

বিনোদন প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের টেলিভিশন নাট্যজগতে রিচি সোলায়মান একটি অনন্য নাম। নব্বই দশকের শেষভাগে যাত্রা শুরু করে তিনি হয়ে উঠেছেন একাধিক প্রজন্মের দর্শকের প্রিয় মুখ। তার অভিনয়শৈলী, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্র নির্বাচনের বুদ্ধিমত্তা তাকে আলাদা করে তুলেছে। রিচির নাট্যজীবন শুধু অভিনয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে এক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, যেখানে তিনি নারীর আবেগ, সংগ্রাম, প্রেম, আত্মত্যাগ ও আত্মপ্রকাশকে তুলে ধরেছেন।

শুরুর গল্প
রিচি সোলায়মানের জন্ম নীলফামারীতে। তার বাবা এম এম সোলায়মান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও সৃজনশীল। ঢাকার সেন্ট জুডস্ টিউটোরিয়াল বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত শিল্পচেতনা তাকে টেনে নিয়ে যায় অভিনয়ের জগতে।
১৯৯৮ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ফারুক ভূঁইয়া প্রযোজিত ‘বেলা ও বেলা’ নাটকে টনি ডায়েসের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার নাট্যজীবনের সূচনা ঘটে। সেই নাটকেই দর্শকরা আবিষ্কার করেন এক নতুন মুখ, যার চোখে ছিল আবেগ, মুখে ছিল মিষ্টতা, আর অভিনয়ে ছিল সততা।
ধারাবাহিক ও একক নাটকে বিচরণ
রিচি সোলায়মান ৪০টিরও বেশি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেছেন এবং দেড় শতাধিক একক নাটকে তার উপস্থিতি দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। তার অভিনীত নাটকগুলোতে তিনি কখনো হয়েছেন প্রেমিকা, কখনো মা, কখনো সংগ্রামী নারী, আবার কখনো নিঃসঙ্গ আত্মা। প্রতিটি চরিত্রে তিনি নিজেকে ভেঙে গড়ে তুলেছেন নতুনভাবে।
‘নন্দিনী’, ‘অন্তরালে’, ‘নীলাঞ্জনা’, ‘সোনালী বিকেল’, ‘সাদা কাগজে কালো দাগ’, ‘শেষ বিকেলের রোদ’, ‘তোমার জন্য’, ‘আকাশের নিচে মানুষ’—এমন অসংখ্য নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন, যা দর্শকদের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে। তার অভিনীত ‘কেন দেখা হলো না’ নাটকটি ইউটিউবে প্রকাশিত হওয়ার পর দর্শকদের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ জাগিয়েছে। এই নাটকে তার সঙ্গে ছিলেন সমু চৌধুরী, সাবিহা জামান, মীর রাব্বি ও মাহিমা। রিচি নিজেই বলেছেন, গল্প ও চরিত্র যদি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তবেই তিনি অভিনয়ে ফিরতে চান।
চরিত্র নির্বাচনে সচেতনতা
রিচি সোলায়মানের অভিনয়জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার চরিত্র নির্বাচনের সচেতনতা। তিনি কখনোই ‘যেনতেন’ কাজ করেননি। বরং প্রতিটি চরিত্রের আবেগ, মনস্তত্ত্ব, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও দর্শকপ্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে তিনি অভিনয় করেছেন। তার মতে, এখনকার সময় দর্শক অনেক বেশি সচেতন। তারা গল্প ও অভিনয়ের গভীরতা খুঁজে পান। তাই একজন শিল্পীর দায়িত্ব হলো সেই গভীরতাকে সম্মান করা।
নৃত্য ও সৌন্দর্যচর্চা
রিচি সোলায়মান শুধু একজন অভিনেত্রী নন, তিনি একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পীও। তার নৃত্যশৈলী নাটকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে নাট্যনাট্যে বা উৎসবভিত্তিক নাটকে তার নৃত্য পরিবেশনা দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তার সৌন্দর্যচর্চা ও ব্যক্তিত্বও তাকে আলাদা করে তুলেছে। তিনি সবসময় পরিপাটি, মার্জিত ও আত্মবিশ্বাসী। তার পোশাক, মেকআপ ও উপস্থিতি নাটকের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
চলচ্চিত্রে পদচারণা
রিচি সোলায়মান বড় পর্দায়ও অভিনয় করেছেন। শাহনেওয়াজ কাকলী পরিচালিত ‘নীরব প্রেম’ চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। যদিও তিনি চলচ্চিত্রে নিয়মিত নন, তবে তার অভিনয় দক্ষতা চলচ্চিত্রেও প্রশংসিত হয়েছে। তার মতে, চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য গল্প ও নির্মাণশৈলীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন।
বিদেশে জীবন ও অভিনয়ের টান
রিচি সোলায়মানের ব্যক্তিগত জীবনও নাট্যজগতের বাইরে আলোচিত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন তার স্বামী রাশেক মালিকের সঙ্গে, যিনি নিউ ইয়র্ক পুলিশের ডিটেকটিভ। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে বারবার দেশে ফিরিয়ে আনে। তিনি বলেন, অভিনয় তার আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই সুযোগ পেলেই তিনি নাটকে ফিরে আসেন।
সমসাময়িক নাট্যজগতের মূল্যায়ন
বর্তমান নাট্যজগত সম্পর্কে রিচি সোলায়মানের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি মনে করেন, এখনকার নাটকে গল্পের বৈচিত্র্য কমে গেছে। অনেক নাটকই একই ধরনের গল্পে আবদ্ধ। তাই তিনি এমন কাজ করতে চান, যেখানে গল্পে নতুনত্ব থাকবে, চরিত্রে গভীরতা থাকবে, এবং দর্শককে ভাবতে বাধ্য করবে। তার মতে, একজন শিল্পীর দায়িত্ব হলো সমাজের আয়না হয়ে ওঠা।
দর্শকদের সঙ্গে সম্পর্ক
রিচি সোলায়মানের দর্শকদের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় না হলেও তার নাটক প্রকাশিত হওয়ার পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া তাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন, দর্শকের ভালোবাসাই একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তাদের মন্তব্য, প্রশংসা, সমালোচনা সবই তাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।
রিচি সোলায়মানের নাট্যজীবন একটি অনুপ্রেরণার গল্প। তিনি প্রমাণ করেছেন, অভিনয় শুধু পেশা নয়, এটি একটি শিল্প, একটি দায়বদ্ধতা, একটি আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। তার অভিনয়শৈলী, চরিত্র নির্বাচনের বুদ্ধিমত্তা, নৃত্য, সৌন্দর্যচর্চা এবং দর্শকদের প্রতি শ্রদ্ধা তাকে বাংলাদেশের নাট্যজগতের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
তিনি শুধু একজন অভিনেত্রী নন, তিনি একজন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি, যিনি নারীর আবেগ, সংগ্রাম ও সৌন্দর্যকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তার নাটকগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং সমাজের প্রতিচ্ছবি, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং মানবিক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
রিচি সোলায়মানের নাট্যজীবন আমাদের শেখায়, শিল্পচর্চা যদি সততা, আবেগ ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হয়, তবে তা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি আমাদের নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলো দীর্ঘদিন ধরে ছড়িয়ে যাবে।
বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫









