শেরপুরের নালিতাবাড়ীর হারুন অর রশিদের কুকর্মের ভয়ংকর বর্ণনা শিশুর জবানবন্দিতে

ডেস্ক রিপোর্ট :

‘হারুন অর রশিদের বউ হাওয়া বেগমের বড় বোন নয়নের বাসায় ঢাকায় দুই বছর কাজ করেছি। সেখান থেকে বাড়িতে চলে আসি। এরপর আব্বা আমাকে হাওয়া বেগমের বাড়িতে কাজ করতে দেয়। তাদের একটা মেয়ে আছে। হাওয়া বেগমের বাসায় তিন মাস কাজ করেছিলাম। এরপর একদিন নানা (হাওয়া বেগমের স্বামী হারুন অর রশিদ) ফার্মেসি থেকে বাসায় ফিরে আসে। দুই রুমের বাসা। যে রুমে আমি ঘুমাতাম সেই রুমে রাত আনুমানিক ১০টার দিকে নানা আসে। পাশের রুমে তার বউ-বাচ্চা ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ করেই নানা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এরপর থেকে প্রস্রাব করতে গেলেই আমার খুব কষ্ট হতো।’ মাত্র ১০ বছরের ছোট্ট শিশু। সমকালের কাছে তার ওপর নির্যাতনের এমন ভয়ংকর তথ্য দিল। একই ধরনের বর্ণনা শিশুটি বুধবার শেরপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিয়েছে। মাসখানেক আগে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর হারুন অর রশিদ শিশুটিকে ধর্ষণ করে। পুরো মাসই দফায় দফায় ধর্ষণ করেছিল ওই কুলাঙ্গার। এরপর গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় শিশুর ওপর এমন পৈশাচিক ঘটনা পুরোপুরি ধামাচাপা দেন স্থানীয় কয়েকজন। জরিমানার টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে জের ধরে সপ্তাহখানেক আগে এ বিষয়টি সামনে আসে। স্থানীয় এক দর্জির দোকানে ঘটনাটি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে নালিতাবাড়ী থানার বিট পুলিশের সদস্য এসআই ওয়াহেদের কানে যায়। এর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে মাসব্যাপী শিশুর ওপর চালানো নির্যাতনের এমন দুর্বিষহ চিত্র।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে শিশুটি বলে, ‘নানার এ ঘটনা নানিকে বলিনি কারণ, বাসায় গ্যাঞ্জাম বাধবে। প্রথম যেদিন নানা এমন আচরণ করেছিল তারপর থেকে প্রতি রাতে একই কাজ করত। এভাবে মাসখানেক ছিলাম। এরপর আমার আব্বা ইটখোলা থেকে একদিন আমাকে দেখতে আসে। আব্বাকে বলেছি, এই বাসায় থাকব না। এরপর আব্বা আমাকে ফরিদ মাস্টারের বাড়িতে কাজ করতে দেয়। সেখানে ভাবিকে (ফরিদ মাস্টারের স্ত্রী) সব খুলে বলি।’

শেরপুরের নালিতাবাড়ী থানার ওসি বশির আহম্মেদ বাদল জানান, শিশুটির ওপর নির্যাতনের এ ঘটনার সময়কাল চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অভিযুক্ত ধর্ষক হারুন অর রশিদের এলাকায় ওষুধের দোকান রয়েছে। শিশুটিকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করার পর তা যাতে অন্য কাউকে না বলে সেজন্য ভয়ভীতি দেখাত হারুন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি জানাজানি হলে এটি ধামাচাপ দেওয়ার জন্য স্থানীয় মাতবররা উঠেপড়ে লাগেন। গোপনে তারা সালিশ বৈঠক করেন। ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা তারা ধর্ষকের কাছ থেকে আদায় করেন। ২০ হাজার শিশুটির বাবাকে দিয়ে বাকি টাকা স্থানীয় মাতবররা হাতিয়ে নেন।

মামলার এজাহার ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, মেয়েটির সঙ্গে বর্বরতার এ ঘটনা যারা টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন হাওয়া বেগম, সিরাজ আলী, আবু তালেব, মো. সুলতান, হাসমত আলী, তাজুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলাম। তাদের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে নালিতাবাড়ী থানা পুলিশ।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, নির্যাতনের ঘটনায় বুধবার শিশুটির পক্ষে বাদী হয়ে ধর্ষক ও আপস-মীমাংসায় জড়িত আরও ৭ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ধর্ষককে বুধবার গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। রোববার রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দিনের পর দিন শিশুটিকে ধর্ষণের পর সে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। তাকে গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছিল। ঘটনাটি জানাজানির পর শিশুটিকে ময়মনসিংহের এক আত্মীয়ের বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন এক আসামি। ওই বাসাটি আসামির স্ত্রীর বড় বোনের। তিনি এ ঘটনায় মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া শিশুটির বাবাকে আরেকটি বাসায় লুকিয়ে রাখা হয়। বুধবার শিশুটি ও তার বাবাকে উদ্ধার করে পুলিশ।

জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার শিশুটির বাবা হতদরিদ্র। শিশুটির বাবা কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনও। তার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটির বয়স ৫ বছর। বছর পাঁচেক আগে তার স্ত্রী অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে যান। এরপর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। বছরের অর্ধেক সময় ইটভাটায় কাজ করেন শিশুটির বাবা। ওই সময় ৫ বছরের ছেলেকে তার সঙ্গে রাখেন। মেয়েটি গৃহকর্মী হিসেবে অনেক বছর ধরেই কাজ করে আসছে।

শেরপুর জেলার পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, শিশুটির বাবা এতটাই দরিদ্র তার নিজের থাকার জায়গাও নেই। মাসে যে কয়েক মাস ইটভাটায় কাজ না থাকে ওই সময় বোনের বাড়িতে ছোট্ট খুপড়ি ঘরে থাকেন। শিশুটির ওপর এমন ভয়ংকর ঘটনা জানার পর তাকে ফুফুর বাসায় রাখাও নিরাপদ নয়। কারণ, এ ঘটনা টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা দেওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের একজন শিশুটির আপন ফুফাত ভাইও। হয়ত জামিন পেয়ে এসে তারা আবার মামলাটি আপসরফার জন্য শিশুটি ও তার বাবাকে চাপ দিতে পারেন। তাই নিরাপদ কোনো জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করতে আদালতের কাছে পুলিশ আবেদন করেছে। আদালত বৃহস্পতিবার এক আদেশে শিশুটিকে গাজীপুরে সেফহোমে রাখার নির্দেশ দেন। এখন শিশুটি সেখানে থাকবে।
সূত্র- সমকাল

আমরা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতায় বিশ্বাসী, প্রিয় সময় গুজব প্রচার করে না

১০ অক্টোবর ২০২০ খ্রি. ২৫ আশ্বিন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, ২২ সফর ১৪৪২ হিজরি, শনিবার