নুপুরধ্বনি ও পবিত্র হাসি

ক্ষুদীরাম দাস :

ইদানিং সীমান্ত বাড়ির ছাদে উঠে পায়চারি করে। আজও অন্ধকার রাতে ছাদে পায়চারি করছে। চারপাশটা অন্ধকারের কালো কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে। দূরের কিছুই চোখে পড়ে না। যতদূর চোখ যায় শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার আর অন্ধকার।

‘আলোকিত’ মেসের নাম। মনে পড়ে এখনো সীমান্তের। মেসটা ছিলো লোকালয় ছেড়ে প্রায় উত্তর দক্ষিণ সীমান্তে। মেস থেকে কয়েক কদম পার হলেই মুচিপাড়া শুরু হয়। ওদেরকে এলাকার মানুষ আলাদা চোখে দেখে। কেননা ওরা জুতা সেলাই করে। খ্রীষ্টানদের গীর্জার সামনে দিয়ে মেসের রাস্তা চলে গেছে। সবাই নিন্দা করলেও খ্রীষ্টানপাড়ার মানুষজন মুচিপাড়ার মানুষদের ভালোবাসে। ভালোবাসা তো পবিত্র; তাই ওরা সবাইকে ভালোবাসে।

গীর্জা বাড়ি ফেলে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই দক্ষিণ পাশে নয়ন মাঝির থাকার ঘর। একটা ছোট ঘর; আর উপরে টিনের চালার ঘর। সেই ঘরে এখন আর কেউ থাকে না। দেড় বছর নয়ন তার ছেলে আর বউকে নিয়ে থাকতো। ছেলেটা খুবই দুষ্টু। চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী করে বেড়ায়। বাবা অনেক চেষ্টা করেও তাকে সোধরাতে পারলো না। দেড় বছর আগে মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যায়। নয়নের বউ কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়েছিলো। আর নয়ন শোকে শোকে সেই ঘরের ভিতর মারা যান। দুদিন পর নয়নের বউকে বাপের বাড়ির লোকজন তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেই থেকে সেই ঘরে আর কউ থাকে না। ঘরের পেছনেই ঝোঁপঝাড়। তারপাশে ছোট, অথচ গভীর পুকুর রয়েছে। গভীর রাতে শেয়াল ডাকাডাকি করে। সন্ত্রাসী ছেলেটা মারা যাওয়ায় কেউ মোটেও দুঃখ পায়নি। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেছে, এ ধরনের মানুষদের বেঁচে থাকার দরকার নেই, এমন মানুষ মারা গেছে তো ভালোই হয়েছে। ছেলেটা মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার পর থেকেই গভীর রাতে সেই রাস্তার পাশ দিয়ে কেউ তেমন প্রয়োজন না হলে যাতায়াত করেই না।

সেই পুকুরের নাম ফুলপুকুর। অবশ্য পুকুরের নাম ফুলপুকুর হলেও এ যাবৎকালে কাউকে সেখানে স্নান করতে দেখা যায়নি। লোকমুখে শোনা যায়, ওই পুকুরের পানি কোনোদিন শুকাতো না, পুকুরটি গভীর র্ছিলো বলে। সুন্দর ঘাঁট করা পুকুর , সবুজাভ কালো রঙের পানি। নয়ন মাঝির ছেলে মারা যাওয়ার পর কেউ কোনোদিন ঐ পুকুরে ¯œান করতে আসে না। তার আগে পর্যন্ত পুকুরটি ¯œান করার জন্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। পুকুরের পানিতে একটু পর পরই খাবি খাওয়ার শব্দ শোনা যায়। অনেক মাছ হবে বোধহয়; পরিত্যক্ত পুকুর বলে কথা !

সীমান্ত এক সময় মেসেই থাকতো। বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় দশ-বারো জন। সবাই হোমড়া-চোমড়া স্বাস্থ্যের অধিকারী। কেবল সীমান্তই বোধহয় একটু জোরে হাওয়া দিলে হেলে পড়ে যাওয়ার মতো। অবশ্য এতে সীমান্তের কোনো আক্ষেপ ছিলো না। সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা আর রাতে মনোযোগ দিয়ে পড়া। বেশ কেটে যাচ্ছিলো। বাড়িটায় সীমান্তেরাই ছিলো সর্বেসর্বা। বাড়িওয়ালা বিশেষত এ বাড়িতে থাকতেন না। মাস শেষে এসে শুধু ভাড়াটা নিয়ে চলে যান। লেখাপড়া করার জন্যে শহরে এসেছে কিন্তু থাকার জন্যে যে এমন গ্রাম্য এলাকা পাওয়া যাবে ভেবেই অবাক লাগতো সীমান্তের। ভাড়া স্বল্প, বাড়ির অবস্থাও বেশ ভালো ছিল। সব মিলিয়ে দারুণ।

সীমান্তের একটা আলাদা বদঅভ্যেস ছিলো। দিনের চেয়ে রাত জেগে পড়ার প্রতি বেশি ঝোঁক । দেখা যেত কোনো কোনো দিন পড়তে পড়তে রাত তিনটে চারটে বেজে যেতো। সীমান্ত যতক্ষণ জেগে থাকতো, ততক্ষণ আর কেউ জেগে থাকতো না। সবাই তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো । ইমু আর অর্নব মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার জন্যে ঘুম থেকে উঠতো। তবে প্রতিদিন নয়, মাঝে মাঝে!

রাত জাগার সুবাদে প্রায় দিনই সীমান্ত অদৃশ্য নুপুরের আওয়াজ শুনতে পেতো। কেউ শুনতো কিনা জানিনা, তবে সীমান্ত সত্যিই শুনতো। অতি মোহনীয় তার রিনিঝিনি নুপুরের শব্দ। প্রায়সময়ই লেখাপড়ার চেয়ে শব্দটা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। কিন্তু, কখনো দুঃসাহস করে ঘর থেকে দু’পা ফেলে দেখা হয়ে উঠেনি, অচেনা সেই নুপুরের শব্দ কোথা থেকে ভেসে আসছে।

বেশ কয়েকদিন পর।

সীমান্তের বয়স উনিশ ছুঁই ছুঁই। আবেগের পাগলামী জেগে উঠে; আর যৌবনের কম্পন তো প্রতিটি মানবের মতো তারও হওয়া স্বাভাবিক। এমন নুপুরের আওয়াজ মানে তো নাচের সময়ই হতে পারে। এসব সীমান্ত মনে মনে ভাবে। ঘরের জানালাগুলো এতো শীতের মধ্যেও খোলা ছিলো। পরীক্ষার আগের রাত যেন খুব তাড়াতাড়িই গভীর হয়ে যায়। বন্ধুদের অনেকেই দশটা না বাজতে আজ শুয়ে পড়ে। কিন্তু, প্রতিদিনের অভ্যেসবশত ঘুমাতে অনেক দেরি হয়, বই পড়ছে। পড়তে পড়তে কেবলই তন্দ্রা মতো এসেছে, ওমনি জানালায় মৃদু টোকার শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। একবার নয় দু. তিন বার !

চোখের পাতা থেকে ঘুম শব্দটা উবে গেল। ছ্যাৎ করে চমকে উঠলো সীমান্ত। টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দেড়টা বাজে। সীমান্ত ভাবলো, এতো রাতে কে টোকা দিলো! তারপর মনে হলো, হয়ত আশেপাশের কোন লোক রাস্তা দিয়ে যেতেই হাতের টোকা লেগেছে, তাই তেমন গুরুত্ব দিলো না সীমান্ত। আর রাত যেহেতু অনেক হয়েছে তাই দেরি না করে ঘুমাবে বলে লাইট অফ করে দিলো সীমান্ত। কিছুক্ষনের মধ্যে চোখ ভার করে ঘুম চলে এসেছে প্রায়, এমন সময় আবার দু’টো টোকা। এবারের টোকাগুলো আগেরগুলোর চেয়ে জোড়ে হলো। বুকে হপারের মতো শব্দ হচ্ছিলো। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল সীমান্ত। ধরফর করে বিছানা ছেঁড়ে উঠে বসে জোড়ে বললো, “কে? “ কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।

হাতের কাছের বেড সুইচটা দিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিলো। আলো জ্বালানোর সাথে সাথে জানালার পাশ থেকে কে যেন পুকুরের দিকে প্রথমে আস্তে, পরে জোড়ে হেঁটে চলে গেলো। নিঝুম রাতে স্পষ্ট পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো না। কিন্তু সুর তোলা নুপুরের আওয়াজ বলে দিল সব। ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো। কিন্তু কই? কেউ নেই তো। ঘরের টিউবলাইটের সাদা আলো জানালার ফাঁক গলে রাস্তার উপর পড়েছে। সেখানে অন্ধকার কুয়াশা ছাড়া আর কিছু নেই। কি আর করা, জানালা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লো সীমান্ত। মনে মনে নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজেই লজ্জা পেল সীমান্ত। সকালে উঠে কাউকেই কিছু বললো না।

মাসখানেক পর।
সেদিনও কৌতুহূলী মন মানছিলো না সীমান্তের। নূপুরধ্বনির শব্দটা আবার শোনা গেল মনে হচ্ছে। শব্দের উৎপত্তিটা মনে হল একদম শিয়রের পাশ থেকে আসছে। সব সন্দেহ ঝেড়ে ফেলে, ভেজানো দরজাটা আস্তে করে খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম। চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম। কেউ জেগে নেই। সবাই গভীর ঘুমে মত্ত। অর্নবকে ডেকে সাথে নিলাম। সে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করে সীমান্তের সাথে বাইরে আসলো। টিনের চালার ওপর গাছের কালো কালো ডাল ঝুলে রয়েছে। কয়েকটা ডাল চালা থেকে নেমে উপুড় হয়ে মাটির দিকে তাকানো, সেখানে কয়েকটা কেঁচো তখন গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত। ঝুলে পড়া গাছটার পাশেই শিরা উপশিরার মতো রাতের পুরো আকাশ দখল করে নেয়া বড় গাছের বিরাট বিরাট ডালপালা। ছোট গাছটা মনে হচ্ছে ঘুমে ঝিমুচ্ছে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ছোট গাছটার সাথে ধাক্কা খেয়ে গাছটা একটু নড়ে উঠলো। তার মাথার উপরের ডালপালায় হঠাৎ নাড়া খাওয়ার শব্দ। ঝটপট ঝটপট শব্দ করে বিশাল এক ঝাঁক বাদুড় নামলো। এত বাদুড়ের একসাথে নামার শব্দে একটু চমকে উঠলো সীমান্ত। উপরের দিকে মুখ তুলে তাকাল সীমান্ত। অর্নবের দিকে তাকিয়ে সীমান্ত বললো, তুমি কি নুপুরের শব্দ শুনতে পেয়েছো?
‘না’ বলেই সে ঘুমাতে চলে গেলো।
সীমান্ত লজ্জা পেলো। কেননা এটা তার একান্ত মনেরই ধারণা। সীমান্তও ঘুমাতে চলে যায়।

পরের দিন।
সৃষ্টির কি অপার সৌন্দর্য ! শাড়ি পরহিত। নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ হচ্ছে। মেয়েটার পথ চলার মোহনীয় সৌন্দর্য সীমান্তকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে। চোখে ঘোর লেগে গেছে। মনে হচ্ছে, সীমান্ত তখন মেয়েটার কাছে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। সীমান্তের মন হাওয়ায় ভেসে শুধু তাকে অনুসরণ করছে।

কয়েকদিন পর।
সীমান্ত টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। সময় পেরিয়ে গেলো অথচ এখনো বাস এলো না। খবর নিয়ে জানতে পারলো বাস আসতে এখনো আধা ঘন্টা দেরি হবে। বিশ কিলোমিটার দূরে জ্যামে আটকা পড়েছে বাসটি। তাই পায়চারি করছে সীমান্ত।
হঠাৎ সীমান্তের চোখ চলে গেলো দূরে চেয়ারে বসে থাকা একটি মেয়ের উপর। সীমান্ত এর আগে কখনো এমন রূপসী মেয়ে দেখেনি। মনের কোণে একটা আবেগ কাজ করলো। আহা! কী রূপসী। ঈশ^র নিজ হাতে তাকে গড়েছেন। সীমান্ত আরো এগিয়ে গেলো দেখার জন্যে, আরো এগিয়ে গেলো। একেবারে কাছে গিয়ে মেয়েটিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছে। সীমান্তের দৃষ্টি ডুবে গেছে মেয়েটির সৌন্দর্যের সাগরে। মেয়েটি সীমান্তের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। আহা! সে কী পবিত্র হাসি। সীমান্তের মন ভরে যায় সেই হাসিতে। মেয়েটির পায়ে সুন্দর নুপুর শোভা পায়। একসময় মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী লোকটির দিকে দৃষ্টি গেলো সীমান্তের। লোকটি সীমান্তের দিকে বেদনাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
সীমান্ত বুঝতে পারলো রূপসী মেয়েটি অবশ্য এই ভদ্রলোকটিরই হবে। ভদ্রলোককে সীমান্ত বেশ ভালো করেই চেনে। তিনি গীর্জার একজন পুরোহিত। বেশ ভালো মানুষ। একটু পর লোকটি মেয়েটিকে কোলে নিয়ে রাস্তার অপর পাশে দাঁড়ালো, যেখানে বাস থামবে। মেয়েটির পায়ে নুপুরের শব্দ বেজে উঠলো।
সীমান্তের বুঝতে আর বাকি রইলো না। বেশ কষ্ট হচ্ছিলো সীমান্তের। কষ্টের পাহাড় যেন ধসে পড়লো তার হৃদয় পিঞ্জরে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পুরোহিত বললেন, সেদিন যদি তুমি ঘরের দরজাটা খুলতে তাহলে আমার মেয়ের এ অবস্থা হতো না। আমি তোমার ঘরে ঢুকে লুকাতে চেয়েছিলাম। সন্ত্রাসীরা আমার মেয়ের পা ভেঙ্গে দিয়েছে। সে আর কোনোদিন নুপুর পড়ে নাচতে পারবে না।
সীমান্ত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দু’চোখে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরে। মনে শুধু আক্ষেপ ও প্রশ্ন, চার বছর বয়সী মেয়েটির সাথে কার কী শত্রুতা!
একটু পরে বাস এসে হর্ণ বাজায়। মধ্যবয়সী লোকটি মেয়েটিকে নিয়ে বাসে উঠে।
সীমান্ত বাসে উঠার জন্যে পা বাড়ায়। এমন সময় কাউন্টারের লোকজন চেঁচিয়ে বলে, আপনি বোকা নাকি? এই বাস আপনার নয়। আপনি পরের বাসে যাবেন।
সীমান্ত কাউন্টারের লোকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে! ওদের এসব কথায় বাড়তি কোনো দুঃখ পায় না; যেখানে তার মন দুঃখে ভর করে আছে।