

বিনোদন প্রতিবেদক :
জাফর ইকবাল—বাংলা চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি নাম, যিনি শুধু অভিনয় নয়, সংগীত ও গিটারবাদনের মধ্য দিয়েও দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। তার জীবন ছিল বহুমাত্রিক, বর্ণাঢ্য এবং শেষদিকে করুণ এক অধ্যায়। এই আলোচনায় তুলে ধরা হবে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, চলচ্চিত্রে পদার্পণ, অভিনীত ছায়াছবি, সংগীতচর্চা, ব্যক্তিজীবন এবং মৃত্যুর প্রেক্ষাপট।

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
জাফর ইকবালের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায়। তার পরিবার ছিল সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক এবং ছোট বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহ ছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। এই সাংস্কৃতিক আবহেই জাফর ইকবালের শিল্পীসত্তা বিকশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাফর ইকবাল সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ভূমিকা ছিল সাহসী ও গর্বের। যুদ্ধের পর তিনি ফিরে আসেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, যেখানে তার প্রতিভা নতুনভাবে বিকশিত হয়।
সংগীত ও ব্যান্ড জীবন
১৯৬৬ সালে বন্ধুদের নিয়ে তিনি গঠন করেন ব্যান্ড দল ‘র্যাম্বলিং স্টোন’। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ গিটারবাদক এবং ইংরেজি গান গাওয়ার ক্ষেত্রে পারদর্শী। এলভিস প্রিসলি ছিলেন তার প্রিয় শিল্পী। তার গাওয়া গান ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই গানটি ছিল ‘বদনাম’ ছবির অংশ, যার সুর করেছিলেন তার ভাই আনোয়ার পারভেজ।
চলচ্চিত্রে পদার্পণ
জাফর ইকবালের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আপন পর’ ছবির মাধ্যমে, যেখানে তার বিপরীতে ছিলেন কবরী। এরপর তিনি একে একে অভিনয় করেন অসংখ্য ছবিতে। আশির দশকে তিনি হয়ে ওঠেন শহুরে রোমান্টিক ও রাগী তরুণের আদর্শ প্রতিচ্ছবি।
অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি
জাফর ইকবাল প্রায় ১৫০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হলো:
– আপন পর (কবরীর বিপরীতে)
– সাধারণ মেয়ে
– এক অঙ্গে এত রূপ
– দূর থেকে কাছে
– বিচার
– অন্তরালে
– মামা ভাগ্নে
– বাদী থেকে বেগম
– পরিণতি
– হারজিত
– মাস্তান
– এক মুঠো ভাত
– অবুঝ হৃদয় (ত্রিভুজ প্রেমের গল্প, ববিতা ও চম্পার সঙ্গে)
– নয়নের আলো
– ভাই বন্ধু
– অবদান
– প্রেমিক
– ফকির মজনু শাহ
– দিনের পর দিন
– বেদ্বীন
– অংশীদার
– মেঘ বিজলী বাদল
– সাত রাজার ধন
– আশীর্বাদ
– অপমান
– গৃহলক্ষ্মী
– ওগো বিদেশিনী
– নবাব
– প্রতিরোধ
– ফুলের মালা
– সিআইডি
– মর্যাদা
– সন্ধি
– বন্ধু আমার
– উসিলা
ববিতার সঙ্গে তার জুটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারা একসঙ্গে প্রায় ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেন।
অভিনয়শৈলী ও জনপ্রিয়তা
জাফর ইকবাল ছিলেন স্টাইলিশ নায়ক। তার ফ্যাশন সচেতনতা, রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব এবং সাবলীল অভিনয় তাকে আলাদা করে তুলেছিল। শহুরে রোমান্টিক তরুণ, রাগী যুবক, হতাশাগ্রস্ত চরিত্র কিংবা বিপথগামী যুবকের ভূমিকায় তিনি ছিলেন নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ। তার অভিনয়ে ছিল আবেগ, গভীরতা এবং বাস্তবতার ছোঁয়া।
সংগীতচর্চা ও গায়কসত্তা
জাফর ইকবাল ছিলেন একজন চমৎকার গায়ক। তার গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
– ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’
– ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরনি’
– ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’
– ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’
আশির দশকে তিনি ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে তার গাওয়া গান ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ব্যক্তিজীবন ও সম্পর্ক
জাফর ইকবাল বিয়ে করেন সনিয়া নামের একজনকে। তাদের সংসারে দুই পুত্রসন্তান ছিল। ববিতার সঙ্গে তার বাস্তব জীবনের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন থাকলেও তা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ববিতা এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, তারা একে অপরকে পছন্দ করতেন।
শেষ জীবন ও মৃত্যু
জীবনের শেষ অধ্যায় ছিল করুণ। পারিবারিক অশান্তি, মানসিক ভাঙন এবং মদের প্রতি আসক্তি তাকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হন, হার্টের সমস্যা দেখা দেয় এবং দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
জাফর ইকবালের মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি ছিলেন একাধারে নায়ক, গায়ক, গিটারবাদক এবং মুক্তিযোদ্ধা। তার স্টাইল, অভিনয়, সংগীত এবং দেশপ্রেম আজও অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। তার মতো সম্পূর্ণ নায়ক বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখা গেছে।
জাফর ইকবালের জীবন ছিল এক বর্ণাঢ্য যাত্রা—যেখানে ছিল সাফল্য, প্রেম, সংগ্রাম, শিল্প এবং শেষপর্যায়ে এক করুণ পরিণতি। তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক শিল্পী, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে দিয়েছেন অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত। তার গান, অভিনয় এবং ব্যক্তিত্ব আজও দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে বেঁচে আছে।
বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫









