

বিনোদন প্রতিবেদক :
সানিয়া সুলতানা লিজা—বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নাম, যিনি কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শুধু জনপ্রিয়তা অর্জন করেননি, বরং একজন সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি সাফল্য, এবং প্রতিটি গান যেন একটি গল্প বলে—একটি মেয়ের বড় হয়ে ওঠার, স্বপ্ন দেখার, এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার গল্প। এই ফিচারে আমরা বিশদভাবে তুলে ধরব লিজার সংগীতজীবনের শুরু, তার গান, সংগ্রাম, সাফল্য, এবং একজন শিল্পী হিসেবে তার বিকাশের ইতিকথা।

লিজার জন্ম ১৯৯৩ সালের ২২ ডিসেম্বর, ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরে। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে সংগীতের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই তার সংগীতের প্রতি আগ্রহ চোখে পড়ে স্কুলের শিক্ষিকা রাবেয়া খানমের। এই শিক্ষিকার উৎসাহে লিজার বাবা তাকে ভর্তি করে দেন ‘গৌরীপুর সংগীত নিকেতন’-এ। এখানেই শুরু হয় তার সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তিন বছর ধরে তিনি উচ্চাঙ্গ, পল্লীগীতি এবং আধুনিক গান শেখেন। এরপর তিনি সংগীতচর্চা চালিয়ে যান ময়মনসিংহ শিল্পকলা একাডেমীর ওস্তাদ আনোয়ার হোসেন আনুর কাছে। এই ওস্তাদজীর কাছ থেকে তিনি ক্ল্যাসিক্যাল ও আধুনিক গানের তালিম নেন।
লিজার সংগীতজীবনের প্রথম বড় মঞ্চ ছিল ২০০৪ সালের “নতুন কুঁড়ি” প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি মিডিয়ায় প্রথমবারের মতো পরিচিতি পান। এরপর ২০০৮ সালে এনটিভির জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো “ক্লোজআপ ওয়ান—তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ” প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয়ী হন। এই বিজয় ছিল তার সংগীতজীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি পান এবং সংগীতাঙ্গনে তার যাত্রা শুরু হয় পেশাদারভাবে।
“ক্লোজআপ ওয়ান” জয় করার পর লিজার সংগীতচর্চা আরও বিস্তৃত হয়। তিনি একের পর এক গান রেকর্ড করতে থাকেন, প্লেব্যাক করেন চলচ্চিত্রে, এবং বিভিন্ন অ্যালবামে অংশগ্রহণ করেন। তার প্রথম একক অ্যালবাম “তৌসিফ ফিচারিং লিজা পার্ট-১” প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এই অ্যালবামে তার কণ্ঠে ছিল আবেগ, গভীরতা, এবং নতুনত্ব। এরপর ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম “পাগলী সুরাইয়া”—যা শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই অ্যালবামের শিরোনাম গান “পাগলী সুরাইয়া” তাকে সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে দেয়।
লিজা শুধু অ্যালবামেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি প্লেব্যাক করেছেন ৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে। তার কণ্ঠে রয়েছে “এই তো ভালোবাসা” চলচ্চিত্রের টাইটেল সং, যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তৌসিফের কম্পোজিশনে “এ মনের আঙ্গিনায় / তোরই তো ঠিকানা” গানটিও শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নেয়। তার গাওয়া দেশাত্মবোধক গানও প্রশংসিত হয়েছে, এবং তিনি এই ক্যাটাগরিতে তিনবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৩ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম হন, ২০০৬ সালে দেশাত্মবোধক ও পল্লীগীতিতে স্বর্ণপদক অর্জন করেন, এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত ইসলামিক গানে রৌপ্যপদক পান।
লিজার সংগীতজীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। লন্ডনভিত্তিক বলিউডের গানের চ্যানেল “BeforeU Music”-এ প্রথম বাংলাদেশি গায়িকা হিসেবে তার মিউজিক ভিডিও “পাগলী সুরাইয়া” প্রচারিত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের সংগীতশিল্পীদের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত। এই স্বীকৃতি প্রমাণ করে, লিজার কণ্ঠ শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও প্রশংসিত।
লিজা সংগীতের পাশাপাশি উপস্থাপনাতেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন এবং ২০২৩ সালে RTV-এর রিয়েলিটি শো “Young Star Season 2”-তে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্ব তার সংগীতজীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে তিনি নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মূল্যায়ন ও উৎসাহ প্রদান করেন।
লিজার শিক্ষাজীবনও তার সংগীতচর্চার সঙ্গে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। তিনি এসএসসি সম্পন্ন করেন গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, এবং এইচএসসি পাশ করেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে। এরপর ঢাকার ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। এই শিক্ষাজীবন তাকে সংগীতের পাশাপাশি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।
লিজার ব্যক্তিজীবনেও রয়েছে নানা রঙ। তিনি ভালো ব্যাডমিন্টন খেলেন এবং ২০০৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে মেয়েদের ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন। স্কুল জীবনে একটানা পাঁচ বছর ময়মনসিংহ জেলার চ্যাম্পিয়ন হন শীতকালীন খেলাধুলা প্রতিযোগিতায়। ২০০৯ সালে জেলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হন। এইসব অর্জন প্রমাণ করে, তিনি শুধু সংগীতেই নয়, খেলাধুলাতেও দক্ষ।
লিজার বড় হয়ে ওঠার কাহিনী আমাদের শেখায়, প্রতিভা থাকলেই যথেষ্ট নয়—চেষ্টা, অধ্যবসায়, এবং আত্মবিশ্বাসও প্রয়োজন। ছোট শহরের একটি মেয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংগীতশিল্পী হয়ে ওঠার গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি গান, এবং প্রতিটি সাফল্য যেন একটি অনুপ্রেরণার উৎস।
আজকের লিজা একজন প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী, যিনি সংগীতের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তার কণ্ঠে রয়েছে আবেগ, গভীরতা, এবং সত্যিকারের শিল্পের ছোঁয়া। তিনি প্রমাণ করেছেন, সংগীত শুধু বিনোদন নয়—এটি একটি আত্মপ্রকাশ, একটি সংগ্রাম, এবং একটি জীবনযাত্রা।
মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫










