

বিনোদন প্রতিবেদক :
নির্মল সৌন্দর্য, নৃত্যশৈলী ও মডেলিংয়ের পরিপূর্ণতা—এই তিনটি শব্দ একত্রে উচ্চারিত হলে যে নামটি প্রথমেই মনে আসে, তিনি সাদিয়া ইসলাম মৌ। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি এক অনন্য প্রতিভা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই ফিচারে আমরা তাঁর জীবন, কর্ম, নাট্যভূমি এবং সাংস্কৃতিক অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

শৈশব ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট
সাদিয়া ইসলাম মৌ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৬ সালের ২১ জুন, একটি সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে। তাঁর মা রাশা ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের মডেল ও নৃত্যশিল্পী। বাবা সাইফুল ইসলাম ছিলেন সংগীতশিল্পী। দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ির পরিবেশেও ছিল সংস্কৃতির ছোঁয়া। এই পারিবারিক আবহেই মৌয়ের শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটে।
মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে তাঁর মা তাঁকে ভর্তি করান বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। সেখানে তিনি নাচের তালিম নেন রাহিজা খানম ঝুনু ও কবিরুল ইসলাম রতনের কাছে। শৈশব থেকেই তাঁর জীবনে নাচ ছিল একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মডেলিংয়ে পথচলা
মডেলিংয়ে মৌয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে, যখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। প্রথম ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণের পরই তাঁর প্রতি আগ্রহ বাড়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের। ১৯৮৯ সালে তিনি প্রথম বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। এরপর একে একে কাজ করেছেন অসংখ্য বিজ্ঞাপনচিত্রে, যা তাঁকে বাংলাদেশের অন্যতম সফল নারী মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
২০০০-এর দশকে মৌ ছিলেন মডেলিং জগতের শীর্ষে। তাঁর সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব ও ক্যামেরার সামনে সাবলীল উপস্থিতি তাঁকে তরুণদের আদর্শে পরিণত করে। যদিও বর্তমানে তিনি মডেলিংয়ে কম দেখা দেন, তবুও তাঁর প্রভাব আজও বিদ্যমান।
অভিনয়ে পদার্পণ
মডেলিংয়ের পাশাপাশি মৌ অভিনয়েও নিজের প্রতিভা প্রকাশ করেন। ১৯৯৪ সালে পরিচালক ফারিয়া হোসেনের নাটক অভিমানে অনুভবে দিয়ে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয়। সহশিল্পী ছিলেন টনি ডায়েস। প্রথম নাটকেই দর্শকদের নজর কাড়েন মৌ, যদিও তাঁর কণ্ঠস্বর নিয়ে বন্ধুরা সমালোচনা করেছিলেন। তবুও তিনি থেমে থাকেননি।
এরপর তিনি অভিনয় করেছেন অল দ্য বেস্ট, বদনাম, মনে পড়ে রুবি রায়, নীল আকাশ প্রেম বিষ, চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, মায়ার খেলা, চণ্ডালিকা, নকশীকাঁথার মাঠসহ বহু নাটকে। তাঁর অভিনয়ে ছিল আবেগ, সৌন্দর্য ও বাস্তবতার ছোঁয়া।
নৃত্যশিল্পী হিসেবে মৌ
নাচ মৌয়ের জীবনের প্রথম প্রেম। তিনি নিয়মিত নৃত্যচর্চা করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, চণ্ডালিকা প্রভৃতি নৃত্যনাট্যে তাঁর পারফরম্যান্স দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর নৃত্যশৈলীতে রয়েছে শুদ্ধতা, আবেগ ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধন।
ব্যক্তিজীবন
মৌ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসানের সঙ্গে। তাঁদের দুই সন্তান—মেয়ে পুস্পিতা ও ছেলে পূর্ণ। মৌ তাঁর পরিবারকে সবসময় অগ্রাধিকার দেন এবং কাজের ক্ষেত্রে মনের মতো না হলে অংশগ্রহণ করেন না।
সাম্প্রতিক কাজ
দীর্ঘ বিরতির পর মৌ অভিনয় করেছেন নাটক সোনার সিন্দুকে। এটি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত একটি বিশেষ নাটক। এতে তিনি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নাটকের গল্পে রয়েছে জমিদার বাড়ির ইতিহাস, উইল, ট্রাস্ট এবং একটি সোনার সিন্দুক ঘিরে রহস্য।
মৌয়ের ভাবনা ও দর্শন
এক সাক্ষাৎকারে মৌ বলেন, তাঁর আজকের অবস্থানে আসার পুরো কৃতিত্ব তাঁর মায়ের। তিনি নিজে কখনোই স্বপ্ন দেখেননি মিডিয়ায় কাজ করার। মা-ই তাঁকে নাচ, মডেলিং ও অভিনয়ের পথে নিয়ে এসেছেন। মৌ বলেন, তিনি কোনো কিছু নিয়ে ভাবতেন না, মা-ই তাঁকে ব্যস্ত রাখতেন যাতে প্রেমটেম না করেন।
এই ভাবনা থেকেই বোঝা যায়, মৌ একজন আত্মবিশ্বাসী, বাস্তববাদী এবং পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নারী। তাঁর জীবন দর্শন, কর্ম ও শিল্পচর্চা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।
সাংস্কৃতিক অবদান
সাদিয়া ইসলাম মৌ শুধু একজন মডেল বা অভিনেত্রী নন, তিনি একজন সাংস্কৃতিক দূত। তাঁর নাচ, অভিনয় ও মডেলিং বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সাদিয়া ইসলাম মৌয়ের জীবন এক অনন্য শিল্পযাত্রা। তাঁর শৈশব, পারিবারিক প্রেরণা, মডেলিং, অভিনয় ও নৃত্যশৈলী আমাদের শেখায়—সফলতা আসে নিষ্ঠা, অনুশীলন ও পারিবারিক সহায়তায়। মৌ আজও তরুণদের অনুপ্রেরণা, একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।
বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫




 










