মধ্যবিত্ত : ক্ষুদীরাম দাস

ক্ষুদীরাম দাস :

সাজু ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘরের দরজাটা খুলে বাইরে বের হয়। তখনও সূর্যটা পৃথিবীকে আলোকিত করেনি। সূর্যের দায়িত্ব এখনো শুরুই হয়নি। কিন্তু রাজুর সংসারের দায়িত্ব শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন বাজারে যাওয়া তার মোটেও ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে সাজু ভাবে, যদি সংসার চালাতে গিয়ে বাজারে যেতে না হতো তাহলে হয়তো খুবই ভালো হতো। এই বাজারে যাওয়াটা তার জন্যে খুবই বিরক্তিকর। বাজারে গেলেই পকেটের সব টাকা শেষ হয়ে যায়। সাজু লম্বা লম্বা হাই তুলে ভোরের প্রকৃতিকে দু’চোখে দেখে। কিন্তু সেখানে কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। অথচ তার চারিদিক খুবই সুন্দর।

কিন্তু সাজু মোটেও সৌন্দর্য বুঝতে পারে না। বোঝা তার দরকারও নেই। ঐ সৌন্দর্য তার পেটে ভাত দেবে না মোটেও। ঠিক যেনো ‘ক্ষধার রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলাসানো রুটি’ কথাটির মতো। কোনো রকমে দাঁত ব্রাশ করে বাজারের থলেটা খুঁজতে বের হয়। খুঁজতে রান্না ঘরে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে, একটি বিড়াল মেউ মেউ করে ডাকতে ডাকতে সাজুর দিকে এগিয়ে আসে। বিড়ালটি তার বেশ চেনা। তাই সাজুকে দেখে সে মোটেও দৌঁড়ে পালালো না। বাজারের থলেটা চুলার পেছনেই ছিলো। থলেটা হাতে নিয়ে ইচ্ছে করলো বিড়ালকে থলে দিয়ে একটা বাড়ি দিয়ে তাড়িয়ে দিতে। কিন্তু মন তার মানে না। ইচ্ছে করে না বিড়ালকে তাড়াতে।

আবার থলেটা ভাঁজ করতে করতে সাজু বিড়ালের দিকে এগিয়ে যায়। আর থলে দিয়ে বাড়ি দিতে হাত দু’টো উঁচু করে সাজু বললো, ‘যা’ তুই, আমার ঘরে কী চাস. আমার নিজেরই খাবার জুটে না; আমি তোকে খাওয়াবো কীভাবে? তখন বিড়ালটা আবার সাজুর দিকে তাকিয়ে ‘মেউ মেউ’ করে উঠে। ইচ্ছে করে না বিড়ালকে তাড়াতে, বড় মায়া লাগে! তারও তো পেট আছে। তারও খাবার দরকার আছে। যদি তাকে খাবার না দিই তাহলে সে খাবার পাবে কোথায়। কিন্তু বিড়াল তো আর সাজুর অবস্থার কথা জানে না। জানবার কথাও নয়।

সাজু বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়। দুই কদম যেতেই আবার রান্না ঘরে ফিরে আসে। বিড়ালটি তখন হা করে তাকিয়ে থাকে সাজুর দিকে। সাজু বিড়ালের তাকিয়ে হাসে। আর বিড়ালকে বলে, থাক তুই, আমার ঘরেই থাক। আমি যা জোটাতে পারি তোকে আমি তার থেকেই দেবো। তুই কোথাও যাবি না।’ এই বলে সাজু রান্নাঘর থেকে আবার বের হয়ে আসে।
সাজু হাঁটতে থাকে বাজারের উদ্দেশ্যে। মনে মনে সাজু হাসে আর বিড় বিড় করে বলতে থাকে, ‘এই কষ্টের দিনেও আমাকে বিড়ালের সাথে হাসতে হলো!’ তবুও ভালো। বিরক্ত হলেও, আমি ফাঁকে একটু হাসতে পেরেছি। হাসি তো মুখ দিয়ে বের হতে চায় না। অভাবের তাড়না হাসিকে চেপে ধরে রাখে। একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে সাজু।

পিছন থেকে খুব চিৎকার দিয়ে শিলা ডাক দেয়, ‘ও সীমার বাপ! এই দিকে আস। শুনে যাও।’ ডাক শুনে সাজু ঘুরে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে, বাজার থেকে কী কী আনতে হবে সেটা পরিস্কার করে বলতে চায়। অথবা, আরো কিছু কেনার কথা বলবে। ভাবতে ভাবতে নিজের পকেটের দিকে তাকায়। পকেট তেমন গরম নয়। কাছে আসলে শিলা বলে ঃ আমাকে ঘুম থেকে না জাগিয়ে তুমি চলে যাচ্ছ কেন?
সাজু ঃ তুমি ঘুমাচ্ছ দেখলাম, তাই তোমাকে ডাকলাম না।
শিলা ঃ আর তুমি ঘরের দরজাটা খোলা রেখেই চলে যাচ্ছিলে?
সাজু ঃ তাতে কী হয়েছে?
শিলা ঃ রান্নাঘরও তো খোলা!
সাজু ঃ সেখানে তো তেমন কিছুই নেই।
শিলা ঃ আছে।
সাজু ঃ কী আছে?
শিলা ঃ যা আছে, তাই তো আমাদের সম্পদ। চোরের দল নিজের মনে করে সবকিছু নিয়ে যেতে পারে। তার কি আর মায়া মমতা আছে? আমরা গরীব, অভাব আছে চোর কিন্তু সেটা মোটেও বুঝবে না। সেটা যদি বুঝতো তাহলে সে চুরি করতো না।
সাজু ঃ ও বুঝতে পারলাম। আমারই ভুল হয়ে গেছে।
শিলা ঃ এখন তাড়াতাড়ি বাজারে যাও। মশুরির ডাল, তেল, লবণ নিয়ে আইসো। সাথে চা-পাতা আর চিনিও আইনো।
সাজু বিড় বিড় করে বললো ঃ চা খাওয়াটা বাদ দেয়া যায় না? আমরা যদি অন্তত চা খাওয়াটা বাদ দিই, তাহলে অন্তত সেখানেই কিছু টাকা রক্ষা পায়।


সাজু আর কিছু বললো না। মনে মনে হয় খুশি হয় যে, বুদ্ধিমান একটা বউ পেয়েছে বলে। মুখে কিছু না বললেও অন্তত এটা বোঝা গেছে যে, চা খাওয়াটা বন্ধ করাতে শিলা নিজেও খুশি হয়েছে। এটাই করা উচিত। কিছু কিছু বিষয়ে খরচ কমানো দরকার। তা না হলে বাঁচা যাবে না। ধার দেনা আর কতো করা যায়?
সাজু বাজারে গিয়ে আগে মাছের দিকে ছুটলো। দেখলো বাজারে মাছের কোনো অভাবই নেই। কিন্তু প্রচুর দাম। দাম শুনে বেশি সময় বাজারে থাকলো না। ফিরে আসা দেখে একজন মাছ ব্যবসায়ী ডাকলো ঃ ও দাদা, এদিকে আসেন। মাছ নিয়ে যান।
সাজু ঃ না গো দাদা, লাগবে না।
মাছ ব্যবসায়ী ঃ কেনো দাদা?
সাজু ঃ বাড়িতে মাছ আছে।
মাছ ব্যবসায়ী ঃ বাড়িতে তো ফ্রীজ নেই। মাছ আছে কোথায়?
সাজু থতমত খেয়ে গেলো। কী উত্তর দেবে এখন? সাজু উত্তরে বললো ঃ আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে একজন মাছ ব্যবসায়ী যাচ্ছিলো, তার থেকে দেড়শ টাকায় মাছ কিনে নিয়েছি, দাদা। সুতরাং এখন আর মাছ কিনবো না।
মাছ ব্যবসায়ী ঃ ও বুঝতে পেরেছি। তাহলে তো আর দরকার নেই। তবুও আমার কাছে ভালো মাছ আছে। কম দামে দিয়ে দিবো। একভাগ মাত্র পঞ্চাশ টাকা। তাও আবার আপনার জন্যে।


সাজু কাছে গিয়ে দেখলো, মন্দ হয় না। নেয়া যেতে পারে। কমের মধ্যে ভালোই মাছ আছে। তারপর বললো ঃ ঠিক আছে, আপনি যখন বললেন নিয়েই নিই।
মাছ ব্যবসায়ী ঃ দেখেন ভাই, মাছ যেন আবার অতিরিক্ত বেশি না হয়ে যায়।
সাজু ঃ সমস্যা নেই। এখানে তো মাত্র সামান্য মাছ। বাড়িতে একজন অতিথি এসেছে, দরকারও আছে।
মাছ ব্যবসায়ী ঃ ঠিক আছে নিন।
বলেই ব্যবসায়ী মাছগুলো সাজুর হাতে দিয়ে দিলো। দূর থেকে অন্য একজন মাছ ব্যবসায়ী এটা দেখে সাজুর দিকে তাকালো। সাজু দেখেও না দেখার ভান করে মাছের বাজার থেকে ফিরে আসছিলো। এমন সময় ইশারা দিয়ে সাজুকে ডাকলেন। আর বললেন ঃ আপনি আমার কাছে কয়েকদিন আগে বাকিতে মাছ নিয়ে গেলেন। আর আজ আপনি আমার কাছ থেকে মাছ না নিয়ে অন্যজনের কাছ থেকে নগদে মাছ কিনছেন কেনো দাদা? এটা তো ভালো হচ্ছে না। ঠিক আছে আপনি যা, তবে কাজটা মোটেও ভালো করলেন না।

সাজু মাথা নিচু করে চলে আসলো। কোনো কথার জবাব সে দিলো না। মনকে শুধু এটাই সান্ত¡না দিলো যে, আমাদের মধ্যবিত্তদের এভাবে মাথা নিচু করেই চলতে হবে। বেঁচে থাকতে হলে এভাবে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সাজু তরকারির বাজারে গিয়ে একদোকানীর কাছে গেলো আলু কেনবার জন্যে। দোকানদার আড়চোখে তাকালো। সাজুকে মোটেও পছন্দ করলো না। তবুও কাস্টমার বলে কথা। রাগ করা মোটেও চলবে না। কাস্টমারের সাথে যে দোকানদার খারাপ আচরণ করে তার দোকানে কাস্টমারের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে।


সাজু দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বললোঃ ও ভাই, দুই কেজি আলুর দাম কতো?
দোকানী ঃ কেজি ২৫ টাকা।
সাজু ঃ দুই কেজি নিলে কত রাখবেন?
দোকানী ঃ ৫০ টাকা।
সাজু ঃ চলে যাবো; নাকি কিছুটা কমে দিবেন?
দোকানী ঃ কত কম দিতে চান?
সাজু ঃ আপনি বলেন।
দোকানী ঃ দুই কেজি আলু বিক্রি করলে আমার লাভ হবে মাত্র সাত টাকা।
সাজু ঃ ডাকাতি ব্যবসা রে ভাই।
দোকানী ঃ সারাদিন বসে এভাবে ব্যবসা করে দেখেন কেমন লাগে! কত টাকা লাভ হয়, আর কতো টাকা থাকে।
সাজু ঃ তবুও তো অনেক দাম। অনেক টাকা লাভ করছেন।
দোকানী ঃ সে রকম হলে তো বিল্ডিং করতাম রে ভাই।
সাজু ঃ আচ্ছা, বলেন ভাই কত দাম রাখবেন?
দোকানী ঃ ৪৫ টাকা দিবেন আপনি দুই কেজির মূল্য।
সাজু ঃ দেন তাহলে, আর বাকি পাঁচ টাকার কাচা মরিচ দিন। তাহলে একবারে ৫০ টাকা দিবো।
দোকানী ঃ ঠিক আছে। আর আপনাকে একটা কথা বলে রাখি ভাই!
সাজু ঃ কী কথা।
দোকানী ঃ আপনি কিন্তু অনেক দামাদামী করেন। এটা যদিও ঠিক, কিন্তু এতে আমাদের সমস্যা হয়।
সাজু ঃ বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, দরদাম করে ক্রেতাদের জিনিসপত্র না কেনা। যদি ক্রেতা দরদাম করে যাচাই বাছাই করে জিনিসপত্র কিনতো তাহলে দোকানীরা জিনিসের দাম বাড়াতে পারে না। আপািন আপনার দোকানে এসে অর্ডার দিবো, আর টাকা দিয়ে চলে যাবো এটা মোটেও ঠিক নয়। তাছাড়া আমাদের মতো গরীবদের জন্যে খুবই কষ্টকর। অন্তত বেঁচে থাকতে হলে দরদাম করে চলতেই হবে। ভাই রাগ করলেও কিছু করার নেই, আমি এরকমই।
দোকানী ঃ সত্যিকারে সবারই এ রকম হওয়া উচিত।
দোকানী সাজুর ব্যাগে ভরে দিলো আলু ও কাচা মরিচ। মুদি দোকান থেকে তেল ও মশুরির ডাল নিতে গেলো। সাজু বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। মুদি দোকানদার তার দিকে তাকালো না; এমনকি কোনো গুরুত্বও দিলো না। অন্যান্য কাস্টমারদের একজনের পর একজনকে জিনিসপত্র দিয়ে বিদাল করছে। কিন্তু সাজুর দিকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। সাজু দাঁড়িয়েই রয়েছে। ভাবছে, আমরা যারা মধ্যবিত্ত, বাকিতে চলতে হয় আমাদের অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। সবাই চলে যাবার পর সাজুকে আধা কেজি তেল ও এক পোয়া মশুরির ডাল দিলো। পরে দোকানী অনেকটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বাকির খাতাটা বের করলো। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো ঃ ভাই, আপনার অনেক টাকা হয়ে গেছে। এভাবে বাকি নিলে আমি আপনাকে আর বাকি দিতে পারবো না। আমার ছোট দোকান, পুঁজি কম। আমার পুঁজির টাকা আপনি এভাবে আটকে রাখবেন এটা তো ঠিক নয়।
সাজু ঃ ভাই, সবই বুঝি। যদি বাকি না দেন তাহলে বাঁচবো কী করে? আপনি মাঝে মাঝে এভাবে বাকি দেন বলেই তো আপনার কাছে বার বার ছুটে আসি।
দোকানী অনেকটা উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে চাইলে সাজু তার হাত চেপে ধরে বললো ঃ আপনি তো আমাকে চিনেন ভাই। আমি আপনাকে সব টাকা দিয়ে দেবো। একটু অপেক্ষা করেন।
সাজু বাজার থেকে বের হয়ে আসছে। আরো কয়েকজনকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে কথা বলতে বলতে বাজার থেকে আসছে। তাদের সবার মুখে একই কথা, সকাল হলে কার কাজ করতে যাবে। কী কাজ করবে। কত টাকা আয় হবে। সংসার কীভাবে চলছে-এই সব। এর মধ্যেই তাদের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ! এর বাইরে তারা যেতে পারে না, সেই সময় তাদের নেই। সাজু বাড়ির কাছাকাছি আসলে অন্যরা যে যার মতো চলে যায়। সাজু বাড়িতে গিয়ে বাজারের ব্যাগটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে জমির আইল কাটতে বের হয়।

একদিন সাজু কাজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে দেখে তার সাত বছর বয়সী মেয়ে কাঁদছে। সে সময় সাজুর স্ত্রী শিলা এসে বললো ঃ কাল থেকে তোমার মেয়ে আর স্কুলে যাবে না।
সাজু ঃ কেন যাবে না।
শিলা ঃ সেটা তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা কর।
সাজু ঃ কেন? তুমি কি জানো না?
শিলা ঃ স্কুলের বেতন দিতে হবে। আর প্রতিদিন তাকে দশ টাকা, নয়তো পাঁচ টাকা দিতে হবে।
সাজু ঃ এতো টাকা তো আমাদের নেই।
শিলা ঃ এটা আমি মেয়েকে অনেক বুঝিয়েছি। সে কিছুতেই বুঝতে চায় না।
সাজু কোনো কথা না বলে গোসল করতে পুকুরে চলে গেলো। সাজু সংসারের এসব ভাবনা আর ভাবতে চায় না। অসহ্য লাগে তার কাছে। যে টাকা আয় করে সেই টাকা তার সংসারের কিছুই হয় না। চারিদিকের মানুষজন টাকা পাবে। পাওনাদারদের জন্যে বাজারেই যাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে পাওনাদাররা এমনভাবে কথা বলে ইচ্ছে করে বিষ খেয়ে মরে যেতে। কিন্তু সেটা সাজু করতে পারে না। কারণ, তার স্ত্রী আছে, সীমা আছে। তাদেরকে দেখবে কেন? তাদের কী উপায় হবে তখন? এসব ভাবতে ভাবতে গোসল শেষে ঘরে ফিরে আসে।
আজ আর সাজু বাজারে যাবে না। কোথাও যেতে তার ইচ্ছে করছে না। আর কিছুক্ষণ হলেই সন্ধা নেমে আসবে। তাছাড়া বাজারে যাওয়ার দরকারও নেই।
রাতের খাবারের পর সারাদিনের ক্লান্তিতে প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যার পর পর ঘুম চলে আসে সকলের। এটা একেবারে স্বাভাবিক যে পরিশ্রমী মানুষের শরীরর বিশ্রামের অপেক্ষয় থাকে। তবুও সংসারের চিন্তা ঘুম আর আসে কেমন করে। বিছানায় এদিক ওদিক করতে করতে সংসারের ভাবনা এমনিতেই চলে আসে। কারণ, অভাবের তাড়না প্রতিটি মুহূর্তে তাড়া করে। পাশে শিলা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বেচারা সারাদিন মেয়েকে সামাল দেয়, বাড়ির সমস্ত কাজ করে। সংসারের জন্যে তারও কোনো কম চিন্তা নেই। সাজু আস্তে করে শিলার গায়ে হাত রাখে। হাত রাখতেই শিলার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
সাজু ঃ কী আশ্চর্য! তুমি ঘুমাওনি এখনো?
শিলা ঃ স্বপ্ন দেখছিলাম। কেন জানি তোমার হাত রাখায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।
সাজু ঃ আজকাল তাহলে তুমি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছো।
শিলা ঃ স্বপ্ন দেখা ভালো।
সাজু ঃ কেমন ভালো?
শিলা ঃ দুঃখেও সান্ত¡না পাওয়া যায়।
সাজু ঃ আমি তোমার কথায় সাহস খুঁজে পাই। তোমার হাসি আমার ভালো লাগে।
শিলা ঃ তুমি এখনো ঘুমাওনি কেনো?
সাজু ঃ ঘুম আসছে না।
শিলা ঃ কেন?
সাজু ঃ সংসারের চিন্তা! কীভাবে চলবে সবকিছু–!
শিলা ঃ হুম!
সাজু ঃ আচ্ছা, আমরা কী একটা হিসাবে আসতে পারি না?
শিলা ঃ কেমন হিসাব?
সাজু ঃ যেমন ধর-আমরা সারা মাসে কত টাকা আয় করি, আর সারা মাসে কতো টাকা ব্যয় করবো তার একটা তালিকা করা। আর সেখান থেকে কিছু বাজে খরচ বাদ দেয়া। যা না হলেই নয় সে রকমই একটা কিছু।
শিলা ঃ আমরা তো কোনো বাজে খরচ করি না। সেটা হয়তো তুমি একটু আধটু করে থাক।
সাজু ঃ যেমন–?
শিলা ঃ তুমি সিগারেট খাও সেটা বাজে খরচ!
সাজু ঃ হুম! ঠিক বলেছো। কিন্তু এটা আমার নেশা!
শিলা ঃ আমাদের মতো মধ্যবিত্ততে কোনো নেশা থাকতে হয় না।
সাজু ঃ একথা তুমি বলছো?
শিলা ঃ হুম! বলছি। এছাড়াও আমাদের আরো বেশ কিছু খরচ কমাতে হবে। কিছু কিছু বাড়তি খরচ বাদ দিতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে অনেক কিছু। ফুটানি করার মতো কোনো খরচ আমরা করতে পারবো না।
সাজু ঃ কেন জানি তোমার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে।
শিলা সাজুর কথা খুশি হয়। এমন ল²ী বউ পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। এমন বউ পেয়েছে বলেই সাজু এখনো বেঁচে আছে। সাজু অনেক সুখী এমন বুদ্ধিমতী বউ পেয়ে। ওরা দু’জন সারা রাত সংসারের হিসাব করতে করতে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু রাত শেষে ভোর হয়ে গেলেও তাদের হিসাব করা শেষ হয় না। সকালের পাখিরা ডেকে উঠে; আর সাজু ও শিলা তখনো তাদের সংসারের হিসাব করেই চলে, মধ্যবিত্তদের সংসারের হিসাব!