন্যায্যতার প্রশ্নেরও নিয়ম করে ঘুরে চলেছে। তাই হয়তো এখনো শ্রমিককে আট ঘণ্টার বদলে দশ ঘণ্টা এমনকি বার ঘণ্টা কাজ করিয়ে সেই আট ঘণ্টার হিসেবেই মজুরি দেয়া হয়। শুধুমাত্র শ্রমিক তার মুক্তির দিন মনে করে ক্ষণিকের উল্লাস করে মে দিবসে।

শ্রমিকের শ্রমকে সস্তা হিসেবেই পরিগণিত করা হচ্ছে। অনেক স্থানে অনেকটা পশুর মতো আর শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। মোড়ে মোড়ে চাঁদাবাজী, উৎকোচ গ্রহণ, ঘুষ, দুর্নীতি-এসবের মধ্যেও সূ²ভাবে শ্রমচুরির স্পষ্ট প্রমাণ মিলে। হায় হায়! শেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষ! শেষ হয়ে যাচ্ছে মানবতা! মানবতা ভূলুণ্ঠিত, বিবেক মৃত! হৃদয়ের মণিকোঠায় মানুষের প্রতি মানুষের দরদ-দয়া-মায়া-মমতা-ভালোবাসা বুঝি হারিয়ে গেছে। কী নিষ্ঠুর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মীদের খাবার জোগাড় করার মতো কোনো আয় নেই। তারা পুঁজি পাবে কোথায়? বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে কীভাবে? তাছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ ভালো নেই, নিরাপত্তারও অভাবে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত। শ্রম শোষণে শোষিত হচ্ছে অধিকাংশ অসহায় মানুষগুলো। শ্রমিককে কাজ সম্পাদন করামাত্রই তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের প্রধান দায়িত্ব। শ্রমিক-মজুরেরা নিজের ও পরিবারের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য কঠিন পরিশ্রম করে থাকেন। প্রাপ্য মজুরিই তাঁদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু যুগ যুগ ধরে শ্রমিকেরা ন্যায্য প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের কাজের সময় কমানো ও ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করতে গিয়েই তাঁরা নিগৃহীত হন। শুরু হয় শক্তির দাপটে তাঁদের ওপর মালিকপক্ষের জুলুম-নির্যাতন। অথচ শ্রমিকেরাই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মালিকের জন্য খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করেন, বাসস্থান নির্মাণ করেন। এমতাবস্থায় শ্রমিকেরা যদি ন্যায্য মজুরি না পান বা প্রয়োজন অপেক্ষা কম পান বা নির্দিষ্ট সময়মতো প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, তবে তাঁদের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। এতে হতাশায় ভারাক্রান্ত হয়ে কাজের প্রতি শ্রমিকদের বীতশ্রদ্ধা ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হতে পারে। সম্পদ ব্যবস্থাপনায় মালিকপক্ষ বা পুঁজিপতি তাঁর মূলধন খাটানোর কারণে এবং শ্রমিক তাঁর শ্রমের বিনিময়ে লাভের হকদার হয়ে থাকেন। মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজমান থাকলে এবং শ্রমিক তাঁর ন্যায্য পাওনা পেলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দেশ ও জাতি যেমন উপকৃত হয় তেমনি শান্তি স্থাপিত হয় সর্বত্র। সামর্থ্যের বাইরে শ্রমিকদের ওপর কাজের বোঝা চাপানো যাবে না এবং তাঁদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সদাচরণ করতে হবে। মজুরির পরিমাণ এমন হওয়া উচিত, যেন তা‘ কোনো দেশ ও যুগের স্বাভাবিক অবস্থা ও চাহিদা অনুসারে যুক্তিসঙ্গত হয় এবং উপার্জনকারী শ্রমিক তাঁর পারিশ্রমিক দ্বারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানবিক, মৌলিক অধিকার ও দৈনন্দিন জীবনধারণের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। শ্রমিকের কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা, পরিবেশ, চাহিদা, জীবনযাত্রা প্রভৃতি পর্যালোচনা করে মজুরি নির্ধারণ করা উচিত।

একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দ্রæত গতিতে বাড়ছে। একদিকে ধনীদের আয় বাড়ছে; অন্যদিকে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাপে রয়েছে। ধনী-গরীবের মধ্যকার এই ব্যবধান কমাতে না পারলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। একদিকে ৭০% অংশ মানুষের শ্রমচুরি; দরিদ্রতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়া পরিস্থিতি করুণ পর্যায়ে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যদি না ধনীরা দরিদ্রদের কিছু সহযোগিতা না করেন, তাহলে তা‘ আরো চরম পর্যায়ে চলে যাবে। এজন্যে আমরা মনে করতে পারি যে, প্রকৃতপক্ষে সমাজের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরাই এ বিষয়ে কার্যকর কিছু করার সামর্থ্য রাখে; আর তাদেরই এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। সম্প্রতি দেখা গেছে যে, ধনী ব্যক্তিদের জনহিতকর কাজগুলো নিয়ে সুনামের পরিবর্তে দুর্নামই বেশি রয়েছে; কেননা তা’ একান্তই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর তাদের এসব জনহিতকর কাজগুলো প্রকৃতপক্ষে বাস্তবিক সমস্যার সমাধান করো না।

যতগুলো কারণ রয়েছে, তার মধ্যে শ্রমচুরির কারণে ধনী-গরীবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বল অর্থনীতি থেকে দ্রæত টেকসই অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে-এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে সমস্যা হচ্ছে সম্পদের বন্টন যথেষ্ট স্বচ্ছ না হলে বৈষম্য অনেক উচ্চমাত্রায় চলে যাবে। শ্রমচুরির কারণে অবৈধ এবং অনৈতিক উপায় গ্রহণ করে ধনী হওয়ার প্রবণতা চলমান; যা’ বিপজ্জনক। আমরা সম্পদের বৈষম্য কমাতে চরমভাবে ব্যর্থ হই, সুতরাং কোনো অগ্রগতি টেকসই হবে না। দুঃখজনক বিষয় হলো, পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তারকারীরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে অপরাধমূলকভাবে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। যেখানে দরিদ্ররা বৈষম্যের মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে। যারা বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে তারা দুর্নীতি, অনিয়ম, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান ইত্যাদি উপায়ে করে থাকে। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ধরাছোয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাধা থাকলে বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বলে একটি কথা রয়েছে। এই যে, আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে আমাদের যেন বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছে। এর মূলে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী। আবার দেখুন, চলমান শিল্পায়নের ফলে দ্রæত কৃষি জমি কমে আসছে এবং কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। সুতরাং তারাও দরিদ্রতায় জীবনযাপন করছে। আর কৃষি জমির মালিকানা চলে যাচ্ছে সমাজের বিত্তবানদের হাতে। কৃষিকাজ পারিবারিকভাবে ছোট হয়ে আসছে।

রোমীয় ৬ অধ্যায় ২৩ পদে রয়েছে, ‘কেননা পাপের বেতন মৃত্যু; কিন্তু ঈশ্বরের অনুগ্রহ-দান আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্টেতে অনন্ত জীবন।‘ সুতরাং আমরা যদি শ্রমচুরি করি; অর্থাত অন্যেও প্রাপ্য না দিয়ে নিজেরা ভোগ করি; তাহলে আমাদের পাপ হবে। সত্যিরা এর মূল্য হিসেবে আমাদের আত্মীক মৃত্যু ঘটে। ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে আমরা দূরে সরে যাই। আমাদের অধার্মিকভাবে চলা উচিত নয়। ২ পিতর ২ অধ্যায় ১৫ পদে রয়েছে, ‘তাহারা সোজা পথ ত্যাগ করিয়া বিপথগামী হইয়াছে, বিয়োরের পুত্র বিলিয়মের পথানুগামী হইয়াছে; সেই ব্যক্তি ত অধার্মিকতার বেতন ভালবাসিত।’ অন্যকে ঠকানোর চেষ্টা করা আমাদের উচিত নয়। যার যতটুকু পাওনা তা’ প্রদান করা উচিত। আদিপুস্তক ২৯ অধ্যায় ১৫ পদে রয়েছে, ‘পরে লাবন যাকোবকে কহিলেন, তুমি কুটুম্ব বলিয়া কি বিনা বেতনে আমার দাস্যকর্ম করিবে? বল দেখি, কি বেতন লইবে?‘ আদিপুস্তক ৩০ অধ্যায় ২৮ পদে রয়েছে, ‘তিনি আরও কহিলেন, তোমার বেতন স্থির করিয়া আমাকে বল, আমি দিব।’ অন্যের পারিশ্রমিক বা বেতন আমাদের হরণ করা উচিত নয়। আদিপুস্তক ৩১ অধ্যায় ৭ পদে রয়েছে, ‘তথাপি তোমাদের পিতা আমাকে প্রবঞ্চনা করিয়া দশ বার আমার বেতন অন্যথা করিয়াছেন; কিন্তু ঈশ্বর তাঁহাকে আমার ক্ষতি করিতে দেন নাই।’ ৪১ পদে রয়েছে, ‘এই বিংশতি বৎসর আমি আপনার বাটীতে রহিয়াছি; আপনার দুই কন্যার জন্য চৌদ্দ বৎসর, ও আপনার পশুপালের জন্য ছয় বৎসর দাস্যবৃত্তি করিয়াছি; ইহার মধ্যে আপনি দশ বার আমার বেতন অন্যথা করিয়াছেন।’ কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করালে তার মূল্য দিতে বাধ্য থাকা উচিত। যাত্রাপুস্তক ২ অধ্যায় ৯ পদে রয়েছে, ‘ফরৌণের কন্যা তাঁহাকে কহিলেন, তুমি এই ছেলেটিকে লইয়া আমার জন্য দুগ্ধ পান করাও; আমি তোমাকে বেতন দিব। তাহাতে সেই স্ত্রী ছেলেটিকে লইয়া দুগ্ধ পান করাইতে লাগিলেন।’ অথবা শ্রমিকের মজুরী দিতে কোনো ক্রমেই দেরি করা উচিত নয়। লেবীয় ১৩ অধ্যায় ১৯ পদে রয়েছে, ‘তুমি আপন প্রতিবাসীর উপর অত্যাচার করিও না, এবং তাহার দ্রব্য অপহরণ করিও না। বেতনজীবীর বেতন প্রাতঃকাল পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি রাখিও না।’ অন্যের শ্রমচুরি করে বা জোরপূর্বক বা কৌশলে নিজের করে নিয়ে ভোগবিলাসে উচ্চ কুঠরি নির্মাণে বসবাস করলে সে ধিক্কারের পাত্র হবে। যিরমিয় ২২ অধ্যায় ১৩ পদে রয়েছে, ‘ধিক্ তাহাকে, যে অধর্ম দ্বারা আপন বাটী, ও অন্যায় দ্বারা আপন উচ্চ কুঠরি নির্মাণ করে, যে বিনা বেতনে আপন প্রতিবাসীকে খাটায়, এবং তাহার শ্রমের ফল তাহাকে দেয় না;’ যিহিস্কেল ২৯ অধ্যায় ১৮ পদে রয়েছে, ‘হে মনুষ্য-সন্তান, বাবিল-রাজ নবূখদ্নিৎসর আপন সৈন্যসামন্তকে সোরের বিরুদ্ধে ভারী পরিশ্রম করাইয়াছে; সকলের মস্তক টাকপড়া ও সকলের স্কন্ধ জীর্ণত্বক্ হইয়াছে; কিন্তু সোরের বিরুদ্ধে সে যে পরিশ্রম করিয়াছে, তাহার বেতন সে কিম্বা তাহার সৈন্য সোর হইতে পায় নাই।’ ২০ পদে রয়েছে, ‘সে যে পরিশ্রম করিয়াছে, তাহার বেতন বলিয়া আমি মিসর দেশ তাহাকে দিলাম, কেননা তাহারা আমারই জন্য কার্য করিয়াছে, ইহা প্রভু সদাপ্রভু বলেন।’ হগয় ১ অধ্যায় ৬ পদে রয়েছে, ‘তোমরা অনেক বীজ বপন করিয়াও অল্প সঞ্চয় করিতেছ, আহার করিয়াও তৃপ্ত হইতেছ না, পান করিয়াও আপ্যায়িত হইতেছ না, পরিচ্ছদ পরিয়াও উষ্ণ হইতেছ না, এবং বেতনজীবী লোক ছেঁড়া থলিতে বেতন রাখে।’ যারা অন্যের বেতন হরণ বা শ্রমচুরি করে ঈশ্বর তাদের বিচার করবেন। মালাখি ৩ অধ্যায় ৫ পদে রয়েছে, ‘আর আমি বিচার করিতে তোমাদের নিকটে আসিব; এবং মায়াবী, পারদারিক, ও মিথ্যাশপথকারিগণের বিরুদ্ধে, ও যাহারা বেতনের বিষয়ে বেতনজীবীর প্রতি, এবং বিধবা ও পিতৃহীন লোকের প্রতি, অত্যাচার করে, বিদেশীর প্রতি অন্যায় করে, ও আমাকে ভয় করে না, তাহাদের বিরুদ্ধে আমি সত্বর সাক্ষী হইব, ইহা বাহিনীগণের সদাপ্রভু কহেন।’ লূক ৩ অধ্যায় ১৪ পদে রয়েছে, ‘১৪ আর সৈনিকেরাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, আমাদেরই বা কি করিতে হইবে? তিনি তাহাদিগকে বলিলেন, কাহারও প্রতি দৌরাত্ম্য করিও না, অন্যায়পূর্বক কিছু আদায়ও করিও না, এবং তোমাদের বেতনে সন্তুষ্ট থাকিও।’ এখানে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে ও নিজের বেতনেই সন্তুষ্ট থাকতে উ’সাহিত করা হয়েছে। অন্যকে ঠকিয়ে নিজের অর্থের পাহাড় তৈরি করলে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। যোহন ৪ অধ্যায় ৩৬ পদে রয়েছে, ‘যে কাটে সে বেতন পায়, এবং অনন্ত জীবনের নিমিত্ত শস্য সংগ্রহ করে; যেন, যে বুনে ও যে কাটে, উভয়ে একত্রে আনন্দ করে।’