অপরাজিতা এক নারী বাইকার রতনা

জিএম মুছা :

জীবন সংগ্রামে হার না মানা অদম্য সাহসী আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এক নারীর নাম রতনা, পুলিশ বলে লেডি বাইকার, সমাজের লোকজন বলে বাইকার রতনা, চলতে পথে রাস্তাঘাটে শিশু-কিশোররা বলে রতনা আন্টি, বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, একসময় স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে দাম্পত্য জীবনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সংসার নামক তরীতে উঠেছিলো, জীবন নদীর তীরে পৌঁছবে সেই আশায় সংসার শুরু করে ছিলো রতনা, কিন্তু সবার কপালে কি আর সুখ সয় ?

হঠাৎ এক দুষ্টু ঝড়ে সব কিছু ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো, কিন্তু অদম্য সাহসী সংগ্রামী রতনা মোটেও বিচলিত হয়নি ভেঙে পড়িনি সে , যশোর শহরে পুলিশ লাইন টালি খোলার মৃত্যু সিদ্দিক সরদারের মেয়ে রতনা মা নুরজাহান বেগম, ছয় বোনের মধ্যে সবার বড় রতনা , যশোর শহরের টালিখোলা একটি ভাড়া বাড়িতে একমাত্র সন্তান ও মাকে নিয়ে তার বসবাস ,স্বামী নামক পাষাণ হৃদয়ের মানুষ টি অনেক আগেই সকল সম্পর্ক ছেদ করে চলে গেছে সেই যে কবে তা তার মনেই নেই, যশোর সদর উপজেলা এড়েন্দা গ্রামে এক ব্যক্তির সঙ্গে মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো রতনার ,এক বছরের মাথায় সংসার আলো করে রতনার কোলজুড়ে এসেছিলো এক পুত্র সন্তান, তার পর সন্তানের আট বছর বয়সের সময় কপাল কপাল ভেঙে যায় রতনার, ভেঙে যায় সংসার নামক শান্তি সুখের ছোট্ট সেই নীড়, সহায় সম্বলহীন রতনা ,জীবন জীবিকার জন্য শুরু করে দেয় কঠিন সংগ্রামী জীবন , সমাজের মানুষ সমাজ- পরনিন্দা কোন কিছু তোয়াক্কা না করেন , প্রথমে বাড়ির পাশে একটা টিনশেডের ঘর তৈরি করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, তারপর শুরু করে সংগ্রামী জীবন অন্য দশজন নারীর মতো জীবন যাপনের ধরনটা একটু পরিবর্তন করে রতনা নানা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে জীবন সংগ্রাম শুরু করে, প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে নিজের মোটর বাইক চালিয়ে চল্লিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে যায় ঝিনেদা- কালীগঞ্জ সেখান থেকে জবাই করা গরুর মাথা পা ভূড়ি কিনে ফিরে আসে যশোরের পুলিশ লাইন টালিখোলা নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে,আর যদি কেউ গরুর মাংসের অর্ডার করে তখন তিনি গরু কিনে জবাই করে নিজের প্রতিষ্ঠানেই তা বিক্রি এবং অর্ডার সরবরাহ করে থাকে।

শুরু হয় বিকিকিনি যৎকিঞ্চিৎ যা লাভ হয় তা দিয়ে চলে যায় মা ও সন্তানকে নিয়ে চলে রতনার অনটনের সংসার, প্রথম প্রথম রতনার বেশ খানিকটা খারাপ লাগতো সমাজ সংসার কে কি বলবে, কে কোন ভাবে দেখবে এখন আর রতনার এসব কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা ও নেই, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, সমাজে নিজেকে স্বাবলম্বী করে প্রতিষ্ঠা পেতেই তার এই কঠিন সংগ্রাম, তাই সততা সংগ্রাম আর পরিশ্রম কে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়াটাই তার এখন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, সমাজ কী বললো কে কি করলো এসব দেখার তার সময় কোথায়?একজন নারী সংগ্রাম করে জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে সেটাই সে আমাদের এই সমাজের অন্য সব নারীদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছে রতনা।

শুধু এটা বললে ভুল হবে, রতনা যেন এখন আমাদের এই সমাজের একজন রোল মডেল, এভাবেই জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চৌদ্দ বছর পার করে দিয়েছে রতনা, ছেলের বয়স এখন উনিশ, যশোরের একটি পলিটেকনিক্যাল কলেজে ডিপ্লোমার ছাত্র, সাত বছর পূর্বে ব্যবসার কাজে ব্যবহারের জন্য রতনা অনেক কষ্ট করে একটি মোটরবাইক ক্রয় করে, তখন সে বাইক চালাতে জানতো না, পরে অবশ্য সে বাইক চালাতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে, প্রথমে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে রাস্তায় চলাচলের তেমন অসুবিধা হতো না কারণ ট্রাফিক পুলিশ প্রশাসন একজন সংগ্রামী মহিলা হিসেবে চেনে সেই সুবাদে তাকে অনেক সময় ছাড়া দিতেন, বছরখানেক হলো ড্রাইভিং লাইসেন্স করে নিয়েছে রতনা ।

এখন আর পথে-ঘাটে চলতে তার আর কোনো অসুবিধা হয় না, রতনার এখন অনেকটা স্বাবলম্বী নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, এখন আর সে পরমুখাপেক্ষী নয়,নিজের মাও সন্তানকে নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে ভালো ভালোভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে জয়ী এক অপরাজিতা নারীর নাম রতনা।।